বিয়ের দেনমোহর
আমার বিয়ের কথাবার্তা প্রায় চুড়ান্ত হয়ে যাবার পর, দেনমোহরের অংক নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে বিয়ে-টা ভেঙ্গে গিয়েছিল!
আমাদের সমাজে এমন হতে শুনেছি কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যে এমন হবে কখনো কল্পনাও করিনি।সপ্তাহ দু’য়েক আগে প্রথমবারে দেখা হবার পরই বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে আমার ‘আব্দুল্লাহ’র সাথে।তারপর থেকে ‘আব্দুল্লাহ’র সাথে আমার মোবাইলে মাঝে মাঝে কথা হত। দুই পরিবারের কেউ বাধা দেয়নি। কিন্তু সম্পর্কটা ভাঙ্গার আগে কেউ আমার মতামত জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি৷
মোবাইলে ‘আব্দুল্লাহ’ নামটার দিকে তাকিয়ে আছি। আঙুলের একটা চাপ দিলেই ‘আব্দুল্লাহ’ নামটা মুছে যাবে। আসলেই কি যাবেে?
ভাল লাগার জন্য ‘আব্দুল্লাহ’র সাথে এটুকুই কথা বলা যথেষ্ট ছিল। বিয়ের পর কোথায় বেড়াতে যাব সেই পরিকল্পনাও হয়ে গিয়েছিল।
ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি আমার বিয়ের দেনমোহর নিয়ে ঝামেলা বাধবে।
আব্বু আম্মুকে কিছু বলতেও পারছি না। আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল পাঁচ লক্ষ টাকা দেনমোহরে। আব্বু আমার জন্য দশ লক্ষ টাকা প্রস্তাব করেছিলেন।’আব্দুল্লাহ’র বাবা মা নাকি ৪ লক্ষ বলেছে। এত কম অংক শুনে আমার মামা, খালা, ফুপুরা সবাই ভেটো দিয়েছেন। এই বিয়ে হবে না ব্যস। বড় আপু এসে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিয়ে গেল, আমাকে জিজ্ঞেসও করল না। এই সমাজে মেয়েদের মতামতের কোন মূল্য নেই।
অথচ রাসূল (সা:) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম পরিমাণের মোহর হচ্ছে তা, যা পরিশোধ করা সহজসাধ্য’।
সহজ ও অনাড়ম্বরভাবে বিয়ে সম্পাদন প্রসঙ্গে হযরত আয়েশা (রা:)বলেন, রাসূল (সা:)বলেছেন,
‘নিশ্চয় বরকতের দিক দিয়ে সর্বোত্তম ও গ্রহণযোগ্য বিয়ে হলো, যে বিয়ে সবচেয়ে স্বল্প খরচে সম্পাদিত হয়’।
মোবাইলে কল বাজছে। একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে। সাধারণত ধরিনা, আজ কি মনে করে ধরলাম।
একজন ভদ্রমহিলার গলা ভেসে এলো,
আসসালামু আলাইকুম! কে জামিলা?
ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু। জ্বী আমি জামিলা, আপনি কে?
আমি ‘আব্দুল্লাহ’র মা, তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।
জ্বী আন্টি বলেন, আমি শুনছি…৷
‘আব্দুল্লাহ’ তো সহজে কাউকে পছন্দ করে না। তিন চারটা প্রস্তাবের পর তোমাকে পছন্দ করেছে। আসলে আমারও তোমাকে খুব ভাল লেগেছে মা। সমস্যা হয়েছে দেনমোহর নিয়ে, তুমি কি কিছু শুনেছ?
জ্বী আন্টি আমি শুনেছি। আপুর দেনমোহর পাঁচ লক্ষ তো,তাই আব্বুরা বলছে অন্তত দশ লক্ষ হতে হবে। এটা মুরুব্বিদের ব্যাপার, আমি আর কিছু জানি না।
আচ্ছা মা শুনো। তবুও তোমাকে একটু বুঝিয়ে বলি যেহেতু তোমার জীবনের ব্যাপার আর এই আর্থিক নিরাপত্তাটাও তোমার। এই যে ইদানিং সবার খুব উঁচু অংকে দেনমোহর ফিক্স হয়, এই টাকাগুলো কি আদায় হয়?
বিয়ের আগে কি টাকা’টা দেয়?
অনেকে এমনকি বিয়ের পরেও দেয় না৷ অনেকে ডিভোর্স মামলা করেও এই উঁচু দেনমোহর আদায় করতে পারেনি, ঠিক না?
আমার ঠিক জানা নেই আন্টি, তবে শুনিনি কখনো পেতে।
‘আব্দুল্লাহ’র বেতন হল ত্রিশ হাজারের মত। দশ লক্ষ টাকা হল ওর ৩ বছরের বেতন। এত টাকা ও চুরি না করলে কোথা থেকে পাবে মা তুমি বল?ওর বয়স তো বাইশ+চাকুরিতে ঢুকেছে বছর দুয়ে’ক হল।
নিজের টাকায় বিয়ে করতে চায় তাই এতদিন টাকা কিছু টাকা জমিয়েছে। শুরুতে বেতনও কম ছিল। ও দেনমোহর পরিশোধ করবে বলে চার লক্ষ টাকা আলাদা করে রেখেছে, বাসর রাতে বউকে চেক দিয়ে দিবে। আমাদের কোন দাবী দাওয়া নেই মা। ‘আব্দুল্লাহ’ নিজের বেডরুম ফার্নিচারও কিনে ফেলেছে, ও শ্বশুরবাড়ি হতে কিছু নিবে না।
বরযাত্রীও বেশি আসবে না, তাই তোমার আব্বুরও বেশী কষ্ট হবে না। তুমি নিশ্চয়ই চাও না, বিয়ে করে ‘আব্দুল্লাহ’ বিশাল একটা চাপ বা ঋণের মধ্যে পড়ে যাক?
আর ‘আব্দুল্লাহ’র প্ল্যান আছে আগামীবছর তোমাকে নিয়ে হজ্ব করার।
দেনমোহর হতে তোমার খরচ তুমি বহন করবে, অর্থাৎ নিজের টাকায় হজ্ব করে আসবে।। জামিলা তুমি কি শুনছ?
তোমাকে আমাদের খুব ভাল লেগেছে তাই এতকিছু শেয়ার করলাম। তোমার আংকেল ফোন করে মানা করে দেয়ার পরও কথাগুলো বললাম। মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা তোমাকে ভালো রাখুক। নিজের যত্ন নিও মা।
মন্ত্রমুগ্ধের মত ভদ্রমহিলার (‘আব্দুল্লাহ’র আম্মুর) কথা শুনছিলাম। কি সুন্দর প্ল্যান।
আধাঘন্টা প্রায় অবশ হয়ে বসে রইলাম। মন স্থির করতে দশ মিনিট সময় লাগল।আব্বুর রুমে আব্বু, আম্মু, মামা, মামী, আপুসহ দশ বারোজন বসে বসে গল্প করছেন। সবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার একটুও গলা কাঁপল না।
আমি আব্বু কে বললাম, আমি ‘আব্দুল্লাহ’কে বিয়ে করব। চার লক্ষ দেনমোহরে আমার আপত্তি নেই।
আপনারা ব্যবস্থা করেন।
সবাই হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাকে কেউ কখনো এভাবে কথা বলতে দেখেনি। কেউ ভাবেনি,’জামিলা’ নিজের বিয়ের কথা নিজেই বলতে পারে। আমি আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে এলাম। অল্প করে আম্মুর গলা শুনলাম, বলছে নির্লজ্জ মেয়ে!
এর ঠিক তিন সপ্তাহ পর ‘আব্দুল্লাহ’র সাথে আমার বিয়েটা হয়ে গেল। পরে শুনেছি, অন্যদের বাধার মুখে আব্বু আমার পক্ষ নিয়েছিলেন। বলেছেন, আমার এই মেয়েটা কখনো কিছু চায় না।
ওর এই ইচ্ছেটা আমি চাই না অপূর্ণ থাকুক। পরে অন্য সম্পর্কে কষ্ট পেলে সারাজীবন দোষারোপ করতে পারে। তাছাড়া ছেলেপক্ষের কোন দাবীদাওয়া নেই, ‘আব্দুল্লাহ’কেও যথেষ্ট ভাল লেগেছে সবার৷ শুধু দেনমোহরের জন্য বিয়ে’টা ভেঙ্গে দেয়া ঠিক হবে না, যখন ওরা পুরো দেনমোহর অগ্রিম পরিশোধ করবে বলেছে।
এরমধ্যে আমার হবু শাশুড়ি বেশ কয়বার কল দিয়েছেন, খোঁজখবর নিয়েছেন। আমি আন্টি ডেকে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
বিয়ের দিন আমাকে ‘আব্দুল্লাহ’র হাতে তুলে দেয়ার সময় হঠাৎ কোথা থেকে প্রচন্ড আবেগ ভর করেছিল। অশ্রুতে মুখের মেকাপ লেপ্টে গিয়েছিল। কিয়াক্টা সাজ টাইনা সাজছিলাম! সাজতে অবশ্যই আমার খুব ভালো লাগে,
আমি আগেও অবশ্যই সাজুগুজু করতাম তবে বাহিরে বের হতাম না কেউ আমার সাজ দেখে ফেলবে বলে! সেজেগুজে রুমেই বসে থাকতাম,আর সেইদিন তো ছিল ‘আব্দুল্লাহ’র সাথে আমার বিয়ের দিন,কেমন সাজ সাজতে পারি সেটা তো সবার ভালো করেই জানা (হিহিহিহি) আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ছাড়তে চাইনি একদম।
আমি আম্মুর আদরের ছোট্ট মেয়ে, কখনো আম্মুকে ছাড়া থাকিনি। এখন থেকে কিভাবে থাকব তাও জানি না।মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে যেতে হবে, কে যে এই অদ্ভুত নিয়ম করেছে। উল্টোটাও তো হতে পারত। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে প্রতিদিনই একবার করে বাসায় চলে আসব।
বিয়ের পরদিন, আমার শাশুড়ি আমাকে ডেকে বললেন,দেখ ‘জামিলা’, আমি চাই না আমাদের সম্পর্ক গতানুগতিক বউ শাশুড়ি টাইপ হোক। এই বাসায় মানুষ মাত্র ৪ জন। তোমার শ্বশুর, আমি, তোমার ননদ ‘আয়েশা’ আর ‘আব্দুল্লাহ’। আমি তোমাকে বাকি তিনজনের দুর্বলতাগুলো শিখিয়ে দিব। ওগুলো একটু যত্ন নিয়ে ফলো করলে কয়েক মাসে দেখবে তুমি সবার খুব প্রিয় হয়ে গিয়েছ, পারবে না মা ?
জ্বী আন্টি, পারব ইনশাআল্লাহ।
উনি (শাশুড়ী আম্মা) অদ্ভুত চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাসলেন,
আন্টি ডাকতে পার মা সমস্যা নেই। আম্মু ডাক মন হতে না এলে অপরিচিত কাউকে জোর করে ডাকার দরকার নেই।
শুরুর কয়েকদিন, মেহমান আত্মীয়স্বজনদের ভিড়ে কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর প্রতি সপ্তাহজুড়ে অন্তত তিনটা দাওয়াত। বাবার বাড়ির দূরত্ব প্রায় অনেক দূর, প্রতি মাসে দুবার মায়ের কোলে গিয়ে শুতাম।
ফেসবুকে শাশুড়িদের নিয়ে ভয়াবহ সব গল্প আর অভিজ্ঞতা পড়েছি। কয়েকটা পড়ে তো আতংকে আমার হাত-পা কাঁপত। না জানি কপালে কি দুর্দশা লেখা আছে। আমার শাশুড়ির কয়েকটা দিক আমার খুব ভাল লেগেছে। গল্পগুলোর সাথে উনার কোন মিল নেই। উনি আমাদের রুমে কখনো নক না করে আসেন না।
আর ছুটির দিনে দুপুরে যখন ‘আব্দুল্লাহ’আর আমি দুপুরে একটু ঘুমাই, উনি কখনো নক করেন না। বিকেলে আমরা বাইরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
আমাকে কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছেন।
শ্বশুর কিরকম চা- বিস্কিট পছন্দ করেন, ফজর পড়ে আবার একটু ঘুমিয়ে সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠেন, তারপর পত্রিকা পড়ার সময় মনোযোগ দিয়ে উনার রাজনৈতিক এনালিসিস শুনে কিভাবে মাথা নাড়তে হবে বাধ্য ছাত্রীর মত, মাথায় কাপড় দিয়ে সামনে গেলে আদর বেশী পাব,’আয়েশা’র জামা কাপড় স্ত্রি করে পরার অভ্যাস, ছুটির দিন সকালে মশলা দিয়ে চা খেতে ভালবাসে, পাশের মার্কেটে ফুড কোর্টে গিয়ে দই ফুচকা খাওয়া প্রিয় আউটিং আর প্রিয় শপিং হল পার্স কেনা৷
‘আয়েশা’র সংগ্রহে অন্তত ৩৭ টা পার্স আছে বিভিন্ন রঙ আর ডিজাইনের। আর ‘আব্দুল্লাহ’ নিজে অগোছালো হলেও চারপাশে সবকিছু গোছালো দেখতে ভালবাসে। এই কাজটা এতদিন আমার শাশুড়ি করে এসেছেন। সপ্তাহে দুইদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়া অভ্যাস। এই আড্ডা নিয়ে বিরক্ত করা কিংবা মানা করা যাবে না৷ নিজ হতে ছেড়ে দিলে ভিন্ন কথা।
শুধু মাথা নেড়ে বললেন,
‘আব্দুল্লাহ’র খাওয়া দাওয়ার মধ্যে একদম অলস, আমি এই অভ্যাসটা ছাড়াতে পারিনি মা। তুমি দেখ পার কিনা। তবে শুরুতেই এটা নিয়ে ঝামেলা বাধিও না। সময় নিয়ে সম্পর্ক আরো মজবুত হলে তারপর। আমি বললাম,
আন্টি অন্যদেরগুলো তো শুনলাম। আপনার দুর্বলতা কি?
আন্টি (শাশুড়ী আম্মা) হেসে উড়িয়ে দিলেন,
পারলে তুমি খুঁজে বের কর। দেখি কেমন মেয়ে তুমি।
রান্নাঘরের আশপাশে ঘুরাঘুরি করতে দেখে আমার শাশুড়ী আম্মা আমাকে একদিন বললেন,
দেখ মা জামিলা, আমি জানি তোমার পছন্দের কিছু রান্না করতে ইচ্ছা করে। আমি কিন্তু তোমাদের বাসার রান্না খেয়েছি। হলুদ, মরিচ বেশী দেয়, একটু ঝাল। আমাদের বাসার স্টাইল কিন্তু আলাদা।’আব্দুল্লাহ’ আর ওর বাবা খেতে পারবে না। তুমি আপাতত চা নাস্তা বানাও, কয়েক মাসে বাসার রান্নার স্বাদ বুঝে গেলে তখন করতে পারবে।
‘আব্দুল্লাহ’ অফিসে চলে গেলে সময় কাটে না। ছাদ হতে আসা বাসার কাপড়গুলো ভাঁজ করে রাখতে দেখে আন্টি (শাশুড়ী আম্মা) বললেন,
এগুলা করার জন্য মানুষ আছে। তোমার হাতে এখন সময় আছে।তুমি এখন মাদ্রাসায়য় হেফজ খানায় ভর্তি হয়ে যাও, একবার মা হয়ে গেলে আর মেয়েদের নিজের জন্য সময় থাকে না, তখন শুধুই অন্যদের জন্য বাঁচতে ইচ্ছা করে।
পড়ালেখা’টা একটানে শেষ করে ফেল। এই ভুলটা আমি করেছিলাম,আমার আর হেফজ করা হয়নি। আমি যতদিন শক্ত আছি ঘরের দায়িত্ব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না মা। নাতি নাতনিও বড় করতে পারব, তোমার মায়ের হেল্প লাগবে না। ও মা, নাতি নাতনির কথা শুনে মেয়ের গাল দেখি লাল নীল বেগুনি হয়ে যাচ্ছে হিহিহি। আরে এক্ষুনি নিতে হবে বলিনি তো…।
লজ্জা পেয়ে পালিয়ে বাঁচলাম আমি। আন্টি কিন্তু মুখে বলেই ভুলে যাননি, সত্যিই হেফজ খানায় ভর্তির ফর্ম আনিয়ে ‘আব্দুল্লাহ’কে দিয়ে জমাও করিয়ে দিলেন। নাহ, এই মহিলা ছাড়ার পাত্র না একেবারেই। বছরখানেক বিয়ের আনন্দে কাটাবো ভেবেছিলাম। বেড়াবো, ঘুরব, হইচই করব। বিয়ের মাত্র পাঁচ মাস পেরিয়েছে আর নতুন ক্লাস শুরু হবে এক মাস পরেই। আবার পড়তে বসতে হবে ভাবলেই গায়ে জ্বর আসছে।
ইদানিং ভাবলে অবাক লাগে, আম্মুর কাছে যাওয়া অনেক কমে গিয়েছে। শুরুর দিকে মাসে দুবার, কমতে কমতে এখন মাসে একবারও যাওয়া হয় না। কথাবার্তা ফোনেই সেরে নেই। প্রতিদিনই আম্মুর কল আসে তবে আমাদের সংসার নিয়ে কিছুই জানতে চান না। বলেছেন, এদিকের কথা ওদিকে আর ওদিকের কথা এদিকে যাতে না করি।
আমার মাঝে মাঝে বলার জন্য পেট ফুলে যায় কিন্তু কিছু একটা বলতে চাইলেই আম্মু থামিয়ে দেন। বলেন, বড় হয়েছ এবার তুমি ম্যানেজ কর। বিয়ের আগে অনেক শিখিয়েছি। আমাকে বাধ্য হয়ে অনেক কিছু আন্টির কাছে জানতে চাইতে হয়।
এখানে শিক্ষনীয় বিষয় হল,আমাদের সমাজের কিছু মায়েরা মেয়েকে সুযোগ দেয়,স্বামীর বাড়ির বদনাম, দুঃখের কথা গুলো মায়ের কাছে বললেই, মা বলে এই স্বামীর ঘরে তর কখনো শান্তি হবে না, এ-ই সেই বলে।
শেষ পর্যন্ত ডিভোর্স! আমার মায়ে এখানে আমাকে কোনো সুযোগ দেননি,সব মায়েরা যদি এমন ভাবে বুঝাত এবং সুযোগ না দিত তাহলে আমাদের সমাজে হয়তোবা ডিভোর্সের হাড় কমে আসত।
মাঝে অবশ্য দুই তিনবার শাশুড়ী আম্মার সাথে তর্ক বেঁধে গিয়েছিল। রাগ করে আম্মুর কাছে চলে গিয়েছিলাম। আম্মু কিছু সময় পাশে বসিয়ে আদর করে দিয়ে আবার ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। ক’দিন থাকতে চাইলেও পাত্তা দেননি। ‘আব্দুল্লাহ’ ফ্রি থাকলে এসে নিয়ে গিয়েছে আর ব্যস্ত থাকলে আব্বু এসে নামিয়ে দিয়ে গেছে। এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসায় লজ্জা লাগছিল কিন্তু আন্টির আচরণে ভুলে যেতেও সময় লাগেনি।খুব ভালোবাসত আমাকে আন্টি, এককথায় মায়ের মতো।সবসময় নিজের মেয়ের মতোই দেখত।
দুপুরে কেউ ঘুমাই না, মাঝে মাঝে ‘আব্দুল্লাহ’ অফিস থেকে এসে কিছুক্ষণ ঘুমাই। আন্টি একটা ইসলামিক সিরিজ দেখেন। দেখতে দেখতে আমিও সেই সিরিজের ভক্ত হয়ে গেলাম। বেডরুমে টিভি থাকলেও আন্টির সাথে ড্রইংরুমে বসেই দেখি। অনেক বিষয়ে তখন আন্টির সাথে আলাপ হয়। পরিবার, সমাজ, ইসলাম সম্পর্ক নিয়ে উনার অভিজ্ঞতা আর ব্যাখ্যা আমাকে মুগ্ধ করে।
ক’দিনের জন্য আমাদের বাসায় গিয়েছিলাম, আব্বুর প্রেশারটা বেড়েছে।’আব্দুল্লাহ’ এসে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে, থাকেনি। সেদিন রাতে ফোনে বলল, আন্টির বেশ জ্বর। সমস্যা নেই, প্যারাসিটামল দিয়েছে ঠিক হয়ে যাবে। পরদিন রাত এগারোটার দিকে জানাল, আন্টির ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। ক্লিনিকে ভর্তি করেছে, শরীর বেশ দুর্বল। প্লাটিলেট এক লাখের নিচে চলে এসেছে, আরো নামলে হয়ত লাইফ সাপোর্ট আছে এমন হসপিটালে ট্রান্সফার করাতে হবে।
আমার বুকটা মুচড়ে উঠল। আব্বু পাশেই ছিলেন। কথাবার্তা উনার কানেও গিয়েছে কিছুটা। আমার মুখভঙ্গি দেখেই আব্বু উঠে গায়ে শার্ট চড়ালেন।
চল মামনি, তোমাকে হসপিটালে নামিয়ে দিয়ে আসি।
আমাকে ব্যাগসহ নামিয়ে আব্বু আর দাঁড়ালেন না। বললেন, তোমার আম্মুকে নিয়ে সকালে আসব। শরীর বেশী ভাল নেই।
কেবিনে ঢুকে ব্যাগ রেখে ‘আব্দুল্লাহ’র পাশে বসলাম। এর আগে এতরাতে কখনো হাসপাতালে আসিনি। কারো জন্য রাত জাগিনি।
আব্বু আম্মু হাসপাতালে ভর্তি থাকলে খালা, আপু আর অন্যরা সামলেছে। ‘আব্দুল্লাহ’র হাত ধরে মিনতি করে বললাম,
আপনার অফিস আছে সকালে। রাতে আমি থাকব আন্টির পাশে। আপনি এখন যান। সকালে অফিসে যাবার সময় নাস্তা আর আমার কিছু কাপড় নামিয়ে দিয়েন। আয়েশা প্যাক করে দিবে, ওকে বুঝিয়ে বলব কল করে।
আন্টি ঘুমাচ্ছেন। সাদা চাদরে শরীরটা গলা পর্যন্ত আবৃত। উনার ডান হাত ধরে পাশে চেয়ার টেনে বসলাম। অন্য হাতে স্যালাইন চলছে।
বিয়ের দিন থেকে সব স্মৃতি মনে পড়ছে। কিভাবে মায়ের মত আগলে রেখেছেন শুরু হতেই। নতুন সংসার কিছুই জানতাম না, কিছুই বুঝতাম না। উনার বুদ্ধি পরামর্শ মত চলে আমি এখন ‘আব্দুল্লাহ’র প্রিয় ওয়াইফ,’আয়েশা’র প্রিয় ভাবী আর শ্বশুরের প্রিয় বৌমা। মনে হতে লাগল এই ভদ্রমহিলা ছাড়া এই সংসারে আমি চোখে পুরোই অন্ধকার দেখব।
উনাকে আমার আরো বহুবছর পাশে দরকার, আমার অভিভাবক হয়ে, মা হয়ে ছায়া দেয়ার জন্য।
এমন শাশুড়ী কয়জনে পায়,আমার ভাগ্য জুটেছে আলহামদুলিল্লাহ।
কখন আমার কপোল বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমেছে টের পাইনি। ফোঁটায় ফোঁটায় সেগুলো আন্টির হাতের উপর পড়ছিল। আমি কখনো ভাবিনি, এত অল্প পরিচয়ে মাত্র কয়েক মাসে, রক্তের সম্পর্ক নেই এমন কোন মহিলা আমার অস্তিত্ব, পরিচয় আর আবেগকে এমনভাবে ছাপিয়ে যাবেন।
উনি কখন চোখ খুলেছেন তাও দেখিনি। মৃদু হাসলেন আমাকে দেখে,
কি রে মা, কাঁদছ কেন…?
আম্মা, আপনি আমাদের ফেলে এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবেন না। আমি আপনাকে কোথাও যেতে দিব না।
আমি কোথাও যাব না রে পাগলী মেয়ে। আরো অনেক বছর এই মেয়েটার সেবা নেয়া বাকি। আমার দুর্বলতা জিজ্ঞেস করেছিলে না?
তোমরাই আমার দুর্বলতা। তুমি কি খেয়াল করেছ তুমি আজ প্রথম আমাকে “আম্মা” ডেকেছ। এইদিনটার জন্য আমার অনেক অপেক্ষা ছিল। ডেঙ্গুটা দেখি শাপে বর হল।
অশ্রুসিক্ত চোখে হেসে ফেললাম,
নিয়েন সেবা দেখি কত বছর পারেন।
চারদিন পর আম্মা কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন, ব্যাগ গুছিয়ে একসাথে আম্মাকে নিয়েই বাসায় ফিরলাম।
আমার ভবিষ্যত অনাগত ‘আব্দুল্লাহ’ আর শাশুড়ী ‘আম্মা’কে নিয়ে কাল্পনিক ভাবনা!
যদিও কাল্পনিক, বাস্তবে এমন অনেক শাশুড়ীই আছেন।