Writing

সত্যের ধারাপাত

সুমি নিজের রুমে বসে বসে কাঁদছে। তার বিয়ের কেবল দুদিন হলো আজ। পাশের রুমে ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসছেন সুমির শাশুড়ী। কটমট করে আপন ছেলেকে ধমকি-ধামকি দিচ্ছেন বারবার।
বলছেন..
“একমাত্র মেয়ের জামাইকে অপমান করার সাহস কিভাবে পায় এই মেয়ে?
ননদের জামাই তাকে দেখবে, এতে কি তার মান ইজ্জত চলে যাবে?

আমি বললাম “মা ঘোমটাটা তুলো তো, আমার একমাত্র মেয়ের জামাই তোমাকে দেখতে এসেছে। কিন্তু মেয়েটা কেমন বজ্জাত, শাশুড়ির কথাটা মানলো না। কিভাবে ফেলে দিলো আমার কথাটা! বললো তার সামনে নাকি চেহারা খুলা যাবে না। ও রে আমার পর্দা রে। আমরা বুঝি আর পর্দা করি না। পর্দা উনি একাই করেন। বজ্জাত মেয়ে কোথাকার!’

রোজিনা তার স্বামীকে নিয়ে চলে যেতে চাইছিল। আপন ভাই বউ তার স্বামীকে অপমান করেছে, এখানে আর এক মুহূর্ত থাকা যায় না। ব্যাগ গুছিয়ে তারা রওনা হচ্ছিল। যায়েদ অনেক কষ্টে ছোট বোনকে আটকালো। সত্যিই চলে গেলে বড়সড় ঝামেলা হয়ে যেতো। ভাইয়ের কথা ফেলে দেওয়া যায় না। রোজিনা তাই থেকে গেল।

কিন্তু সে পরিষ্কার বলে দিয়েছে— এই বাড়ির এক লোকমা খাবার তার মুখে যাবে না, যতক্ষণ না তার স্বামীর কাছে সুমি ক্ষমা চাইবে।

সংবাদটা সুমির কানে পৌছার পর থেকে তার চোখের নালা দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছে। ভেতরে বয়ে যাচ্ছে কান্নার জোয়ার। রবের দরবারে বারংবার ফরিয়াদের স্বরে বলছে

“ও মাবুদ, এ কেমন পরীক্ষা আপনি আমাকে দিলেন?
আপনার হুকুম পালনের অপরাধে একজন সীমালঙ্ঘনকারীর কাছে ক্ষমা চাইব?
এটা তো নিঃসন্দেহে সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যের বিজয়। এটা তো অসম্ভব! মাবুদ, আপনি আমাকে হেফাজত করুন।

সবচেয়ে বড় বিপদে আছে যায়েদ। এই সময়টাতে সে কোন পথে হাঁটবে বুঝতে পারছে না। তার মাথায় যেন আকাশটা নেমে এসেছে। সুমি যা করেছে নিশ্চয়ই এটা ন্যায়। সুমি একজন ধার্মিক মেয়ে। পর্দানশিন। এটা সবার জানা থাকলেও এই মুহূর্তে তার ব্যবহারটা মেনে নিতে পারছে না কেউ। সবার চোখে জামাই অপমানের বিষয়টা বড় হয়ে ভাসছে। কাজটা পর্দার খেলাফ ছিল কি-না এটা দেখার বিষয় না। কিন্তু বিষয়টা সবাইকে বুঝাতে গেলে হবে আরেক ঝামেলা। সবাই বলবে বউয়ের হয়ে ওকালতি করতে এসেছে। মহা মুশকিল।

মা বারবার যায়েদকে ঠেলছে— সুমিকে বল জামাইয়ের কাছে মাফ চাইতে।

যায়েদ কিছু বলতে পারছে না। তার মায়ের সম্পর্কে সে খুব অবগত। এই মুহূর্তে মা’কে কিছু বলা মানে মৌচাকে ঢিল ছুঁড়া। আকাশ বাতাস ভারি করে কান্নার দোকান খুলে বসবেন তিনি। পরে হাতে পায়ে ধরে মাফ চেয়ে কান্না থামাতে হবে। এই কাহিনীটা যাতে না ঘটে তাই যায়েদ চুপ করে আছে। খানিক্ষণ পর রুমে এলো যায়েদ। বালিশে মাথা রেখে সুমি তখন কাঁদছিল। স্বামীকে দেখে চোখ মুছে ওঠে বসল।

সুমি তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল “আপনি কী আমাকে ওই লোকটার কাছে ক্ষমা চাইতে বলেন?
যায়েদ চোখ তুলে তাকালো সুমির দিকে। শক্ত কণ্ঠে জবাব দিলো
“জীবন চলে গেলেও তুমি এটা করবা না।
কথাটা শুনে সুমির চেহারায় দীপ্ত বাতি জ্বলে উঠল। এই মানুষটা তার পাশে থাকলেই হয়। কোন ভয় তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। মোকাবেলা করা যাবে শক্ত হাতে।

যায়েদ বলে উঠল ” কিন্তু আমার পরিবারের লোকদের কথা আমি জানি। এরা যা বলেছে তা করেই ছাড়বে। যে করেই হোক। তাই আমি চিন্তা করছি বিষয়টা কিভাবে মীমাংসা করা যায়।

“মীমাংসা তো হয়ে গেছে” সুমি বললো।
“কিভাবে? আগ্রহ ভরা কণ্ঠে জানতে চাইল যায়েদ।
সুমি জবাব দিলো না। বললো ”আপনার ওজু আছে?
যায়েদ বললো ” হ্যাঁ আছে।

“তাহলে চলুন দু’রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে আল্লাহর কাছে দরখাস্ত করি। উনিই তো উত্তম মীমাংসাকারী।

সুমির প্রভুভক্তি দেখে যায়েদ বিমোহিত হল। এমন ভাবে কেউ আল্লাহ’কে ডাকে আজকাল?
বিপদের সময় প্রথমেই নিকটাত্মীয়ের কাছে ছুটে চলে সবাই। একেবারেই যখন পারছে না, তখন ওপরে সাহায্যের আবেদন পেশ করে। এ-ই তো সবার নিত্যদিনের আচরণ।

যায়েদ আরো বেশি অবাক হলো সুমির মোনাজাতে বলা কথাগুলো শুনে। সুমি বলছিল..

” মাবুদ, ইউনুস আঃ কে যদি আপনি মাছের পেটের মতো অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে পারেন, এখানে তো আমি ততটাও অন্ধকারে নই। ইউসুফ আঃ কে যদি দরজা ভেঙে রক্ষা করতে পারেন, আমার সামনে তো কোন দরজা আটকানো নেই। মুহাম্মদ সাঃ কে যদি শত-শত যুবকের মাঝখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারেন, আমার সামনে তো শত-শত মানুষ নেই। মাত্র কয়েকটি মানুষ আমাকে আপনার হুকুমের বিরোধিতা করতে বলছে। এখানে আপনি আপনার সাহায্যকে আমার জন্য প্রশস্ত করে দিন না মাবুদ।

সিদ্ধান্ত হলো সুমিকে ক্ষমা চাইতেই হবে। রোজিনা তার স্বামী সহ মায়ের রুমে এসে বসে আছে। পাশের সোফায় মা’ও বসেছেন। এদের সামনে গিয়ে সুমি ক্ষমা চাইবে। সুমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আল্লাহর দিকে মননিবেশ করে আছে। তার বিশ্বাস আছে আল্লাহ সুবহানাহু ওতায়ালা তাকে অবশ্যই সাহায্য করবেন। যায়েদ অপারগ। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজে ধিক্কার দিচ্ছে। কী হচ্ছে এসব! তার কি এই মুহূর্তে কিছুই করার নেই?

মা ডাকলেন “যায়েদ।
” জ্বি মা।
“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাই তো বসে আছে।
” তো?
কথাটা যায়েদ একটু কঠিন গলায় বললো।
“তো কী? তোর বউকে বল এসে ক্ষমা চাইতে।

“ও কেন ক্ষমা চাইতে আসবে? ক্ষমা চাওয়ার মতো কোন অপরাধ তো সে করেনি।
“অবশ্যই অপরাধ করেছে।
“পর্দা করা কি তোমার কাছে অপরাধ মনে হয় মা?
“যায়েদ তুই আমার সাথে তর্ক করছিস?
“তর্ক করছি না মা। তুমি এখানে সত্যটা না বুঝে একজনকে শুধুশুধু দোষারোপ করছ।

” তোর বউ যে আমাকে সবার সামনে অপমান করেছে এটাও অপরাধ হয়নি তার, তাই না?
“ও তোমাকে অপমান কোথায় করেছে? শুধুমাত্র রোজিনার জামাইয়ের সামনে দেখা দেয়নি। এইটুকুই তো?

রোজিনা তার স্বামীকে নিয়ে ওঠে চলে গেল। এবার আর সে থাকছে না। ব্যাগটা হাতে নিয়ে রওনা হলো তারা। যায়েদ এবার আর আটকাতে গেল না। যাবে যাক। সে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। সুমি বললো

“মায়ের কাছে ক্ষমা চাইতে কোন অসুবিধে নেই। ওনাকে সত্যি অপমান করা হয়েছে। যেহেতু উনিই নিয়ে এসেছিলেন।

“তো কি করবে এখন?

সুমি কিছু না বলে মায়ের রুমে প্রবেশ করল। ওনি বিছানায় শুয়ে আছেন। মনে হচ্ছে কাঁদছেনও। ভুলটা নিতান্তই ওনার, কিন্তু বুঝতে পারেন নি।

সুমি তার শাশুড়ির পা ধরে ফেললো। এবং বলতে লাগলো.

“মা, আপনি আমার মায়ের মতো। আপনার কাছে আমি হাজারবার ক্ষমা চাইতে পারি। অপরাধ না থাকলেও আপনি আমাকে শাসন করার অধিকার রাখেন। তাতে আমি কিচ্ছু মনে করব না। আর রোজিনার স্বামীকে আমি ছোট করে দেখি না, ওনাকে আমি অবশ্যই সন্মান করি। কিন্তু উনি আমার মাহরাম নন। ওনার সামনে যাওয়া আমার জন্য হারাম। আমি জেনেশুনে কিভাবে হারাম কাজ করব আপনি বলুন?
আপনি কি চান আপনার মেয়ে হারাম কাজে লিপ্ত হোক?
আপনার মেয়ে হয়ে আমি আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য হই এটা কি আপনি চান?

যায়েদ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে তার মা মুহূর্তেই কিভাবে বুঝ ফিরে পেলেন। মা বললেন “কিন্তু আমার মা’টা যে রাগ করে চলে গেল।

সুমি বলল “রাগ কমলে একদিন আমরা তাদের বাসায় গিয়ে তাদেরকে বুঝাব। তখন অবশ্যই তারা বুঝবে মা। ইন-শা-আল্লাহ। আপনি দোয়া করবেন। আর একেবারেই টেনশন করবেন না।

একটু পর বাহিরে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হল। বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে। যায়েদও দৌড়ে বের হল। সুমি জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, কিন্তু মানুষজনের ভিড় ছাড়া তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কিছু একটা ঘটেছে এটুকু বুঝতে পেরেছে।

যায়েদ দৌড়ে রুমে এলো। সুমিকে বললো “হাসপাতালে যাচ্ছি। রোজিনারা যাওয়ার পথে এক্সিডেন্ট করেছে। রোজিনার স্বামীর অবস্থা নাকি বেশি ভালো না। দোয়া করো।

সুমির শাশুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। সুমি এবং অন্যান্য মহিলারা ওনার মাথায় পানি দিতে ব্যস্ত। বাবা বেঁচে নেই তাই সব দায়িত্ব যায়েদের ওপর। দু’জনকে নিয়ে অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে তাকে। প্রথমে প্রাথমিক হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাদেরকে রাখা হয়নি। পরে ঢাকায় নিতে হয়েছে। দু’জনের চেহারা-ই ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। জামাইর একটা পা ভেঙে গেছে।

দুদিন চিকিৎসার পর স্বাভাবিক সুস্থ হয়েছে রোজিনা। তার স্বামী অনেকটাই সুস্থ। তবে পা’টা ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে বলল ডাক্তার। সি এন জি’র চাপায় পড়েছিল পা’টা। পুরোপুরি সুস্থ হয়ে আগের মতো হাঁটতে পারবে বলে আশা আছে মাত্র বিশ পার্সেন্ট। ধরা যায় একটা পা প্রায় অচল।

রোজিনার স্বামী ইদানিং প্রায়শই একটা কথা বলছে। সে বলছে— আমার মনে হয় যায়েদের স্ত্রী’র কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ। তার সাথে আমরা যেটা করেছি সেটা অন্যায়। সেই অন্যায়ের ফল এখন ভোগ করছি আমরা। ক্ষমা চাইলে হয়তো-বা আমাদের শাস্তি কিছুটা কমতে পারে। রোজিনাকে সে বারবার তাগাদা দিচ্ছে ”আমাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে চলো। সুমির কাছে আমার ক্ষমা চাইতে হবে। তাড়াতাড়ি নিয়ে চলো আমাকে। স্বামীর আবদারের কাছে রোজিনা কি পরাস্ত না হয়ে পারে?

লিখেছেন

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture