Writing

মায়ের ঈদ উপহার

বাবা! তোকে না আজ খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। সময় করে একটু বাড়িতে আসিস আচ্ছা। কতদিন হলো তোকে দেখিনা। শহরে গেছিস আজ এক মাস হলো। এর মধ্যে একবারও বাড়ি আসলি না। মাকে মনে পড়ে না বুঝি তোর? আজ কেন যেন তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। সময় করে চলে আসিস বাবা! ঠিক আছে?

ঠিক আছে মা। তুমি চিন্তা করো না। আমি বিকেলে ছুটি পেলেই চলে আসবো বাড়িতে। আমায় নিয়ে একদম ভাববে না। আচ্ছা।

শহরের যান্ত্রিকতায় থাকতে থাকতে কেমন যেন ভুলেই গেছি গ্রামের নির্মল প্রকৃতির কথা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটুনি করে শরীর একদম অবশ হয়ে যায়। ক্লান্তিতে ছেঁয়ে যায় পুরো শরীর। অবসাদ দখল করে নেয় মস্তিষ্ক। বিকেলে বাইরে হাঁটাহাঁটির কথা কেমন যেন ভুলেই গেছি কাজের ব্যস্ততায়। মন বারবার ছুটে যেতে চায় চিরচেনা সবুজ সেই গ্রামে। বাঁশঝাড়, কাশবন আর পাখিদের কলকাকলি আমায় এখনো খুব আপন করে কাছে টানে। কিন্তু ঐ যে চাকরী আর দায়বদ্ধতা!

আজ অনেকদিন পর গ্রামে যাচ্ছি। শহরে কাজের মধ্যে ডুবে থাকলেও মাকে মিস করি অনেক বেশি। মায়ের প্রতিটা স্মৃতি অন্তরকে নাড়া দেয়। এখনো হৃদয় জুড়ে শুধু মায়েরই জল্পনা কল্পনা । ইশ! কতদিন হলো মায়ের হাতের রান্না খাইনা। মায়ের পাশে বসে গল্প করি না। কতদিন হলো দেখা হয়না মায়ের মিষ্টি চেহারাটা। এগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ির সামনে এসে পড়েছি খেয়ালই করিনি। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দেখলাম আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত মায়াভরা এক আঙিনা। জানান দিচ্ছে নিজের অস্তিত্বের।

(২)

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। রাতের আকাশটা আমার খুব পছন্দের। বাড়িতে আসলে চাঁদের আলোয় একাকী বসে থাকি উঠোনে। তারাদের ঝিলমিল দেখি। বাতাসের সুরে হারিয়ে যাই অজানা দেশে। ছোট বেলায় দাদির গল্পের আসরগুলো এখন খুব মনে পড়ে। উঠোনের ঠিক মাঝখানে পাটি বিছিয়ে আমরা চাচাতো ভাইবোনরা ঘিরে ধরতাম দাদিকে গল্প শোনানোর বাহানায়। দাদি আমাদের শোনাতেন রূপকথার গল্প, ভূতের আড্ডা আরো কত কিছু। এখন সেগুলো শুধুই স্মৃতি আর কল্পনা।

ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মা কখনোই আমাকে বুঝতে দেননি বাবার শূণ্যতা আর আদরের অভাব। আদর-যত্ন, স্নেহ-ভালোবাসা আর মায়া-মমতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন আমাকে। প্রতিটা মুহূর্তে আগলে রেখেছেন নিজের বুকে। নিজে না খেয়ে খাবার তুলে দিয়েছেন আমার মুখে। আমি বিশ্বাস করি, আমার অস্তিত্বের প্রতিটি কণা এখনো ঋণী আমার মমতাময়ী মায়ের কাছে।

আমার হাতে সবুজ রঙের একটি প্যাকেট। উপরে সুন্দর করে লেখা ” মায়ের পক্ষ থেকে প্রিয় ছেলের জন্য ঈদের সামান্য উপহার “। আমি মূর্তির মত প্যাকেটটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুখে কোনো কথা নেই। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি ঘটনার আকস্মিকতায়। বুঝে উঠতে পারছিনা কি করবো? পা দুটো পাথরের মত নিশ্চল হয়ে আছে। আমার কষ্টের সাথে মিলিত হয়েছে প্রকৃতির নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছে শূন্যতা বিরাজ করছে সবখানে।

(৩)

ডাক্তারবাবু এসেছিলেন সন্ধ্যার একটু আগে। মাকে দেখে ঔষধ লিখে দিয়ে গেছেন। মায়ের রক্তশূন্য চেহারাটা দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। মা জ্ঞান হারিয়েছিলেন সেই দুপুরে। বিকেলে বাড়িতে ঢুকে দেখি মায়ের নিথর দেহটা পড়ে আছে বিছানায়। নিজের অজান্তেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছি মাকে দেখে। বুকে জড়িয়ে ধরেছি শক্তভাবে। কেন যেন মনে হচ্ছিল আমার পুরো পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আমি হারিয়ে যাচ্ছি কষ্টের মহাসাগরে।

~ ভাইয়া ! তুমি কখন এসেছো ?

~ এইতো একটু আগেই আসলাম। এসে দেখি মা বিছানায় পড়ে আছে। তোরা একটু খোঁজখবরও রাখতে পারিস না আম্মার। দেখিস না আমি কত দূরে থাকি ! সবসময় কি আমার বাড়িতে আসা সম্ভব বল ? মাকে যে আমার কাছে নিয়ে যাবো সেটাও তো পারি না। দেখিস না মা এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। আমি শহরে নিয়ে যেতে চাইলে আমাকে বলে, এখানে নাকি লেগে আছে বাবার স্মৃতি। মামারা কতবার আসে মাকে নানা বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য কিন্তু কখনই দেখিনি মা যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটু দম নিলাম।

~ আচ্ছা ভাইয়া ! তুমি কোন চিন্তা করো না। আমরা সব সময় আন্টিকে দেখে রাখবো ।

নাজীবের এমন সান্তনা আমার একটুও ভালো লাগছেনা। মনটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। হৃদয়টা আটকে আছে মায়ের কাছে। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা? ইচ্ছে করছে চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে এখনই মায়ের কাছে চলে আসি। মায়ের সেবা করি। কিন্তু কেন এমন হলো ? সকালেও তো মা কত সুন্দর করে আমার সাথে কথাবার্তা বললেন। আমি বাড়ি আসলে কত কিছু রান্না করে আমাকে খাওয়াবেন সেটা বললেন। তাহলে হঠাৎ করে কেন এমন হবে বুঝে উঠতে পারছিনা।

(৪)

মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে পাশের বাড়ির ভাবীরা দেখতে এসেছেন। মরিয়ম চাচী মায়ের খুব যত্ন নিচ্ছেন। মাথায় পানি ঢেলে দিচ্ছেন। এখনও মায়ের জ্ঞান ফিরেনি। চোখ মুখ এখনও রক্তশূন্য হয়ে আছে। এখনো কিছু খেতে পারছেন না। আমার উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা কাটছে না একটুও। চিন্তাক্লিষ্ট মুখে উঠোনের কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। ছোটবেলায় বাবা সহ লাগিয়েছিলাম এই কাঁঠাল গাছটা। কাঁঠালগুলো খুব মিষ্টি। জ্যৈষ্ঠ মাসে কাঁঠাল পাকলে বাড়িটা সুগন্ধে মৌ মৌ করে। আজ বাবা নেই কিন্তু বাবার স্মৃতিবিজড়িত সেই গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে।

সবুজ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। কি জানি মা আমার জন্য কি কিনেছেন ? হঠাৎ পিঠে কার যেন হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম। তাকিয়ে দেখি জামিল চাচা দাঁড়িয়ে আছেন রক্তশূন্য মুখে। আমি ওনাকে দেখে ভড়কে গেলাম। মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হয়েছে। কি বলব কিছু বুঝতে পারছিনা।

~ বাবা কখন এসেছো ?

~ এইতো চাচা ! বিকালে এসেছি। ঘরে ঢুকেই দেখলাম মা বিছানায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। ডাক্তার ডেকে আনলাম দ্রুত। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে চলে গেলেন কিন্তু এখনো মায়ের জ্ঞান ফেরেনি। খুব চিন্তা হচ্ছে মায়ের জন্য।

~ বাবা কিছু মনে করো না। তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো ।

~ জ্বী চাচা ! আমাকে খুলে বলুন সব। কি হয়েছে ?

~ তোমার মা কদিন থেকে বলছিলো , জামিল ! শোন, ছেলেটা আমার অনেকদিন হলো বাড়ি আসে না। ও এখন অনেক বড় হয়েছে কিন্তু জানিস আমার অনেক ইচ্ছে, ওকে ঈদের সময় খুব সুন্দর একটা পাঞ্জাবি কিনে দিবো কিন্তু আমার কাছে একটা টাকাও নেই রে। আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি ? আমি পরে তোকে দিয়ে দেব।

আমি বলেছিলাম, বুবু আমার কাছে এখন টাকা নেই। হাটের ধানগুলো এখনো বিক্রি করতে পারিনি। কিভাবে টাকার ব্যবস্থা করবো বল ? তাছাড়া বাড়িতে সুজনও বায়না ধরেছে নতুন পাঞ্জাবী আর জুতা কেনার জন্য। ঈদের জন্য গোস্ত, পোলাও, সেমাই আরো অনেক কিছু কিনতে হবে যে । আমার নিজেরই এখন চলছে না বুবু !

এরপর দু’দিন ধরে বুবুর সাথে আর কোন দেখা নেই আমার। সকালে শুনলাম বুবু কার সাথে যেন সদর হাসপাতালে গিয়েছে। আমি মনে করেছিলাম হয়তো শরীর খারাপ। ডাক্তার দেখানোর জন্য গিয়েছে। পরে শুনলাম কাকে যেন রক্ত দিয়েছে দুই ব্যাগ। উনি খুশি হয়ে কিছু টাকা দিয়েছেন। সেটা দিয়েই তোর জন্য ঈদ উপলক্ষ্যে খুব সুন্দর দেখে একটা পাঞ্জাবি কিনে এনেছে।

আমার মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। দুচোখে যেন অন্ধকার দেখছি। পা দুটো অচল হয়ে যাচ্ছে। আমার উপর যেন ভেঙ্গে পড়ছে পুরো পৃথিবী। মায়ের রক্তশূন্য চেহারাটা ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে। সবুজ রংয়ের প্যাকেটটা এখনো আমার হাতে। উপরে লেখা ” মায়ের পক্ষ থেকে প্রিয় ছেলের জন্য ঈদের সামান্য উপহার ” !!

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture