Writing

কুরবানি: বাবার স্বপ্ন, ছেলের ধৈর্য

মানুষ যে বয়সে বাবা হবার আশাই ছেড়ে দেয়, ঠিক সেই বয়সে নবী ইব্রাহীমকে (আলাইহিস সালাম) আল্লাহ একটি পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলেন। প্রায় আশি বছর বয়সে একজন ব্যক্তি যখন বাবা হবেন, তখন তিনি কতোটা আনন্দিত হবেন চিন্তা করা যায়?

ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর স্নেহের সন্তানের নাম রাখলেন ইসমাইল (আলাইহিস সালাম)। বাবা-মায়ের আদরের সন্তান ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) বড়ো হতে লাগলেন।

ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) যখন বাবার সাথে চলাফেরা করার বয়সে উপনীত হলেন, সেটা হতে পারে তাঁর কিশোরকাল; তখন তাঁর বাবা একটি স্বপ্ন দেখলেন।
ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) স্বপ্নে দেখলেন যে, তিনি তাঁর সেই আদরের ছেলেক জবাই করছেন। অদ্ভুত স্বপ্ন বটে! যিনি আল্লাহর কাছে দু’আ করেছিলেন একজন সন্তানের জন্য, তিনিই কিনা স্বপ্নে দেখলেন যে, সেই সন্তানকে জবাই করছেন।

নবীগণের স্বপ্ন হলো আল্লাহর ওহী। নবীগণ স্বপ্নে যা দেখেন, সেটা মূলত আল্লাহ ওহী প্রেরণ করেন। তিনি যেহেতু স্বপ্নে দেখছেন তাঁর ছেলেকে জবাই করছেন, সেটা নিশ্চয়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে। তাই বলে আমরা এরকম স্বপ্ন দেখলে এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। আমাদের স্বপ্নের মাধ্যমে কাউকে হত্যা করার পরিকল্পনা করতে পারি না।

স্বপ্ন দেখার পর সাথে সাথেই তিনি ছুরি নিয়ে ছেলেকে জবাই করতে চলে যাননি। স্বপ্নে যা দেখেছেন, তাঁকে সেটা পালন করতে হবে। আল্লাহর নির্দেশের ব্যাপারে ‘না’ বলার অবকাশ নেই। তবুও তিনি তাঁর ছেলেকে গিয়ে পুরো ঘটনাটি খুলে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবা, ভেবে বলো এই বিষয়ে তোমার কী মত?”

ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) আল্লাহর একজন নবী হিশেবে বিধানটি অবশ্যই পালন করতে হতো। তবুও তিনি এখানে ‘প্যারেন্টিং’ –এর একটি কৌশল সমস্ত পৃথিবীর বাবা-মাকে শিখিয়ে যাচ্ছেন।

সন্তানকে নিয়ে মা-বাবা অনেক সময় বড়ো সিদ্ধান্ত নিতে হয়। হতে পারে সন্তানকে এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে ভর্তি করানো, ভালোভাবে পড়ালেখা করার জন্য তাকে হোস্টেলে পাঠানো, সন্তানকে আলেম বানানোর জন্য তাকে মাদ্রাসায় পাঠানো ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে বাবা-মা যেনো স্বেচ্ছাচারী আচরণ না করেন সেটাই ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) এই ঘটনায় শিখিয়ে যাচ্ছেন। সন্তান ছোটো হতে পারে। কিন্তু, তাকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হলে সেক্ষেত্রে তার মতামতও যেনো জেনে নেয়া হয়। সে যদি বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে মতপোষণ করে, তাহলে যেনো তাকে বুঝানো হয় অথবা মন দিয়ে তার মতামতগুলোও যেনো শুনা হয়।

সন্তানের ভালোর জন্য মা-বাবার সিদ্ধান্ত যেনো সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়া না হয়, সেটাও আমরা এই ঘটনা থেকে শিখতে পারে। এই ধরণের প্যারেন্টিংকে বলে ‘Toxic Parenting’; যেখানে মা-বাবা সন্তানকে গুরুত্ব না দিয়ে সন্তানের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।

নবী ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) যখন ছেলের কাছে মতামত জানতে চান, তখন ছেলে ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) বললেন:
“আব্বু, আপনাকে যা বলা হয়েছে আপনি তাই করুন। নিশ্চয়ই আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।”
[সূরা আস-সাফফাত ৩৭: ১০২]

কথায় আছে- ‘বাপ কা বেটা, সিপাহী কা ঘোড়া’। অর্থাৎ, বাবা যেমন, ছেলেও তেমন। আদরের সন্তানকে জবাই করার কথা বলতে বাবার কষ্ট হলেও তাঁকে সেটা করতে হবে, ধৈর্য ধরতে হবে। ঐদিকে ছেলেও বাবাকে বলছেন, আল্লাহ আপনাকে যা বলেছেন, আপনি তাই করুন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আমাকে তো ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন।

ইসমাইল (আলাইহিস সালাম) বাবার প্রস্তাব শুনে বলেননি, ‘আপনি এসব কী বলছেন? পাগল হয়েছেন? স্বপ্নে দেখলেন আর আমাকে মেরে ফেলবেন? বললেই হলো!’
তিনি জানতেন যে, তাঁর বাবা একজন নবী। বাবা যা স্বপ্নে দেখেছেন, তাঁকে সেটাই করতে হবে। সেই হিশেবে তিনি বাবার মতের সাথে সহমত পোষণ করছেন এবং বাবাকে উল্টো মোটিভেশন দিচ্ছেন- আপনি তাই করুন।

বাবা-ছেলে দুজনই বিনা বাক্যে আল্লাহর নির্দেশ মাথা পেতে নিলেন। আল্লাহর নির্দেশের ক্ষেত্রে তারা ‘শুনলাম এবং মেনে নিলাম’ নীতি অবলম্বন করলেন। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, যখনই আমরা কোনো কিছু শুনবো যে, সেটা আল্লাহর নির্দেশ বা নিষেধ, আমরা বিনা বাক্যে সেটা পালন করার চেষ্টা করবো। আল্লাহর কোনো নির্দেশ বা নিষেধ আমাদের যুক্তিতে ধরা পড়ুক বা না পড়ুক, আল্লাহর কোনো নির্দেশে চ্যালেঞ্জ করার কোনো সুযোগ নেই। আল্লাহ করতে বলেছেন, এতোটুকুই যথেষ্ট।

আল্লাহর নির্দেশের ক্ষেত্রে শুনামাত্রই মেনে চলা হলো মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে বলেছেন। আমরা যদি এখন ‘বুঝা’ শুরু করে দিই যে, আল্লাহ কেনো ৫ ওয়াক্ত বলেছেন, কেনো ৬ ওয়াক্ত বলেননি, কেনো ৪ ওয়াক্ত বলেননি, এগুলো বুঝা শেষে নামাজ পড়া শুরু করবো; তাহলে হবে না।

ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) যদি যুক্তি দিয়ে আল্লাহর নির্দেশ পর্যালোচনা করতেন, তাহলে সেটা মানা তাঁর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াতো। যেই আল্লাহ তাঁকে এতো বছর পর সন্তান দিলেন, সেই সন্তানকে তিনি কিভাবে নিজের হাতে জবাই করবেন? এটা যুক্তি দিয়ে মানা সম্ভব? একজন মুসলিমের দায়িত্ব হলো আল্লাহর বিধানের কাছে নিজের ইচ্ছাকে সমর্পণ করা।

একদিন ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) ছেলেকে কুরবানি করার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। পথিমধ্যে শয়তান তাঁকে বাধা দিতে লাগলো। ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) শয়তানকে তাড়ানোর জন্য ৭ বার পাথর নিক্ষেপ করলেন। নবী ইব্রাহীমের (আলাইহিস সালাম) সেই সুন্নাত আজও মুসলিমরা হজ্জের সময় পালন করে।

ছেলেকে মাটিতে শুইয়ে যখন জবাই করতে যাবেন, তখন আল্লাহ তাঁর উপর ওহী নাযিল করলেন। আল্লাহ বলেন:

“হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছো। নিশ্চয়ই আমি এভাবে সৎকর্মশীলদের পুরষ্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা।”
[সূরা আস-সাফফাত ৩৭: ১০৪-১০৬]

আল্লাহ চাননি যে, নবী ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) তাঁর আদরের সন্তানকে জবাই করুন। আল্লাহ চেয়েছিলেন, আল্লাহ তাঁর নবীকে যে প্রিয় সন্তান দান করেছেন, সেটাকে তাঁর রাস্তায় উৎসর্গ করতে তিনি প্রস্তুত কিনা।

কুরবানিতে আমরা উট, গরু, ছাগল কুরবানি করি। আমরা যে পশুগুলো কুরবানি করি, আল্লাহর কাছে তো সেই পশুগুলোর মাংস, রক্ত পৌঁছে না। তবুও আমরা কেনো বলি যে, আমরা আল্লাহর জন্য কুরবানি করি?

কারণ, আমাদের কুরবানির মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বিধান পালন করা। আমরা কতোটা আল্লাহর জন্য, আল্লাহর ভয়কে সামনে রেখে কুরবানি করছি সেটাই আল্লাহ দেখতে চান। এজন্য আল্লাহ বলেন:

“আল্লাহর কাছে পৌঁছে না এগুলোর মাংস, রক্ত; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া।”
[সূরা আল-হাজ্জ ২২: ৩৭]

নবী ইব্রাহীমকে (আলাইহিস সালাম) তাঁর ছেলেকে কুরবানির নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ মূলত তাঁকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সেই পরীক্ষায় পিতা-পুত্র দুজনই উত্তীর্ণ হোন। পরবর্তীতে আল্লাহ একটু দুম্বা প্রেরণ করেন কুরবানির জন্য। ইব্রাহীম (আলাইহিস সালাম) সেটা কুরবানি করেন। সেই থেকে মুসলিমরা নবী ইব্রাহীমের (আলাইহিস সালাম) সুন্নাতানুসারে পশু কুরবানি করে যাচ্ছে।

পিতা এসেছিলেন ছেলেকে কুরবানি করে বাড়িতে নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে যাবার জন্য। যাবার সময় আল্লাহ তাঁর ছেলেকেও ফিরিয়ে দেন, সাথে একটি দুম্বাও দেন; যা জবাই করে তারা বাড়ি ফিরেন।

যেকোনো পরীক্ষায় আমরা যদি নবী ইব্রাহীম-ইসমাইলের (আলাইহিমাস সালাম) মতো ধৈর্যধারণ করতে পারি, তাহলে দেখা যাবে পরীক্ষায় পড়ে আমরা যা হারিয়েছি, ধৈর্যধারণের ফলে আল্লাহ আমাদেরকে তারচেয়েও উত্তম কিছু দান করবেন।

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture