Abdullahil HadiQ/A

শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি পুত্রবধূ ও জামাইদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি পুত্রবধূ ও জামাইদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং শ্বশুর-শাশুড়িকে খুশি করার ১০ উপায়:
নিম্নে শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি পুত্রবধূ এবং জামাইদের কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করা হলো:

১. শ্বশুর-শাশুড়ি অত্যন্ত সম্মান এবং শ্রদ্ধার পাত্র। সুতরাং চাই স্বামী হোক বা স্ত্রী হোক-সকলের কর্তব্য, তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে আচরণ করা। কারণ তারা বয়সে বড় বা বয়স্ক মুরুব্বি। আর হাদিসে বয়সে বড় ও মুরব্বিদেরকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করার নির্দেশ এসেছে। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,

ﻟَﻴْﺲَ ﻣِﻨَّﺎ ﻣَﻦْ ﻟَﻢْ ﻳَﺮْﺣَﻢْ ﺻَﻐِﻴﺮَﻧَﺎ ﻭَﻳُﻮَﻗِّﺮْ ﻛَﺒِﻴﺮَﻧَﺎ
“যে ছোটদেরকে দয়া এবং বড়দেরকে শ্রদ্ধা করে না সে আমাদের দলভুক্ত নয়।“
[তিরমিযী, সহিহুল জামে, হা/৫৪৪৫]।

যে পিতা-মাতার মাধ্যমে আপনি আপনার জীবন সঙ্গী অথবা সঙ্গিনীকে পেয়েছেন তাদেরকে ভালোবাসা এবং সম্মান ও শ্রদ্ধা করার মাধ্যমে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা আদায় করা হয়।

২. স্ত্রী যেভাবে স্বামীর পিতা-মাতাকে সম্মান-শ্রদ্ধা করে স্বামীরও কর্তব্য, স্ত্রীর পিতা-মাতাকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা করা। এটি স্ত্রীর প্রতিও ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার শামিল।

৩. বয়সে বড় বা বয়োবৃদ্ধ-মুরব্বিদের সাথে উত্তম আচরণ করা একজন মুসলিমের উন্নত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। এর বিপরীতটা হল, নিতান্তই অসৎ চরিত্রের প্রমাণ।

৪.প্রতিটি মানুষের উচিৎ, তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে নরম ও সম্মানজনক ভাষায় কথা বলা। তাদের সাথে কর্কশ, কষ্টদায়ক ও অশালীন বাক্য সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য।

৫. আপনার কোন কথা বা আচরণে তারা কষ্ট পেলে তাদের নিকট ক্ষমা চাওয়া জরুরি। ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করা উভয়টি মানুষের মহত্ত্বের লক্ষণ।

৬. তারা কোনোভাবে কষ্ট দিলে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়া কর্তব্য। কারণ বয়োবৃদ্ধ অবস্থায় রোগ-ব্যাধি, ঘুম সমস্যা, জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষের ধৈর্য শক্তি হ্রাস পায় এবং মন-মানসিকতা কিছুটা খিটমিটে হয়ে যায়। তাই এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিৎ।

৭. বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, হৃদ্‌রোগ, স্মৃতি ভ্রম, ক্যানসার ইত্যাদি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি পুত্রবধূ বা জামাইদের উচিত, যথাসাধ্য তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করা।

৮. বার্ধক্যে মানুষের রুচির পরিবর্তন ঘটে, দেখা দেয় হজমের সমস্যা। খাদ্য গ্রহণে অনীহা হয়। তাই তাদের রুচির প্রতি খেয়াল রেখে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার-দাবারের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখা কর্তব্য।

৯. বয়স বাড়তে থাকলে মানুষের ঘুমের অসুবিধা দেখা দেয়। ঘুম কম হয় বা রাতে ঘুম আসে না। তাই তাদের আরাম দায়ক ঘুমের দিকটি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

১০. তাদের পোশাক-আশাক, বিছানা, ঘর, ঘরের আসবাব-পত্র ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সুন্দরভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা উচিত।

১১. তাদের একাকীত্ব কাটাতে তাদের সঙ্গ দেওয়া এবং তাদের পাশে বসে কিছু সময় দ্বীন ও দুনিয়াবি বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

১২. প্রয়োজন দেখা দিলে তাদের ওজু, গোসল ও ইবাদত-বন্দেগিতে সাহায্য করা কর্তব্য।

১৩. শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে জোরপূর্বক যৌতুক বা বিভিন্ন ধরনের উপহার-উপঢৌকন দাবি করা এবং তার না পেলে তাদের প্রতি অসদাচরণ করা শুধু হীন চরিত্রের পরিচায়ক নয় বরং তা প্রচলিত আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ এবং শরিয়তে দৃষ্টিতে হারাম।

১৪. কোন জামাই কিংবা পুত্রবধূর জন্য তার শ্বশুর-শাশুড়ির উপরে অহংকার প্রকাশ করা বা তাদেরকে কোনোভাবে খাটো করা জায়েজ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-গরিমা, বংশগত আভিজাত্য ও মর্যাদা ইত্যাদি কারণে অনেক পুত্রবধূ বা জামাই তাদের শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি উপরে অহংকার ও দাম্ভিকতা সুলভ আচরণ করে এবং নানাভাবে তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে। যা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

১৫. সর্বোপরি তারা যদি আর্থিক, শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক ইত্যাদি কোন ভাবে অশান্তি বা কষ্টে থাকে তাহলে তা লাঘব করার চেষ্টা করা এবং তাদেরকে খুশি রাখার চেষ্টা করা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ কাজ।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

أَحَبُّ النَّاسِ إِلَى اللهِ تَعَالَى أَنْفَعُهُمْ لِلنَّاسِ وَأَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللهِ تَعَالَى سُرُورٌ تُدْخِلُهُ عَلَى مُسْلِمٍ أَوْ تَكَشِفُ عَنْهُ كُرْبَةً أَوْ تَقْضِي عَنْهُ دَيْنًا أَوْ تَطْرُدُ عَنْهُ جُوعًا, وَلأَنْ أَمْشِيَ مَعَ أَخِ فِي حَاجَةٍ أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَعْتَكِفَ فِي هٰذَا الْمَسْجِدِ – يَعْنِي مَسْجِدَ الْمَدِينَةِ – شَهْرًا وَمَنَ كَفَّ غَضَبَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَمَنْ كَظَمَ غَيْظَهُ وَلَوْ شَاءَ أَنْ يُمْضِيَهُ أَمْضَاهُ مَلأَ اللهُ قَلْبَهُ رَجَاءً يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَمَنْ مَشَى مَعَ أَخِيهِ فِي حَاجَةٍ حَتّٰـى يُثْبِتَهَا لَهُ أَثْبَتَ اللهُ قَدَمَهُ يَوْمَ تَزُولُ الأَقْدَامِ وَإِنَّ سُوَّء الْخُلُقِ لَيُفْسِدُ الْعَمَلَ كَمَا يُفْسِدُ الْخَلّ الْعَسَل
“আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় মানুষ হল সে ব্যক্তি যে মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করে। আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় আমল হল, একজন মুসলিমের অন্তরে আনন্দ প্রবেশ করানো অথবা তার দুখ-কষ্ট লাঘব করা, অথবা তার পক্ষ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা ও তার ক্ষুধা নিবারণ করা।

আর আমার এই মসজিদে (মদিনার মসজিদে নববীতে) একমাস ব্যাপী ইতিকাফ করার থেকে আমার একজন ভাইয়ের কোনও প্রয়োজন মেটানোর জন্য তার সাথে গমন করা আমার নিকট অধিক পছন্দনীয়। যে ব্যক্তি তার ক্রোধ সংবরণ করবে আল্লাহ তার দোষ-ত্রুটি গোপন করবেন। যে ব্যক্তি ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করবে অথচ সে ইচ্ছা করলে তা প্রয়োগ করতে পারত, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার অন্তরকে সন্তুষ্ট করবেন। যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য তার সাথে গমন করবে এবং তা পূরণ করে দেবে, আল্লাহ সেদিন তার পদযুগলকে সুদৃঢ় রাখবেন, যে দিন মানুষের পাগুলো পিছলে যাবে। আর মন্দ চরিত্র আমলকে নষ্ট করে যেমন সিরকা (ভিনেগার) মধুকে নষ্ট করে দেয়।” [সহিহ তারগিব, হা/২০৯০, সিলসিলা সহীহা, হা/৯০৬, সহীহুল জামে, হা/১৭৬]

১৬. এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজ যদি কেউ শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে খারাপ ব্যবহার করে তাহলে সম্ভাবনা আছে, এর বদলা হিসেবে সে যদি ভবিষ্যতে শ্বশুর-শাশুড়ি হয় তাহলে তার জামাই/পুত্রবধূর পক্ষ থেকে খারাপ আচরণের শিকার হবে। যেমনটি বলা হয়,

كَمَا تَدِينُ تُدَانُ ، وَكَمَا تَزرَعُ تَحصُدُ
“যেমন কর্ম করবে তেমন ফল পাবে, যেমন চাষ করবে তেমন ফসল পাবে।”
[ইকতিযাউল ইলমিল আমাল-খতিব বাগদাদি, পৃষ্ঠা নং ৯৮]

বিশেষ দ্রষ্টব্য, ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানদের জন্য পিতা-মাতার সেবা-শুশ্রূষা, অর্থ খরচ করা ও দেখভাল করা ফরজ। কিন্তু পুত্রবধূ বা জামাইয়ের জন্য তা ফরজ না হলেও অত্যন্ত নেকির কাজ। ‌তাই তাদের কর্তব্য, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা ও সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে অবারিত নেকি অর্জনের চেষ্টা করা।

আর শ্বশুর-শাশুড়ির কর্তব্য, যদি তাদের পুত্রবধূ বা জামাই তাদেরকে কোনভাবে সাহায্য-সহযোগিতা ও উপকার করে তাহলে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কারণ যে মানুষের কৃতজ্ঞতা আদায় করে না সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞতা আদায় করে না।

আল্লাহ তাআলা তওফিক দান করুন।
আমিন।

শ্বশুর-শাশুড়িকে খুশি করার ১০ উপায়:

শ্বশুর-শ্বশুর-শাশুড়ির মন খুশি রাখতে কী করণীয়?

১. মনে রাখা কর্তব্য যে, মানুষের সাথে সুন্দর আচরণ, নরম ভাষায় কথা বলা, ধৈর্যের সাথে সেবা ও সহযোগিতা করা, রাগ নিয়ন্ত্রণ করা, খারাপ আচরণের জবাব খারাপ আচরণের মাধ্যমে না দেওয়া-এগুলো হল, মানুষের মন জয় করার স্বীকৃত মূলমন্ত্র।
সুতরাং আপনি যদি আপনার শ্বশুর-শাশুড়িকে খুশি রাখতে চান তাহলে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে এ সকল গুণ ও আচরণ প্র্যাকটিস করুন। এতে আপনি তাদের প্রিয় হয়ে উঠবেন।

২. তাদের পক্ষ থেকে খারাপ আচরণের সম্মুখীন হলে প্রতিশোধ পরায়ণ না হয়ে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দিবেন এবং আল্লাহর নিকট তাদের হেদায়েতের জন্য দুআ করবেন।

৩. দূরে থাকলে তাদের সাথে নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ রাখুন এবং খোঁজ-খবর নিন।

৪. বিভিন্ন বিষয়ে তার থেকে পরামর্শ নিন এবং বিশেষ ক্ষেত্রে তাদেরকে পরামর্শ দিন।

৫. তাদের সামনে অথবা তাদের অনুপস্থিতে তাদের জন্য আল্লাহর নিকট দুআ করুন।

৬. সম্ভব হলে, তাদেরকে অর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করার পাশাপাশি কিছু উপহার দিন। উপহার মানুষের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

৭. তাদের প্রশংসনীয় দিকগুলো তুলে ধরে তাদের প্রশংসা করুন।

৮. তারা আপনার কোনও উপকার করলে কৃতজ্ঞতা আদায় করুন।

৯. তাদের সুখে সুখী হোন এবং তাদের দুঃখে দুঃখী হন।

১০. মাঝেমধ্যে কিছু সময়ের জন্যে হলেও তাদের নিকট সময় কাটানো এবং তাদের সেবা-যত্ন করুন। এতে আল্লাহ আপনার উপর সন্তুষ্ট হবেন এবং আখিরাতে এর উত্তম বিনিময় দান করবেন। আল্লাহ তাওফিক দান করুন।
আমিন।

Translator & daee at jubail Da`wah & Guidance Center Saudi Arabia
Islamic University of Madinah
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture