Writing

আল্লাহর হুকুমেই যদি সব কিছু হয় তো আমার দোষ কি?

আল্লাহর হুকুমেই যদি সব কিছু হয় তো আমার দোষ কি?

ভাগ্য বা কদর (predestination) নিয়ে অনেক মুসলিমকে প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে দেখা যায়। ভাগ্য সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন হয়তো মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না, এই ওয়েবসাইট দেখছেন, ঐ বই পড়ছেন —আর এই সুযোগে শয়তান এসে মনের মধ্যে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দিয়ে গেল! দ্বন্দ তৈরীকারী এরকম একটা প্রশ্ন হলো—

আল্লাহ্‌ যা ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তার বাইরে তো নাকি কিছুই হবে না।
তাহলে আমার আর চেষ্টা করার দরকার কি?

১) আল্লাহ্‌ যা ভাগ্যে লিখে রেখেছেন তার বাইরে তো নাকি কিছুই হবে না। তাহলে আমার আর চেষ্টা করার দরকার কি?
আসুন এই প্রশ্নটার উত্তর বুঝা যাক একটা গল্পের মাধ্যমে।

একটা ক্লাসের কথা মনে করুন।
সেই ক্লাসে একজন শিক্ষক এবং অনেকগুলো ছাত্র আছে। সেমিষ্টারের ক্লাস শেষে এক সময় ফাইনাল পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসলো। শিক্ষক সাহেব যেহেতু তার ছাত্রদের সবাইকেই খুব ভালো করে চিনেন-জানেন, তিনি চ্যালেঞ্জ করে বললেন – আমি এক্স্যাক্টলি জানি কোন‌ ছাত্র কী গ্রেড পাবে। শুধু মুখে বলাই নয় – তিনি একটা কাগজে লিখে পর্যন্ত রাখলেন – অমুকে এ+ পাবে, অমুকে এ পাবে, অমুকে ফেইল করবে ইত্যাদি।
শিক্ষক কাগজে কী লিখেছেন তা সম্পর্কে ছাত্রদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তারা প্রত্যেকেই যার যার মতো পরীক্ষা দিল। মার্কিং স্কিম অনুসারে পরীক্ষার খাতাগুলি চেক করা হলো।

এরপর দেখা গেল – একি! শিক্ষক সাহেব যে ছাত্র সম্পর্কে যেই গ্রেড কাগজে লিখেছিলেন, হুবুহু ঐ গ্রেডই সে পেয়েছে! ছাত্রের সম্পর্কে শিক্ষকের জ্ঞান এতই নিখুঁত ছিলো যে, তিনি গ্রেডগুলো অনুমান করতে একবিন্দু ভুল করেননি।

ভেবে দেখুন, এই অবস্থায় কোনও ছাত্র এসে বলতে পারবে না – শিক্ষক আগেই গ্রেড লিখে রেখেছিলেন বলে আমি ঐ গ্রেড পেয়েছি। কারণ, শিক্ষক আগে যে গ্রেড লিখে রেখেছিলেন – সেটা কিছুতেই পরীক্ষার রেসাল্টকে প্রভাবিত করেনি। ছাত্ররা তো আর আগে-ভাগে জানতো না কে কী গ্রেড পাবে। কাজেই, যে এ+ পেয়েছে সে নিজের ইচ্ছাতেই পড়াশুনা করে এ+ পেয়েছে, আর যে ফেইল করেছে সে নিজের ইচ্ছাতেই পড়াশুনা না করার জন্য ফেইল করেছে।


যেহেতু আল্লাহ্‌ “আল-আলিম” বা সকল বিষয় সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে জ্ঞানী, তাই তিনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সব কিছুই সম্পূর্ণভাবে জানেন। কবে কী হবে, কে কবে জন্মাবে, কে কবে বিয়ে করবে, কার কত টাকা হবে, কোথায় কোন্‌ দুর্ঘটনা ঘটবে, কার কী অসুখ হবে, কে কিভাবে মারা যাবে, কে জান্নাতে যাবে, কে জাহান্নামে যাবে – এ সবই আল্লাহ্‌ জানেন।

আল্লাহর অজানা কিছুই নেই। আল্লাহ্‌ জানেন ভবিষ্যতে কী হবে, কী না হবে, যা না হবে তা হলেই বা কি হতো – তার সব কিছু। আর এই তথ্যগুলোকে তিনি “লাওহে মাহফুজ” নামক এক গ্রন্থে লিখে পর্যন্ত রেখেছেন।

إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَى وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ وَكُلَّ شَيْءٍ أحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُبِينٍ
আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং তাদের কর্ম ও কীর্তিসমূহ লিপিবদ্ধ করি। আমি প্রত্যেক বস্তু স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।
[সূরা ইয়াসীন: ১২]

কার জন্য লিখেছেন?
আমাদের জন্য। আমাদেরকে বুঝানোর জন্য যে, হে মানবজাতি, চেষ্টা করো, দু’আ করো, কিন্তু টেনশন কোরো না। চারপাশের এই পৃথিবীকে তোমার যতই বিশৃঙ্খল, নিয়ন্ত্রনহীন মনে হোক না কেন – আল্লাহর অগোচরে কোনও কিছুই হচ্ছে না, ভালো-মন্দ যা-ই হচ্ছে তা আল্লাহ্‌ হতে দিচ্ছেন বলেই হতে পারছে।

আপনি কি তাহলে বলতে চাচ্ছেন পৃথিবীতে এত অনাচার-অত্যাচার সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে?

২) দাড়ান, আপনি কি তাহলে বলতে চাচ্ছেন পৃথিবীতে এত অনাচার-অত্যাচার সব আল্লাহর ইচ্ছাতেই হচ্ছে?
আমি যে পাপগুলি করি তার সবও আল্লাহর ইচ্ছাতেই করি?
তাহলে পাপের জন্য পরকালে মানুষকে আর শাস্তি দেয়া হবে কেন?
মানুষরা কি সবকিছু আল্লাহর ইচ্ছাতেই করছে না?

এই মহাবিশ্বে যা কিছুই হচ্ছে – হোক সে কোনও প্রাকৃতিক ঘটনা, অন্যায়-অত্যাচার, মন্দ কাজ বা ভালো কাজ – তার সবই আল্লাহর অনুমতিতে হচ্ছে। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া গাছের একটা পাতা পর্যন্ত পড়ে না।

وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ
তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এ গুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্য কণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুস্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে।
[সূরা আল আন-আম: ৫৯]

আমরা যা করতে চাই, আল্লাহ্ সেটা হতে দেন। কিন্তু আল্লাহ আমাদেরকে কোনও কিছু করার স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই সেটা করে ফেলা উচিত হবে না। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা) যে কাজগুলোকে ফরজ/ওয়াজিব বলেছেন আমাদের দায়িত্ব হলো সেগুলো অবশ্যই পালন করা, আর তাঁরা যেগুলো হারাম বলেছেন সেগুলো থেকে বিরত থাকা।

পরীক্ষার হলের উদাহরণটা আবার টেনে আনা যাক।
ধরুন – শিক্ষক সাহেব এবার এমসিকিউ টাইপের পরীক্ষা নিচ্ছেন। পরীক্ষায় দেয়া হয়েছে ৫০টি প্রশ্ন, প্রতিটা প্রশ্নের সাথে দেয়া আছে ৪টি সম্ভাব্য-উত্তর, যার মধ্যে একটি মাত্র উত্তর হলো সঠিক। এখন শিক্ষক চাইলে পরীক্ষায় এই ৫০টি প্রশ্ন না দিয়ে সম্পূর্ন ভিন্ন ৫০টি প্রশ্ন করতে পারতেন। অথবা, বর্তমান প্রশ্নপত্রে যে সম্ভাব্য-উত্তরগুলো দেয়া হয়েছে, সেগুলোকে পরিবর্তন করে ভিন্ন উত্তরও দিতে পারতেন।

অর্থাৎ, পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে কি দেয়া হবে- তার উপর শিক্ষকের পূর্ন নিয়ন্ত্রণ আছে। একজন ছাত্র যখন উত্তর লিখবে তখন তাকে শিক্ষক যে সম্ভাব্য-উত্তরগুলি দিয়েছিলো তার থেকেই একটাকে উত্তর হিসাবে বেছে নিতে হবে, সে চাইলেও এই সম্ভাব্য উত্তরগুলোর বাইরে যেতে পারবে না – এটাই পরীক্ষার নিয়ম। সুতরাং, ছাত্র কী উত্তর দিতে পারবে তা শিক্ষকের প্রশ্নের উপর নির্ভরশীল। একইভাবে আল্লাহও প্রতিটা মানুষকে জীবনে বিভিন্ন চয়েস দেন। আমরা চাইলেও সেই চয়েসগুলোর বাইরে যেতে পারি না।

এবার ভাবুন: পরীক্ষার সময় শিক্ষক নিজেই হল পরিদর্শন করে ছাত্রদের অবস্থা দেখছেন। ঘুরতে ঘুরতে এক সময় শিক্ষকের চোখে পড়ল যে, একজন ছাত্র ভুল উত্তর বেছে নিচ্ছে।

এখন শিক্ষক চাইলে ঐ ছাত্রকে তখুনি থামিয়ে দিয়ে বলতে পারেন – “এই ছোড়া! তুমি তো ভুল উত্তর দিচ্ছ!”, এমনকি খাতা পর্যন্ত কেড়ে নিতে পারেন।
কিন্তু তিনি সেরকম কিছু না করে ছাত্রকে ভুল উত্তর বেছে নিতে দিলেন।
কেন?

কারণ, পরীক্ষার মধ্যে উত্তর বলে দিলে তো পরীক্ষা নেয়ারই মানে হয় না। পরীক্ষা শেষে ছাত্র খাতা জমা দিল। এখন যেটা হওয়ার কথা তা হলো: শিক্ষক মার্কিং স্কিম অনুসারে খাতা চেক করবেন।

সঠিক উত্তর হলে পয়েন্ট দিবেন, ভুল উত্তর হলে কোনো পয়েন্ট দিবেন না। কিন্তু, শিক্ষক যদি সিদ্ধান্ত নেন তিনি খুব উদারভাবে খাতা দেখবেন, প্রায় সঠিক উত্তরের জন্যও মার্ক দিবেন, তাহলে কারো কিন্তু কিছু বলার থাকবে না। একইভাবে, আল্লাহ্‌ মানুষকে পৃথিবীতে অন্যায়-অত্যাচার করে যেতে দেন। সব অন্যায় যদি আল্লাহই থামিয়ে দেন তাহলে মানুষের মধ্যে কে ভালো কে মন্দ – এই পরীক্ষা কিভাবে হবে?

পৃথিবী রেসাল্ট পাওয়ার জায়গা না, পৃথিবী হলো পরীক্ষার জায়গা, আর এই পরীক্ষার রেসাল্ট পাওয়া যাবে পরকালে।

তাহলে পরীক্ষার হলের উদাহরণ থেকে আমরা বুঝতে পারি – একজন ছাত্রের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সম্পূর্ণ শিক্ষকের নিয়ন্ত্রণে, সে যখন উত্তর লিখছে তখন সে তা আদৌ লিখে শেষ করতে পারবে কিনা, সেটাও শিক্ষকের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। সে পরীক্ষার খাতা জমা দেয়ার পর রেসাল্ট কী হবে তাও শিক্ষকের নিয়ন্ত্রনে।

অর্থাৎ, পরীক্ষা গ্রহণের পুরো প্রক্রিয়াটার উপর শিক্ষক পূর্ণ নিয়ন্ত্রণাধীন। ছাত্রের স্বাধীনতা শুধু এমসিকিউ এর গোল্লা পূরণে– আর সে কোন্‌ গোল্লা পূরণ করলো সেই অনুসারেই তাকে মার্ক দেয়া হবে। এখন ছাত্র যদি ফেইল করে তাহলে দায়ী কে? উত্তর হবে – ছাত্রই দায়ী। তাকে শিক্ষক ভুল উত্তর বেছে নেয়ার সুযোগ দিয়েছিল পরীক্ষা করার জন্য – কিন্তু শিক্ষক মোটেও চাননি সে ফেইল করুক।

অনুরূপভাবে, মহান আল্লাহ্ জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আমাদের কিছু চয়েস দেন, এই চয়েসগুলো কী হবে তা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ করছেন। আমরা সেই চয়েসগুলো থেকে আমাদের যেটা পছন্দ হয় সেটা বেছে নেই। সেই বেছে নেয়ার ফলাফল কী হবে সেটাও আল্লাহই নিয়ন্ত্রণ করছেন। আগুনে ঝাঁপ দিলে মানুষ পুড়ে মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহ্ চেয়েছিলেন তাই ইব্রাহিম(আ.) আগুনে পুড়েননি। গলায় ছুরি চালালে মানুষ মরে যাবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহ্ চাননি তাই ইব্রাহিম(আ.) তাঁর সন্তানের গলায় ছুরি চালানোর পরেও তিনি মরেননি।

চয়েস এবং তার ফলাফলের জন্য পরকালে আমাদের জবাব দিতে হবে না, ওগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রনে নেই। আমাদের জবাব দিতে হবে আমরা কোন‌ চয়েসটিকে বেছে নিচ্ছি তার জন্য।

আল্লাহ্‌ কি একটা জগত তৈরী করতে পারতেন না যেখানে কোনও অন্যায়-অত্যাচার থাকবে না?

৩) আচ্ছা ভাই সবই বুঝলাম, সব কিছুই আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে আছে। কিন্তু, উনি যদি সব কিছুর উপর এতই পাওয়ারফুল হয়ে থাকেন তাহলে পৃথিবীতে এত অন্যায়-অত্যাচারে হচ্ছে এগুলি তিনি থামাচ্ছেন না কেন?
উনি কি একটা জগত তৈরী করতে পারতেন না যেখানে কোনও অন্যায়-অত্যাচার থাকবে না?

আপনার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে – আপনি যে অন্যায়-অত্যাচারহীন জগতের কথা বলছেন সেরকম জগত মহান আল্লাহ্ বহু আগেই তৈরী করে রেখেছেন – সেটা হলো ফেরেশতাদের জগত। ফেরেশতারা আল্লাহর অবাধ্য হয় না, পাপও করে না, ফলে কোন অন্যায়-অত্যাচারের মধ্যেও পড়ে না। মহান আল্লাহ্‌ মানুষকে ইচ্ছে করেই এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, মানুষ পাপ করবে, অন্যায় অত্যাচারে করবে – এটাই মানুষ সৃষ্টির পার্ফেক্ট মডেল।

মানুষ যে খারাপ কাজ করে এটা হচ্ছে মানুষের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বাই-প্রোডাক্ট। সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো – “বেছে নেয়ার ক্ষমতা”।
আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোনও অস্তিত্বই যেহেতু ভুলের উর্ধ্বে নয়, কাজেই আল্লাহ্ কোনও অস্তিত্বকে বেছে নেয়ার ক্ষমতা দিলেই সে ভুল করবে। এ জন্যই মহান আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদের বলেছিলেন আমি পৃথিবীতে আমার খলিফা (মানুষ) পাঠাবো।

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلاَئِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الأَرْضِ خَلِيفَةً قَالُواْ أَتَجْعَلُ فِيهَا مَن يُفْسِدُ فِيهَا وَيَسْفِكُ الدِّمَاء وَنَحْنُ نُسَبِّحُ بِحَمْدِكَ وَنُقَدِّسُ لَكَ قَالَ إِنِّي أَعْلَمُ مَا لاَ تَعْلَمُونَ
আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদিগকে বললেনঃ আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বলল, তুমি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবে যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত তোমার গুণকীর্তন করছি এবং তোমার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না।
[সূরা আল বাক্বারাহঃ৩০]

তখন তারা বলে উঠেছিল – “আপনি কি এমন কাউকে পাঠাবেন যারা দুর্নীতি আর খুন-খারাপি করবে?” কেন এমন বলেছিল ফেরেশতারা?
কারণ, “খলিফা” শব্দের একটা অর্থ হলো যে অপরের কথায় উঠবস করে না, যে স্বাধীনচেতা, যার নিজের বেছে নেয়ার ক্ষমতা আছে। আর “বেছে নেয়ার ক্ষমতা”-ওয়ালা অস্তিত্বটি যদি ভুলের উর্ধ্বে না হয়, ভুল সে করবেই, যার পরিপ্রেক্ষিতে গন্ডগোল সে বাধাবেই।

মানুষকে পাপ করতে দেয়ার আরেকটা মহান সুফল আছে। ফেরেশতারা পাপ করতে পারে না, ফলে তারা আল্লাহর কাছে মাফও চাইতে পারে না।

কিন্তু, মানুষ পাপ করে, পাপ করে বলেই আল্লাহর কাছে মাফ চায়। আর মহান আল্লাহ্ হচ্ছেন গফুর, গাফফার – পরম ক্ষমাশীল। মানুষ যত পাপ করতে পারে তিনি তার চাইতেও বেশী ক্ষমা করতে পারেন। তিনি শুধু ক্ষমাই করেন না, তিনি ক্ষমা করতে ভালবাসেন। আর তাই মানুষের পাপ করা আর ক্ষমা চাওয়ার মধ্যেই মানব সৃষ্টির স্বার্থকতা লুকিয়ে আছে। পাপ আর ক্ষমাপ্রার্থনার মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর ভালবাসা পায়, আল্লাহর কাছে আসে।

পৃথিবীতে এত অন্যায়-অত্যাচার হচ্ছে আর আল্লাহ্‌ কিছুই করছেন না কেন?

৪) যত যাই বলেন ভাই, পৃথিবীতে এত অন্যায়-অত্যাচার হচ্ছে আর আল্লাহ্‌ কিছুই করছেন না, ব্যাপারটা মেনে নেয়া যায় না। ঠিক কিনা?


আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীতে ঘটা প্রতিটা অন্যায়, প্রতিটা অত্যাচারের শেষ পরিণতিতে ভালো কিছু আছে। সেই ভালো কিছু হয়তো আমরা এই দুনিয়ায় দেখে যেতে পারবো অথবা পারবো না।

কিন্তু, বিচার দিবসে এই পৃথিবীর প্রতিটা ঘটনার পেছনের ঘটনা, পরের ঘটনা আল্লাহ্ আমাদের কাছে পরিষ্কার করে দেবেন। আল্লাহ্ পরকালে সব কিছুর হিসাব কড়ায়-গন্ডায় মিটিয়ে দেবেন। সেদিন কারো মনে বিন্দু পরিমাণ অসন্তোষ থাকবে না – যে জান্নাতে যাবে তার মনে তো কোনো অসন্তোষ থাকবেই না, এমন কি যে জাহান্নামে যাবে সেও নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারবে যে, জাহান্নামই তার জন্য প্রাপ্য স্থান।


একটা ১০০ পৃষ্ঠার বইকে যেমন ১০ পৃষ্ঠা পড়ে বিচার করা যায় না, ঠিক তেমনি জীবনের কিছু ঘটে যাওয়া অন্যায়-অত্যাচার দেখে পুরো কালের প্রবাহকে বিচার করা যাবে না। আমরা যখন আমাদের শিশু সন্তানকে টীকা দিতে নিয়ে যাই, তখন সে হতবিহবল চোখে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে – আমার মা-বাবার চোখের সামনে এই নিষ্ঠুর ডাক্তারটা আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছে কীভাবে?

কিন্তু সেই মুহুর্তে আমরা মা-বাবারা ডাক্তারের প্রতি উল্টো কৃতজ্ঞতা অনুভব করি। কারণ, আমরা জানি এই সাময়িক বেদনাই আমাদের সন্তানকে দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতার দিকে নিয়ে যাবে। একইভাবে, একজন মুসলিম ভালো-মন্দ সকল সময়েই মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখে। সে জানে, সাময়িক এই কষ্টের মাধ্যমে হয়তো আল্লাহ আমাদের আরো বড় কোনো বিপদ হটিয়ে দিচ্ছেন, গুনাহ মাফ করছেন, ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন, ভালো কোনও পুরষ্কারের জন্য প্রস্তুত করছেন অথবা মুনাফিক থেকে মুসলিমদেরকে পৃথক করছেন।

ثُمَّ أَنزَلَ عَلَيْكُم مِّن بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُّعَاسًا يَغْشَى طَآئِفَةً مِّنكُمْ وَطَآئِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللّهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَل لَّنَا مِنَ الأَمْرِ مِن شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنفُسِهِم مَّا لاَ يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ مَّا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُل لَّوْ كُنتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللّهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحَّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ


অতঃপর তোমাদের উপর শোকের পর শান্তি অবতীর্ণ করলেন, যা ছিল তন্দ্রার মত। সে তন্দ্রায় তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঝিমোচ্ছিল আর কেউ কেউ প্রাণের ভয়ে ভাবছিল। আল্লাহ সম্পর্কে তাদের মিথ্যা ধারণা হচ্ছিল মুর্খদের মত। তারা বলছিল আমাদের হাতে কি কিছুই করার নেই? তুমি বল, সবকিছুই আল্লাহর হাতে। তারা যা কিছু মনে লুকিয়ে রাখে-তোমার নিকট প্রকাশ করে না সে সবও। তারা বলে আমাদের হাতে যদি কিছু করার থাকতো, তাহলে আমরা এখানে নিহত হতাম না। তুমি বল, তোমরা যদি নিজেদের ঘরেও থাকতে তবুও তারা অবশ্যই বেরিয়ে আসত নিজেদের অবস্থান থেকে যাদের মৃত্যু লিখে দেয়া হয়েছে। তোমাদের বুকে যা রয়েছে তার পরীক্ষা করা ছিল আল্লাহর ইচ্ছা, আর তোমাদের অন্তরে যা কিছু রয়েছে তা পরিষ্কার করা ছিল তাঁর কাম্য। আল্লাহ মনের গোপন বিষয় জানেন।
[সূরা আল ইমরানঃ১৫৪]

পৃথিবীতে হতাশা-বেদনা, অকস্মাৎ দুর্ঘটনা, প্রাণঘাতী অসুখের হঠাৎ আক্রমণ, যে কোনও মুহুর্তে মরে যাওয়ার আশংকা সত্ত্বেও মানুষ যেভাবে দুনিয়াকে পাওয়ার লোভে অন্ধ হয়ে থাকে, সেই পৃথিবীতে যদি এই সব কষ্ট-সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো না থাকত তাহলে মানুষের লোভ যে কোন্‌ পর্যায়ে যেয়ে ঠেকত তা সহজেই অনুমেয়।

সরাসরি মানুষকে জান্নাতে-জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়?

৫) শেষ প্রশ্ন, আল্লাহ্‌ যদি সবই জানেন তাহলে আর পৃথিবীতে এত পরীক্ষা নেয়ার দরকার কি?
সরাসরি মানুষকে জান্নাতে-জাহান্নামে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়?


একজন শিক্ষক যদি পরীক্ষার হলে কোনো ছাত্রকে বলে – “আমি জানি তুমি খুব খারাপ ছাত্র, তাই তোমাকে আমি পরীক্ষার প্রশ্ন দিব না, তুমি “এফ” পেয়েছ, এখন তুমি বাসায় যাও”। ছাত্রটি যদি ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রও হয় তবু কি সে এটা মেনে নিবে? না, সে পরীক্ষা দিয়ে চান্স নিতে চাইবে। আল্লাহ্‌ তো জানেনই কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে কিন্তু আমরা তো আর জানি না। তাই আল্লাহ্‌ আমাদের এই দুনিয়ায় পরীক্ষা দিতে পাঠিয়েছেন।

আমরা যা করছি তার সবকিছু দুই ফেরেশতা লিখে রাখছে। বিচার দিবসে যখন সেই পরীক্ষার খাতা আমাদের সামনে এনে লাইন ধরে ধরে মার্কিং করা হবে – তখন পাশই করি আর ফেইলই করি, কারোই কমপ্লেইন করার মতো কিছু থাকবে না।

আল্লাহর একটা নাম হলো “আল-খালিক” বা সৃষ্টিকর্তা। তাই তিনি সুন্দর-সুন্দর জিনিস তৈরী করতে ভালবাসেন। এর জন্যই তিনি মানুষ তৈরী করেছেন, মহাবিশ্ব তৈরী করেছেন, ফেরেশতা তৈরী করেছেন, জান্নাত-জাহান্নাম তৈরী করেছেন। মহান আল্লাহ্‌ তাঁর কাজগুলো স্টেপ বাই স্টেপ করেন, তিনি চিন্তাশীলতা পছন্দ করেন, তাড়াহুড়া নয়।

তাই তিনি বিশ্বজগতকে এক মুহুর্তে সৃষ্টি না করে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। একইভাবে তিনি মানুষকেও তার পাপের জন্য সাথে সাথেই পাকড়াও না করে, মৃত্যু পর্যন্ত সময় দেন যাতে সে পরকালে যেয়ে বলতে না পারে – “আল্লাহ্‌ আমাকে তো তুমি যথেষ্ট পরিমানে সুযোগ দাওনি”।

আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(সা) বলেন যে, পুনরুত্থানের দিন এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে পৃথিবীতে আরাম-আয়েশ এবং প্রাচুর্যতার মধ্যে জীবন কাটিয়েছিল কিন্তু এখন সে জাহান্নামের বাসিন্দা হবে। এই লোকটিকে একবার মাত্র জাহান্নামের আগুনে ডুবানো হবে এবং জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও শান্তি বা কোনও সম্পদ পেয়েছিলে?
সে উত্তর দিবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব!

এবং এরপর এমন একজন ব্যক্তিকে আনা হবে যে জান্নাতের বাসিন্দা কিন্তু সে পৃথিবীতে সবচেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছিলো।

এই লোকটিকে জান্নাতে একবার মাত্র ডুবানো হবে এবং তাকে জিজ্ঞেস করা হবে: হে আদমসন্তান! তুমি কি (দুনিয়াতে) কোনও কষ্টের মধ্যে ছিলে? সে বলবে: আল্লাহর কসম! না, ও আমার রব! আমি দুনিয়াতে কখনোই কোনো কষ্টের সম্মুখীন হইনি বা কোনো দুর্দশায় পড়িনি। – (সহীহ মুসলিম)

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture