Writing

গিবত কখন করা বৈধ এবং গিবত থেকে বাচতে কিছু বিষয় মাথায় রাখা

অন্যের গিবত শুনা কি বৈধ?
আমার সামনে কারও গিবত করা হলে আমি কী করবো?
জগদ্বিখ্যাত আলিম, উসুলবিদ, মুহাদ্দিস ও ফকিহ ইমাম নববি (রাহ.) স্পষ্টভাবে বলেন যে, ‘‘গিবত করা যেমন হারাম, তা শোনা এবং একে সত্যায়ন করাও হারাম।’’
[ইমাম নববি, জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ৪৬]

তিনি বলেন, ‘‘কোনো মুসলমানের গিবত কর্ণগোচর হওয়া (কানে আসা) মাত্রই শ্রোতার কর্তব্য হলো, গিবতকারীকে বাধা দেওয়া এবং তাকে সতর্ক করে দেওয়া। যদি মুখের কথায় সে নিবৃত্ত না হয় (না থামে), তাহলে প্রয়োজনে হাত দ্বারা তাকে প্রতিহত করবে। আর যদি হাত ও মুখ দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব না হয়, তবে উক্ত মজলিস ত্যাগ করবে।’’
[জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ৫৬]

ইমাম নববি (রাহ.) কুরআনের আয়াত থেকে সূক্ষ্ম হুকুম বের করে তাঁর এই মতের পক্ষে দলিল দিয়েছেন, যেখানে আল্লাহ তাঁর রাসুলকে বলছেন,
‘‘আর আপনি যখন তাদের দেখেন, যারা আমার আয়াতসমূহে উপহাসমূলক আলোচনায় মগ্ন হয়, তখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন, যে পর্যন্ত না তারা অন্য প্রসঙ্গ শুরু করে। আর শয়তান যদি আপনাকে ভুলিয়ে দেয়, তবে স্মরণ হওয়ার পর জালিম সম্প্রদায়ের সাথে বসবেন না।’’
[সুরা আনআম, আয়াত: ৬৮]

তাছাড়া গিবত যেহেতু হারাম কাজ, তাই এই কাজে সহযোগিতা করা নিঃসন্দেহে হারাম বিবেচিত হবে। মন দিয়ে গিবত শোনা বা গিবতের আলোচনায় সঙ্গ দেওয়া মানে গিবতে সহযোগিতা করা।

গিবতের আলোচনা/বৈঠক থেকে উঠে আসা সম্ভব না হলে কী করণীয়?

ইমাম নববি (রাহ.) বলেন, ‘‘কেউ যদি গিবতের বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়, যেখানে সে বাধাদানে বা অমত প্রকাশে অপারগ হয়, কিংবা তার বাধা ও অমতকে গ্রাহ্য না করা হয় আর তার পক্ষে সেখান থেকে উঠে আসাও সম্ভব না হয়, তদুপরি (তবুও) তার জন্য এ ধরনের গিবতে কান দেওয়া বা মনোযোগ দিয়ে শোনা জায়েয নয়। এ ধরনের অপ্রীতিকর অবস্থায় এসব থেকে বেঁচে থাকার উপায় হলো: মুখে ও অন্তরে একান্তে আল্লাহর যিকর করা এবং অন্য কোনো বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু করা, যাতে গিবতের কথায় তার মন না বসে আর সেও তা না শোনে। (গিবতের আলোচনা) এড়িয়ে যাওয়ার যাবতীয় চেষ্টা সত্ত্বেও যদি কিছু গিবত তার কানে এসেই যায়, এতে তার উপর (গুনাহের) দায় বর্তাবে না। তবে, গিবতের আড্ডা চলমান অবস্থায় যখনই কেউ বৈঠক ত্যাগের সুযোগ লাভ করে, তৎক্ষনাৎ এ ধরনের বৈঠক ত্যাগ করা চাই।’’ [জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ৪৭]

তিনি আরও বলেন, ‘‘যখনই কেউ কারও গিবত শুরু করে, তখন কোনোরূপ ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে, তৎক্ষনাৎ তাকে বাধা দেওয়া উচিত। আর যদি কোনোরূপ আশঙ্কা থাকে, তবে অন্তর থেকে তা অস্বীকার করা চাই। সেই সাথে সম্ভব হলে এ ধরনের বৈঠক ত্যাগ করা উচিত (যেখানে গিবতের আলোচনা চলে)। তেমনিভাবে মৌখিকভাবে গিবতে বাধা দেওয়ার সামর্থ্য থাকলে বা কোনোভাবে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকলে তা করা আবশ্যক। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাধা না দিলে গুনাহগার হবেন।’’
[জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ৪৬]

গিবত থামাতে গিয়ে আমাদের মুনাফিকি!

আমরা অনেক সময় মুখে গিবতের আলোচনা থামানোর চেষ্টা করি, অথচ অন্তর দিয়ে চাই না যে, এটা থামুক; বরং শুনতে ভালোই লাগে। এটি মুনাফিকি। ইমাম নববি (রাহ.) বলেন, ‘‘যদি কেউ মুখে মুখে গিবত বন্ধের উপদেশ দেয় আর মনে মনে তা অব্যাহত রাখার অভিলাষ (ইচ্ছা) পোষণ করে, এমন ব্যক্তির ব্যাপারে ইমাম গাযালি (রাহ.) বলেন, ‘‘তার এই কাজ স্পষ্ট নিফাক (মুনাফিকি)। আর সে কোনোভাবেই গুনাহমুক্ত নয় (ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন: ৩/১৪৬)।’’ বরং তার উচিত হলো, মুখে মুখে বাধাদানের পাশাপাশি অন্তর থেকেও একে মন্দ মনে করা।’’ [জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ৪৬-৪৭]

সালাফগণ কী করতেন?

আমাদের সালাফগণ (পূর্বসূরিগণ) নিজেরা তো গিবত থেকে দূরে থাকতেনই, অন্যদেরকেও গিবত থেকে কঠোরভাবে বাধা প্রদান করতেন।

প্রখ্যাত তাবিঈ সাঈদ বিন জুবাইর (রাহ.) তাঁর সামনে কারও ব্যাপারে গিবত করার সুযোগ দিতেন না।
[ইমাম যাহাবি, সিয়ারু আলামিন নুবালা: ৪/৩৩৬]

প্রখ্যাত কারি ও হাদিসের রাবি তাবিঈ মাইমুন বিন সিয়াহ (রাহ.) কারও গিবত করতেন না এবং তাঁর সামনে অন্য কারও গিবত করার সুযোগ দিতেন না। গিবতকারীকে কঠোরভাবে বাধা দিতেন। বাধা না শুনলে সেই মজলিস থেকে ওঠে চলে যেতেন।
[ইমাম কুরতুবি, আল-জামি’ লি আহকামিল কুরআন: ১৬/২৮৭; ইমাম ইবনু আবিদ দুনইয়া, আস-সমতু: ১/১৫১]

গিবত প্রতিহত করার মহান পুরস্কার:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গিবত প্রতিরোধ করে, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা আল্লাহর হক (অর্থাৎ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর)।’’
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৭৬৫০; শায়খ আলবানি, সহিহুত তারগিব: ২৮৪৭; হাদিসটি সহিহ]

অন্য হাদিসে এসেছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘যে তার (মুসলিম) ভাইয়ের মান-সম্মানের উপর আঘাতকে প্রতিরোধ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখমণ্ডল হতে জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত করবেন।’’
[ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ১৯৩১; হাদিসটি সহিহ]

গিবত থেকে বাচতে ১০টি বিষয়

গিবত থেকে বাঁচতে ১০টি বিষয় মাথায় রাখবো। ইনশাআল্লাহ, গিবত থেকে বাঁচতে পারবো।

প্রয়োজন ব্যতীত একটি কথাও না বলা

গিবত থেকে বাঁচার সবচেয়ে উত্তম উপায় হলো, প্রয়োজন ব্যতীত একটি কথাও না বলা। আমরা যখন জবানকে লাগামহীন করে দিই, তখনই গিবতে জড়িয়ে পড়ি—ইচ্ছাকৃত হোক বা অবচেতন মনে। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি ঈমান এনেছে, সে যেন ভালো কথা বলে নতুবা চুপ থাকে।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬১৩৬]

ইমাম নববি (রাহ.) বলেন, ‘‘কল্যাণলাভের বিচারে যদি কথা বলা বা না বলা উভয়ই সমান হয়, তবে সেক্ষেত্রে নিরব থাকাই সুন্নাত। কেননা, স্বাভাবিক জায়েয কথাবার্তাও ক্ষেত্রবিশেষে মানুষকে মাকরুহ বা হারামের দিকে ধাবিত করার আশঙ্কা রাখে; বরং অভ্যাসবশত অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুলের আশঙ্কাই প্রবল।’’
[জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ২৮]

ভেবেচিন্তে কথা বলা:

ইমাম শাফিয়ি (রাহ.) বলেন, ‘‘মানুষ যখন কথা বলতে চায়, তখন তার উচিত আগে ভেবে নেওয়া। যদি (কথা বলা) স্পষ্টত কল্যাণকর (মনে) হয়, তাহলে বলবে; আর যদি সন্দেহ হয়, তাহলে স্পষ্ট কল্যাণ না দেখা পর্যন্ত কথা বলবে না।’’ [জবানের হেফাজত, পৃষ্ঠা: ২৮]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘সে (মানুষ) যা-ই উচ্চারণ করে, তা (লিখে রাখার জন্য) তার কাছে রয়েছে সতর্ক প্রহরী।’’
[সুরা কাফ: ১৮]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জিহ্বা ধরে বলেন, ‘‘একে সংযত রাখো।…মানুষকে তো তার জিহ্বার ফসলের (অপব্যবহারের) কারণেই অধোমুখী করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে!’’ [ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৬১৬; হাদিসটি সহিহ]

অপছন্দের লোকগুলোকে আমরা আমাদের কষ্টার্জিত নেকিগুলো দিয়ে দিচ্ছি?

গিবতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিস্ময়কর আইরনিটা কি জানেন?
আমরা যে লোকগুলোকে অপছন্দ করি, সাধারণত তাদেরই গিবত করি; অথচ এর বিনিময়ে তারা আমাদের নেকিগুলো নিয়ে যাচ্ছে! আফসোস! আমরা যদি উপলব্ধি করতাম!

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যদি কেউ (গিবত, গালি বা অপমান করে) কারো মর্যাদা নষ্ট করে অথবা অন্য কোনোভাবে কারো প্রতি জুলুম করে থাকে, তবে সে যেন কিয়ামতের পূর্বে আজই তার থেকে মুক্তি নিয়ে নেয়। কারণ সেই দিন কোনো দিনার-দিরহাম (অর্থের বিনিময়) থাকবে না। যদি তার নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুমের পরিমাণ অনুসারে নেক আমল নিয়ে নেওয়া হবে (এবং মজলুমকে এর দ্বারা বদলা দেওয়া হবে)। আর যদি তার নেক আমল না থাকে, তবে তার সাথির (যার অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে) পাপ নিয়ে তার কাঁধে চাপানো হবে।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২৪৪৯]

প্রখ্যাত তাবে তাবিয়ি ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক (রাহ.) বলেন,
‘‘আমি যদি কারো গিবতে লিপ্ত হতাম, তাহলে আমার পিতা-মাতারই গিবত করতাম। কেননা তারা দুজনই আমার নেকি পাওয়ার অধিক হকদার।’’
[ইমাম ইবনু বাত্তাল, শারহু সাহিহিল বুখারি: ৯/২৪৫]

গিবতের প্র্যকটিস যেভাবে হয়:

গিবতের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রভাবক হলো, বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্য এবং সারাউন্ডিংস—যাদের সাথে তার ওঠাবসা। কারণ আমি দেখেছি, একজন মানুষ যখন গিবতকারীদের সাথে ওঠাবসা করে, তখন চাইলেও সে গিবত থেকে দূরে থাকতে পারে না। গিবত এক মজার জিনিস। আলোচনা জমানোর জন্য গিবতের চেয়ে লোভনীয় কিছু হতেই পারে না। এজন্য কোনোভাবেই এদেরকে গিবতের সুযোগ দেওয়া যাবে না। গিবত শুরু হওয়া মাত্রই এদের বাধা দিতে হবে। তাহলে এরা আপনাকে এটুকু সম্মান দিতে বাধ্য হবে যে, আপনার সামনে অন্তত গিবত করবে না।

গিবতকারীর গিবত থেকে আপনি নিজেও নিরাপদ নন; এটা মাথায় রেখে তাকে বাধা দিন।

একজন বিজ্ঞ মানুষ বলেছিলেন,
‘‘যে তোমার কাছে অন্যদের নিন্দা করে, সে তোমার নিন্দাও অন্যদের কাছে করবে।’’ সুতরাং গিবতের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি হওয়া উচিত। গিবতকারীকে কোনোভাবেই সঙ্গ দেওয়া যাবে না।

লজ্জা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলতে হবে।

আমরা অনেক সময় গিবতকারীকে বাধা দিতে সংকোচবোধ করি। ভাবি, সে মাইন্ড করবে বা সম্পর্ক খারাপ করবে। অথচ এটি একটি ভুল ধারণা। আমরা যদি নম্রভাবে গিবতকারীকে বাধা দিই এবং গিবতের ভয়াবহতা তুলে ধরি, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সে মেনে নেবে বা চুপ হয়ে যাবে। আর চুপ না হলেও মনে মনে আপনার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্বকে সম্মান জানাবে। আমার পরিচিত এক ভাই প্রায়ই গিবতে লিপ্ত হয়ে পড়েন।
অথচ তিনি আমার কাছে ঠিকই এমন এক ভাইয়ের প্রশংসা করেছেন, যিনি তাকে গিবত করতে চাইলেই বাধা প্রদান করেন।

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি মানুষের অসন্তুষ্টিতেও (মানুষকে অখুশী করে হলেও) আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, আল্লাহ তা‘আলা মানুষের মোকাবেলায় তার জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করে মানুষের সন্তুষ্টি তালাশ করে, আল্লাহ তাকে মানুষের দায়িত্বে ছেড়ে দেন।’’
[ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৪১৪; হাদিসটি সহিহ]

মন্দ কিছু বলার আগে ভেবে চিন্তে নিবেন

কারও ব্যাপারে যদি মন্দ কিছু বলতেই হয়, তাহলে তার নাম ও পরিচয় প্রকাশ করবেন না। যেমন: আপনার এক কাজিন, দেখতে বেশ ভদ্র, কিন্তু এক মেয়ের সাথে যিনায় লিপ্ত। কেউ তার ব্যাপারে খারাপ ধারণা করে না। তো, আপনি আমার সাথে বলছেন যে,
‘‘ভাই, মানুষ চেনা এত সহজ না। আমি একজনকে চিনি, যে সমাজে ভালো ও ভদ্র ছেলে হিসেবে পরিচিত, কিন্তু যিনা করে।’’ এই যে, আমাকে কথাগুলো বলেছেন, এতে কিন্তু আপনি গিবত করেননি। কারণ আমি সেই লোকটিকে চিনি নাই। আর যদি বলতেন,
‘‘আমার এক চাচাতো ভাই উপরে ফিটফাট, কিন্তু যিনা করে’’, তাহলে গিবত হতে পারতো। কারণ আমি হয়তো তখন অনুমান করে নিতে পারতাম যে, কার কথা বলা হচ্ছে। আর যদি সরাসরি নাম নিয়ে বলতো, তাহলে তো নিঃসন্দেহে গিবত হতো।

গিবত থেকে দূরে থাকা

গিবত থেকে দূরে থাকা এবং গিবতের আলোচনা প্রতিহত করার পুরস্কার মাথায় রাখা:

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গিবত প্রতিরোধ করে, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা আল্লাহর দায়িত্ব।’’
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৭৬৫০; শায়খ আলবানি, সহিহুত তারগিব: ২৮৪৭; হাদিসটি সহিহ]

নিজের দোষগুলোর প্রতি লক্ষ করা:

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; এবং প্ৰত্যেকের উচিত চিন্তা করা যে, সে আগামীকালের জন্য অগ্রিম কী পাঠিয়েছে!’’
[সুরা হাশর:১৮]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘তোমাদের কেউ কেউ অন্যের চোখে থাকা সামান্য খড়কুটোও দেখতে পায়, অথচ নিজের চোখে থাকা বৃক্ষটাও ভুলে যায় (চোখে পড়ে না)।’’
[ইমাম ইবনু হিব্বান, আস-সহিহ: ৫৭৬১; শায়খ আলবানি, সহিহুল জামি’: ৮০১৩; হাদিসটি সহিহ]

গিবতের ভয়াবহতা জানা:

নবি সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
‘‘মিরাজের রাতে আমি এমন এক সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলাম, যাদের নখগুলো তামার তৈরি আর তা দিয়ে তারা অনবরত তাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে আঁচড় মারছিলো। আমি বললাম, হে জিবরিল! এরা কারা?’’ তিনি বললেন, ‘‘এরা সেসব লোক, যারা মানুষের গোশত খেতো (গিবত করতো) এবং তাদের মানসম্মানে আঘা*ত হানতো।’’
[ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪৮৭৮; হাদিসটি সহিহ]

গিবত কখন করা বৈধ

গিবত কখন করা বৈধ?
কার গিবত করলে গুনাহ হয় না?
দলিলসহ আলোচনা করা হলো।

(১) কোনো ব্যক্তি জুলুমের শিকার হলে, সে এটার বিচার দাবি করার জন্য এবং জুলুম থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃত ঘটনা বলতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

‘‘মন্দ কথার প্রকাশ আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর জুলুম করা হয়েছে (তার ব্যাপারটি ভিন্ন)। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’
[সুরা নিসা: ১৪৮]

(২) পরিচয় দেওয়ার সুবিধার্থে কারও কোনো ত্রুটির কথা বলা যাবে। যেমন: আপনি কাউকে রাশেদের পরিচয় দিচ্ছেন, কিন্তু সে তাকে চিনতে পারছে না। তখন নির্দিষ্ট করে বলে দিলেন, ‘‘ওই যে দেখেন না, একটা খাটো লোক, অমুক জায়গায় প্রায়ই বসে থাকে, উনিই রাশেদ।’’ এই যে রাশেদের পরিচয় দেওয়ার জন্য ‘খাটো’ শব্দটি বলা হয়েছে, এটি কেবলই তার পরিচিতির জন্য। এভাবে বললে গিবত হবে না। তবে, তাকে হেয় করার উদ্দেশ্যে যদি বলা হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে গিবত হবে। তাই, একান্ত বাধ্য না হলে পরিচয় দেওয়ার সময় ত্রুটি উল্লেখ করা যাবে না।

অন্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-এর ব্যাপারে প্রয়োজনের তাগিদেই কুরআনে সুরা আবাসার শুরুতে এবং অনেক হাদিসে তাঁর অন্ধত্বের বিষয়টি এসেছে। এক্ষেত্রে তাঁকে ছোট করার মানসে উল্লেখ করা হয়নি।

(৩) হাদিসের বর্ণনাকারী রাবিদের ব্যাপারে দোষ-ত্রুটি উল্লেখ করা বৈধ। কারণ কোনো রাবির মধ্যে মিথ্যা কিংবা প্রতারণা থাকলে, তার সূত্রে বর্ণিত হাদিস ‘মাওদ্বু’ (জাল-বানোয়াট) হিসেবে গণ্য হয় এবং কেউ ব্যক্তিজীবনে ন্যায়পরায়ণ না হলে তার বর্ণিত হাদিস প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তাই, হাদিসের বিশুদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে ইলমুল জারহ ওয়াত তাদিলের ইমামগণ হাদিসের রাবিদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে সামান্যও ভ্রুক্ষেপ করতেন না; এমনকি নিজেদের আপনজনদের ব্যাপারেও ছাড় দিতেন না। হাদিসের বর্ণনাকারীদের মধ্যে কোনো নৈতিকতা বিবর্জিত ত্রুটি থাকলে, তা স্পষ্ট করা ওয়াজিব, যেন তার বর্ণিত হাদিস থেকে সাবধান থাকা যায়।

জারির বিন আবদুল হামিদ (রাহিমাহুল্লাহ) নিজ ভাই আনাস সম্পর্কে বলতেন, ‘তার থেকে হাদিস লেখা যাবে না। কেননা সে মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে।’
[আল-জারহু ওয়াত-তা’দিল: ২/২৮৯]

(৪) বিদ‘আতি এবং প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির ব্যাপারে সমালোচনা বা গিবত করা জায়েয। যেমন: কেউ প্রকাশ্যে মদপান করে, ইভটিজিং করে, মানুষকে যাচ্ছেতাই গালাগালি করে, জোর করে সম্পদ আত্মসাৎ করে ইত্যাদি। যেহেতু এই কাজগুলো সে প্রকাশ্যেই করছে এবং এসব কাজের ব্যাপারে তার মধ্যে কোনো লজ্জা-সংকোচ নেই, সেহেতু এগুলো গোপন রাখা জরুরি নয়।

একবার এক ব্যক্তির ব্যাপারে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমালোচনা করে বলেছিলেন,
সে তার গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি।
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৬০৫৪]

হাসান আল বাসরি (রাহ.) বলেন, বিদ‘আতি এবং ফাসিকিতে (প্রকাশ্য পাপাচারে) লিপ্ত ব্যক্তি সম্পর্কে সমালোচনা করা হলে, তাতে কোনো গিবত নেই।
[ইমাম লালাকাঈ, শারহু উসুলিল ই’তিক্বাদ: ১/১৪০]

ভালোভাবে জেনে রাখুন: এসব ব্যক্তির শুধু প্রকাশ্য অপরাধগুলোই বলা যাবে। কিন্তু এদের কোনো গোপন পাপ থাকলে, সেটি বলে বেড়ানো যাবে না। তবে, এরা যদি গোপনে অপরাধ ছড়িয়ে দেয় বা তাদের মাধ্যমে মানুষ অপরাধে জড়ায়, তাহলে সেগুলোও প্রকাশ্যে বলতে হবে, যেন তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়। প্রথমে পার্সোনালি বলে সাবধান করা হবে। কাজ না হলে সবাইকে জানাতে হবে। বিশেষ করে, নেতৃস্থানীয় বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে এদের ব্যাপারে নালিশ দিতে হবে।

(৫) কোনো আলিমের কাছে ফতোয়া চাওয়ার সময় একান্ত প্রয়োজনবশত কারও ত্রুটি উল্লেখ করা যাবে। তবে, সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, যেন ত্রুটি বর্ণনাই মূল উদ্দেশ্য না হয়। যেমন: একবার আবু সুফিয়ান (রা.)-এর স্ত্রী নবিজির কাছে এসে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আবু সুফিয়ান একজন কৃপণ লোক। আমাদের এত পরিমাণ খরচ দেন না, যা আমার ও আমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট হতে পারে, যতক্ষণ না আমি তার অজান্তে তার মাল থেকে কিছু নিয়ে নিই।’ তখন তিনি বললেন, ‘‘তোমার ও তোমার সন্তানের জন্য ন্যায়সঙ্গতভাবে যা যথেষ্ট হয়, তা তুমি নিতে পার।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৩৬৪]

আবু সুফিয়ান (রা.)-এর কৃপণতার কথা বলার পরও নবিজি তাঁর স্ত্রীকে এ ব্যাপারে সাবধান করেননি। কারণ এটা বলা দরকার ছিলো।

(৬) সঠিক পরামর্শ দেওয়ার স্বার্থে:

[ক] কেউ কারও ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে প্রয়োজনে ত্রুটি উল্লেখ করা যাবে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ত্রুটি উল্লেখ করা জরুরিও। যেমন: আপনি জানেন সালমান একজন অলস ও অকর্মণ্য লোক। তো, কেউ একজন এসে বললো, সে সালমানের সাথে শেয়ারে ব্যবসা করতে চায়, এটা উচিত হবে কি না। তখন আপনি তাকে বলে দিতে পারবেন যে, সালমান অলস মানুষ। তার সাথে শরিকানা ব্যবসা করা ঝুঁকিপূর্ণ।

[খ] আবার কেউ বিবাহের সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য পাত্র-পাত্রী এবং তাদের গোষ্ঠীর ব্যাপারে জানতে চাইলে, তখনও সঠিকটা বলতে হবে, যেন সে প্রতারিত না হয়। উল্লেখ্য, যদি পাত্র-পাত্রীর কোনো খারাপ অতীত থাকে, কিন্তু বর্তমানে সে তাওবাহ করে সম্পূর্ণ বদলে গিয়ে উত্তম জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে থাকে, তাহলে তার অতীত বলবে না। এর বাইরে বাকি যেসব বাহ্যিক ত্রুটি বা নেতিবাচক দিক আছে, সেগুলো বলবে, যেন সঠিক তথ্য পেতে পারে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যার নিকট পরামর্শ চাওয়া হয়, সে একজন আমানতদার (অর্থাৎ, তার উপর এটা আমানত যে, সে সঠিক পরামর্শ দেবে এবং সত্য বলবে)।”
[ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ২৮২২; ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৫১২৮; হাদিসটি সহিহ]

(৭) কাউকে সংশোধন করার ইচ্ছা থেকে তার ভুল-ত্রুটি এমন ব্যক্তিকে বলা যাবে, যে তাকে শাসন করতে পারবে অথবা সংশোধন করতে পারবে, কিংবা অন্তত আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবে, তাকে ফেরানোর জন্য। যেমন: কাউকে দেখলেন, সে বাজে ছেলেদের সাথে মেলামেশা করে। তাহলে, আপনি তার ভাই অথবা বাবাকে বলতে পারেন, তার খেয়াল রাখার জন্য।

উপরে যেসব আলোচনা করা হলো, সেগুলো আমাদের নিজেদের মনগড়া কোনো ফতোয়া নয়। ইমাম নববি (রাহ.) এবং অন্যান্য ইমামগণের এ সংক্রান্ত মতামতের আলোকেই লেখাটি উপস্থাপন করা হলো।

সতর্কতা: গিবতের জায়েয ক্ষেত্রগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকা জরুরি। না হলে কীভাবে যে জায়েয থেকে হারাম গিবতে চলে যাবেন, তা ভাবতেই পারবেন না। তাই, একান্ত বাধ্য না হলে গিবত হওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা থেকেও দূরে থাকতে হবে। উপরে উল্লিখিত পরিস্থিতিতে গিবত জায়েয হলেও আমরা যেন আল্লাহর সাথে এবং নিজেদের মনের সাথে সৎ থাকি। কাউকে তুচ্ছ করা যেন উদ্দেশ্য না হয়। আল্লাহ আমাদেরকে গিবতের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দিন। আমিন।

লিখেছেন

Picture of নুসুস টিম

নুসুস টিম

কুরআন ও হাদিসের মূল পাঠকে নুসুস (text) বলা হয়। নুসুসের উপর ভিত্তি করেই আমরা লেখালেখি করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture