Writing

চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত বনাম তাড়াহুড়ো

অষ্টম হিজরির ঘটনা। বাহরাইনের একটি প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে সাক্ষাৎ করতে আসে। এই গোত্র কোনো ধরণের যুদ্ধ ছাড়া ইসলাম গ্রহণ করে। তারা ইসলাম সম্পর্কে শুনামাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আসে এবং ইসলাম গ্রহণ করে।

দশ-পনেরো জনের প্রতিনিধি দল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মসজিদে প্রবেশ করলো। তারা রাসূলের সাথে দেখা করার জন্য এতোটা উদগ্রীব ছিলো যে, মসজিদে প্রবেশের আগে উট বাঁধতে ভুলে গেলো। তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাত ও পায়ে চুমো দিলো।

কিন্তু, তাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি ছিলেন বেশ ব্যতিক্রম। তাঁর নাম আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু। তিনি সবার সাথে বাহরাইন থেকে আসলেও একসাথে মসজিদে প্রবেশ করলেন না। বাকিরা যা করলো, তিনি তা করলেন না।

তিনি উট বাঁধলেন। সফর করে ক্লান্ত ছিলেন, ফলে গোসল করলেন। একটি পরিষ্কার জামা পরলেন। দুটো জামা নিয়ে এসেছিলেন। একটি সফরের জন্য, একটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করার সময় পরার জন্য।

অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে দেখা করেন। খুব শান্তভাবে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। অন্যদের মতো তাড়াহুড়ো করেননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশাজ্জ ইবনে কায়সের এই গুণের প্রশংসা করে বলেন-

“ও আশাজ্জ! তোমার দুটো বিশেষ গুণ রয়েছে যা আল্লাহ পছন্দ করেন। সেগুলো হলো- ধৈর্যশীলতা ও সহিষ্ণুতা; ধীর-স্থিরতা।”

আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের প্রশংসা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুব বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমিই কি এই গুণ অর্জন করেছি নাকি আল্লাহ আমাকে এই দুটো গুণের ওপর সৃষ্টি করেছেন?”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দিলেন:

“আল্লাহ তোমাকে এই দুটো গুণের ওপর সৃষ্টি করেছেন।”

অর্থাৎ, আল্লাহ সুবহানাহু ওতা আ’লা আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহুকে সৃষ্টির সময় এই দুটো গুণ দান করেন, গুণ দুটো তিনি নিজে অর্জন করেননি। এটা শুনে আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন:

“আলহামদুলিল্লাহ্‌, কৃতজ্ঞতা আদায় করছি সেই আল্লাহর যিনি আমাকে এমন দুটো স্বভাবের ওপর সৃষ্টি করেছেন; যাকে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পছন্দ করেন।” [সহীহ মুসলিম: ২৫, সুনানে আবু দাউদ: ৫২২৫]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশাজ্জ ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু আনহুর চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করাটা পছন্দ করেন, ধীর-স্থিরতা পছন্দ করেন।

একজন মুমিন তাড়াহুড়ো করে, চিন্তা-ভাবনা না করে কোনো কাজ করে না। সে যখন যা মন চায় তা করে না। একজন মুমিন প্রতিটি কাজ চিন্তা-ভাবনা করে করে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“ধৈর্য ও স্থিরতা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর তাড়াহুড়ো শয়তানের পক্ষ থেকে।” [জামে আত-তিরমিজি: ২০১২]

ধৈর্যের সাথে কাজ করলে আল্লাহ বরকত দান করেন। তাড়াহুড়োর কাজে কোনো বরকত নেই। তবে, দ্বীনি কোনো ব্যাপারে আমরা চট-জলদি করতে পারি। যেমন: কাউকে দান করতে গেলে অনেক্ষণ ভাবার দরকার নেই। সে যদি দান গ্রহণের উপযুক্ত হয়, তাকে দান করে দিন। আপনি নিয়ত করছেন দুই রাকআত নামাজ পড়বেন। সুযোগ পাওয়া মাত্র পড়ে নিন।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মানুষের তাড়াহুড়োর প্রবণতা সম্পর্কে বলেন:

“মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাড়াহুড়োর প্রবণতা দিয়ে।”
[সূরা আল-আম্বিয়া:৩৭]

তাড়াহুড়ো করার কারণে আল্ললাহ কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় মানুষের সমালোচনা করেছেন। নবী ইউনুস আলাইহিস সালামের ঘটনা উল্লেখযোগ্য।

নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম তাঁর কওমকে আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত দেন। কিন্তু, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিলো না। বারবার চেষ্টা করেও যখন কোনো ফল আসছে না দেখলেন, তখন তিনি তাঁর জনপদ ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। যাবার আগে তাঁর কওমকে বলে যান যে, তিনদিনের মধ্যে আল্লাহর আযাব এসে উপস্থিত হবে।

তাঁর কওমের লোকেরা আল্লাহর আযাবের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলো। তারা আল্লাহকে মেনে নিলো, শিরক ত্যাগ করলো এবং আল্লাহর কাছ থেকে আযাব মুক্তি দু’আ করতে লাগলো। আল্লাহ তাদের দু’আ কবুল করে নিলেন এবং তাদের উপর থেকে যাব উঠিয়ে নিলেন।
[সূরা ইউনুস: ৯৮]

অন্যদিকে ইউনুস আলাইহিস সালাম তাঁর কওমের উপর রাগ করে সেই জনপদ থেকে চলে গিয়েছিলেন। তিনি সেটার জন্য আল্লাহর হুকুমের অপেক্ষা করেননি। নবীগণের এরকম সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আল্লাহর অনুমতির প্রয়োজন হয়। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তারা হিজরত করতে পারেন না। মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্যও আল্লাহর অনুমতির প্রয়োজন ছিলো। [সহীহ বুখারী: ২১৩৮]

আল্লাহর অনুমতি ছাড়া নবী ইউনুস আলাইহিস সালামের এভাবে চলে যাওয়াকে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ উল্লেখ করেন ‘পালিয়ে যাওয়া’ হিশেবে। [সূরা আস-সাফফাত ৩৭:৪০]

নবী ইউনুস আলাইহিস সালাম আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করে তাড়াহুড়ো করেন। আল্লাহ তাঁর এমন তাড়াহুড়োর জন্য তাঁকে পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন।

অন্যদিকে, নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম জেলের মধ্যে ধৈর্যধারণ করেন। বাদশাহ যখন ইউসুফ আলাইহিস সালামকে জেল থেকে মুক্তির আদেশ দেন, তখন ইউসুফ আলাইহিস সালাম তাড়াহুড়ো করেননি। তিনি যে মিথ্যা মামলার আসামী হয়ে জেলে যান, সেই কেইস থেকে আগে মুক্তি পেতে চান। এজন্য তিনি বলেন-

“তুমি তোমার মনিবের কাছে ফিরে যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো, যে নারীরা হাত কেটেছিলো, তাদের কী অবস্থা?” [সূরা ইউসুফ: ৫০]

ইউসুফ আলাইহিস সালামের এমন ধৈর্যধীলতা, ধীর-স্থিরতা দেখে স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অবাক হন। তিনি ইউসুফ আলাইহিস সালামের প্রশংসা করে বলেন:

“ইউসুফ আলাইহিস সালাম যতোদিন জেলে কাটিয়েছেন, যদি আমি ততোদিন কাটাতাম, আর আমার কাছে বাদশাহর আহ্বানকারী আসতো, সেক্ষেত্রে আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দিতাম।” [সহীহ বুখারী: ৬৯৯২]

ইউসুফ আলাইহিস সালাম মুক্তির প্রস্তাব শুনেই জেল থেকে বের হননি। ফলে, তিনি যখন বের হন, কলুষমুক্ত হয়ে বের হন। পরবর্তীতে বাদশাহ থাকে অর্থমন্ত্রী-খাদ্যমন্ত্রী বানান। ধীরে-সুস্থে কাজ করার ফলে তিনি হাতেনাতে তার ফল ভোগ করেন।

মূসা আলাইহিস সালাম ও খিজির আলাইহিস সালামের ঘটনায় আমরা দেখেছি মূসা আলাইহিস সালাম বেশিক্ষণ ধৈর্যধারণ করতে পারেননি। তিনটি ঘটনা দেখে তিনি খিজির আলাইহিস সালামকে প্রশ্ন করতে থাকেন। ফলে, খিজির আলাইহিস সালাম তাদের শিক্ষা সফরের সমাপ্তি ঘটান। ঘটনাগুলো বর্ণনা করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্তব্য করেন-

“আল্লাহ তা’আলা মূসা আলাইহিস সালামের ওপর রহম করুন। আমাদের কতোই না মনোবাঞ্চনা পূরণ হতো, যদি তিনি ধৈর্যধারণ করতেন, তাহলে আমাদের নিকট তাঁদের আরো ঘটনাবলী বর্ণনা করা হতো।” [সহীহ বুখারী: ১২২]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে তাড়াহুড়ো করতে যেমন নিষেধ করেন, তেমনি তাঁর স্ত্রীকেও তাড়াহুড়ো করতে নিষেধ করেন।

একবার তাঁর স্ত্রীগণ তাঁর কাছে দুনিয়াবী চাহিদার দাবি করেন। কিন্তু, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান যে, তিনি এমন জীবনযাপন পছন করেন না। ফলে, প্রায় এক মাস তিনি স্ত্রীদের থেকে আলাদা থাকেন। অতঃপর আল্লাহ পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল করে এই বিষয়ের মীমাংসা করেন-

“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদেরকে বলুন- যদি তোমরা দুনিয়ার জীবন ও তার চাকচিক্য কামনা করো, তবে আসো, আমি তোমাদের ভোগ-বিলাসের ব্যবস্থা করে দেই এবং তোমাদের উত্তম পন্থায় বিদায় করে দিই। আর যদি তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও পরকালীন নিবাস কামনা করো, তবে তোমাদের মধ্য থেকে সৎকর্মশীলদের জন্য আল্লাহ অবশ্যই মহান প্রতিদান প্রস্তুত করে রেখেছেন।”
[সূরা আহযাব: ২৮-২৯]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথমে তাঁর স্ত্রী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন-

“আমি তোমার কাছে একটি বিষয় উপস্থাপন করছি। তোমার মা-বাবার সাথে পরামর্শ না করা পর্যন্ত তুমি তাড়াহুড়ো করো না। তাড়াহুড়ো করলে তোমার লোকসান হবে।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশঙ্কা করছিলেন যে, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তাড়াহুড়ো করে না বুঝি চলে যান! তিনি আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে কুরআনের আয়াত দুটো তেলাওয়াত করে শুনানোর পর আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা জবাব দেন-

“এই ব্যাপারে আবার আমার মা-বাবার সাথে পরামর্শ করবো? আমি তো আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ও আখিরাতকেই বেছে নিচ্ছি।”
[সহীহ মুসলিম: ৩৫৭৩]

এই ঘটনায় আমরা দেখতে পারি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রী আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বে তাড়াহুড়ো না করতে বলেন এবং মা-বাবার পরামর্শ নিতে বলেন। তাড়াহুড়ো করলে ভুল সিদ্ধান্ত নেবার সম্ভাবনা ছিলো।

আমরা সবসময় ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবো, তাড়াহুড়ো করবো না। তবে, তিনটি ক্ষেত্রে খুব সতর্ক থাকতে হবে। এসব ক্ষেত্রে একেবারেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। সেগুলো হলো:

১। নামাজের সময়

আমরা যখন নামাজ পড়বো, তখন তাড়াহুড়ো করতে পারবো না। এমনকি নামাজে যাবার সময় রাস্তায় দৌড়াতে পারবো না। ধীরে-সুস্থে যেতে হবে।

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামাজে এদিক-সেদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জবাব দেন-

“এটা একধরনের ছিনতাই, যার মধ্যমে শয়তান বান্দার নামাজ হতে অংশ বিশেষ ছিনিয়ে নেয়।”
[সহীহ বুখারী: ৭৫১]

আপনি যখন নামাজ পড়বেন, বুঝে-শুনে, ধীরে-সুস্থে পড়বেন। নামাজে তাড়াহুড়ো করবেন না, এদিক-সেদিক তাকাবেন না।

২। দু’আর ক্ষেত্রে

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

“তোমাদের প্রত্যেক ব্যক্তির দু’আ কবুল হয়ে থাকে; যদি সে তাড়াহুড়ো না করে আর বলে যে, আমি দু’আ করলাম, কিন্তু আমার দু’আ তো কবুল হলো না।”
[সহীহ বুখারী:৬৩৪০]

অনেকেই দু’আ করে অধৈর্য হয়ে পড়ে। তারা সাথে সাথে দু’আর ফল পেতে চায়। এমনটা করলে আল্লাহ দু’আ কবুল করেন না। আপনি দু’আ করে যাবেন; কবুল হোক বা না হোক।

৩। কারো ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে

কারো ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্তে গ্রহণের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনের অনেক জায়গায় এই ব্যাপারে আমাদেরকে সাবধান করে দেন। কিছু করতে হলে যেন ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে করা হয়।

আল্লাহ বলেন:

“হে মুমিনগণ! যদি কোনো ফাসিক তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তাহলে তোমরা তা যাচাই করে নাও; এই আশঙ্কায় যে, তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো কওমকে আক্রমণ করে বসবে। ফলে, তোমরা তোমাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।”
[সূরা আল-হুজুরাত: ৬]

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে আরো বলেন:

“হে মুমিনগণ! যখন তোমরা আল্লাহর রাস্তায় বের হবে, তখন যাচাই করবে এবং যে তোমাদেরকে সালাম দেবে, দুনিয়ার জীবনের সম্পদের আশায় তাকে বলবে না যে, তুমি মুমিন নও।”
[সূরা আন-নিসা: ৯৪]

আমরা কোনো সংবাদ শুনলে যেমন যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবো, তেমনি যদি কাউকে কিছু করতে দেখি, তাহলে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার আগে জেনে নেবো সে এটা কেনো করেছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে এরকম একটি ঘটনা দেখতে পাই। মক্কা বিজয়ের পূর্বে একজন বদরী সাহাবী মুসলিমদের মক্কা অভিযানের সংবাদ চিঠি লিখে মক্কায় জানিয়ে দিতে চান। তাঁর নাম ছিলো হাতিব ইবনে আবু বালতা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহু।

আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে, বিশ্বাসঘাতকা। তিনি মুসলিমদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মক্কায় আগাম সংবাদ জানিয়ে দিচ্ছেন। একজন মহিলার কাছে চিঠিটি দেন। মহিলা চিঠিটি নিয়ে মক্কার পথে রওনা দেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহী মারফত খবরটি জানেন। তারপরও আলী ইবনে আবি তালিব ও যুবাইর ইবনে আবু বালতা’আ রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে পাঠালেন চিঠিটি উদ্ধার করতে। চিঠি উদ্ধারের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাতিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে কারণ জানতে চান। তিনি বলেন, তাঁর পরিবার মক্কায় আছে। তিনি কুরাইশদেরকে আগাম সংবাদ জানিয়ে দিচ্ছেন এই আশায় যে, মক্কায় আক্রমণ হলে তারা যেন তাঁর পরিবারকে সুরক্ষা দেয়।

হাতিব রাদিয়াল্লাহু আনহুর চিঠি প্রেরণের কারণ জানার আগ পর্যন্ত মনে হতে পারে তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। কিন্তু, কারণ বলার পর মনে হয় তিনি আসলে তাঁর পরিবার নিয়ে দুশ্চিন্তা করে চিঠি পাঠিয়েছেন। ফলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে ক্ষমা করে দেন। [সীরাত ইবনে হিশাম: ৪/৩৭-৩৮, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া: ৪/৪৮৮-৪৮৯]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওহী লাভের সাথে সাথে হাতিব ইবনে আবু বালতা’আকে শাস্তি দেননি। তিনি তাড়াহুড়ো না করে বরং কারণ জানতে চান।

তালাকের ক্ষেত্রেও দেখা যায় অনেকে তাড়াহুড়ো করে, রাগের মাথায় স্ত্রীকে তালাক দেয়। তালাকের ক্ষেত্রে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“আর যদি তারা তালাকের দৃঢ় ইচ্ছা করে নেয়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।”
[সূরা বাকারা: ২২৭]

তালাকের ‘দৃঢ় ইচ্ছা’ কখন করা হয়? এটা কি রাগের মাথায়, তাড়াহুড়ো করে হয়?

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে বেশিরভাগ তালাক হয় তাড়াহুড়ো করে, রাগের মাথায়!

একবার এক লোক আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর কাছে এসে বললো, “আমি আমার স্ত্রীকে রাগের মাথায় এক হাজার তালাক দিয়েছি, এখন আমি কী করবো?”

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু জবাব দিলেন-

“তুমি তাড়াহুড়ো করে এমন এক কাজ করেছো, এখন আসছো আমার কাছে ফাতওয়া জানতে? তোমার তাড়াহুড়ো তোমার ধ্বংস ডেকে এনেছে!”

বিয়ে ও তালাকের ব্যাপারে কখনো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিবেন না। এসব ক্ষেত্রে অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কিভাবে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেবো?

  • আপনি যখন রাগান্বিত থাকবেন, তখন কোনো সিদ্ধান্ত নিবেন না।
  • আপনি যখন কোনো কিছুর সংবাদ পাবেন, সাথে সাথে সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন না। কিছু সময় নিন। সংবাদটি ভালোভাবে যাচাই করে নিন। ফেসবুকে অনেকসময় মিথ্যা গুজবের ওপর ভিত্তি করে মানুষ অনেক বড়ো বড়ো লেখা লিখে। পরে পস্তাতে হয়। অথচ একটু সময় নিলে আসল সত্যতা বুঝা যেতো।
  • পরামর্শ গ্রহণ করুন। বড়ো কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই কারো সাথে পরামর্শ গ্রহণ করুন; যেমনটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বলেছেন মা-বাবার পরামর্শ নিতে।
  • সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে ইস্তিখারা করুন। নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করুন। তাহলে দেখবেন সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ হবে।

একজন মুমিন হুজুগে কোনো কাজ করে না। সে অবশ্যই ভেবে-চিন্তে কাজ করে, পরামর্শ নিয়ে কাজ করে, ইস্তিখারা করে কাজ করে।

লিখেছেন

Picture of আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture