Q/AAbdullahil HadiScholar Bangla

সময়কে গালমন্দ করাকে ইসলাম কি বলে

সময়কে গালমন্দ করা আল্লাহকে গালমন্দ করা ও তাঁকে কষ্ট দেওয়ার নামান্তর:
আল্লাহর এক অমোঘ নিয়মে রাতের পরে দিন ও দিনের পরে রাতের আবির্ভাব ঘটে। এভাবে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর, যুগ এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী অবিরত ধারায় বয়ে চলেছে।

এ সময় আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। তার নিজস্ব কোনও ইচ্ছা ও ক্ষমতা নেই। সময় তার নিজস্ব ইচ্ছা বলে কোনও কিছু করতে সক্ষম নয়। সে মানুষের জীবনে কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনও কিছুই করতে পারে না।

সময়ের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তিত না হলেও সময়ের সাথে মানুষের প্রকৃতি, আচার-আচরণ ও রীতি-নীতি ইত্যাদি পাল্টে যায়। তাই মানুষ খারাপ হতে পারে; সময় নয়। সুতরাং সময় খারাপ, যুগ খারাপ, দিনটা খারাপ, রাতটা খারাপ ইত্যাদি বাক্য বলা কিংবা সময়কে লানত বা অভিশাপ দেওয়াও জায়েজ নয়।

আর যেহেতু সময় আল্লাহর নির্দেশক্রমে আবর্তিত হয় তাই সময়কে গালি দেওয়া আল্লাহকে গালি দেওয়ার নামান্তর। আর আল্লাহকে গালি দেওয়া মানে তাকে কষ্ট দেওয়া। সুতরাং তা হারাম

বহু হাদিসে সময়কে গালমন্দ করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন:

১. আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
لاَ تَسُبُّوا الدَّهْرَ فَإِنَّ اللهَ هُوَ الدَّهْرُ
“তোমরা সময়কে গালমন্দ করো না। কারণ আল্লাহই সময়।”
[সহিহ মুসলিম, হা/৬০০৩]

২. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেছেন,

قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يَسُبُّ ابْنُ آدَمَ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ بِيَدِيَ اللَّيْلُ وَالنَّهَارُ
“আল্লাহ তাআলা বলেন (হাদিসে কুদসি), আদম সন্তান সময়কে গালমন্দ করে। অথচ আমি তো সময়। আমার হাতেই রাত ও দিন (এর বিবর্তন সাধিত হয়)।”
[মুসলিম, হা/৬০০৩]

৩. হাদিসে কুদসিতে আরও বর্ণিত হয়েছে,

قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ يُؤْذِينِي ابْنُ آدَمَ يَسُبُّ الدَّهْرَ وَأَنَا الدَّهْرُ أُقَلِّبُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ
“আল্লাহ বলেছেন, আদম সন্তান আমাকে কষ্ট দেয়। সে সময়কে গালি দেয় অথচ আমিই তো সময়। আমি রাত-দিন আমিই আবর্তিত করে থাকি।”
[সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৪২/ শব্দচয়ন ও শব্দ প্রয়োগে শিষ্টাচার, পরিচ্ছেদ: ১. সময় ও কালকে গালমন্দ করা নিষিদ্ধ]

এর দিন-রাতের পরিবর্তন প্রসঙ্গে একমাত্র আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন বিষয়। মহাগ্রন্থ কুরআনে আল্লাহ তাআলা এ প্রসঙ্গে বলেন,

يُقَلِّبُ اللَّهُ الَّيْلَ وَالنَّهَارَ ۚ إِنَّ فِى ذٰلِكَ لَعِبْرَةً لِّأُولِى الْأَبْصٰرِ
“আল্লাহ রাত ও দিনের আবর্তন ঘটান। নিশ্চয় এতে শিক্ষা রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য।”
[সূরা নূর: ৪৪]

তাফসিরে বিন সাদিতে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “অর্থাৎ তিনি (আল্লাহ) ঠাণ্ডা থেকে গরম, আবার গরম থেকে ঠাণ্ডা, দিন থেকে রাত আবার রাত থেকে দিন তিনিই পরিবর্তন করেন। অনুরূপভাবে তিনিই বান্দাদের মধ্যে দিনগুলো ঘুরিয়ে আনেন। যারা সত্যিকার বান্দা, বুদ্ধি ও বিবেকবান, তারা এগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিয়ে এগুলো কেন সৃষ্টি করা হয়েছে সেটা সহজেই বুঝতে পারে। কিন্তু তারা ব্যতিক্রম, যারা পশুদের মত এগুলোর দিকে তাকায়।” [তাফসিরে সাদী]

আর তাফসিরে আহসানুল বয়ানে বলা হয়েছে, “আল্লাহ তাআলা কখনো দিন বড়, রাত ছোট, আবার কখনো এর বিপরীত করে থাকেন। অথবা কখনো দিনের উজ্জ্বলতাকে কালো মেঘের (ছায়ায়) অন্ধকার দিয়ে এবং রাতের অন্ধকারকে চাদের জ্যোৎস্না দিয়ে বদলে দেন।”

জাহেলি যুগের আরব মুশরিকরা সময় সম্পর্কে বিরূপ কথা বলত এবং সময়কে গালমন্দ করত। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, শুধু সময়ই তাদেরকে মৃত্যু দেয়:

মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেন,

وَقَالُوا مَا هِيَ إِلَّا حَيَاتُنَا الدُّنْيَا نَمُوتُ وَنَحْيَا وَمَا يُهْلِكُنَا إِلَّا الدَّهْرُ ۚ وَمَا لَهُم بِذَٰلِكَ مِنْ عِلْمٍ ۖ إِنْ هُمْ إِلَّا يَظُنُّونَ
“তারা (কা ফের-মুশ রিকরা) বলে, শুধু পার্থিব জীবনই আমাদের জীবন। আমরা এখানেই মরি ও বাঁচি। সময় ছাড়া অন্যকিছুই আমাদেরকে ধ্বংস করতে পারে না। তারা কেবল অনুমান করে কথা বলে।”
[সূরা জাসিয়া: ২৪]

অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস ছিল, রাত-দিনের বিবর্তনে মানুষের বয়স শেষ হয়ে গেলে মানুষ এক সময় মরে যায়। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর পেছনে একমাত্র অনুঘটক হল, সময়। আল্লাহ মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করে না, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন বা আখিরাত বলেও কিছু নেই। কিন্তু তা তাদের ভ্রান্ত ধারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। প্রকৃতপক্ষে সময়ের নিজস্ব কোনও শক্তি নেই। সে কারও উপকার করতে পারে না, কোনও ক্ষতি করতে পারে না। বরং এ বিশ্ব চরাচরের নিয়ন্ত্রণ, সময়ের এ গতিধারার নিয়ন্ত্রণ, মানুষে জীবন, মৃত্যু সব কিছু আল্লাহর হাতে ন্যস্ত। জীবনের উত্থান-পতন, ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহর আওতাধীন।

সময়ের অবস্থা বর্ণনা করা জায়েজ; গালমন্দ করা জায়েজ নয়:

আনাস ইবনে মালিক রা. এর নিকট হাজ্জাজ কর্তৃক মানুষ যে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছে সে সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করা হলে তিনি বললেন,
اصْبِرُوا؛ فإنَّه لا يَأْتي علَيْكُم زَمَانٌ إلَّا الذي بَعْدَهُ شَرٌّ منه، حتَّى تَلْقَوْا رَبَّكُمْ. سَمِعْتُهُ مِن نَبِيِّكُمْ صَلَّى اللهُ عليه وسلَّمَ
“ধৈর্য ধর। কেননা, মহান প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবার পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে) তোমাদের উপর এমন কোন যুগ অতীত হবে না, যার পরের যুগ তার চেয়েও বেশি খারাপ নয়। তিনি বলেন, এ কথাটি আমি তোমাদের নবী থেকে শুনেছি।”
[সহিহুল বুখারি]

আল্লাহ তাআলা বলেন,

هَٰذَا يَوْمٌ عَصِيبٌ ‎
“আজ অত্যন্ত কঠিন দিন।”
[সূরা হুদ: ৭৭]

তিনি আরও আরও বলেন,

إِنَّا أَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا صَرْصَرًا فِي يَوْمِ نَحْسٍ مُّسْتَمِرٍّ
“নিঃসন্দেহে আমরা তাদের উপরে এক চরম দুর্ভাগ্যের দিনে পাঠিয়েছিলাম এক প্রচণ্ড ঝড়-তুফান।”
[সূরা কামার: ১৯]

আল্লামা বিন বায রাহ. বলেন,

فلا يجوز للمسلم أن يسبَّ الدهر، ولكن يُجاهد نفسه في طاعة الله ورسوله، وترك ما نهى الله عنه ورسوله، فما أصابه من الأذى هو بأسباب أعماله السيئة، لا بأسباب الدهر، الدهر ما له تصرُّفٌ، لكن وصفه بالشدة لا يضرُّ، يقول: هذا زمان شديد، أو هذا زمان حارٌّ أو بارد، ما يضرُّ هذا.
“অত:এব কোনও মুসলিমের জন্য সময়কে গালি দেওয়া জায়েজ নাই। বরং তার কর্তব্য, আল্লাহর ও রসুলের আনুগত্যের ক্ষেত্রে প্রচুর চেষ্টা-সাধনা করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। সে যে সব কষ্ট-শ্লেষের সম্মুখীন হয় তা তার অপকর্মের কারণে; সময়ের কারণে নয়। সময়ের নিজস্ব কোনও কর্মক্ষমতা নেই। তবে সময়কে কঠিন বলায় সমস্যা নেই। যেমন: মানুষ বলে, সময়টা কঠিন বা সময়টা গরম বা ঠাণ্ডা। এতে কোনও ক্ষতি নেই।”

মোটকথা, সময় এবং কাল-মহাকাল মহান অধিপতি এক আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। তার নিজস্ব কোনও শক্তি বা ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। সময়ের প্রভাবে কারও কোনও উপকার বা ক্ষতি হয় না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। তাই সময়কে গালমন্দ করা মানে আল্লাহকে গালমন্দ করা ও তাকে কষ্ট দেওয়ার নামান্তর। তাই তাওহিদপন্থী মুসলিমের জন্য আবশ্যক হল, কথাবার্তায় আরও সতর্কতা অবলম্বন করা, জীবনে কোনও বিপদাপদ নেমে এলে সে জন্য সময়কে দোষারোপ না করা বরং এ ক্ষেত্রে বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, জীবনে ভালো-মন্দ যা কিছু ঘটুক সবই আল্লাহ নির্ধারিত তকদিরের আলোকেই ঘটে থাকে। এ বিশ্বাস ইমানের ৬টি স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম।

আল্লাহ আমাদেরকে তাওহিদ বিরোধী বিশ্বাস ও কথা ও কর্ম থেকে হেফাজত করুন।
আমিন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture