যে হাত আমায় হত্যা করবে!
সবচেয়ে অসম্ভব্য পরিস্থিতিতেও যে দু’আ করা যায় এবং তা কবুল হয় তার উদাহরণ ওমরের (রা:) শাহাদাত বরণের দু’আ।
اللهُمَّ ارْزٌقْنِيْ شَهَادَةً فِيْ سَبِيْلِكَ وَاجْعَلْ مَوْتِيْ فِيْ بَلَدِ رَسُوْلِكَ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَتْلِيْ عَلَى يَدِ عَبْدٍ سَجَدَ لَكَ سَجْدَةً يَحَاجُّنِيْ بِهَا يَوْمَ القِيَامَةِ
মোটামুটি উচ্চারণ : আল্লাহুম্মারযুকনি শাহাদাতান ফী সাবিলিকা ওয়াজ’আল মাওতি ফী বালাদি রাসুলিকা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, আল্লাহুমা লা-তাজাল কাতলি আলা ইয়াদি আবদিন সাজদা লাকা সাজদাতান ইয়াহাজ্জুনী বিহা ইয়াওমা আল-কিয়ামাহ
অর্থ: হে আল্লাহ, আমি তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, যেন তোমার নবীর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শহরে আমার শহীদি মৃত্যু হয়, হে আল্লাহ, যে তোমাকে সেজদা করেছে তার হাতে যেন আমার মৃত্যু না হয়, পাছে বিচারের দিন সে আমার বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করে।
এই সিরিজের প্রথম পর্বে আমরা আবু বকরের (রা.) মৃত্যু এবং তার দু’আ নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর জীবনের শেষ অংশটুকু যেন হয় সর্বোত্তম, তাঁর জীবনের শেষ আমলটি যেন হয় সর্বোত্তম আমল, এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের দিনটি যেন হয় সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। এখন ওমরের (রা:) অবস্থাটা একবার চিন্তা করে দেখুন। তিনি জানেন তিনি নিহত হতে যাচ্ছেন এবং তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে একটি হত্যাকান্ডের মাধ্যমে।
ওমর (রা:) জানতেন তিনি শহীদ হবেন, কারণ রাসুল (ﷺ) একবার আবু বকর (রা:), ওমর (রা:) ও উসমানকে (রা:) নিয়ে ওহুদ পাহাড়ে আরোহন করেছিলেন এবং তা কেঁপে উঠেছিল। তখন রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘হে ওহুদ তুমি দৃঢ় হও! তোমার উপর একজন নবী (স্বয়ং), একজন সিদ্দিক – আবু বকর (রা:) এবং দুইজন শহীদ – অর্থাৎ ওমর (রা:) ও উসমান (রা:) রয়েছে। সুতরাং ওমর (রা:) ভালো করেই জানতেন যে তিনি শহীদ হবেন, কিন্তু তাও তাঁর জন্য যথেষ্ট ছিল না।
তিনি জানতেন যে তাঁকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে কারণ রাসুল (ﷺ) অনেকবার বিভিন্ন প্রসঙ্গে ওমরকে (রা:) জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। ওমর (রা:) ভন্ডামিকে ভয় করতেন। তিনি হুযায়ফার (রা.) কাছে জানতে চেয়েছিলেন মুনাফিকদের তালিকায় (যে তালিকা রাসুল (ﷺ) হুজাইফাকে (রা:) দিয়েছিলেন) তাঁর নাম আছে কিনা। তাঁকে হত্যা করা হবে এটা তিনি জানতেন, তারপরেও কে তাঁকে হত্যা করবে, কোথায় তাঁকে হত্যা করা হবে, এবং কিভাবে তাঁকে হত্যা করা হবে সে মুহূর্ত সম্পর্কে তিনি অনেক দু’আ করেছেন।
তাঁর একটি বিখ্যাত দু’আ আছে যেখানে ওমর (রা:) বলেছিলেন: ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে অনুরোধ করছি আপনার পথে শহীদ হিসেবে আমাকে কবুল করার জন্য, এবং সেই শাহাদাত যেন সংঘটিত হয় আপনার রাসুলের (ﷺ) নগরীতে।’ মদিনায় তাঁকে হত্যা করা হবে এটা মনে করা ওমরের (রা) জন্য ছিল অস্বাভাবিক, কারণ রাসুল (ﷺ) স্পষ্টতই মদীনায় বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং মুসলমানরা তখন মদীনায় অবস্থান করছিলেন। তাই রাসুলের (ﷺ) নগরীতে একজন মুসলমান কর্তৃক খুন হওয়ার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম।
প্রকৃতপক্ষে, যখন তিনি এই দু’আ করতেন, তখন তাঁর কন্যা তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা কিভাবে সম্ভব যে তিনি মদীনায় শাহাদাত বরণ করবেন। এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহ যদি চান তবে তাই হবে।’ এই সেই ব্যক্তি যিনি একদিন রাসুলকে (ﷺ) হত্যা করতে বের হয়ে নিজেই মুসলিম হয়েছিলেন, এই সেই ব্যক্তি যিনি মদিনায় শাহাদাত বরণ করেছিলেন, এবং যাকে রাসুলের (ﷺ) পাশে কবর দেওয়া হয়েছিল। কাজেই আপনি কখনোই জানেন না একজন মানুষের জীবনের পরিসমাপ্তি কেমন হবে।
ওমর (রা:) এই দু’আও করেছিলেন,
‘হে আল্লাহ, যে ব্যক্তি তোমাকে সেজদা করে তার হাতে যেনো আমি খুন না হই, পাছে বিচারের দিন সে আমার বিরুদ্ধে তা ব্যবহার করে।’
ওমর (রা:) এমন কারো হাতে নিহত হতে চান নি যে কিনা মুমিন বা যার মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার আভাস আছে। তিনি চাননি কেউ ‘আল্লাহু আকবার’ বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ‘ বলে চিৎকার করে তাঁকে হত্যা করুক।
প্রকৃতপক্ষে, যখন ওমরকে (রা.) ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল, তখন তিনি মসজিদুন নবাবীতে নামাযের ইমামতি করছিলেন, এবং তিনি প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিলেন তা হল তাঁকে ছুরিকাঘাতকারী ব্যক্তি মুসলিম কিনা।
যখন ওমর (রা:) জানতে পারলেন যে তাঁর হত্যাকারী মুসলমান নয়, তখন তিনি আলহামদুলিল্লাহ বললেন। তিনি এই জেনে স্বস্তি লাভ করেছিলেন যে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি একজন মুমিনের হাতে হয়নি। ওমর (রা:) দুনিয়া থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং জান্নাতের বাগানের সাথে এতটাই সম্পৃক্ত ছিলেন যে তিনি ইতিমধ্যেই তাঁর দু’আয় এগুলি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
তিনি আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন তিনি যেন রাসুলের (ﷺ) শহরে মৃত্যুবরণ করেন। রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘কেউ যদি আন্তরিকতার সাথে শাহাদাত প্রার্থনা করে, তবে বিছানায় শুয়েও সে শহীদি মৃত্যুবরণ করতে পারে।’
সুতরাং একজন ব্যক্তি যদি আন্তরিকভাবে তার প্রার্থনায় শাহাদাত প্রার্থনা করে, তবে আশা করা যায় তার মৃত্যুর ঘটনা এবং পরিস্থিতি যাই হোক না কেন সে শাহাদাত লাভ করবে ইন শা আল্লাহ।
ওমর (রা:) রাসুলের (ﷺ) নগরীতে শাহাদাত চেয়েছিলেন এবং রাসুল (ﷺ) বলেছেন,
‘তোমাদের মধ্যে (মুসলিম) যার সুযোগ হয় সে যেন মদিনায় মৃত্যুবরণ করে, মদিনার মৃত্যুবরণকারীর জন্য আমি সুপারিশ করব।’
পরিশেষে, এই উম্মতের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং বিচারের দিনে একজন মুমিনের বিরোধী হওয়ার ভয়ে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, যে তাঁকে হত্যা করবে সে যেন মুমিন না হয়, এবং আল্লাহ অসম্ভাব্য পরিস্থিতিতে তাঁর সব দু’আ মঞ্জুর করেছেন। তিনি শাহাদাত বরণ করেছেন মদিনায়, তাঁকে কোন মুসলিম হত্যা করেনি, এবং তিনি শায়িত আছেন আবু বকর (রা:) এবং রাসুলের (ﷺ) এর পাশে। তাই আল্লাহ সুবাহানাহু তা’য়ালার শক্তিকে অবমূল্যায়ন করবেন না, কারণ পরম করুণাময়ের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।
যে হাত আমায় হত্যা করবে!
পর্ব: ৫
মূল: ড. ওমর সুলাইমান
সিরিজ পুণ্যবানদের প্রার্থনা