Writing

নারীদের মসজিদে নামাজ আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা

আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো কিছু হারাম বললে পৃথিবীর সবাই মিলে যদি সেটকে হালাল বলে, তাহলে কি হালাল হবে?
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো কিছু হারাম বললে, পৃথিবীর সবাই মিলে সেটাকে কি হালাল বলতে পারবে?
স্বাভাবিক অবস্থার কথা। বিশেষ পরিস্থিতিতে (যেমন: জীবন বাঁচাতে) তো এমন অনেক কিছু বৈধ, যা সাধারণত অবৈধ। কিন্তু, সাধারণত কি কেউ আল্লাহর ওপর খবরদারি করতে পারে?

হাইপোথিটিকাল কুয়েশ্চন, সাহাবীদের কি এই অধিকার ছিলো? ধরুন, আল্লাহ মদ নিষিদ্ধ করেছেন। সাহাবীরা সবাই মিলে যদি সিদ্ধান্ত নিতেন, মদ নিষিদ্ধ না, এখন থেকে সবাই মদ খাবো; তাহলে কি সাহাবীদের ‘ইজমার’ ওপর ভিত্তি করে মদ হালাল হয়ে যেতো?

উদাহরণটি এক্সট্রিম হয়ে গেছে। এটা শুধু বুঝানোর জন্য বললাম। সাহাবীরা ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে কখনো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথার বাইরে যাননি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা আদেশ করেছেন, তা মেনেছেন, যা নিষেধ করেছেন, তা থেকে বিরত থেকেছেন।

তবে, হ্যাঁ, সাহাবীদের সময় দেখা যায় কিছু বিধান পালনের ক্ষেত্রে মাকাসিদে শরীয়া এবং সার্বিক দিক বিবেচনায় সাময়িক সময়ের জন্য উইথ কন্ডিশন সেগুলো পালন করা থেকে বিরত থেকেছেন বা অনুৎসাহিত করেছেন। যেমন: অমুসলিমকে যাকাত দেবার ব্যাপারে উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর নীতি।
কারণ, তখন ইসলাম শক্তিশালী ছিলো। কিংবা ইহুদি-খ্রিস্টান নারীকে বিয়ে, দুর্ভিক্ষের সময় চোরের হাতকাটার নীতি সহ অন্যান্য। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু কখনো বলেননি, ‘এখন থেকে আল্লাহর আইন মানবেন না, আমার আইন মানবেন।’

কেননা, আল্লাহ যা হালাল করেছেন, সেটা হারাম বলার এখতিয়ার উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নেই। ফিকহের চেইন অব কমান্ডও কিন্তু এরকম। প্রথমে কুরআন, তারপর সুন্নাহ, তারপর ইজমা, কিয়াস ইত্যাদি। কিন্তু, ইজমা-কিয়াস কখনো কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত হতে পারে না।

আল্লাহ সুবহানু ওতা’আলা নারীদেরকে মসজিদে নামাজ পড়তে নিষেধ করেননি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নারীদেরকে মসজিদে নামাজ পড়তে কখনো নিষেধ করেননি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বরং নারীদেরকে মসজিদে নামাজ পড়তে নিষেধ করাকে ‘নিষেধ’ করেছেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“তোমরা আল্লাহর বান্দীদের আল্লাহর মসজিদে যেতে নিষেধ করো না।”
[সহীহ বুখারী: ৯০০]

অনেকেই দেখা যায় দিনের নামাজে (যুহর, আসর, মাগরিব) মেয়েদেরকে মসজিদে যাবার অনুমতি দেয়, কিন্তু রাতের নামাজে (এশা, ফজর) মেয়েদেরকে মসজিদে যাবার অনুমতি দেয় না। এক্ষেত্রেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীদেরকে সতর্ক করে বলেন:
“তোমরা নারীদেরকে রাতের নামাজে মসজিদে যাবার অনুমতি দিবে।”
[সহীহ বুখারী: ৮৯৯]

ব্যক্তিগত গায়রতের কারণে অনেক স্বামী এটা পছন্দ করবেন না যে, রাতের বেলা তার স্ত্রী মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ুক। এমন একজন ছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর নাতি, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে বিলাল।

তিনি তার স্ত্রীকে রাতের বেলা মসজিদে যেতে বাধা দিতেন। তাকে রাসূলুল্লাহর নিষেধের নিষেধাজ্ঞার হাদীসটি শুনানো হয়।
হাদীসটি শুনার পর তিনি বললেন “আমরা তাদেরকে ঘর থেকে বের হতে দেবো না! কেননা, লোকেরা এটাকে ফ্যাসাদে রূপ দেবে।”
তাঁর দাদা উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু নিজের স্ত্রীকে মসজিদে যেতে বাধা দেননি, তাঁর বাবা সেই হাদীস বর্ণনা করেন; কিন্তু, তিনি বললেন, ‘আমরা বাধা দেবো’।
এটা শুনার পর আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ছেলেকে জোরে ধমক দিলেন। তিনি বললেন, “আমি বলছি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস, আর তুমি বলছো আমরা বের হতে দেবো না!” [সহিহ মুসলিম: ৮৭৮]

রাসূলের এই হাদীসের বিরোধিতা করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু আজীবন ছেলের সাথে কোনো কথা বলেননি!
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু জানতেন শরীয়তের চেইন অব কমান্ড কী। আল্লাহ ও রাসূল কোনো বিষয়ের অনুমতি দিলে, অন্য কেউ সেটাকে নিষেধ বলার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। ফলে, তিনি ছেলেকে ধমক দেন এবং রাগ করে ছেলের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর কথায় যেটা স্পষ্ট বুঝা গেলো, আল্লাহ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেটা ‘নিষেধ’ করেননি, সেটা নিষেধ করার এখতিয়ার আর কারো নেই।

একবার আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা মসজিদে নববীতে কয়েকজন নারীকে নামাজ পড়তে দেখেন। তাদেরকে মসজিদে দেখতে পেয়ে তিনি মন্তব্য করেন:
“মহিলারা (সাজসজ্জার) যেসব নতুন পন্থা বেছে নিয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এগুলো দেখলে বনী ইসরাঈলের নারীদের মতো তাদেরকেও মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন।”
[সহীহ বুখারী: ৮৬৯, সহীহ মুসলিম: ৮৮৫]

এই হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে অনেকেই বলেন, নারীদের মসজিদে নামাজ পড়া হারাম/নিষিদ্ধ। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিষেধ করেছেন।
এটি একটি অযৌক্তিক কথা এবং যেই হাদীস দিয়ে রেফারেন্স দেয়া হয়, সেই হাদীসই তার বিপরীত কথা বলে।
তিনটি পয়েন্টে বলি।

১. আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এই হাদীসেই জানিয়ে দিচ্ছেন যে, ‘যদি দেখতেন’ তাহলে রাসূলুল্লাহ নিষেধ করতেন। তারমানে বুঝা গেলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেননি। আর যা স্পষ্টত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিষেধ করেননি, সেটা নিষেধ করার এখতিয়ার আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার নেই।
কথাটি সাহাবীদের প্রতি অবমাননাকর নয়। বরং যদি কেউ বলে আল্লাহ ও রাসূলের বিপরীতে সাহাবীদের কোনো মতামত গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে সেই কথাটি বরং আল্লাহ ও রাসূলের শানে বেয়াদবি, অবমাননাকর, কুফরিও হতে পারে।

২. আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা একটি সিনারিওর কথা উল্লেখ করেন। হাদীসটির উদ্ধৃতি দিতে প্রায় সবাই এই দৃশ্যপট উহ্য রাখে। তারা বলে না, তখন কী এমন হয়েছিলো, যার দরুন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা এমন কথাটি বলেন৷
মহিলারা কোনসব নতুন পথা বের করেছিলো?
যেই কারণে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা If clause টি ব্যবহার করেন, সেই কারণটি কোথায়?
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় একজন নারী ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হন। একজন নারীর জন্য ধর্ষণের চেয়ে বড়ো ফিতনা আর কী হতে পারে? তখনো তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নারীদের জন্য মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করেননি। [জামে আত-তিরমিজি: ১৪৫৪]
তাহলে আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার সময় কী এমন ঘটেছিলো, যার ফলে তিনি এমনটা বলেন?
সেটা খুবই সহজ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে নারীরা মসজিদে নামাজে যাবার আগে পারফিউম মেখে যেতো না। তিনি নিষেধ করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:
“তোমাদের কোনো নারী যদি মসজিদে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে, সে যেন সুগন্ধি মেখে না আসে।” [সহীহ মুসলিম: ৮৩৩]
আরেকটি বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাতের নামাজে (এশা) যেন সুগন্ধি ব্যবহার করে না আসে। [সহীহ মুসলিম: ৮৩৪]
কারণ, তখনকার নারীরা দিনে কাজ করতেন, রাতে সুগন্ধি ব্যবহার করতেন। ফলে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়ে দেন, রাতের নামাজে আসার আগে যেন তারা সুগন্ধি না মাখে। দেখুন, রাতে নারীরা সুগন্ধি মাখতেন, সেজন্য সুগন্ধি মাখতে নিষেধ করেন, কিন্তু মসজিদে যেতে নিষেধ করেননি।
তাহলে বুঝা গেলো যে, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা যে শর্তের ভিত্তিতে বলছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেখলে নিষেধ করতেন’ সেই শর্তানুসারে তিনি শতোভাগ সঠিক।
তাঁর কথার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার নিষেধাজ্ঞার নিষেধের কোনো বিরোধিতা নেই। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলের নিষেধের বাইরে নিষেধ করছেন না, নির্দেশের বাইরে নির্দেশ দিচ্ছেন না।

৩. আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ঐ হাদীসকে যারা মেয়েদের মসজিদে নামাজ পড়ার বিরোধিতার রেফারেন্স দেখাতে নিয়ে আসেন, তারা একটি জিনিস ভুলে যান। সেটা হলো, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা নিজে কি মসজিদে নামাজ পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন?
রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের পর তিনি কি কখনো মসজিদে নামাজ পড়তে যাননি?
কিংবা তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কি কোনো নারীকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেছিলেন?
আমরা উল্টো দেখতে পাই, রাসূলের যুগে নারীরা যে ফজরের নামাজে মসজিদে যেতেন, সেসব হাদীসের বর্ণনাকারী ছিলেন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা। [সহীহ বুখারী: ৩৭২]
রাসূলের যুগে নারীরা মসজিদে নামাজ পড়তেন, খুলাফায়ে রাশেদার যুগে নারীরা মসজিদে নামাজ পড়তেন। উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে তো নারীদের মসজিদে প্রবেশের আলাদা রাস্তা তৈরি করা হয়েছিলো।

এই যে সবাই বলে, মসজিদে নারীরা গেলে ফিতনা হবে, দেখুন উমর ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু ফিতনা নিরসনে কী চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
আপনি যদি ঢাকার কাটাবন মসজিদে নামাজ পড়েন, আপনাকে কেউ না বললে আপনি জানতেই পারবেন না যে কাটাবন মসজিদে নারীরাও নামাজ পড়ে। কারণ, মসজিদের উত্তর দিকের যে গেইটে নারীরা প্রবেশ করে, সেই গেইটে সাধারণত পুরুষদের যাওয়া লাগে না। পুরুষদের মসজিদে প্রবেশদ্বার, ওজুর ব্যবস্থা পূর্বদিকে।
এটা হলো ফিতনা নিরসনে মানবিক উপায়, পদ্ধতি অবলম্বন। হাদীসে নারীদেরকে ফিতনা বলা হয়েছে। ফিতনা তো আপন সন্তান, সম্পত্তিকেও বলা হয়েছে। তাই বলে কি কেউ সন্তান জন্ম দেয়া বন্ধ করে দিয়েছেন, সম্পদ উপার্জন করা বন্ধ করে দিয়েছেন।

এগুলো তখনই ফিতনা, যখন আপনি সেগুলোর মিসইউজ করেন বা সেগুলো আল্লাহর পথে আপনার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
‘নারী ফিতনা’ বলে যে হাদীস দিয়ে আপনি নারীদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দিচ্ছেন, নিষেধ করছেন, ঠিক সেই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু, সেটার সর্বপ্রথম শ্রোতা ছিলেন সাহাবীগণ।
কই, তারা তো সেই হাদীসটি বর্ণনা করে, সেই হাদীসটি শুনে নারীদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করেননি?
আপনি যখন ‘নারী ফিতনা’ সংক্রান্ত হাদীস দিয়ে বলবেন, নারীদের মসজিদে যাওয়া নিষেধ, তখন আসলেই আপনি বুঝাচ্ছেন আপনি রাসূল ও সাহাবীদের চেয়ে হাদীসটি ভালো বুঝেছেন বা উনারা বুঝেননি (নাউজুবিল্লাহ)। নতুবা এই হাদীস বলা সত্ত্বেও তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমনটা বলেননি বা সাহাবীরা আপনার মতো এমন দাবি করেননি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, যে হাদীস দিয়ে বুঝানো হয় ‘নারীদের বাড়িতে নামাজ পড়া উত্তম’, সেটাকে দুইভাবে দেখা যায়।
১. আন্দালুসের বিখ্যাত ইমাম ইবনে হাযম হাদীসটির ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছেন। হাদীসটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
২. প্রথম পয়েন্টটা বাদ দিয়ে দিলেও দেখা যায় সেই হাদীসটি সম্পূর্ণ পড়লে পুরো দৃশ্যপট ক্লিয়ার হয়৷
‘রিক্লেইমিং মস্ক’ বইয়ে এটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে:

উম্মে হুমাইদ (রা) সম্পর্কে ইবনে হিব্বান ও আহমদ কর্তৃক উদ্ধৃত একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছিলো— ‍“তোমার জন্য জামায়াতে নামায পড়ার চেয়ে ঘরে নামায পড়া উত্তম।” হাদীসটি সহীহ, কিন্তু উদ্ধৃত বর্ণনাটি অপূর্ণাঙ্গ। প্রচলিত বর্ণনাগুলোতে হাদীসটির প্রেক্ষাপট ও পূর্ণাঙ্গ ঘটনা ব্যাখ্যা করা হয়নি।

যাই হোক, ইমাম তাবারানী, বায়হাকী, ইবনে আবু শায়বা, ইবনে আবু আসিমসহ অন্যান্য হাদীস সংকলকগণ এ ঘটনাটির বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। তাঁদের (বিশুদ্ধ) বিস্তারিত বর্ণনা থেকে জানা যায়, উম্মে হুমাইদের (রা) সাথে তাঁর স্বামী আবু হুমাইদ আস-সাইদীর (রা) দাম্পত্য কলহের প্রেক্ষিতে রাসূল (সা) এ পরামর্শটি দিয়েছেন। উম্মে হুমাইদ (রা) জামায়াতে নামায পড়ার জন্য নিয়মিত মসজিদে নববীতে আসতেন। একে কেন্দ্র করেই তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হতো। তাই একদিন উম্মে হুমাইদ (রা) কয়েকজন নারীকে সাথে নিয়ে রাসূলের (সা) কাছে এসে বললেন, “হে রাসূলুল্লাহ! আমরা আপনার সাথে জামায়াতে নামায পড়তে পছন্দ করি, কিন্তু আমাদের স্বামীরা আমাদেরকে মসজিদে আসতে বাধা দেয়। [বায়হাকী, ১৯০/৩; ইমাম তাবারানী, মুজামুল কবীর, ১৪৮/২৫ এবং আহাদ ওয়াল মাসানী, ১৫০/৬।]

‘নারীদের জন্য ঘরে নামাজ পড়া উত্তম’ এই কথাটি যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সবার উদ্দেশ্যে বলেননি, নির্দিষ্ট এক বা একাধিকজনের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হল-
এই হাদীসটি জানার পর থেকে কি নারী সাহাবীরা মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে দেন? তারা কি উত্তম আমল ছেড়ে অনুত্তম আমল সারাজীবন করে গেছেন?
না, এমনটা হয়নি। বরং, তার বিপরীত দৃশ্যই দেখা যায়। রাসূলের যুগে, সাহাবীদের যুগে নারী সাহাবীরা ঠিকই মসজিদে নামাজ আদায় করেছেন এবং একযোগে কখনো তারা মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করেননি। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহার যে কথাটি দিয়ে নারীদের নামাজ নিষিদ্ধ প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়, সেই হাদীসটিই এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ।

নতুবা আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন, “রাসূলুল্লাহ তো বলেছেন ঘরে নামাজ পড়তে, ঘরে নামাজ পড়া উত্তম, তোমরা মসজিদে আসছো কেন?”
ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর ছেলে তো বলতে পারতেন, “আব্বা, রাসূলুল্লাহ তো বলেছেন, নারীদের ঘরে নামাজ পড়া উত্তম, এজন্য আমি আমার বউকে নিষেধ করছি।”
অথচ দেখা যায়, সাহাবীরা ঠিকই উম্মে হুমাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহার হাদীস সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করতেন না। সেটা উম্মে হুমাইদের জন্য প্রযোজ্য মনে করতেন।
এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক একটি উদাহরণ দিই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাহাবী জিজ্ঞেস করেছেন ‘ইসলামের মধ্যে সর্বোত্তম কাজ কোনটি?’ বা রাসূলুল্লাহ বিভিন্ন সময় সাহাবীদেরকে বলেছেন ‘তোমাদের মধ্যে সেই সর্বোত্তম…’।

এসব ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাত্র একটি কারণ বলেননি। একেকজনকে একেক কারণ বলেছেন। যার মধ্যে যে কারণ অনুপস্থিত, তাকে সেই কারণ বলেছেন এবং কোনোটিই একটি আরেকটির বিপরীত নয়।
যেমন: কাউকে বলেননি সত্য কথা বলা উত্তম, আরেকজনকে বলেননি মিথ্যা বলা উত্তম।

বরং যাকে যেটা বলেছেন সেটা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উত্তম।
যেমন, কাউকে বলেছেন:
সালাম দেয়া ও মানুষকে খাওয়ানো উত্তম।
যে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করে, সে উত্তম।
যে অন্যকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
যার আখলাক উত্তম, সে সর্বোত্তম।
যে তার পরিবারের কাছে উত্তম, সে সর্বোত্তম।
যার প্রতি মানুষ উত্তম ব্যবহার লাভ করে, যার ক্ষতি থেকে মানুষ নিরাপদ।

এরকম আরো অনেক উৎসাহব্যঞ্জক হাদীস আছে। এগুলো দ্বারা সাহাবীরা এটা বুঝেননি, ‘আমাকে একটা বললেন কেনো আর আরেকজনকে আরেকটা বললেন কেনো? আসলেই উত্তম কোনটা?’

বরং স্ব-স্ব কাজই প্রত্যেকের জন্য উত্তম। আতিকা বিনতে যায়িদ রাদিয়াল্লাহু আনহাদের মতো নারী সাহাবীদের কাছে মসজিদে নামাজ পড়া উত্তম, অন্যদিকে উম্মে হুমাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহার মতো নারী সাহাবী, যাদের বাড়ি মসজিদ থেকে অনেক দূরে, তাদের জন্য ঘরে নামাজ পড়া উত্তম।
পুরো বিষয়টি এভাবে দেখা যায়। হাম্বলী মাজহাবের আলেমগণ নারীদের মসজিদে নামাজ পড়াকে জায়েজ বলেন। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী থেকে শুরু মুসলিম সভ্যতার অগণিত ইমাম নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার পক্ষে মতামত দেন। ইবনে হাজম রাহিমাহুল্লাহ তো নারীদের জন্য ঘরের চেয়ে মসজিদে নামাজ পড়াকে উত্তম মনে করেন!

সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ফিতনার আশংকা দেখিয়ে কোনো কোনো মাজহাব নারীদের মসজিদে নামাজ পড়াকে নিরুৎসাহিত করে। কিন্তু, সেইসব মাজহাব নারীদের মসজিদে নামাজ পড়াকে ‘হারাম’ বলে না, নারীদের মসজিদে যাওয়াকে নিষিদ্ধ বলে না। আর এমনটা বলার অধিকারও কারো নেই। কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এটাকে হারাম বলেননি।

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন:

“তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার ওপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে, তারা সফলকাম হবে না।”
[সূরা আন-নাহল ১৬: ১১৬]

আল্লাহ যা হারাম করেননি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পারসেপশন থেকে সেটাকে হারাম বলার এখতিয়ার কারো নেই। তিনি যতো বড়োই স্কলার হন না কেনো!
পরিশেষে বলতে চাই, এটা অন্তত সবার মাঝে প্রচার হওয়া উচিত যে, আল্লাহ ও রাসূলের কোনো সিদ্ধান্তের বিপরীতে অন্য কারো সিদ্ধান্ত দেবার এখতিয়ার নেই। এই বিষয়টি জনসাধারণকে বুঝাতে হবে। নতুবা তারা এরকম হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে সাহাবীদেরকে বানিয়ে ফেলবে আল্লাহ ও তার রাসূলের চেয়ে বড়ো!
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের অসংখ্য জায়গায় নারী-পুরুষের যাতায়াত থাকলেও সেসব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের নামাজের ব্যবস্থা নেই। যেমন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাস স্টপেজ, মার্কেট। মা, বোন, স্ত্রীকে নিয়ে সেসব জায়গায় গেলে হয় দুজনের নামাজ কাজা হয় (তাদেরকে কোথায় রেখে যাবো এই ভেবে), নতুবা মা-বোনদের নামাজ কাজা হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই আমরা তো মানুষ, নামাজ মিস হলে বাসায় এসে সেই নামাজ পড়ার আগ্রহ অনেক সময় চলে যায়, কখনোবা ভুলে যাই। এজন্য সময়মতো নামাজ পড়া উত্তম।

তৃতীয়ত, সামাজিকভাবে আলেম-উলামাগণ যদি মানুষকে না বুঝান, ঢালাওভাবে যদি গ্রামে-গঞ্জে নারীরা মসজিদে যাওয়া শুরু করে, সেটা বরং সামাজিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। সেই হিশেবে ঢালাওভাবে সব নারীকে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করা উচিত হবে না। এক্ষেত্রে অনেকধরনের ঝুঁকি রয়েছে। নিরাপত্তার ব্যাপারও জড়িত।

কিন্তু, যেসব জায়গায় নারীদের যেতেই হয়, সেসব জায়গায় নারীদের নামাজের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকতে হবে। সেটার জন্য অন্তত আমাদের প্রজন্ম প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এসব সামাজিক সংস্কার রাতারাতি হবে না।
আর বাকি সবাইকে এই ম্যাসেজটা দিতে হবে, নারীদের মসজিদে প্রবেশাধিকার হারাম নয়; আল্লাহ সেটা হারাম করেননি, রাসূলও সেটা হারাম করেননি। বিশেষ সামাজিক অবস্থা ও নিরাপত্তাজনিত কারণে কোনো কোনো আলেম এটাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। তাদের এই অবস্থানকে আমরা সম্মান জানাই। তাদের উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানাই।

পুনশ্চ:
লেখটির অনেক কিছু কারো কারো কাছে নতুন মনে হতে পারে, অজানা থাকতে পারে। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সেগুলোর তথ্যসূত্র দেবার।

এই বিষয়ে বিজ্ঞ আলেমগণ আমার চেয়ে অবশ্যই ভালো জানবেন। কোনো পয়েন্টে ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন। কিন্তু, গালাগালি, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, ট্যাগট্যাগি করবেন। আমি নিজে এগুলোর কোনোটা করি না, কারো কাছ থেকে প্রত্যাশাও করিনা। গঠনমূলক সমালোচনা সবসময় ওয়েলকাম।

[elementor-template id=”6787″]

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button