Writing

সেরা হাদিয়া

আমার যখন বিয়ে হয়েছিলো তখন আমি মাদ্রাসায় অধ্যায়ণরত। একদিন দুপুরে আমার মাদ্রাসায় কল যায়। বাসায় ফিরতে বলা হয়েছে। মাদ্রাসা থেকে ফিরে দেখলাম আমার বাসায় কিছু মেহমান। আমাকে চিন্তিত দেখে আমার আব্বু হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আমার বেটি তোমাকে চিন্তিত লাগছে কেন?’

প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বললাম,
আব্বু আমাদের বাসায় কিসের এতো আয়োজন চলছে? আপনার কোনো মেহমান আসবে?’
আব্বু হাসলো। তারপর ভাবুক কন্ঠে বলল, ‘আমার মেয়ে তো বুদ্ধিমতী! সে কি কিছুই বুঝেনি কেন এতো আয়োজন?’

সত্যিই আমি তখন পর্যন্ত কিছুই বুঝতে পারিনি। নিভু নিভু চোখে উত্তর দিলাম, ‘আমাকে মাফ করবেন! সত্যিই আমি কিছুই বুঝতে পারিনি।’
তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। মুচকি হেসে বললেন, ‘আজ আমার কন্যা সাওদার বিয়ে যে..!’

বুকের ভেতর মুচড়ে উঠলো। আমার বিয়ে অথচ আমি কিছুই জানিনা। আব্বুর উপর রাগ হয়নি। তিনি পিতা! আমার ভালো-মন্দের দিকে খেয়াল রাখা তাঁর দায়িত্ব। এতোদিন আমার জন্য এতোকিছু করেছেন আমি কোনো দ্বিমত পোষণ করিনি; তবে আজ কেন করবো? লজ্জা পাচ্ছিলাম। লজ্জা লজ্জা মুখ করে সেখান থেকে ছুটে এলাম নিজের ঘরে।

সুন্দরমত আমার বিয়েটা হয়ে গেলো। খুব বেশি ধুমধামে আমার বিয়েটা হয়নি। তবে যেমন করে হয়েছে একদম আমার মনের মতো। মসজিদে আমার বিয়ে পড়ানো হয়েছে। বিয়ে শেষে খেজুর ছিটানো। ওয়াল্লাহি! পুরো দেশের মানুষ খাইয়েও যদি আমার বিয়ে দেওয়া হতো আমি এতোটা খুশি হতাম না, যতটা খুশি হয়েছি মসজিদে বিয়ে হওয়াতে এবং তবারক হিসেবে সবাইকে খেজুর দেওয়াতে।

বিদায় বেলা! আমাকে নেওয়ার জন্য পাঁচজন মানুষ এসেছেন। আমার যাওজ, আমার ননদী, আমার শাশুড়ি, মামা শ্বশুর এবং আমার চাচা শ্বশুর। খুব দরকারি কাজ থাকায় আমার শ্বশুর আসতে পারেননি। বাড়ি ছাড়ার আগে আমি আমার আব্বুর সামনাসামনি দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছিলো আমার হৃদয়টা কেউ দু’টো ভাগ করে দিয়েছে। লক্ষ্য করলাম তাঁর চোখে পানি টলমল করছে।

আমার মাথায় হাত রেখে কান্না বিজড়িত কন্ঠে বললেন,
আব্বাজানের উপর মনঃকষ্ট রেখো না। আব্বাজান তোমায় খুব খুব ভালোবাসে। ভালোবাসায় সবাইকে বেঁধে রেখো। শাশুড়িকে কখনো দুঃখ দিও না। চেষ্টা করবে তুমি থাকতে যেনো তোমার শাশুড়ি ব্যথা না পায়। তোমার স্বামীর উপর সবচেয়ে বেশি হক্ব কিন্তু তার মায়ের। জানো কন্যা! একটি সংসারকে সুখী রাখতে হলে সর্বপ্রথম ভালোবাসতে হয়। নিজের সাথে বেঁধে নিতে হয়। তোমার সংসারের প্রত্যেকজন সদস্যকে নিয়ে তুমি সুখী থেকো। আল্লাহ তোমাকে ভালো রাখুক।

তাঁর চোখ দিয়ে পানি গড়াতে শুরু করলো। তিনি আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললেন,
‘দু’আ করি নবী কন্যাদের মতো তোমার জীবন সুন্দর হোক। রব তোমাকে সবর, তাওয়াককুল এবং তাকওয়া দান করুন।’
কাঁদতে কাঁদতে তিনি কথাগুলো বললেন। আমি অনুভব করলাম তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত কষ্ট না হলে পুরুষ মানুষ কখনো কাঁদেনা।
চলে এলাম শ্বশুর বাড়িতে। খুব সুন্দর পরিবেশ। সবাই আমাকে আপন করে নিলো। আমার শাশুড়ি আম্মু অসম্ভব ভালো মানুষ। তার ব্যবহার আমাকে প্রথম দিনই মুগ্ধ করেছে। তিনি আমায় গ্রহণ করেছেন তাঁর কন্যা রূপে। আলহামদুলিল্লাহ এটা আমার কাছে অনেক বড় কিছু!

এদের সাথে আমার খুব ভালো সময় যাচ্ছিলো। বিয়ের এক সপ্তাহ শেষ হলো। আজ আমার শ্বশুর বাসায় এসেছেন। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আমার যেমন আগ্রহ তেমন তাঁরও। বড় পুত্রবধূ আমি। সুন্দর করে একটা ঘোমটা টেনে ড্রয়িং রুমে গেলাম। যেখানে তিনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন।
আমি গিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে বলললাম,
‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।’
তিনি জবাবে বললেন,
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ আমার বউমা। মাশাআল্লাহ আপনার সালাম তো খুব সুন্দর।’
মুচকি হেসে বললাম,
‘আপনি কেমন আছেন আব্বু?’

‘আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো আছি। এখন আপনাকে দেখে এবং আপনার মুখে আব্বু সম্বোধন শুনে আরো ভালো আছি আলহামদুলিল্লাহ আ’লা কুল্লি হাল।’
তিনি আমাকে ইশারা করে নিজের পাশে বসতে বললেন। আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছিলাম তাই সোফায় না বসে নিচে বসলাম। শ্বশুর আব্বু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘কি চান আপনি আমার থেকে? কোন জিনিস পেলে আপনি খুশি হবেন?’
কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলাম,
‘আব্বু! আপনি সবাইকে অনেক সুন্দর সুন্দর নাসীহত করেন। আপনার নাসীহত পাওয়ার আশায় কতজন আপনার কাছে ছুটে আসে। আজ আমি আপনাকে আমার সামনে পেয়েছি নিজের শ্বশুর হিসেবে। কত সৌভাগ্য আমার আলহামদুলিল্লাহ। আমি চাই আপনি আমাকে কিছু নাসীহত দেন যার দ্বারা আমার উপকার হবে। আর এই মূহুর্তে আপনার থেকে এটা পেলেই আমি সবচেয়ে বেশি খুশি হবো।’
শ্বশুরের মুখে হাসি।

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললেন,
‘আমার কন্যা! আপনার কথায় আমি অত্যন্ত খুশি।
ইচ্ছে করছে আপনাকে একবার মা ডাকি। ঠিক যেভাবে আমি আমার আম্মাকে ডাকতাম।’
বুকের ভেতর ধপ করে শব্দ করলো। কি জবাব দিবো আমি তাঁকে। একরকম ভাবনায় পড়ে গেলাম। ভাবনাচিন্তা ফেলে আমি তাঁকে বললাম,
‘আপনি আমাকে মা ডাকবেন এযে বড়ই আনন্দের কথা। তবে এই ভেবে আমার ভয় হচ্ছে আমি কি আপনার এই সম্মানের যোগ্য? আমি কি সবসময় আপনাকে আপনার মায়ের মতো আগলে রাখতো পারবো?’

আমার শ্বশুর চোখ বন্ধ করে বললেন,
‘میری بیٹی!
تمہارے سسر لوگوں کو غلط سمجھتے ہیں, لیکن ماں نہیں پہچانتی!’
(আমার বেটি!
তোমার শ্বশুর মানুষ চিনতে ভুল করে কিন্তু মা চিনতে নয়!)
ভীষণ কান্না পেলো আমার। নিজেকে সংযত রেখে বললাম,
‘আমার পাওনা!’

‘জ্বি আম্মা আপনার পাওনা আপনি পাবেন। আমি আজ আপনাকে যে কথাগুলো বলবো আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনবেন আশা করছি।
আমরা কেউ যখন বাসায় থাকবো না তখন আপনি এবং আপনার শাশুড়ি আম্মু একসাথে থাকবেন। সময় কাটানোর জন্য আপনারা বসে গল্প করবেন, কথা বলবেন। খুব ভালো। রব আপনাদের একসাথে রাখুন। কিন্তু আম্মা সবসময় খেয়াল রাখবেন কথা বলতে বলতে না কারো গীবত করে ফেলেন। গীবত বড়ই ভয়ানক। এটার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবেন।

আপনি এবং আপনার শাশুড়ি আম্মু দু’জন যখন একা বাসায় থাকবেন;তখন কুরআনকে নিজেদের সঙ্গী রূপে গ্রহণ করবেন। একজন আরেকজনকে তেলাওয়াত করে শুনাবেন। ইনশাআল্লাহ এতে আপনারা অহেতুক কথা বলা থেকে বেঁচে যাবেন।

নিজেকে সবসময় যিকিরে মশগুল রাখবেন। জিহ্বাকে থামতে দিবেন না, সবসময় যিকির করতে থাকবেন। যিকির করতে করতে একসময় আপনার জিহ্বা চালু হয়ে যাবে; তখন যিকির ছাড়া কিছুতেই মন বসবে না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নিজের পরকালীন জীবনে কিছু করার উত্তম মাধ্যম হলো যিকির। যিকিরে যেই অন্তর মশগুল থাকে সেই অন্তরে খারাপ চিন্তা আসে না।

আম্মা! আপনি ছোটবেলা থেকে পর্দার ভেতর বেড়ে উঠেছেন। আমি চাই আপনি সেটাকেই আঁকড়ে ধরে থাকুন। আল্লাহ না করুক কখনো যদি খারাপ কিছুর সম্মুখীন হতে হয় তখনও নিজের পর্দাকে আঁকড়ে ধরে রাখবেন। বলুন নারীর কাছে তার ইজ্জ্বতের চেয়ে বড় আর কি? পর্দা ছাড়া নারীকে সম্মান দিতে পারে আছে কি এমন কিছু?

মা! আপনার শাশুড়ির সাথে চলাফেরায় মাঝেমধ্যে হয়তো কথা কাটাকাটি হতে পারে। কিন্তু চেষ্টা করবেন এমন যেনো না হয়। আর যদি হয়েও যায় চুপসে যাবেন, পিছিয়ে আসবেন। তাঁকে বলার সুযোগ দিবেন। বয়স হয়েছে, মেজাজ এখন খিটখিটে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। দুজনে যদি একসাথে বলতে থাকেন তাহলে অনেক বড় সমস্যা হবে। তাই সবসময় নিজেকে পিছিয়ে আনার চেষ্টা করবেন। দেখবেন শান্ত হয়ে গেলে তিনিই আপনাকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বলবে। আপনাদের দুজনের সম্পর্ক জান্নাত পর্যন্ত স্থায়ী হোক, আমীন।

শেষ যে কথাটা বলবো আম্মা সেটা খুবই জরুরি।
একটু মন দিয়ে শুনুন। আপনি আমার ঘরের বউ। আপনার স্বামী পড়ালেখা করছে। সবসময় হয়তো আপনার আবদার গুলো পূরণ করতে পারবে না। মন খারাপ করার দরকার নেই, আপনার বাবার বাড়িতেও বলার কোনো দরকার নেই। যতদিন আমি আছি আপনার শ্বশুর। ততদিন আপনি আপনার শাশুড়ির মাধ্যমে আমার কাছে চাইবেন। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করবো আপনার শখ পূরণ করার। আম্মা! আপনার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ আপনার বাবার বাড়িতে কখনো কিছু চাইবেন না। তাঁরা অনেক করেছেন, ছোটবেলা থেকে আপনাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, আপনার চাহিদা গুলো পূরণ করেছেন। এজন্য আমার তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকার কথা। আপনি তাঁদের কাছে এমন কিছু বলবেন না বা এমন কিছু চাইবেন না যাতে আপনার শ্বশুরকে লজ্জা পেতে হয়।

আল্লাহ আমাকে যতটুকু সামর্থ্য দিয়েছে আমি ততটুকু দিয়ে আপনার শখ পূরণ করবো ইনশাআল্লাহ। রব আমাদের ভালো রাখুক, আমাদের সংসারটাকে আনন্দে ভরিয়ে দিক, আমীন।

কথাগুলো বলে আমার শ্বশুর আমার হাতে একটা বক্স এগিয়ে দিলেন। আমি সবার সামনেই সেটা খুললাম। একটা কুরআন, একটা হিজাব, একটা তাসবিহ, একটা আতর, একটা জায়নামাজ, একটা সুরমা আর একটা ডায়মন্ডের রিং। ডায়মন্ডের রিংয়ের উপর ছোট্ট করে লেখা এটা আপনার শাশুড়ি আম্মু দিয়েছেন। সত্যি বলতে দুনিয়ায় আমি এতো ভালো উপহার আর পাইনি। আমি শেখানেই কাঁদতে শুরু করলাম।

আমাকে এভাবে কাঁদতে দেখে শাশুড়ি আম্মু জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার কি হাদিয়া পছন্দ হয়নি সাওদা?’

কতটা পছন্দ হয়েছিলো আমি মুখে প্রকাশ করতে পারবো না। কাঁদতে কাঁদতে শুধু এতোটুকু বললাম,
‘মাশাআল্লাহ! আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
আপনারা আমার পাওয়া সেরা হাদিয়া।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture