Writing

ইসলামি শরীয়াহ না ডেমোক্রেসিঃ মুসলিম হিসেবে আইডিওলোজি

একজন লোক গভীর অরণ্যে ঘুরতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে আটকা পড়ে। সেখানে সে কোনো হালাল খাবার না পেয়ে বাধ্য হয়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য শূকর খেলো। শূকর খাওয়া তার জন্য ঠিক ততোটুকুই হালাল ছিল, যতোটুকু খেলে সে প্রাণে বাঁচবে। কিন্তু শূকরের মাংস খেতে লোকটির খুব সুস্বাদু লাগলো। তাই সে “বিসমিল্লাহ” পড়ে ‘আল্লাহ-আল্লাহ’, ‘ইয়া সালাম’, ‘লাযিয জিদ্দান’, ‘আজীব ওয়াল্লাহ’ ইত্যাদি বলে উদরপূর্তি করে ঢেকুর তুলতে তুলতে খেতে লাগলো।

আমাদের বর্তমান অবস্থাও ঠিক এরকমই। আমরা গণতন্ত্র ব্যবহার করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেরাই মানবসৃষ্ট এই গণতন্ত্রের বেড়াজালে আটকে গেছি, আর লক্ষ্যচ্যুত হয়ে প্রতিনিয়ত প্রলুব্ধ হচ্ছি। যা কখনোই হওয়ার ছিল না।

মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। এই পৃথিবীতে একমাত্র আল্লাহরই হুকুম চলবে, কোনো মানুষের বা অন্য কোনো সৃষ্টির হুকুম নয়। একজন মুসলিমের জন্য এটি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, আল্লাহর শাসনব্যবস্থা ছাড়া পৃথিবীতে ইনসাফভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েমে বিকল্প আর কোনো ব্যবস্থা নেই। বর্তমান পশ্চিমা গণতন্ত্র বা আধুনিক গণতন্ত্র মানুষকে শোষণ এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, এটিই বাস্তবতা। মূলত শাসনব্যবস্থা হবে শুধু ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক, যেখানে প্রত্যেকে তার ন্যায্য অধিকার নিয়ে কোনো হাহুতাশ করবে না কিংবা কোনো প্রকার অবিচার দেখতে হবে না। আর এটা কেবলই সম্ভব ইসলামি শরীয়াহ শাসনব্যবস্থার অধীনে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের মধ্য থেকে মাঝেমাঝে এমন রকমেরও ঘোষণা আসে যে, আমরা নির্বাচিত হলে ডেমোক্রেসি পরিপূর্ণতা পাবে। মূলত আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক সকল সমস্যার নিখুঁতভাবে সমাধান দেয়। সেখানে রাজনীতিতে ইসলামকে সরিয়ে মানবসৃষ্ট গণতন্ত্রে পরিপূর্ণভাবে ভরসা করা সত্যিই ভয়ংকর এবং ঈমান বিধ্বংসী অশনিসংকেত।

ইসলামি ফিক্বহে একটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল আছে: ارتكاب أخف الضّررين অর্থাৎ, যখন দুটি ক্ষতি একসাথে এড়ানো অসম্ভব এবং যখন অন্য কোনো বিকল্পও বিদ্যমান থাকে না, তখন তুলনামূলক কম ক্ষতিকর বিষয়টিকে গ্রহণ করতে হয়, যাতে বড় ক্ষতিটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। গণতন্ত্রও এই প্রেক্ষাপটে ঠিক এরকমই। বর্তমানে সরাসরি ইসলামি শরীয়াহ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব না হওয়ায়, আমাদের বাধ্য হয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আপাতত মেনে নিতে হচ্ছে। তবে এটার অর্থ এই নয় যে, আমরা গণতন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছি, অথবা মনে করছি ইসলাম ছাড়াও গণতন্ত্র বা এরকম মানবসৃষ্ট অন্য শাসনব্যবস্থায় মানুষের সমাধান বিদ্যমান রয়েছে। না, আমাদের অন্তরে শুধুই খিলাফতের আকাঙ্ক্ষা থাকবে।

এখানে পশ্চিমাদের খুশি রাখতে বা লিবারেল মুসলিম হিসেবে নিজেদেরকে পরিচিত করতে নিজেদেরকে মডারেট মুসলিম বা পরিপূর্ণ মডার্ন ডেমোক্রেটিক বলে পরিচয় দেওয়ার কোনো মানে হয় না। এগুলো স্পষ্ট কাপুরুষতা এবং নিজেদের আসল পরিচয় ভুলে যাওয়ার লক্ষণ।

প্রশ্ন হতে পারে, আমরা গণতন্ত্রকে খারাপ বলেই যখন বিশ্বাস করি, তাহলে কেন এটিকে সাময়িক সময়ের জন্য হলেও গ্রহণ করছি? উত্তর একদম সহজ। যদি আমরা বর্তমান বাস্তবতায় গণতন্ত্র এড়িয়ে যাই, তাহলে আমাদের উপর আবার চেপে বসবে কোনো অত্যাচারী জুলুমবাজ।

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা কখনোই যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে অর্পণ করা হয় না; বরং দেখা হয় কার কতো বেশি ম্যানপাওয়ার আছে। এতে যতো খারাপ লোকই হোক, তার ম্যানপাওয়ার থাকলে সে ক্ষমতায় যাবে। আমরা গত ফ্যাসিস্ট রেজিমের সময় এর বাস্তবতা দেখেছি; কতো অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ লোক ক্ষমতার আসনে সমাসীন ছিল। সেই কারণেই ফিক্বহের উসূল ارتكاب أخف الضّررين অনুসারে, ক্ষতি সীমিত করার জন্য এবং আমাদের কাছে অন্য কোনো বিকল্প না থাকায়, আমাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণতন্ত্রকে আপাতত মেনে নিতে হচ্ছে।

সুতরাং, আমাদের আইডিওলোজি হবে একদম স্পষ্ট ও সুদৃঢ়: “বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে বর্তমানে অন্য কোনো মাধ্যম আমাদের কাছে বিদ্যমান না থাকায় গণতন্ত্র সাময়িক সময়ের জন্য গ্রহণ করা; কিন্তু অন্তরে আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণ শরীয়াহ ও খিলাফতের আকাঙ্ক্ষা অটুট রাখা, প্রকাশ্যে এর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এবং জনসাধারণকে তাদের অন্তর থেকে এটা ভালোভাবে অনুধাবন করাতে সক্ষম হওয়া যে, ইসলামি শরীয়াহ শাসনব্যবস্থা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই। তৎসঙ্গে আমাদের এটাও ভালোভাবে মাথায় রাখতে হবে যে, গণতন্ত্র দিয়ে ইসলাম কস্মিনকালেও কায়েম হবে না। কারণ গণতন্ত্রের জন্মই হয়েছে ইনসাফভিত্তিক ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য।”

আমরা যেন আল্লাহ প্রদত্ত ইসলামি শরীয়াহ শাসনব্যবস্থা তথা খিলাফতের আকাঙ্ক্ষা হৃদয়ে ধারণ করি এবং এর জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখি। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে পরিপূর্ণভাবে ইসলামি শরীয়াহ শাসনব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার তাওফিক দান করুন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button