Writing

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন- বন্ধু নির্বাচন

[১]

মানবজীবনে বন্ধুর প্রভাব অনেক বেশি। কারণ জীবনে চলার পথে সবচেয়ে বেশি যাদের সাথে উঠা-বসা করা হয় তারাই হচ্ছে বন্ধু। ভালো বন্ধুর ছোঁয়ায় যেমন জীবন আলোকিত হয়ে উঠতে পারে তেমনি কোনো খারাপ বন্ধুর সংস্পর্শে পুরো জীবনটাতে অন্ধকার নেমে আসতে পারে,জীবনটাকে ধ্বংসের অতল গহবরে পৌঁছে দিতে পারে। তাই সুস্থ সুন্দর জীবনযাপনের জন্য, ভালো মানুষ হওয়ার জন্য ভালো বন্ধু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

সন্তানের বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে মা বাবাকে উদাসীন হলে চলবে না। তাদেরকে শুরু থেকেই খেয়াল রাখতে হবে যে, সন্তানকে কাদের সাথে মিশতে দেওয়া হচ্ছে, কাদের সাথে চলাফেরা করতে দেওয়া হচ্ছে কিংবা কোন পরিবেশে রাখা হচ্ছে। সন্তানের ছোটবেলা থেকেই মা বাবার এসব বিষয়ে সচেতন থাকা কাম্য। এমন বিষয়ে অবহেলা করলে সন্তানের ঘাড়ত্যাড়ামির মতো কষ্টদায়ক আচরণ সহ্য করে একসময় ভীষণ কঠিন মাশুল দিতে হতে পারে। তখন আর আফসোস করেও লাভ হবে না। অন্তত আজকের যুগ বিবেচনায় সন্তান একবার পথহারা হয়ে গেলে তাকে সঠিক পথে পুনরায় ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকাল তো অনেক মা বাবারা তাদের সন্তানদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলেন না। কেমন জানি এক ধরণের দূরত্ব বজায় রেখে চলেন। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে সন্তানদের সময় দেওয়ার বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যান। অথচ সন্তানদেরকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এই কাজ তাদের ব্যস্ততার অংশ হওয়া উচিত তা যেন তারা বুঝতেই চান না। একটি বৃক্ষ থেকে ভালো ফল আশা করলে যেমন সেই বৃক্ষের শুরু থেকেই মেহনত করতে হয়, সময় দিতে হয় ঠিক তেমনি একজন মানুষের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করলে সেই মানুষের জীবনের শুরু থেকে তার পেছনে মেহনত করতে হয়, তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হয়।

যেসব মা-বাবারা সন্তানদেরকে পর্যাপ্ত সময় দেন না, সন্তানদের কেয়ারিং এর বিষয় যাদেরকে ঐভাবে ভাবায় না জীবনের একটা পর্যায়ে তাদের সন্তানেরাও তাদেরকে সময় দেয় না, তাদের সাথে ঠিক মতো কথাও বলে না, দূরত্ব বজায় রেখে চলে ঠিক যেমন তারা তাদের মা বাবাকে দেখে দেখে শিখে এসেছে। এটা অনেক কষ্টের বিষয় হলেও বাস্তব। সন্তানেরা তাদের পরম আপনজন মা বাবার কাছে যথেষ্ট সময় পায় না বলেই তারা বাছবিচারহীন ভাবে একের পর এক বন্ধু বানাতেই থাকে। কারণ তারা তাদের নিঃসঙ্গতা কাটাতে চায়, একাকীত্বের বিরক্তি দূর করতে চায়। যার দরুন অবাধে বন্ধুর সাথে মেলামেশা করতে শুরু করে। আর এভাবেই একসময় খারাপ বন্ধুর সংস্পর্শে চলে যায়, নিজেকে অন্য এক জগতের মানুষ হিসেবে আবিষ্কার করে।

এজন্য মাত্রাতিরিক্ত বন্ধুত্ব না করার স্বার্থে সন্তানদেরকে কাছে রেখে বেশি বেশি সময় দিতে হবে। তাদের সাথে হাসিমুখে কথা বলতে হবে। মাঝে মাঝে তাদের খেলার সাথীর ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদেরকে যথাসম্ভব সাথে রেখে উৎসাহ দিয়ে দিয়ে প্র্যাকটিক্যালি আদব কায়দা শিখাতে হবে।যে রব তাকে সৃষ্টি না করলে সে আপনার সন্তান হতে পারতো না,আপনিও বাবা হতে পারতেন না সেই মহান রবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। একইসাথে, নিজে আল্লাহর অনুগত থেকে তাদেরকেও আল্লাহর অনুগত থাকার অভ্যাস করাতে হবে। মা বাবাকে এমন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে যেন তারাই তাদের বেস্ট ফ্রেন্ড।

[২]

সন্তানকে গুরুত্বের সাথে ভালো বন্ধুর সাথে বন্ধুত্ব গড়ার এবং খারাপ বন্ধু থেকে নিজেকে হেফাজত করার গুরুত্ব বোঝাতে হবে। তাকে ভালো বন্ধু ও খারাপ বন্ধুর সাথে চলার প্রভাব বোঝাতে হবে যেনো সে নিজেকে সবসময় ভালো বন্ধুর সংস্পর্শে রাখার তাগিদ অনুভব করে।

যে বন্ধু নামাজের সময় মাসজিদে না গিয়ে সিনেমা হলের দিকে ডাকে কিংবা বিভিন্ন আড্ডায় মাতিয়ে রাখে, যে বন্ধু আল্লাহর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার উৎসাহ দেওয়ার পরিবর্তে তথাকথিত অমুক তমুক লেখকের ফ্রি মিক্সিং যুক্ত বই পড়তে উৎসাহ দেয়, যে বন্ধু ইসলামিক ওয়াজ-লেকচার দেখার সাজেস্ট না করে সদ্য মুক্তি পাওয়া নাটক, মুভিজ দেখার সাজেস্ট করে, যে বন্ধু আল্লাহর রাস্তায় দান করার কথা না বলে তথাকথিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চাঁদা দেওয়ার কথা বলে, যে বন্ধু মানুষের সাথে সুন্দর ব্যবহারের পরিবর্তে খারাপ ব্যবহার করে, সর্বোপরি যে বন্ধু আল্লাহর সন্তুষ্টির বিষয় তোয়াক্কা না করে বেপরোয়াভাবে চলতেই থাকে সে বন্ধু আর যাই-হোক কখনো ভালো বন্ধুর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দুনিয়া ও আখিরাতে নিজের কল্যাণের স্বার্থে এমন বন্ধুর সঙ্গ পরিত্যাগ করা খুবই আবশ্যক।

তবে হ্যাঁ, যদি তাদেরকে প্রভাবিত করার মতো দ্বীনের বুঝ থেকে থাকে কেবল তখন হয়তো একমাত্র দ্বীনে ফিরানোর লক্ষ্যই তাদের সাথে মেশা যেতে পারে। অর্থাৎ তাদেরকে প্রভাবিত করার দ্বীনি শক্তির বিষয় তথা নিজেকে শেষ পর্যন্ত দ্বীনের ওপর অটল থাকার বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা উল্টো তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের দ্বীনকে হুমকির মুখে ফেলা যাবে না।

[৩]

চলার পথের সঙ্গী অর্থাৎ যাকে আমরা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবো তার কোয়ালিটি নিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, তুমি নিজেকে সবসময় সেসব মানুষদের সাথে রেখে চলবে, যারা সকাল সন্ধ্যায় তাদের মালিককে ডাকে, তারা একমাত্র তারই সন্তুষ্টি কামনা করে, কখনো তাদের কাছ থেকে তোমার স্নেহের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ো না, (তোমার অবস্থা দেখে এমন যেন মনে না হয়) যেন তুমি এ পার্থিব জগতের সৌন্দর্যই কামনা করো, কখনো এমন কোনো ব্যক্তির কথামতো চলো না, যার অন্তরকরণকে আমি আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, আর যে ব্যক্তি নিজের নফসের গোলামী করতে শুরু করেছে এবং যার কার্যকলাপ আল্লাহ তা’য়ালার সীমালঙ্ঘন করেছে।
[সূরা আল কাহাফ:২৮]

উল্লেখিত আয়াতের আলোকে আল্লাহ তা’য়ালা তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ার তথা বন্ধুত্ব করার নির্দেশ দিয়েছেন যারা সবসময় নিজেদের সালাতে মনোযোগী থাকে, যারা সবসময় আল্লাহর জিকিরে জিহবা ভিজিয়ে রাখে, যারা উঠতে বসতে দুনিয়াবি অনর্থক কথা বাদ দিয়ে সারাক্ষণ আল্লাহর নিয়ামত নিয়ে কথা বলে, যারা প্রতিটি কাজ করার পূর্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি তালাশ করে, যারা এমন কোনো কাজে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করে না যার দরুন রব তাদের উপর অসন্তুষ্ট থেকে যান। এক কথায়, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তাদের সাথে চলার নির্দেশ দিয়েছেন যারা তাদের পুরো জীবনটাই আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর কাটানোর চেষ্টা করে। এমনকি রব এমন মানুষের কাছ থেকে মহব্বতের দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেও জোরালোভাবে নিষেধ করেছেন।

বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আল্লাহর এমন চমৎকার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও, আমরা কি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী এমন কারো সাথে বন্ধুত্ব করছি, যে সবসময় তার মালিককে নিয়ে চিন্তা করে, যে তার মালিকের সন্তুষ্টি কামনা করে?- তা নিয়ে এখনি ভাবা দরকার।

পক্ষান্তরে, আল্লাহ তা’য়ালা স্পষ্ট ভাষায় তিন ধরণের মানুষের সাথে চলাফেরা কিংবা বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন। প্রথমত, এমন মানুষদের সাথে যেনো চলা না হয় যাদের অন্তরকে আল্লাহ গাফেল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ যারা আল্লাহর অবাধ্য হয়ে চলতে চলতে নিজের অন্তরকে কলুষিত করে ফেলেছে, যাদের কর্মকান্ড আল্লাহর দিকে না ফেরার ইঙ্গিত দেয়।

দ্বিতীয়ত, যারা একরোখা স্বভাবের, যারা সবসময় নিজের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেয়, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির ধার ধারে না সর্বোপরি নিজের নফসের তথা নিজ খেয়ালখুশি মতো চলাফেরা করতে থাকে তাদের থেকেও নিজের নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে আমাদের রব আদেশ করেছেন।

তৃতীয়ত, যারা জীবনে চলার ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানকে প্রাধান্য না দিয়ে মানবরচিত বিধানকে প্রাধান্য দেয়, যারা হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করে জীবন পরিচালনা করে, যারা এমন কাজে নিজেদেরকে যুক্ত রেখেছে যা সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত তাদের থেকেও দূরত্ব নিশ্চিত করতে রবের নির্দেশেনা রয়েছে।

অতএব, আমাদের দ্বারা যেন জীবনে এমন কোনো বন্ধু নির্বাচন করা না হয় যে বন্ধুর সাথে থাকলে কিয়ামতের দিন অনুতপ্ত হয়ে এভাবে বলতে হয় ঠিক যেভাবে আল্লাহ আমাদেরকে পূর্ব থেকেই সাবধান করে বলেছেন,
হায়, আফসোস! কতো ভালো হতো রে, আমি যদি অমুককে আমার বন্ধু না বানাতাম!
[সূরা আল ফুরকান: ২৮]

লিখেছেন

পরকালীন তথা স্থায়ী জীবনের লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। নিজে হেদায়েতের ওপর অটল থাকার পাশাপাশি অন্যেদেরকেও হেদায়েতের দিকে আহবান করা তথা পথ হারাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই আমার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture