Q/AAbdullahil Hadi

উকুনের কারণে মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডন করার বিধান

উকুনের কারণে মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডন করার বিধান এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া একটি হাদিস কেন্দ্রিক বিভ্রান্তির অবসান। সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা হাদিসকে কেন্দ্র করে মহিলাদের মাথায় উকুন হলে তাদের চুল মুণ্ডন করার বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। হাদিসটি হল: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার পোকাগুলো (মাথার উকুনগুলো) কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে?” তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, “তাহলে তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেলো এবং ছয়জন মিসকিনকে খাবার খাইয়ে দাও অথবা তিন দিন রোজা রাখ অথবা একটি পশু কুরবানি কর।” (সহিহ বুখারি)

এখন প্রশ্ন হল, ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডনের বিধান কি এবং উক্ত হাদিসের মূল ব্যাখ্যা কি?
নিম্নে মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডন করা কখন জায়েজ আর কখন না জায়েজ তা হাদিস ও আলেমদের বক্তব্যের আলোকে উপস্থাপন করত: উপরোক্ত হাদিসটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য পেশ করা হল:

মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডন করার বিধান

ক. বিপদ-মসিবত অপতিত হলে অথবা প্রিয়জনের মৃত্যুতে শোক পালনের উদ্দেশ্যে মাথা ন্যাড়া করা হারাম:

হাদিসে এসেছে, আবু বুরদা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: (তাঁর পিতা) আবু মুসা আশআরি রা. যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। আর (ঐ সময়) তাঁর মাথা তাঁর এক স্ত্রীর কোলে রাখা ছিল এবং সে চিৎকার করে কান্না করতে লাগল। তিনি (অজ্ঞান থাকার কারণে) তাকে বাধা দিতে পারলেন না। সুতরাং যখন তিনি চেতনা ফিরে পেলেন, তখন বলে উঠলেন,

أَنَا بَرِيءٌ مِمَّنْ بَرِىءَ مِنْهُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللّٰهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم بَرِيءٌ مِنَ الصَّالِقَةِ وَالحَالِقَةِ وَالشَّاقَّةِ
“আমি সেই মহিলা থেকে সম্পর্ক মুক্ত, যে মহিলা থেকে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সম্পর্ক মুক্ত হয়েছেন। নিঃসন্দেহে আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেই মহিলা থেকে সম্পর্কমুক্ত হয়েছেন, যে মৃত্যুশোকে উচ্চ স্বরে মাতম করে, মাথা মুণ্ডন করে এবং কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।”
[বুখারি, হা/১২৯৬, মুসলিম, হা/২৯৮]

খ. অনুরূপভাবে জরুরি কারণ ব্যতিরেকে মহিলাদের চুল মুণ্ডন করা হারাম। যেমন: মাথায় বিশেষ কোনও রোগ-ব্যাধি বা জরুরি কারণে চিকিৎসার স্বার্থে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাথার চুল মুণ্ডন করা প্রয়োজন ইত্যাদি। এমনকি হজ্জ-উমরার সময়ও পুরুষদের জন্য মাথার চুল মুণ্ডন করা জায়েজ হলেও মহিলাদের জন্য তা জায়েজ নয়। তারা আঙ্গুলের মাথা বরাবর চুল কাটবে। কারণ লম্বা চুল নারীর স্বভাবজাত সৌন্দর্য। অত:এব তারা মাথার চুল মুণ্ডন করবে না বরং চুল লম্বা করবে ও চুলের পরিচর্যা করবে-এটাই শরিয়ত সম্মত কথা ও সৃষ্টিগতভাবে নারী স্বভাবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

এ প্রসঙ্গে আলেমদের ফতোয়া

ক. আল্লামা শাইখ উসাইমিন রাহ. কে প্রশ্ন করা হয় যে, কোনও মহিলার মাথায় খুশকি থাকলে মাথা মুণ্ডন করার বিধান কি?

তিনি বলেন, “প্রয়োজন থাকলে মহিলাদের মাথার চুল মুণ্ডন করায় কোনও দোষ নেই। যেমন: যদি মাথায় ক্ষত থাকে এবং মাথার চুল মুণ্ডন করা ছাড়া তা চিকিৎসা করা সম্ভব না হয় তাহলে এতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু জরুরি দরকার ছাড়া মাথার চুল মুণ্ডন করা হারাম-যেমনটি বিজ্ঞ আলেমগণ বলেছেন। কেননা তা পুরুষদের সাদৃশ্য অবলম্বনের অন্তর্ভুক্ত। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পুরুষের সাদৃশ্য অবলম্বন কারীনী নারীদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। [ফতোয়া নূরুন আলাদ দারব ১০/১৩-শামেলা]

খ. সৌদি আরবের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতি আল্লামা শেখ আব্দুল্লাহ বিন বাজ রাহ. বলেন,

“নারীর মাথা মুণ্ডন করা জায়েজ নয় বরং তার মাথায় চুল অবশিষ্ট রাখা অপরিহার্য। কেননা চুল নারীর সৌন্দর্য এবং অলঙ্করণ। এটি নারী এবং পুরুষদের মধ্যে অন্যতম পার্থক্য। তাই হজের সময়ও তার মাথার চুল মুণ্ডন করার সুযোগ নেই। বরং হজ ও ওমরাতে চুল ছোট করবে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলছেন, মহিলাদের জন্য মুণ্ডন নেই। তারা চুল ছোট করবে।

মাথার চুল তাদের সৌন্দর্য। সুতরাং তা মুণ্ডন করা যাবে না। তবে যদি মাথায় কোনও রোগ-ব্যাধি থাকে যার কারণে ডাক্তার মাথার চুল মুণ্ডন করার অভিমত দেয় তাহলে ভিন্ন কথা। রোগের বিষয়টি ভিন্ন। কিন্তু অবহেলা বশত: বা কাফের বা অন্যদের অন্ধ অনুকরণ হলে এমনটি করা যাবে না। বরং তার জন্য আবশ্যক হল, চুলের পরিচর্যা করা ও যত্ন নেয়া। কারণ এতে সৌন্দর্য রয়েছে। তবে যদি চুল খুব ঘন বা লম্বা হয় তাহলে ছোট করতে অসুবিধা নেই।” [binbaz-org-sa]

উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য

আসলে প্রেক্ষাপট উল্লেখ ব্যতিরেকে আংশিক হাদিস পেশ করা হলে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে-এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই একশ্রেণীর মূর্খ মানুষ মন মত কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করুন।
যাহোক, পূর্ণ হাদিসটি পাঠ করলে তার মর্মার্থ ও মূল উদ্দেশ্য পরিষ্কার হবে আশা করি।

পূর্ণ হাদিসটি নিম্নরূপ

কাব ইবনে উজরা রা. থেকে বর্ণিত যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার নিকট দাঁড়ালেন। তখন তার মাথা থেকে উকুন ঝরে পড়ছিল। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, “তাহলে তোমার মাথা কামিয়ে ফেল।”
বর্ণনাকারী বলেন, অতএব আমার সম্পর্কে এ আয়াত নাজিল হয়:

فَمَنْ كَانَ مِنْكُمْ مَرِيضًا أَوْ بِهِ أَذًى مِنْ رَأْسِهِ فَفِدْيَةٌ مِنْ صِيَامٍ أَوْ صَدَقَةٍ أَوْ نُسُكٍ‏
“তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোগাক্রান্ত হবে অথবা যার মাথায় কোন অসুখ হবে (এবং এ কারণে মাথা মুড়িয়ে ফেলবে) তবে তাকে ফিদিয়া হিসেবে সওম পালন করতে হবে অথবা সদকা দিতে হবে অথবা কুরবানি করতে হবে”
[সূরা আল বাকরা: ৯৬]।

অতঃপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন,
صُمْ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ أَوْ تَصَدَّقْ بِفَرَقٍ بَيْنَ سِتَّةِ مَسَاكِينَ أَوِ انْسُكْ مَا تَيَسَّرَ ‏
“তুমি তিন দিন সওম পালন কর অথবা এক ফারাক (তিন সা) খাদ্য ছয়জন মিসকিনকে দান কর অথবা কুরবানি কর- যা সহজলভ্য হয়।”
(বাকরা: ১৯৬)
[সহিহ মুসলিম, অধ্যায়: ১৬। হজ্জ, পরিচ্ছেদ: ১০. কোন অসুবিধার কারণে ইহরাম অবস্থায় মাথা কামানো জায়িয, মাথা কামালে ফিদিয়া দেয়া ওয়াজিব এবং ফিদিয়ার পরিমাণ]

অন্য বর্ণনায় হাদিসটি এসেছে এভাবে

কাব ইবনে উজরা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় পৌঁছার আগে হুদায়বিয়ায় তার নিকট দিয়ে গমন কালে লক্ষ করলেন যে, তাঁর মুখমণ্ডল বেয়ে উকুন ঝরে পড়ছে। সে সময় কাব রা. ইহরাম অবস্থায় ছিলেন এবং একটি হাঁড়ির তলায় আগুন ধরাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন,
“তোমার পোকাগুলো (মাথার উকুনগুলো) কি তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে?”
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
তিনি বললেন,
«فَاحْلِقْ رَأْسَكَ وَأَطْعِمْ فَرَقًا بَيْنَ سِتَّةِ مَسَاكِينَ»
“তাহলে তুমি তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেলো এবং (এর ফিদিয়া/কাফফারা হিসেবে) ছয়জন দরিদ্র মানুষকে এক ‘ফারাক্ব’ খাবার খাইয়ে দাও অথবা তিন দিন সিয়াম পালন কর অথবা একটি পশু কুরবানি কর।” [বর্ণনাকারী বলেন, এক ফারাক্ব হল, তিন সা’ (প্রায় ৩*৩=৯ কেজি) এর সমপরিমাণ]।
[বুখারি ও মুসলিম। মিশকাতুল মাসাবিহ, অধ্যায়: ১১: হজ্জ, পরিচ্ছেদ: ১১. প্রথম অনুচ্ছেদ: ইহরাম অবস্থায় যা থেকে বেঁচে থাকতে হবে]

এ হাদিসের উদ্দেশ্য হল, হজ্জ বা উমরায় ইহরাম অবস্থায় মাথার চুল কাটা বা মুণ্ডন করা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি মাথায় উকুন হয় বা অন্য কোনও জরুরি কারণ দেখা যায় তাহলে তখন মাথার চুল কাটা বা মুণ্ডন করা জায়েজ আছে। তবে এ কারণে ফিদিয়া (কাফফারা) দিতে হবে। হাদিসে সেটাই বলা হয়েছে।

যেমনটি ইমাম মুসলিম এবং মিশকাতুল মাসাবিহ এর গ্রন্থকারের অনুচ্ছেদের শিরোনাম থেকে প্রতিভাত হয়। তবে এ বিধান পুরুষদের জন্য; নারীদের জন্য নয়। নারীদের জন্য সাধারণভাবে চুল মুণ্ডন করা হারাম। অবশ্য বিশেষ কারণে অপরিহার্য হলে ভিন্ন কথা-যেমনটি বড় আলেমদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়েছে। আল্লাহু আলাম।

আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক ইসলাম বুঝার তাওফিক দান করুন এবং সবধরণের বিভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture