Writing

ট্যাবু যখন যুলুম

অজ্ঞতা থেকে ট্যাবুর সূচনা হয়। সেই ট্যাবু কখনো কখনো যুলুমের পথে নিয়ে যায়। যে ট্যাবু যুলুমের দিকে নিয়ে যায়, সেই ট্যাবুকে আঁকড়ে ধরার কি কোনো প্রয়োজন আছে?
ইসলাম সর্বপ্রকার যুলুমকে নির্মুল করতে চায়। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মযলুমকে যুলুমের কবল থেকে আর যালিমকে যুলুম করা থেকে (বাধা দিয়ে) সাহায্য করতে।

যেই ট্যাবু অজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে আছে, সেই ট্যাবু যখন যুলুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে আটকাতে হয়। কিভাবে সেটা সম্ভব?
অজ্ঞতার আরেক নাম যদি অন্ধকার হয়, সেখানে জ্বালাতে হয় জ্ঞানের প্রদীপ। যে যুলুম অজ্ঞতার উপর দাঁড়িয়ে আছে, তাকে প্রতিহত করতে পারে জ্ঞান। অতিলজ্জা এবং লজ্জাহীনতার মতো দুই প্রান্তিক জায়গাকে ইসলাম সমন্বয় করেছে। সেন্সিটিভ বিষয়গুলোকে ইসলাম সুকৌশলে ডিল করেছে। লজ্জার দোহাই দিয়ে সেসব ক্ষেত্রে ইসলাম চুপ থাকেনি, আবার নির্লজ্জভাবে এতোটা খোলামেলা, বিস্তারিত আলোচনা করেনি।

অজ্ঞতার অন্ধকারকে জ্ঞানের মাধ্যমে ইসলাম আলোকিত করেছে। অজ্ঞতা, লজ্জা, ট্যাবু, অশ্লীলতা সবকিছুকে ইসলাম নৈতিকতার শিক্ষায় পরিবর্তন করেছে, যুলুম যেনো না হয় সেজন্য একটা ব্যালেন্সে এনেছে। ইসলামের ‘ব্যালেন্স’ শিক্ষা থেকে কেউ চলে গেছে অনেক দূরে, যেখানে ‘লজ্জা’ বলতে কোনো টার্ম রাখা হয়নি, নির্লজ্জ এবং অশ্লীলতার বিস্তার ঘটেছে সেখানে। অন্যদিকে, ইসলামের ‘ব্যালেন্স’ শিক্ষাকে লজ্জাশীলতা এবং জ্ঞান এই দুটোর মধ্যে সমন্বয় করতে না পারায় সেখানে জন্ম নিয়েছে অজ্ঞতা; যার ফলশ্রুতিতে জন্ম হয়েছে সামাজিক ট্যাবু এবং যুলুমের।

আল্লাহর কাছে মর্যাদার দিক থেকে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। একজন পুরুষ এই কারণে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান নন যে, তিনি পুরুষ। আবার একজন নারী এই কারণে আল্লাহর কাছে মর্যাদাহীন নন যে, তিনি নারী। মর্যাদার মাপকাঠি হিশেবে ইসলাম নারীত্ব বা পুরুষত্বকে রাখেনি; রেখেছে তাকওয়া, ঈমান-আমল এগুলোকে।

অন্যদিকে, আল্লাহর বিধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইন-জেনারেল হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আল্লাহ নারী-পুরুষের জন্য বিধানের শিথিলতা রেখেছেন। এর কারণ হলো- ‘আল্লাহ কারো উপর সামর্থ্যের অধিক বোঝা চাপান না’। কার পক্ষে কতোটুকু বিধান মানা সম্ভব, সেটা যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন সেই আল্লাহই ভালো জানেন। সেজন্য নারী এবং পুরুষভেদে বিধানের সামান্য তারতম্য আছে।

নারী-পুরুষ উভয়ের উপর নামাজ ফরজ, রোজা ফরজ, এটা জেনারেল কমান্ড। পাশাপাশি আল্লাহ নারীকে সাময়িক সময়ের জন্য সেগুলো থেকে অব্যহতি দিয়েছেন। মাসের ১৫০ ওয়াক্ত (৩০*৫) নামাজ যেমন একজন নারীকে আদায় করতে হয় না, তেমনি রামাদ্বান মাসে একটানা ৩০/২৯ দিন একজন নারীকে রোজা রাখতে হয় না। নারীর শারীরিক সক্ষমতা যেহেতু আল্লাহ জানেন, সেহেতু তাদের সক্ষমতা অনুযায়ী তাদের জন্য বিধান শিথিল করে দিয়েছেন।

রামাদ্বান মাসে একজন মেয়েকে ৫-৬ দিন রোজা রাখতে হয় না। এগুলো রামাদ্বান পরবর্তী সময়ে রাখার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। ইসলামের বিধান না জানার কারণে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় অজ্ঞতার কারণে ট্যাবু বাসা বেঁধেছে। আর সেই ট্যাবুর কারণে একপক্ষ শিকার হচ্ছে যুলুমের।

একজন মেয়েকে ৩০/২৯ দিন রোজা রাখতে হয় না, এই বিষয়টি আমার মনে হয় দেশের অনেক মানুষ জানেই না, জানলেও এই বিষয়ে পারিবারিকভাবে সচেতনার ছিটেফোঁটা নেই। যার ফলে অজ্ঞতা, ট্যাবু এবং যুলুম হাতে হাত ধরে চলছে।

শারীরিকি দূর্বলতার কারণে খোদ আল্লাহ যেখানে মেয়েদেরকে আল্লাহর ইবাদাত রোজা রাখা থেকে অব্যহতি দিয়েছেন, সেখানে লোকলজ্জার ভয়ে মেয়েদেরকে রোজা রাখার ভান করে যেতে হয় ‘পরিবারের লোকজন কী বলবে?’ এই ভয়ে! আল্লাহর বিধান শিথিল করা হলেও সমাজের ট্যাবুর নামে সেই শিথিলতার স্বাদ তারা নিতে পারছে না, উল্টো ট্যাবুর নামে তাদের উপর যুলুম করা হচ্ছে।

একজন মেয়েকে ঐ কষ্টকর মুহূর্তগুলোতে, যখন শরীরের জন্য ভালো খাবার দরকার, পুষ্টিকর খাবার শরীরকে দিতে হয়, তখন তাদেরকে উপোষ থাকতে হচ্ছে! অনেকেই এই সময়গুলোতে ঠিকমতো সেহরী করে না, দিনের বেলা লুকিয়ে খাবে, সেই ভয়টিও থেকে যায় ‘কেউ দেখে ফেলছে না তো?’

পরিবারে সমবয়সী ভাই থাকলে দেখা যায় কখনো মা-বোনকে লুকিয়ে খেতে দেখলে এই নিয়ে হাসি-তামাশা করে। কারণ কী?
সে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে না। বড়োরা-ই যেখানে ঠিকমতো জানে না, সেখানে ছোটো বাচ্চারা না জানারই কথা। ছোটো বাচ্চা যদি মা-বোনকে দিনের বেলা খেতে দেখে, সে তার সমবয়সীদের, বাড়ির বড়োদেরকে সেটা বলে বেড়ায়- ‘অমুককে আজকে লুকিয়ে খেতে দেখেছি’।

যারফলে, ঘরের মধ্যেও যে মেয়েরা লুকিয়ে কিছু খাবে, সেটারও সুযোগ রইলো না; ঘরের মধ্যে প্রকাশ্যে এক রুমে দরজ বন্ধ করে খাবার খেতে যাওয়া তো অনেক দূরের কথা। আল্লাহ তাকে যে সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, ট্যাবুর নামে সমাজে যে অজ্ঞতা প্রচলিত, সেই অজ্ঞতা তাকে আল্লাহর দেয়া সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছে।

এই যুলুমের অবসান কিভাবে ঘটানো যায়?
আমার কাছে মনে হচ্ছে, যে যুলুমের মূল কারণ হলো অজ্ঞতা, একমাত্র জ্ঞানই পারে সেই যুলুমের অবসান ঘটাতে।

আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আরবের মতো এমন একটা জাহেলী সমাজকে তিনি আমূল বদলে দিয়েছিলেন। জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে মানুষকে উৎসাহিত করেছেন, বদর যুদ্ধের যুদ্ধবন্দীদেরকে মদীনার বাচ্চাদেরকে পড়ালেখা শেখানোর বিনিময়ে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তৎকালীন সমাজে অজ্ঞতার কারণে অন্যান্য ধর্ম যেখানে নারীদের উপর যুলুম চালাতো, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এসব বিষয়ের মোকাবিলা করেন জ্ঞান দিয়ে।

বর্তমান মুসলিম সমাজে ট্যাবুর নামে নারীদের উপর যে যুলুম চলছে, সেটা মোকাবিলা করতে পারেন আলেমগণ। দেশের শহরাঞ্চল থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। তারা হলেন নবীগণের ইলমের উত্তরাধিকারী। দেশের বড়ো বড়ো আলেমগণ মিডিয়ায় এই বিষয়ে কথা বলন, লেখালেখি করেন, দেশের লক্ষাধিক মিম্বার থেকে খতীবগণ যদি ট্যাবুর নামে সমাজে প্রচলিত যুলুমের ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান তুলে ধরেন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান হতে বেশিদিন লাগবে না। এটা হলো অজ্ঞতার কারনে অসেচতনতা, জ্ঞানের আলোয় সেটা রূপ নিতে পারে সচেতনতায়।

আলেমগণের সামাজিক এবং ধর্মীয় মর্যাদা ও প্রভাব এদেশে অনেক বেশি। এই বিষয়টিকে যদি সত্যি সত্যি তাঁদের কাছে ‘যুলুম’ মনে হয়, তাহলে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীসানুযায়ী সেই যুলুমকে প্রতিহত করার দায়িত্বও তাঁদের উপর বর্তায়।

এক্ষেত্রে জুমুয়ার ওয়াজে একেবারে ভেঙ্গে ভেঙ্গে ডিটেইলস না বলে স্রেফ “রামাদ্বান মাসে ঘরের মা-বোনদের খাবার খেতে দেখলে আপনারা কিছু মনে করবেন না। এটা আল্লাহ প্রদত্ত তার অধিকার। এমন বিধান ইসলামে আছে” এটুকু বললেই কাজ হয়ে যায়।

লজ্জা ঈমানের অংশ, জ্ঞানার্জনও তেমনি ফরজ। শালীনতা এবং যুলুমের বিরুদ্ধে প্রজ্ঞার সাথে বয়ান হাজির করা, এই দুটোকে ব্যালেন্স করে সুকৌশলে, সুন্দর ভাষায় এড্রেস করতে না পারলে এই যুলুমের অবসান ঘটবে না।

দ্বিতীয়ত, আমাদের পরিবারগুলোতে ঘরোয়া মিটিং হয়ই না বলা যায়। যেসব পরিবারগুলোতে তাবলীগের মেহনত আছে, সেগুলোতে মোটামুটি মাশোয়ারা (পরামর্শ সভা) হয়। রামাদ্বানের পূর্বে পরিবারের কর্তা (বাবা, বড়ো ভাই বা মা) একদিন পরিবারের সবার সাথে বসতে পারেন। রামাদ্বান কিভাবে কাটাবেন, আমল-আখলাক, দান-সাদকা কিভাবে করবেন, সেগুলো নিয়ে পরিবারের সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে নিতে পারেন।

পাশাপাশি আলোচনা সভায় টেকনিক্যালি মেয়ে-বোনদেরকে স্বাচ্ছ্যন্দে একটি রুমে গিয়ে খাবার অধিকারটি দিতে পারেন। সুকৌশলে এমন অনেক কথা বলা যায়, কৌশল না জানার কারণে যেগুলো বললে বিশ্রী শুনায়। এজন্য স্থান, কাল, পাত্র এবং ভাষাজ্ঞান থাকতে হয়। কোন সিচুয়েশনে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা রপ্ত করতে হয়; রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জীবনী পড়লে আমরা এমনটা দেখতে পাই।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর হয় পরিবারের স্বামী-স্ত্রী যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে নিজেরা কথা বলে নেন। ফলে ভাই বা বাবা ঘরের বাকিদেরকে (মেয়ে) বলতে হচ্ছে না, স্ত্রী তার ননদদেরকে এ বিষয়ে সচেতন করতে পারে, মা তার মেয়েদেরকে। পরিবারের পুরুষরা সরাসরি পরিবারের প্রত্যেক নারীদের সাথে এ বিষয়ে কথা না বললেও এক্ষেত্রে হয়ে যায়।

পরিবারের ছোটো বাচ্চাদেরকে বুঝানো যায় যে, “আল্লাহ মেয়েদেরকে রামাদ্বান মাসের সবগুলো রোজা রাখার জন্য বলেননি, সবগুলো রাখতে বলেছেন ছেলেদেরকে। বড়ো হলে তুমি বুঝবা…” এভাবে বলে তাদেরকে বুঝানো যেতে পারে। অথবা যার কাছে ঠিক যে এপ্রোচটা সহজ এবং কার্যকর মনে হয়, সেই এপ্রোচটার অনুসরণ করতে পারে।

যদি দেখা যায় যে, বাচ্চাদেরকে বুঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে, তখন না হয় তাদেরকে না বুঝিয়ে লুকিয়ে খাবার জন্য এমন এক সময় নির্বাচন করতে হবে, যখন তারা ঘরে থাকে না। পরিবারের বন্ডিং যদি ভালো হয়, তাহলে ঐ সময়ে হয়তো পরিবারের অন্য কেউ বাচ্চাদেরকে বাইরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে পারে।

শালীনতার মধ্যে এই সংক্রান্ত আরো অনেক লেখালেখি হোক। এতে করে সমাজে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত যুলুমকে নির্মুল করা সম্ভব হবে। বর্তমানে একটি পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে (ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ) আছেন। উপরের উদ্যোগগুলো নেবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দেখা দিলে, এমনসব লেখাগুলোর লিংক পরিবারের এক সদস্য আরেক সদস্যের ইনবক্সে দিয়ে বলতে পারে- ‘ইমার্জেন্সি, এটা পড়ো’।

তাহলে দেখা যাবে, অন্তত ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র মতো হলেও একজন-দুজন করে আস্তে আস্তে সচেতন হবে। তাদের মধ্যে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর হয়ে কোনো একদিন জ্ঞানের আলো ঝলক দিবে। দূর হবে মানবসৃষ্ট, অজ্ঞতাপুষ্ট যুলুম।

উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “জাহেলী যুগে আমরা নারীদেরকে কোনো কিছু বলে গণ্যই করতাম না। যখন ইসলাম আবির্ভূত হলো এবং (কুরআনে) আল্লাহ তাদের (মর্যাদার কথা) উল্লেখ করলেন, তাতে আমরা দেখলাম যে, আমাদের উপর তাদের হক্ব আছে এবং তাতে হস্তক্ষেপ করা চলবে না।”
[সহীহ বুখারী: ৫৮৪৩]

লিখেছেন

Picture of আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture