Writing

সন্তানের সামনে ঝগড়া গালাগালি ও অশালীন ভাষা ​ব্যবহার

বাবা মায়ের সন্তানের সামনে ঝগড়া

সে সব বাবা-মা’র প্রতি ​যারা সন্তানদের সামনে ঝগড়াঝাঁটি, গালাগালি ও অশালীন ভাষা ​ব্যবহার করেন…
ইসলাম এসেছে, মানুষকে সভ্যতা, সৌন্দর্য ও চরিত্র মাধুরীতে উদ্ভাসিত করতে। তাই মুসলিম মানেই উন্নত চরিত্রবান, নম্র, ভদ্র, শালীন ও ব্যক্তিত্ব বান মানুষ

মুমিন ব্যক্তি কখনোই অশালীন, ঝগড়াটে, নোংরা ও অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করতে পারে না। এটা মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়।
চাই সে বাবা, মা, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, ভাই, বোন, আত্মীয়, অনাত্মীয়, শিক্ষক, ছাত্র, আলেম, নন আলেম, বাসের ড্রাইভার, হেল্পার, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ ইত্যাদি যেই হোক না কেন।
তাই তো ইসলামে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করাকে কবিরা গুনাহ, ফসেকি কাজ এবং মুনাফেকির স্বভাব হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

মুনাফেকের বৈশিষ্ট্য

অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ মুনাফেকের বৈশিষ্ট্য:
হাদিসে এসেছে:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُرَّةَ، عَنْ مَسْرُوقٍ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو، أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ “‏ أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، وَمَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنَ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا إِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ وَإِذَا حَدَّثَ كَذَبَ وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ ‏”‏‏.‏ تَابَعَهُ شُعْبَةُ عَنِ الأَعْمَشِ

‘আব্দুল্লাহ বিন আমর রা. থেকে বর্ণিত- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যার মধ্যে চারটি দোষ থাকবে সে নির্ভেজাল মুনাফিকে পরিণত হবে আর যার মধ্যে সেগুলোর মধ্যে থেকে একটি থাকবে সে তা পরিত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে একটি মুনাফেকির নিদর্শন বিদ্যমান থাকবে। সেগুলো হল:
◆ ১. আমানত রাখা হলে খেয়ানত করে।
◆ ২. কথা বললে মিথ্যা বলে।
◆ ৩. প্রতিশ্রুতি দিলে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
◆ ৪. এবং ঝগড়া-বিবাদে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে।”
(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

মুমিন ব্যক্তি অশ্লীল ভাষী ও গালিগালাজ কারী হয় না।

ইমানদার ব্যক্তি কখনো অশ্লীল ভাষী ও গালিগালাজ কারী হতে পারে না:

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
 لَيْسَ الْمُؤْمِنُ بِالطَّعَّانِ وَلاَ اللَّعَّانِ وَلاَ الْفَاحِشِ وَلاَ الْبَذِيءِ
“মুমিন কখনো দোষারোপ কারী, অভিশাপ দাতা, অশ্লীল ভাষী ও গালিগালাজ কারী হয় না।” (তিরমিজি, হা/ ২০৪৩-শাইখ আলবানি হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন)

গালাগালি করা ফাসেকি:

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন,
سِباب المُسْلِمِ فُسوقٌ، وقِتَالُهُ كُفْرٌ (متفقٌ عَلَيهِ)
“কোন মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকি (পাপাচার) এবং তার সাথে লড়াই ও মারামারিতে লিপ্ত হওয়া কুফরি।” [সূনান আত তিরমিজী, হা/২৬৩৫]

রবের পক্ষ থেকে ভাষা প্রয়োগের নির্দেশ

মহান রবের পক্ষ থেকে সুন্দরতম ভাষা প্রয়োগের নির্দেশ:
তা ছাড়া আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্দর ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا
“আর তোমরা মানুষের সাথে সুন্দর ভাষায় কথা বলবে।”
(সূরা বাকারা: ৮৩)

আল্লাহ তাআলা সকল প্রকার অশ্লীল কথা বা কর্মকে নিষিদ্ধ করেছেন:

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ مَا لاَ تَعْلَمُونَ
“আপনি বলে দিন, আমার পালনকর্তা কেবলমাত্র অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য এবং হারাম করেছেন গুনাহ, অন্যায়-অত্যাচার আল্লাহর সাথে এমন বস্তুকে অংশীদার করা, তিনি যার কোন, সনদ অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহর প্রতি এমন কথা আরোপ করা, যা তোমরা জান না।”
(সূরা আরাফ: ৩৩)

তর্ক-বিতর্ক পরিহারের পুরষ্কার:

আবু উমামা রা. বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
أَنا زَعِيمٌ ببَيتٍ في ربَضِ الجنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ المِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقًّا، وَببيتٍ في وَسَطِ الجنَّةِ لِمَنْ تَرَكَ الكَذِبَ وإِن كَانَ مازِحًا، وَببيتٍ في أعلَى الجَنَّةِ لِمَن حَسُنَ خُلُقُهُ
‘অন্যায়ের স্বপক্ষে থেকে যে ব্যক্তি তর্ক-বিতর্ক পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের পাশে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়। আর ন্যায়ের স্বপক্ষে থেকেও যে ব্যক্তি তর্ক পরিহার করে তার জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়। আর যে ব্যক্তি তার চরিত্রকে সুন্দর করে তার জন্য জান্নাতের উপরিভাগে এক গৃহ নির্মাণ করা হয়।
(আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, বায়হাকি)

বিশেষ করে, পিতামাতা তার সন্তানদের জন্য আদর্শ-অনুকরণীয়। সুতরাং তারা যদি অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে এবং নোংরা ও অন্যায় আচরণ করে তাহলে তা সন্তানদের মাঝে দ্রুত সংক্রমিত হয়।

সুতরাং আদর্শ পিতামাতার উচিৎ, সন্তানদের সাথে কথাবার্তা আচরণের ক্ষেত্রে সংযম রক্ষা করা এবং সন্তানদের সামনে এমন কোন কথা না বলা বা এমন কোন আচরণ না করা যা তাদের মধ্যে খারাপ প্রভাব ফেলে।

সন্তানদের সামনে পিতামাতার নিত্যদিনের ঝগড়াঝাঁটি, কথা কাটাকাটি ও চেঁচামেচি তাদের উপর কেমন প্রভাব ফেলে?


সন্তানের সামনে নিত্যদিন কথা কাটাকাটি, চিৎকার-চেঁচামেচি চলতে থাকলে সন্তানের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক সময় তাদের আবেগ, মানসিক ও শারীরিক বিকাশেও তা বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রায়ই ঝগড়াঝাঁটি সন্তানের মন অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা হীনতায় জর্জরিত করে।

সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স ও আরলি ইন্টারভেনশন ফাউন্ডেশন যৌথভাবে একটি গবেষণা চালায়। গবেষণা বলছে, মা-বাবার প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘমেয়াদী সন্তানের মানসিক বৈকল্য সৃষ্টি করে, এমনকি তা জীবন ঝুঁকিতেও ফেলে দেয়।

মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা:

মা-বাবার মধ্যে কলহ ও তাদের বিচ্ছেদের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানরা। মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এদের মধ্যে ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, হাঁপানিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। শুধু তাই নয়, সমাজবিরোধী ও নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকেও ঝুঁকে পড়তে পারে এসব সন্তান। মা-বাবার ঝগড়া সন্তানকে আগ্রাসী করে তোলে।

নিরাপত্তা হীনতা:

ঝগড়াতে একে-অপরের ওপর দোষারোপ চলতেই থাকে। এ আচরণ সন্তানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তারা বিরক্ত হয়। নিজেকে উপেক্ষিত মনে করে। এর ফলে সন্তানের মনে নিরাপত্তা হীনতা তৈরি হয়। (Source: Somoy Tv)

ছ’মাস বয়সী শিশুর উপরে প্রভাব পড়ে:

পিতামাতার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে ব্রিটেনে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গত কয়েক দশকে যেসব গবেষণা হয়েছে তাতে দেখা গেছে, তাদের ঝগড়াঝাঁটির প্রভাব পড়তে পারে ছ’মাস বয়সী শিশুর উপরেও।

বাড়িতে যখন তারা বাবা মায়ের মধ্যে কোন ধরনের সহিংস সম্পর্ক দেখে তখন তাদের হৃদকম্পন বেড়ে যেতে পারে কিম্বা মানসিক চাপের কারণে হরমোন-জনিত সমস্যারও সৃষ্টি হতে পারে।

এর ফলে বাচ্চা, শিশু এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্ক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, ভুগতে পারে ঘুমের সমস্যায়, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তায়, বিষণ্ণতা এবং এধরনের পরিবেশের মধ্যে খুব বেশিদিন থাকলে তাদের আচরণগত গুরুতর সমস্যাও দেখা দিতে পারে। (Source: bbc)

অত:এব আসুন, আমরা দাম্পত্য জীবনে আরও বেশি ধৈর্য ও সহনশীলতা প্র্যাকটিস করি, মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করি, মুখে লাগাম টানি এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তাদের সামনে নিজেদের সম্পর্কের তিক্ততা প্রকাশ করা থেকে সাবধান হই।
আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
আমিন।

লেখক:
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল
দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ সেন্টার, সৌদি আরব

Source
www.somoynews.tvwww.bbc.com
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture