Writing

মহিলাদের মুখমণ্ডল কি পর্দার অন্তর্ভুক্ত?

এ বিষয় সঠিক কথা হল, মহিলাদের মুখমণ্ডল পর্দার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং তা পরপুরুষদের সামনে ঢাকা ফরজ। এ মর্মে কয়েকটি দলীল নিন্মরূপ:
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,

يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّبِيُّ قُل لِّأَزۡوَٰجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡهِنَّ مِن جَلَٰبِيبِهِنَّۚ ذَٰلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورٗا رَّحِيمٗا
‘হে নবী, তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মু’মিনদের নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’
[সূরা আল-আহযাব: ৫৯]

পর্দা বিষয়ে এ আয়াত অত্যন্ত পরিষ্কার ও স্পষ্ট। কারণ, এ আয়াত থেকে জানা যায়, পর্দার নির্দেশের মধ্যে মুখমণ্ডলও অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া এ আয়াতে আযওয়াজে মুতাহহারাত (রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পুতঃপবিত্র সহধর্মীনীগণ) ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যাগণের সঙ্গে মুসলিম মহিলাদেরও সম্বোধন করা হয়েছে।
এ আয়াতে ‘জালাবীব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। আরবি অভিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘লিসানুল ‘আরাব’ –এ লেখা হয়েছে, ‘জিলবাব’ ওই চাদরকে বলা হয় যা মহিলারা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার জন্য ব্যবহার করে।
[১/২৭৩]

অভিধান থেকে সরে গিয়ে মুফাসসিরগণের বক্তব্য দেখলেও জানা যায়, ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলে যদ্বারা মহিলারা নিজেদের শরীর ঢাকেন। ‘জিলবাব’ অর্থ বড় চাদর, যা দ্বারা মুখমণ্ডল ও পূর্ণ দেহ আবৃত করা যায়।
[কুরতুবী, আল-জামে‘ লিআহকামিল কুরআন : ১৪/২৪৩]

২. আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. মুখমণ্ডলের ওপর ‘জিলবাব’ ফেলার যে পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তা হল, ‘মুসলিম মহিলারা নিজেদের চাদর দ্বারা নিজ নিজ মাথা ও মুখমণ্ডল ঢেকে বের হবে। তারা কেবল একটি চোখ খোলা রাখতে পারে’।
[শাওকানী, ফাতহুল কাদীর : ৭/৩০৭]

৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তমা পত্নী আয়েশা রা. বর্ণনা থেকে। তিনি বলেন,
يَرْحَمُ اللَّهُ نِسَاءَ الْمُهَاجِرَاتِ الأُوَلَ لَمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ : {وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ} شَقَّقْنَ مُرُوطَهُنَّ فَاخْتَمَرْنَ بِهِ.
“আল্লাহ হিজরতকারী অগ্রবর্তী নারীদের ওপর রহমত করুন। যখন তিনি নাজিল করলেন, ‘আর তারা যেন তাদের বক্ষের ওপর ওড়না টেনে দেয়’ তখন তারা তাদের নিম্নাংশের কাপড়ের প্রান্ত ছিঁড়ে ফেলেন এবং তা দিয়ে ওড়না বানিয়ে নেন।”
[বুখারী : ৮৫৭৪]

আলোচ্য বর্ণনায় ‘ইখতামারনা’ (اخْتَمَرْنَ) শব্দটি এসেছে। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকার হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি এ শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘গাত্তাইনা উজুহাহুন্না (غطين وجوههن)। অর্থাৎ তারা নিজেদের মুখমণ্ডল ঢেকে রাখতেন।
[ফাতহুল বারী: ৮/৩৪৭]

৪. আয়েশা রা. বলেন,
كَانَ الرُّكْبَانُ يَمُرُّونَ بِنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- مُحْرِمَاتٌ فَإِذَا حَاذَوْا بِنَا سَدَلَتْ إِحْدَانَا جِلْبَابَهَا مِنْ رَأْسِهَا إِلَى وَجْهِهَا فَإِذَا جَاوَزُونَا كَشَفْنَاهُ.
“আমরা ইহরাম অবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আরোহীরা আমাদের সঙ্গে পথ চলছিলেন। যখন তারা আমাদের আড়াআড়ি হন, আমাদের সঙ্গিনীরা তাদের বড় চাদর মাথা থেকে চেহারায় ঝুলিয়ে দেন। তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যাবার পরই আমরা তা উন্মুক্ত করি।” [আবু দাউদ: ১৮৩৩; বাইহাকী : ৩৩৮৮]
উক্ত হাদিসটিকে শাইখ আলবানি অন্যান্য সাক্ষ্য হাদিস (الشواهد)-এর আলোকে ‘হাসান’ বলেছেন।
[দেখুন: জিলবাবুল মারআতিল মুসলিমাহ, পৃষ্ঠা নম্বর: ১০৭]

তবে এটিকে অনেক মুহাদ্দিস জইফ বললেও অন্যান্য বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত যে, মা আয়েশা রা. পরপুরুষের নিকট মুখমণ্ডল ঢাকতেন। যেমন: ইফক (অপবাদ) সংক্রান্ত হাদিসে এসেছে,
فَرَأَى سَوَادَ إِنْسَانٍ نَائِمٍ فَأَتَانِي فَعَرَفَنِي حِينَ رَآنِي وَقَدْ كَانَ يَرَانِي قَبْلَ أَنْ يُضْرَبَ الْحِجَابُ عَلَىَّ فَاسْتَيْقَظْتُ بِاسْتِرْجَاعِهِ حِينَ عَرَفَنِي فَخَمَّرْتُ وَجْهِي بِجِلْبَابِي

“দূর থেকে তিনি (সাফওয়ান ইবনু মুয়াত্তাল আস-সুলামী আয যাকওয়ানী রা.) একটি মানব দেহ দেখতে পেয়ে আমার নিকট এলেন এবং আমাকে দেখে সে চিনে ফেলল। কেননা পর্দার হুকুম নাজিল হওযার পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে চিনে তিনি “ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিঊন” পড়লে তাঁর ইন্না লিল্লাহ-এর আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তৎক্ষণাৎ আমি আমার চাদর দিয়ে মুখমণ্ডল আবৃত করে নিলাম।”
[সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৫১/ তাওবা, পরিচ্ছেদ: ১০. অপবাদ রটনার ঘটনা এবং অপবাদ রটনাকারীর তাওবা কবুল হওয়া]

মুখমণ্ডল খোলা রাখার পক্ষে নিম্নোক্ত হাদিসটি সহিহ নয়:

আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার আসমা বিনত আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট পাতলা কাপড় পরে হাজির হলে, তিনি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং বলেন,
‏ يَا أَسْمَاءُ إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَمْ تَصْلُحْ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلاَّ هَذَا وَهَذَا ‏”‏ ‏.‏ وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ ‏
“হে আসমা, যখন মেয়েরা সাবালিকা হয়, তখন তাদের এমন পাতলা কাপড় পরা উচিত নয়, যাতে তাদের শরীর দেখা যায়। তবে তিনি ইশারা করে মুখমণ্ডল ও দু’হাতের কব্জা পর্যন্ত খোলা রাখার নির্দেশ দেন।
ইমাম আবু দাউদ রাহ. বলেন, এ হাদিছ মুরসাল। কেননা, রাবী (বর্ণনাকারী) খালিদ ইবন দুরায়ক রাহ. আয়িশা রা.-এর সাক্ষাৎ পাননি।

আল্লামা মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. উক্ত হাদিস সম্পর্কে বলেন,
هذا الحديث ضعيف سنداً ومنكرٌ متنا
“এ হাদিসটি সনদ ও মতন উভয় দিক থেকে মুনকার (চরম আপত্তি জনক)।”
[ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব: ১২/৮৪]
এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস রা. এর ব্যাখ্যায় মুখমণ্ডল এবং হাতের কব্জিদ্বয় খুলে রাখার ব্যাপারে একটি বর্ণনা পাওয়া যায় কিন্তু সেটিও সনদগতভাবে দুর্বল।

হাতে গোনা কিছু আলেম ছাড়া পূর্ববর্তী এবং আধুনিক যুগের অধিকাংশ আলেম মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা ফরজ হওয়ার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন। তবে যারা তারা মুস্তাহাব বলেছেন, তারাও এ ব্যাপারে একমত যে, যদি চেহারা খুলে রাখার কারণে ফিতনার আশঙ্কা থাকে তাহলে তা ঢেকে রাখা ফরজ। আর এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে যে, চতুর্দিকে ভয়াবহ ফিতনার সয়লাবের মধ্যে নারীরা ঘরে-বাইরে কতটা ফেতনার সম্মুখীন হয়। এমন পরিস্থিতিতে তাদের কথা অনুযায়ীও মুখমণ্ডল ঢেকে রাখা ফরজ।

একান্ত জরুরি পরিস্থিতে পরপুরুষের সামনে মহিলাদের মুখমণ্ডল খোলা জায়েজ:

মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডল ঢাকা ফরজ হলেও একান্ত জরুরি অবস্থায় পর পুরুষের সামনে সাময়িকভাবে মুখমণ্ডল খোলা জায়েজ রয়েছে। যেমন: চিকিৎসার প্রয়োজনে বা নিরাপত্তা তল্লাশী করার সময় বা এ জাতীয় বিশেষ দরকারে। কারণ ইসলামের প্রসিদ্ধ মূলনীতি হল, الضرورات تبيح المحظورات
“প্রয়োজন নিষিদ্ধ বিষয়কে বৈধ করে দেয়।”
এ মূলনীতিটির সমর্থনে সূরা আনআমের ১১৯ নাম্বার আয়াতটি প্রযোজ্য। মহান আল্লাহ বলেন,

وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلَّا مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ
“অথচ আল্লাহ ঐ সব জন্তুর বিশদ বিবরণ দিয়েছেন, যেগুলোকে তোমাদের জন্যে হারাম করেছেন; কিন্তু সেগুলোও তোমাদের জন্যে হালাল, যখন তোমরা নিরুপায় হয়ে যাও।”

আল্লাহু আলাম।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture