Q/A

স্বর্ণের মূল্য হিসাবে করজ দেওয়া‌-নেওয়ার বিধান

এখন কাউকে আমি ৫ লাখ টাকা ধার দিয়ে যদি ৫ বছর পর ফেরত পাই সেই ৫ লাখ টাকাই তবে সেই কর্জদাতার লস। বর্তমান মূদ্রা ব্যবস্থার দোষ এটা। তাই যদি এমন করা হয় যে, বর্তমান বাজার মূল্যে ১০ ভরি স্বর্ণ এর দাম পরিমাণ অর্থ কাউকে ধার দিয়ে ৫ বছর পর আবার সেই সম‌য়ের বাজার মূল্য অনুযায়ী ১০ ভরি স্বর্ণের দাম ফেরত নেয়া হয় তবে কি সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে?
আসলে ধার দিলেই লস হয়ে যাচ্ছে আর্থিক ভাবে, এই জন্য বিনা সুদে বেশিরভাগ সময়ই দীর্ঘমেয়াদী ঋণ পাওয়া কষ্টসাধ্য হয়। এর কোন উপায় আছে কি?

এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা হলো :
মু‌মিন তার লাভ‌-লোকসান কেবল অ‌র্থের বিচা‌রে করে না; বরং নৈ‌তিকতা, মান‌বিকতা, পরোপকার, সওয়াব ও পুণ্য দিয়েও করে। পুঁ‌জিবাদ ও সমাজবাদের সা‌থে ইসলামী অর্থনী‌তির অন্যতম তফাৎ এখা‌নে। বিষয়‌টি বুঝে থাকলে আপনার প্র‌শ্নের শেষ প্যা‌রা‌টির ভুল আপ‌নি সহজেই ধর‌তে পার‌বেন।

লাভ‌ করার কিছু ক্ষেত্র আছে। সেখা‌নে নিয়মমত লাভ করতে শরীয়তে কোনো অসু‌বিধা নেই। কিন্তু সব জায়গায় লাভ করতে চাওয়া অমান‌বিকতা, কৃপণতা বা নির্বু‌দ্ধিতা প্রমাণ হ‌তে পা‌রে।

কেউ যদি আপনার কাছে করজ চায়, সেখানে আপ‌নি দেখ‌তে পারেন লোক‌টি কী উদ্দেশ্যে ঋণ করতে চাচ্ছে। উন্নয়ন ও প্র‌বিদ্ধমূলক কাজের জন্য, না‌কি অনুন্নয়ন ও ইমার্জেন্সী কোনো প্রয়োজন সারার জন্য। ‌
যেমনচি‌কিৎসার জন্য, নিজের বা ছেলে-মেয়ের বিয়ের প্রয়োজনে, আব‌শ্যিক (‌বিলাসীতার নয়) ঘরদোর নির্মা‌ণের উদ্দেশ্যে; বা এ জাতীয় কোনো প্রয়োজনে। এ ক্ষেত্রে করজ দি‌য়ে লাভ করতে চাওয়া অমান‌বিক ও অ‌নৈ‌তিক। এখন মুস‌লিম ভাই‌কে সাহায্যে করার সময়। সক্ষম ব্য‌ক্তি এখা‌নে কৃপণতা কর‌তে পা‌রেনা। বরং তার সাহা‌য্যে এ‌গি‌য়ে আসাই শরীয়‌তের কাম্য।

‌কিন্তু য‌দি কেউ এমন কো‌নো ক্ষে‌ত্রে করজ চায়, যেখা‌নে তার কো‌নো মুনাফা ও লাভ হ‌বে। যেমন ব্যবসা বা‌ণিজ্য করা, ব্যবসা বাড়া‌নো ইত্যা‌দি। সে‌ক্ষে‌ত্রে আপনার জন্য দু‌টি অপশন র‌য়ে‌ছে।

উপরে ব‌র্ণিত‌টি। অর্থাৎ বিনা লাভে করজে হাসানা দেবেন।
তার ব্যবসার পাটনার হয়ে তার সঙ্গে আপ‌নিও লাভবান হওয়ার চেষ্টা করবেন। এ ক্ষেত্রে আপ‌নি কেবল এমন ধর‌ণের চু‌ক্তিই কর‌তে পার‌বেন, ‌যেখা‌নে আপ‌নি ও তি‌নি উভ‌য়ে‌ লাভ ও লোকসা‌নের সমান দায় বহণ কর‌বেন। লাভ-লোকসা‌নের পূর্ণ ঝুঁ‌কি‌তে আপনার ভাই‌কে ছেড়ে দিয়ে আপ‌নি একতরফা লাভের বা‌লিশে আরা‌মে ঘুমাবেন; তা হতে পারবে না। যে আইন দিয়ে এটা নিষেধ করা হ‌য়ে‌ছে, সেটার নাম ‘সুদ‘; যা অকাট্য দলীল দ্বারা হারাম প্রমা‌ণিত।

এবার আসুন আপনার মূল মাসআলায়।

আপ‌নি য‌দি প্রথম ক্ষেত্রে করজ প্রদান করতে চান, সেখানে আ‌র্থিক লাভের চিন্তা মাথায় রাখতে পারেন না। এখা‌নে নৈ‌তিককা, মান‌বিকতা, পরোপকার ও সওয়াবকেই আপ‌নি প্রধান্য দি‌বেন।
আর য‌দি দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ঋণ দিতে চান, সেক্ষেত্রে আপ‌নি লাভের সুযোগ গ্রহণ করতে পা‌রেন। তবে সেটা হতে হবে শরীয়ত‌সিদ্ধ কোনো পন্থায়।

আপ‌নি যে পন্থা উ‌ল্লেখ ক‌রেছেন, সেটা শরীয়ত সিদ্ধ নয়। এ‌তে দু‌’ধর‌ণের অসু‌বিধা র‌য়ে‌ছে।
১) এই লেন‌দে‌নে সু‌দের আশঙ্কা র‌য়ে‌ছে। কারণ, লেন‌দে‌নের ৫বছর পর আপ‌নি য‌দি বাজা‌রের স্বর্ণমূল্যে টাকা গ্রহণ করেন, আর স্বর্ণমূল্য আ‌গের চে‌য়ে বে‌শি হয়, তা হ‌লে সেটা নি‌শ্চিত সুদ হ‌বে। কারণ, আপ‌নি ব‌র্ধিত অংশ তা‌কে প্রদান ক‌রেন‌নি।

‌দ্বিতীয়ত : এ‌তে শরীয়ত নি‌ষিদ্ধ ‘গরর’ র‌য়ে‌ছে, যা জুয়ার ম‌তো। কারণ, ঋণ বা করজ আদান-প্রদা‌নের ক্ষে‌ত্রে শরীয়ত প্রদত্ত বস্তু বা মুদ্রার সমপ‌রিমাণ বিকল্পবস্ত (بدل العين ) প‌রি‌শোধ করার নিয়ম রে‌খে‌ছে। তার মান বা মূ‌ল্যের হিসা‌বে নয়। এ‌তে বেশ অসু‌বিধা আ‌ছে।

উদাহরণত- আপ‌নি যে পদ্ধ‌তির লেন‌দে‌নের কথা বলে‌ছেন, সেটাতে আপনার লাভের কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ, ৫বছর পর স্বর্ণের দাম ক‌মেও তো যে‌তে পা‌রে। সে‌ক্ষে‌ত্রে তা‌কে বে‌শি টাকা গুণ‌তে হ‌বে। আর আপনি বে‌শি টাকা গ্রহণ কর‌বেন; যা স্পষ্টত সূদ। আর য‌দি স্ব‌র্ণের দাম বে‌ড়ে যায়, আপনার টাকা ক‌মে যা‌বে। এ‌তে ও লাভবান হ‌বে,‌ আর আপ‌নার লোকসান হ‌বে। এমন অ‌নি‌শ্চয়তা‌কে শরীয়‌তে “গরর” (الغرر ) ব‌লে। গররযুক্ত লেনদেন শরীয়তে নি‌ষেধ।

এ গরর আরেক‌টি সমস্যা সৃষ্টি করবে। সেটা হ‌লো পরস্পর ঝগড়াঝা‌টি। মুসলমানদের ঝগড়াঝা‌টি সৃ‌ষ্টি ক‌রে (المفضي إلى المنازعة), এমন যে‌কো‌নো বিষয়‌কে লেন‌দে‌নের ক্ষে‌ত্রে সম্পূর্ণ উ‌পেক্ষা ক‌রা হ‌য়ে‌ছে।

তা ছাড়া স্ব‌র্ণের বি‌নিম‌য়ে বা‌কি‌তে স্বর্ণ গ্রহণ করাও জা‌য়িয হ‌বে না। এটাও শরীয়ত ম‌তে সুদী লেন‌দেন।

‌মোটকথা, ঋণ দি‌য়ে নগদ টাকা থেকে নগদ টাকা বের করার শরীয়তের সরাস‌রি কোনো উপায় আমার জানা নেই। হাঁ, যেটা আছে, সেটা হলো মুদারাবা, শিরকাহ, মুরাবাহা ইত্যা‌দি।

আল্লাহু আ’লাম।

লিখেছেন

‌শিক্ষকতা, দাওয়াহ, লেখা‌লে‌খি, সস্পাদনা, খুতবা প্রদান

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture