মুখ ও মুখোশ
নিজের কাছে সৎ থাকা অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। আমাকে আমার চেয়ে ভালো আর কোনো মানুষ চিনে না। এটা সবার জন্য প্রযোজ্য। আমরা নিজেরা জানি আমরা কতোটা ভালো, কতোটা খারাপ। ফেসবুকে মুখোশ পরে থাকা যায়। আমি নিজে যেমন না, তেমনভাবে উপস্থাপন করা যায়। এমনও হতে পারে একজন ব্যক্তির অনলাইন বিহেভিয়ার এবং অফলাইন বিহেভিয়ার একেবারেই ভিন্ন।
খুব একসট্রিম উদাহরণ না দিয়ে স্বাভাবিক দুটো উদাহরণ দিই।
এখন আইপিএলের সিজন, শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট টিম বাংলাদেশ সফরে এসেছে, ঐদিকে চ্যাম্পিয়ান্সলীগের ফাইনাল।
আবার দেখুন, গান, মুভি, ড্রামা সিরিজ, নায়ক-নায়িকাদের সাক্ষাৎকার তো আছেই।
এই পোস্টটি যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেই উপরের দুই ধরনের প্রোগ্রাম টিভি বা মোবাইলে দেখেন। স্বাভাবিক-অস্বাভাবিকতার কথা বললে এই জেনারেশনের কিশোর-যুবক, সে দ্বীন মানুক বা না মানুক, উপরের দুই ধরনের প্রোগ্রামকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে পারছে না এবং এটাই বাস্তবতা।
যারা একসময় খুব আসক্ত ছিলেন, দ্বীনের বুঝ আসার পর তারা হয়তো আসক্তি কমাচ্ছেন, আগের মতো প্রোগ্রামগুলো দেখছেন না। তাদের এই একটু একটু করে সরে আসাটা প্রশংসনীয়।
আর যারা একেবারেই সরে আসছেন, নিজেদের অভ্যাসগত পছন্দকে র্যাডিকাল শিফট করে কল্যাণকর কিছুতে নিয়ে গেছেন, তাদেরকে বলা যায় সম্পূর্ণরূপে দ্বীনে ফিরেছেন। তারা আরো বেশি প্রশংসার দাবিদার।
আমার আজকের আলোচনার অডিয়েন্স হলো তারা, যারা পূর্বের অভ্যাস পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি, নিয়মিত বা মাঝেমাঝে খেলা/মুভি দেখেন।
তারা মুভি দেখছেন, গান শুনছেম, কিন্তু ফেসবুকে এসে পাপের কথা প্রচার করছেন না, নিজের গোপন পাপ লুকিয়ে রাখছেন; এটাকে প্রশংসনীয় না বলে বলা যায়- ‘আচ্ছা, মেনে নেয়া যায়’।
আরেক দল আছেন, যারা নিজেরা ঠিকই খেলা দেখছেন, গান শুনছেন, মুভি দেখছেন, কিন্তু ফেসবুকে এসে এসবের ব্যাপারে অন্যকে উপদেশ দেন, ভুল ধরেন।
বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা দেখে আসলেন। বাংলাদেশ জিতছে বা হারছে। ফেসবুকে এসে তারা যখন দেখেন আরেকজন ক্রিকেট খেলা নিয়ে পোস্ট দিয়েছে, তখন তারা ‘অসৎ কাজের নিষেধ’ দেবার আমল করেন। ঐ পোস্টকারী কেনো খেলা নিয়ে পোস্ট দিচ্ছে এজন্য তাকে ব্যাঙ্গ করেন, পোস্টকারীর দ্বীনদারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
কিংবা মুভি দেখা নিয়েই বলি। যে ট্রেন্ডিং একটা মুভি দেখে আসলো, ট্রেন্ডিং একটা গান শুনে আসলো, ফেসবুকে আরেকজন সেই গান-মুভি নিয়ে কথা বললে তাকে নিষেধ দেবার নৈতিক অধিকার তার নেই; সে সচেতনভাবে একটু আগে সেই গান-মুভি দেখে আসছে।
এই ধরনের ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহয় কড়া সতর্কবাণী শুনানো হয়েছে। তারা মনে করে, ‘আমি পাপ করছি, গোনাহ হচ্ছে বুঝলাম, আরেকজনকে সেই পাপ থেকে নিষেধ করলে তো সওয়াব হবে। গুনাহয় সওয়াবে কাটাকাটি’।
এই ধরনের মনোভাব অনেকটা চুরির গরু দিয়ে কুরবানির মতো। চুরি করায় গুনাহ হবে, কুরবানি দিলে সওয়াব; গুনাহয় সওয়াবে কাটাকাটি, মাঝখানে গরুর মাংস পেলাম!
আল্লাহ পবিত্র কুরআনে বলেন, “হে ইমানদারগণ! তোমরা তা কেনো বলো, যা তোমরা করো না? তোমরা যা করো না, তা বলা আল্লাহর নিকট বড়ই ক্রোধের।”
মানুষকে তাহাজ্জুদের নামাজ, শাওয়াল মাসের রোজা, শুক্রবারে সূরা কাহাফের জন্য উৎসাহিত করা ভালো কাজ। কিন্তু, স্বেচ্ছায়, সচেতনভাবে নিজেরা আমল না করে শুধুমাত্র অন্যকে উৎসাহিত করলে আল্লাহর কাছে সেটা অপছন্দনীয়। আপনি মানুষকে উৎসাহিত করছেন কিন্তু যৌক্তিক কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এক-দুইদিন আমল করতে পারেননি, সেটা মেনে নেয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানান, এক ব্যক্তিকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, আগুনে পুড়ে তার নাড়িভুঁড়ি হয়ে যাবে, গাধার চাকা ঘোরার মতো সে ঘুরতে থাকবে।
জাহান্নামবাসীরা তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করবে, “হে অমুক! তোমার আজ এমন অবস্থা কেনো? তুমি না আমাদেরকে ভালো কাজে আদেশ করতে আর মন্দ কাজে নিষেধ করতে?”
অর্থাৎ, তুমি জাহান্নামে কেনো? তোমার তো জান্নাতে থাকার কথা?
লোকটি বলবে, “আমি তোমাদেরকে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে বলতাম, কিন্তু আমি নিজে বিরত থাকতাম না। আমি তোমাদেরকে ভালো কাজের নির্দেশ দিতাম ঠিকই, কিন্তু আমি ভালো কাজ করতাম না (এজন্য আজ আমার এমন দশা)।”
ফেসবুক ও বাস্তব জীবনের আমাদের মুখ ও মুখোশের জন্য এই হাদীসটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা মাথায় সেট করে নিন- আপনি ফেসবুকে যা বলছেন, আপনি কি তেমন?
আপনি নিজের কাছে কতোটা সৎ এর উত্তর আপনাকেই খুঁজতে হবে।
ইসলামের জ্ঞানার্জনের অন্যতম কারণ হলো তাকওয়া অর্জন। আর তাকওয়া অর্জনের মানে হলো- অর্জিত জ্ঞানানুযায়ী আমল করা। সেই হিশেবে অন্যের সংশোধনের চেয়ে প্রাধান্য দেয়া উচিত নিজের সংশোধনে।
আল্লাহ আপনার ফেসবুক পোস্ট আর কমেন্ট দেখে আপনার আল্টিমেট বিচার করবেন না। আল্লাহ বিচার করবেন আপনার ওভারল অবস্থা দেখে। ব্যক্তিগত জীবনে যদি আপনি অসৎ হন, ফেসবুক লাইফে সৎ হবার মুখোশ পরে পার পেতে পারবেন না।