Writing

এক আত্মীয়ের সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার গল্প

অনেকদিন ধরেই বড়ো চাচার বাসায় যাওয়া হচ্ছে না।এমনকি একটি ফোন করেও তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে না।চাচা আমাদেরকে কতো মায়া করতেন,মাঝে মাঝে বাসায় খাবার দিয়েও পাঠাতেন। কিন্তু আমরা চাচার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলছি।বাবার সাথে টেবিলে সকালের নাস্তা খেতে খেতে চাচার কথা স্মরণ করে এমনটাই বলছিল মা হারা ছেলে সাকির।তার বাবা বশির মিয়া এসব শুনেও যেনো না শুনার ভান করে থাকতে চাইলেন।কিন্ত সাকির যেভাবে তার চাচার কথা বলতেই থাকলো তাতে আর তিনি সাঁড়া না দিয়ে পারলেন না।

তিনি বললেন–কী বলবো রে বাবা, তোমার চাচা তো রীতিমতো আমাদের গাল-মন্দ করাতেই লিপ্ত আছেন।এই তো সেদিনও আমাকে একজন এসে বলল,তিনি নাকি আমাদের অনেক নিন্দা করেন, গালিগালাজ করেন,উপকারের খোঁটা দেন। এমনকি আরও শুনলাম তিনি নাকি বিভিন্ন মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন।অথচ আত্নীয় হিসেবে আমরাই তো সাহায্য পাওয়ার সবচেয়ে বেশি হকদার ছিলাম।আমাদের অসচ্ছলতার কথা জেনেও তিনি কিভাবে আমাদেরকে সাহায্য না করে অন্যদেরকে সাহায্য করতে পারেন?এসব শুনলে কি আর মন মেজাজ ভালো থাকে-তুমিই ভালো?

–বাবা,এসব আপনাকে কে এসে বলে?আপনি কেনই-বা এদের কথা শুনতে যান?কিসের ভিত্তিতে এদের কথা বিশ্বাসই-বা করেন?এরা যে আপনার অমঙ্গল চাচ্ছে সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন না?এরা যদি আপনার মঙ্গলই চাইতো তবে তাদের কাছে চাচা আপনার বিরুদ্ধে কোনো মন্দ কথা বলে থাকলেও সেই মন্দ কথা আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারতো না বরং গোপন রাখতো।এরা রীতিমতো চোগলখুরী করছে।এরা মুনাফেকির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।এরা আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করে চলছে।আপনি একটু চিন্তা করুন তো,যেখানে আপনার কাছে এসে চাচার মন্দ কথা বলতে পারছে সেখানে চাচার কাছেও গিয়ে আপনার অনেক নেতিবাচক কথা বলাটাও কি তাদের জন্য স্বাভাবিক নয়?এগুলো তো আপনার বুঝতে পারার-ই কথা,বাবা।

এমন মানুষেরা চায় না,আপনারা ভাইয়ে-ভাইয়ে মিল হোক,এরা চায় না ছিন্ন হওয়া সম্পর্ক ফিরে পাক।তারা শুধু কান ফোঁড়া দিয়ে একজনের সাথে আরেকজনের দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখতে চায় এবং সম্পর্কের দূরত্ব বাড়িয়ে রাখতে চায়।তাদের কাজই হচ্ছে আগুনে পানি না ঢেলে পেট্রোল ঢেলে আগুনের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া। আজকের সমাজের প্রতিটি সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পিছনে এমন মানুষদের অনেক বড়ো দায় রয়েছে। এরা সমাজের জন্য বিষাক্ত।আমাদেরকে এমন মানুষদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে,বাবা।

–ঠিকই বলেছিস রে বাবা।এই বিষয়টি আগে এতোটা খেয়াল করি নি।এদের নেতিবাচক কথা শুনলে মনে অশান্তি আরও বাড়ে,ভাইয়ের প্রতি ক্ষোভও জন্মে।অযথাই টেনশন হয়।অথচ যাচাই -বাছাই না করে এদের কথা বিশ্বাস করা মোটেই উচিত হয় নি।এখন থেকে এদেরকে এড়িয়ে চলবো।

–এই তো আপনি ঠিক ধরেছেন।সত্যিই,এতে মনে আরও অশান্তির সৃষ্টি হয়।ভাইয়ের প্রতি ক্ষোভ থেকে ঘৃণারও সৃষ্টি হয় যা সম্পর্কের ফাটল আরো বাড়িয়ে দেয়।দেখুন বাবা,ভাইয়ে-ভাইয়ে সম্পর্ক না থাকা সমাজের নিকট একটি খারাপ বিষয় বটে।এতে মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিরুপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়।তাদের নিকট আমাদের পুরো পরিবার কিংবা পুরো বংশের মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।একইসাথে,এতে অন্যের নিকট নিজেদের দূর্বলতা প্রকাশ পায়।অনেক সময় শত্রুরা ভাইয়ে-ভাইয়ে অমিল থাকার সুযোগ নিয়ে অনেক ক্ষতি করতে পারে।আর আপনি কেনো শুধু শুধু আপনার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন রেখে অন্যের নিকট নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে যাবেন?এতে তো নিজেরই ক্ষতি।তাই না,বাবা?

–অবশ্য এটা ঠিক যে,এতে পরিবার-সমাজের বদনাম হয়,শত্রুরাও ওঁৎ পেতে থাকে।কিন্তু কি আর করবো বলো,তোমার চাচা তো এসব বুঝতেই চান না।তিনিই তো হঠাৎ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে এখন অবধি আর কোনো যোগাযোগই করলেন না।

–বাবা,একই কথা তো আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।চাচার মতো আমরাও তো উনাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করছি না।আমাদের মতো উনিও হয়তো একই ধারায় চিন্তা করছেন।এভাবে চলতে থাকলে তো এর কোনো সমাধানই হবে না।

–আমার কথা হচ্ছে,তোমার চাচাও তো আমাদের একটু খোঁজখবর নিতে পারতেন।আর কিছু না পারলেও অন্তত এই ফোনের যুগে একটি ফোনও তো করতে পারতেন।সবকিছুর পর তিনি আমার বড়ো ভাই ছিলেন।ছোট ভাইয়ের খবর নেওয়া উনার দায়িত্ব ছিল।এছাড়া,উনাকে কি আমরা কম যত্ন করতাম!আমাদের বাসায় উনার আসার খবর পেলেই আমরা উনার প্রিয় খাবার গরুর মাংসের কলিজা কিভাবে প্রস্তুত রাখা যায় সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তাম।আর এখন বুঝি তিনি সব ভুলে গেলেন!এভাবেই অভিমানী স্বরে কথাগুলো বলছিলেন সাকিরের বাবা।

কিন্তু সাকির কিছুটা দ্বীনের সংস্পর্শে থাকার কারণে দ্বীন নিয়ে চর্চা করে,দ্বীন মানার চেষ্টা করে।তাই বাবার মতো ওইসব চিন্তা মাথায় আনে নি,ঐভাবে যুক্তিও দাঁড় করায় নি।সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে সে মনে মনে অনেকে কিছুই ভাবতে লাগলো।সে ভাবতে লাগলো, বাবাকে কিভাবে বিষয়টি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে মীমাংসার দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।এক পর্যায়ে সে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,আচ্ছা,বাবা!আপনি আমাকে বলুন তো,কেউ যদি কোনো অপরাধ বা দোষ করে থাকে তবে কি সেই অপরাধ আমিও করতে পারি?

–না,কোনোভাবেই না!তুমি কেনো সেটাকে দোষ জেনেও একই দোষ করতে যাবে?

–এই তো বাবা,ঠিক বলেছেন!দেখুন বাবা,চাচা আমাদের খবর নিচ্ছেন না,তো কি হয়েছে! আমরাও তো বড়ো চাচার খবর নিচ্ছি না, আমরাও তো চাচার সাথে সব ধরণের যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছি।চাচা যদি আমাদের খোঁজখবর না নিয়ে বা যোগাযোগ না করে দোষ করে থাকেন তবে আমরাও কি চাচার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে একই দোষ করছি না?

ছেলের এমন যৌক্তিক কথা শুনে বাবা থমকে গেলেন এবং কী বলবেন তাও যেনো ভেবে পাচ্ছিলেন না।আবার মনে মনে বুঝতে পারলেন যে,কথাটি তো সত্যই বলেছে।কিন্তু বিষয়টিকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ছেলেকে বললেন,বাবা, সাকির!তোমার তো কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে।এসব কথা না হয় অন্যদিন হবে।এবার তুমি রেডি হয়ে নাও।কেমন?

–বাবা!আজকে না শনিবার।আজকে তো আমার কলেজ বন্ধ।

–ওহ!তোমার সাথে কথা বলতে বলতে তা ভুলেই গিয়েছিলাম।

–বাই দ্যা ওয়ে,বাবা!আমরা যে প্রসঙ্গে ছিলাম।আমরা কিন্তু চাচার মতো একই কাজ করে যেতে পারি না।চাচা আমাদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে আত্নীয়ের হক নষ্ট করে যাচ্ছেন বলে আমরাও উনার সাথে একই আচরণ করে আত্মীয়ের হক নষ্ট করে যেতে পারি না,বাবা।

এছাড়া,তিনি আমাদের খোঁজখবর নিলেন কিনা তার চেয়ে বড়ো বিষয় হচ্ছে আমরা উনার খোঁজখবর নিচ্ছি কিনা।কারণ প্রত্যেকেরই পৃথক পৃথক দায়িত্ব রয়েছে।কারো দায়িত্ব পালনের উপর নির্ভর করে অন্যের দায়িত্ব নির্ধারণ হয় না,বাবা। আমরা আমাদের জায়গা থেকে আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাবো।আর উনারা উনাদের জায়গা থেকে তাদের দায়িত্ব পালন করে যাবেন এমনটাই নিয়ম।আর সেক্ষেত্রে উনি উনার দায়িত্ব পালন করছেন না বলে আমরাও আমাদের দায়িত্বকে এড়িয়ে যেতে পারি না।

–কিন্তু বাবা সাকির,তোমার চাচা যদি আমাদের সাথে যোগাযোগ করতেন,সম্পর্ক রাখতেন তবে আমরাও তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতাম,আসা যাওয়া করতাম।আর তাতে আত্নীয়তাও বিচ্ছিন্ন হতো না।কিন্তু তিনি তো এসবের ধারে কাছেও নেই।

–বাবা,আপনার এই কথাটির জবাব সরাসরি একটি হাদীসের মাধ্যমে দিতে চাই।আর তা হচ্ছে, রাসূল (সা:) বলেছেন,“সে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী হিসেবে গণ্য হবে না যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করলেই সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে।বরং আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষাকারী সে ব্যক্তি যে কেউ তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করলেও সে তার সাথে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে”
[সহীহ বুখারী,হাদীস নং : ৫৯৯১]

দেখেছেন বাবা,রাসূল (সাঃ) কী বলেছেন আর আমরা কী করে চলছি।চাচা যোগাযোগ করলে আমরা যোগাযোগ করতাম এমন বিষয় তো রীতিমতো আত্নীয়তার সংজ্ঞাতেই পড়ে না।এই হাদীসের আলোকে চাচা আমাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন বলে আমরাও উনার সাথে একই কাজ করে যেতে পারি না। আমাদের সাথে উনারা যোগাযোগ না করা সত্ত্বেও আমাদের বরং উনাদের সাথে যোগাযোগ করাই উচিত।প্রকৃত অর্থে,তাতেই আত্নীয়তার পরিচয় দেওয়া হবে।

পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন,’যদি তোমরা ক্ষমতা পাও,তাহলে কি পৃথিবীতে তোমরা বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে?এদের প্রতিই আল্লাহ অভিসম্পাত করেন, অতঃপর তাদেরকে বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করেন।’
[সূরা মুহাম্মাদ,আয়াত নং : ২২-২৩]

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীকে আল্লাহ তা’য়ালা রীতিমতো লা’নত,অভিশাপ দিয়েছেন,বধির ও দৃষ্টিশক্তিহীন করে দেওয়ার কঠিন থেকে কঠিনতর হুমকি দিয়েছেন।আর আল্লাহর এমন হুমকি বান্দার জন্য কতোটা ভয়াবহ তা কি আমরা উপলব্ধি করতে পারছি,বাবা?আল্লাহর নিকট আত্মীয়তার বিষয় কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝার জন্যও কি এই আয়াতই যথেষ্ট নয়,বাবা?

আবার,রাসূল (সাঃ) বলেছেন,যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে সে যেনো আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। [সহীহ বুখারী,আয়াত নং : ৬১৩৮]

এই হাদীস মতে,আমরা যদি আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা না করে চলি তবে কেমন জানি আমাদের আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমানই আনা হলো না।আর আল্লাহ এবং আখিরাতের প্রতি ঈমান না আনা কতোটা ভয়ঙ্কর সেটাও কি আপনি চিন্তা করেছেন,বাবা?

এদিকে,রাসূল (সাঃ) বলেছেন,’যে ব্যক্তি রিজিকের প্রশস্ততা ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেনো তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।’ [সহীহ বুখারী,হাদীস নং : ৫৫৫৯]

বাবা,এখন আপনি কি চান না,আপনার সন্তান দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকুক সর্বোপরি আমরা সবাই দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকি,আমাদের আয়ু বৃদ্ধি পাক?আপনি কি চান না আমাদের রিজিক বৃদ্ধি পাক?

–হ্যাঁ,বাবা!তা চাইবো না কেনো?আমার সন্তানেরা দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকবে,রিজিকের সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে এগুলোই তো বাবা হিসেবে আমার কাম্য।

–তাহলে বাবা,আমরা কেনো শুধু শুধু আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন রেখে নিজেদেরকে আয়ু বৃদ্ধি ও রিজিক বৃদ্ধির মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত পাওয়া থেকে বঞ্চিত রাখছি?আপনিই বলুন,এটা কি কোনো চিন্তাশীলের কাজ হতে পারে,বাবা?

বাবা!আপনি কি জানেন,আরো ভয়ংকর ব্যাপার হলো,আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কারী ব্যক্তি জান্নাতেই যাবে না।রাসূল (সা:) কঠিন হুশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না’।
[সহীহ বুখারী,হাদীস নং : ৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম হাদীস নং : ২৫৫৬]

এমন বিষয় যে কতো মারাত্মক,কতো আত্মঘাতী সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি,বাবা?আমরা কি চাই, জান্নাতের মতো স্থায়ী এবং পরম সুখময় স্থান আমাদের জন্য হারাম হয়ে যাক?

রাসূল (সাঃ) বলেছেন,“দু’টি গুনাহ্ ছাড়া এমন কোনো গুনাহ্ নেই যে গুনাহ্‌গারের শাস্তি আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়াতেই দিবেন;উপরন্তু তার জন্য আখিরাতের শাস্তি তো আছেই।সেই গুনাহ্ দু’টি হচ্ছে,অন্যায় বিচার করা ও আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী”। [আবু দাউদ,হাদীস নং ৪৯০২; তিরমিযী, হাদীস নং ২৫১১;]

এজন্যই হয়তো আমাদের পরিবারে রোগ-বালাই, অর্থ সংকট,ঋণের সমস্যা ইত্যাদি একটির পর আরেকটি লেগেই আছে।কে জানে আল্লাহর পক্ষ থেকে এগুলোও তো হতে পারে আমাদের জন্য আত্নীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার দুনিয়ার সেই শাস্তি।আখিরাতের শাস্তি তো পড়েই আছে।ফলে এগুলো আমাদেরকে এখনি বুঝতে হবে এবং নিজেদেরকে সংশোধন করতে হবে,বাবা।

অপরদিকে,রাসূল (সাঃ) বলেছেন,“আদম সন্তানের আমলসমূহ প্রতি বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত্রিতে (আল্লাহ তা‘আলার নিকট) উপস্থাপন করা হয়।তখন আত্মীয়তার বন্ধন বিচ্ছিন্নকারীর আমল গ্রহণ করা হয় না” [আহমদ,হাদীস নং : ১০২৭৭]

ফলে এতো এতো নেক আমল করে কী হবে যদি আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা না করার কারণে নিজের আমলেরই গ্রহণযোগ্যতা না থাকলো?এতোকিছুর পরও কি আমরা আত্নীয়তার ব্যাপারে অনড় থাকতে পারি?এতোকিছুর পরও কি আমাদের মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দিতে পারে যে,তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন না তাই আমরা কেনো তাদের সাথে যোগাযোগ করবো? এরপরও কী আমরা আত্নীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার গুরুত্ব বুঝবো না,বাবা?

এখানেই তো শেষ নয়,হাদীসে এমনও অতি ভয়ঙ্কর বিষয় এসেছে যে,কেউ আত্নীয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলে স্বয়ং আল্লাহ তা’য়ালাও ঐ বান্দার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিবেন।চিন্তা করেছেন,বাবা!এটা তো রীতিমতো মারাত্মক পর্যায়ের ভীতিপ্রদর্শন?একজন বান্দার জন্য আল্লাহর সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার চেয়ে বড়ো ক্ষতিকর জিনিস আর কী হতে পারে? বান্দার জন্য এর চেয়ে বড়ো অসহায়ত্বের বিষয় আর কী হতে পারে?

বুঝলে বাবা,আত্মীয়ের ব্যাপারে পবিত্র কোরআন হাদীসে আরও অনেক বাণী রয়েছে যা কেউ জেনে থাকলে আত্মীয়তার সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না,থাকতে পারারও কথা নয়।

চাচা আমাদের খোঁজখবর না নেওয়ার মাধ্যমে আত্মীয় হিসেবে আমাদের হক নষ্ট করার কারণে আমরা কেনো উনার হক নষ্ট করবো?আল্লাহ যদি আমাদেরকে উনার হকের ব্যাপারে প্রশ্ন করেন তবে আমরা কী জবাব দেবো?উনি আমাদের হক রক্ষা করলেন কিনা সেটার দিকে না তাকিয়ে তাদের হক আমরা রক্ষা করে আল্লাহর কাছে এ ব্যাপারে জবাব দেওয়ার রাস্তা কি পরিষ্কার করে রাখা উচিত নয়,বাবা?প্লিজ বাবা,আমার কথাগুলো আপনি একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনি তো সহজে বুঝতে পারার মতো একজন মানুষ।

আসলে,দেখুন বাবা!শয়তান আমাদেরকে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন রাখার জন্য এমন হিংসাত্মক মনোভাব সৃষ্টি করে রেখেছে।আমরা যদি প্রত্যেককে একে অপরকে দোষারোপ করতে থাকি তবে এর শেষ কিভাবে হবে?আল্লাহর ভয়ে আমাদের নিজেদের জায়গায় থেকে আমাদের নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাওয়াই তো উত্তম। তাই না?সেক্ষেত্রে কে কী করলো বা না করলো সেটি মূখ্য বিষয় নয় বরং আমি কী করলাম সেটাই মুখ্য বিষয়।

প্রসঙ্গত,অনেক সময় শয়তান তুলনামূলক অসচ্ছল আত্মীয়ের মনে এমন বিষয় এনেও খোঁচাতে থাকে যে,তোমার আত্মীয় তো তোমাকে অসচ্ছল জেনেও অন্যত্র দান করছে,অন্যকে সাহায্য করছে অথচ তোমাকে কোনো সাহায্যই করছে না।এভাবে উস্কে দিতে থাকে।সাথে কিছু দুষ্ট প্রকৃতির মানুষও উস্কানি দিয়ে থাকে যেমনটা আপনাকে একজন উস্কেও দিয়েছে।কিন্তু এখানে আমাদেরকে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, যিনি আত্মীয়কে অবহেলা-অবজ্ঞা করছেন,পাত্তা দিচ্ছেন না,প্রাপ্য হক থেকে বঞ্চিত রাখছেন তাকে আল্লাহর কাছে এর কঠিন জবাবদিহিতা করতে হবে,আল্লাহই তাকে পাকঁড়াও করবেন।কিন্তু তাই বলে আমরা শয়তানের কিংবা খারাপ মানুষের উস্কানিতে এসব চিন্তা মাথায় এনে নিজেদের দায়িত্বকে অবহেলা করতে পারি না,আত্নীয়তার বন্ধন ছিন্ন করতে পারি না,তাদেরকে বাঁকা চোখে দেখতে পারি না,সর্বোপরি হিংসা করতে পারি না।

দেখুন বাবা,অন্যেদের উপর থাকা আমার হক যথাযথভাবে আদায় করা হলো কিনা সেটির দিকে না তাকিয়ে নিজের উপর থাকা অন্যের হক আমি সঠিকভাবে আদায় করছি কিনা সেটির প্রতিই পূর্ণ মনোনিবেশ করা উচিত।দু’দিনের এই দুনিয়াতে নিজের হিংসুক মনোভাবকে ঝেড়ে ফেলে এবং অহংকারকে নিয়ন্ত্রণ রেখে চলা কি উচিত নয়, বাবা?আজকে আমি মারা গেলে আত্মীয়ের হকের ব্যাপারে মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবো আমি?

আমি আপনাকে এতোটুকুই বলবো,যদি আপনার কাছে চাচার কোনো কার্যক্রমকে ভুল হিসেবে মনে হয়ে থাকে কিংবা চাচার কোনো কথায় আপনি মনে কষ্ট পেয়েও থাকেন তবুও তো বাবা আপনি চাইলে উনাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন।এই দুনিয়ায় একদিন তো আমরা কেউ-ই থাকবো না।এখানে তো আমরা সবাই মুসাফির।তাই মনের ভেতর কোনো কষ্ট জমিয়ে না রেখে চাচাকে কি ক্ষমা করে দেওয়া যায় না,বাবা?আপনি কি জানেন,আল্লাহ তা’য়ালা ক্ষমাকারীকে খুব ভালোবাসেন।আর আপনি তো নিশ্চয়ই আল্লাহর ভালোবাসাই পেতে চাইবেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেছেন,সচ্ছল হোক কিংবা অসচ্ছল সর্বাবস্থায় যারা (আল্লাহর পথে) নিজেদের ধন সম্পদ ব্যয় করে,যারা নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে এবং মানুষের (অপরাধ) ক্ষমা করে দেয়;(আসলে) ভালো মানুষদের আল্লাহ তা’য়ালা (হামেশাই) ভালোবাসেন। [সূরা আলে ইমরান,আয়াত নং : ১৩৪]

এছাড়া,আল্লাহ বলেছেন,যে ব্যক্তি ধৈর্য্য ধারণ করে এবং (মানুষদের) ক্ষমা করে দেয় (সে যেনো জেনে রাখে),অবশ্যই এটা হচ্ছে সাহসিকতার কাজসমূহের মধ্যে অন্যতম। [সূরা আশ শূরা,আয়াত নং : ৪৩]

খেয়াল করেছেন,বাবা!ধৈর্য্যশীল ও ক্ষমাকারীকে স্বয়ং মহান রাব্বুল আলামিন সাহসী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।আর আল্লাহর কাছ থেকে সাহসী তকমা পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়,বাবা। ফলে আমরা কি অন্যের অপরাধ ক্ষমা করে নিজেদেরকে সাহসী হিসেবে প্রমাণ করতে পারি না?

এতোক্ষণ ধরে গভীর মনোযোগের সাথে ছেলের মুখ থেকে অমায়িক কথাবার্তা এবং আত্মীয়ের ব্যাপারে কোরআন হাদীসের পাশাপাশি নীতিকথা শুনে তার বাবা আর চুপ থাকতে পারলেন না, পারলেন না আর এড়িয়ে যেতে, পারলেন না আর নিজের মধ্যে হিংসুটে এবং অহংকারপূর্ণ মনোভাব ধরে রাখতে।মনের মধ্যে আল্লাহর ভয় আসতে শুরু করলো। ভাবতে লাগলেন, যদি আমার ছেলে এ ব্যাপারটি এতো সুন্দর বুঝতে পারে তাহলে আমি কেনো বুঝতে পারবো না।আর সত্যিই তো! যদি আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে,তুমি কি তোমার আত্মীয়ের খোঁজ নিয়েছিলে? আত্মীয়ের হক আদায় করছিলে?

তখন কী জবাব দেবো আমি!এমন ভাবনা মনের মধ্যে আসতে লাগলো।আর বুকটাও তখন ধরফর করতে লাগলো এই ভেবে যে,আমার ভাই যদি আমার হক নষ্ট করে থাকেন তবে আমিও তো আমার ভাইয়ের হক নষ্ট করছি।মহান আল্লাহ আমার ভাইয়ের হক তথা আত্মীয়ের হকের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবো আমি?

এসব চিন্তা করে ছেলেকে বললেন,হ্যাঁ বাবা, সাকির!আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা এতোটা ভয়াবহ তা কখনো চিন্তাও করতে পারি নি।আমার ভাইয়ের দায়িত্বের দিকে না তাকিয়ে আমার নিজের দায়িত্বের উপর নজর দেওয়া উচিত ছিল।তুমি আমার অন্তর্চক্ষু খুলে দিলে, বাবা।

আসলে,তোমার চাচার প্রতি আমার আর কোনো রাগ নেই রে বাবা।তোমার চাচাই আমাকে ক্ষমা করে দিলেই হলো।কিন্তু সাকির,আমি ভাবছি,হঠাৎ এতো বছর পর তোমার চাচার বাসায় গেলে তিনি যদি আমাদেরকে রাগ করে তাড়িয়ে দেন?

–আপনি এসব কী বলেন,বাবা?চাচা এমন জঘন্য কাজ করতে যাবেন কেনো?এগুলো তো নিম্ন মানসিকতার কাজ।চাচার তো রীতিমতো আরও খুশি হওয়ার কথা।চাচা কিছুটা রাগী হলেও এসব ব্যাপারে মোটেও রাগ করবেন না।কিন্তু তারপরও যদি আপনার আশঙ্কা অনুযায়ী চাচা আমাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেনও তবুও তাতে কোনো সমস্যা নেই।এতে আমাদের মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার কিছু নেই।আমরা বরং হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে আসবো।কেননা তখন অন্তত আত্মীয়ের হক ছিন্ন করার দায় মুক্ত থাকা হবে।আল্লাহকে জবাব দেওয়ার রাস্তাও পরিস্কার থাকবে।

এ ব্যাপারে আপনাকে একটি অনুপ্রেরণামূলক হাদীস জানিয়ে রাখি,এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার এই বলে প্রশ্ন করলো:হে আল্লাহর রাসূল!আমার কতিপয় আত্মীয় আছে। আমি তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে চলি অথচ তারা আমার সাথে তা ছিন্ন করে,আর আমি তাদের সাথে সুন্দর ব্যবহার করা সত্ত্বেও তারা আমার সাথে মন্দ আচরণ করে থাকে।আমি তাদের ব্যাপারে সহিষ্ণুতার পরিচয় দেই অথচ তারা তার উল্টো করে।তখন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,তোমার অবস্থা যদি এরূপই হয় যা তুমি বললে, তা হলে তুমি যেনো তাদের মুখে গরম ছাই নিক্ষেপ করলে। আর তাদের বিপক্ষে তুমি সব সময়ই আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন সাহায্যকারী পাবে, যতোক্ষণ পর্যন্ত তুমি ঐ অবস্থায় বহাল থাকবে। [সহীহ মুসলিম,আয়াত নং : ২৫৫৮]

এই হাদীস মোতাবেক,এমনসব আত্নীয়ের প্রতি রাসূল (সাঃ) এর তীব্র রাগ প্রকাশ পাচ্ছে যারা তাদের আত্মীয়ের ভালো ব্যবহারের বিপরীতে খারাপ ব্যবহার করে,অবজ্ঞা করে,এড়িয়ে চলে।কতোটা রাগ প্রকাশ পাচ্ছে তা ‘মুখে গরম ছাই নিক্ষেপ’ এর বিষয় থেকে সহজেই অনুমেয়।বিষয়টি এতোটা সেনসেটিভ না হলে রাসূল (সাঃ) এতোটা কঠিন ভাষা ব্যবহার করতেন না।

বুঝলে,বাবা!ফলে তাতেও কোনো চিন্তার কারণ নেই।এছাড়া,আমরা তো আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন স্পেশাল সাহায্যকারী পাচ্ছিই।সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে,বাবা,আমি চাচার ব্যাপারে সু-ধারণাই রাখি।উনি কখনোই আত্মীয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করবেন না।তাই আপনি শুধু শুধু এসব নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করবেন না,বাবা।চাচা এমন মানুষই নয়।দেখবে,চাচা কিন্তু আমাদেরকে দেখে অনেক খুশি হবেন।এমনকি খুশিতে অশ্রুসিক্তও হতে পারেন।ইন শা আল্লাহ!

–তোমার কথাগুলো শুনে খুব ভালো লাগলো রে বাবা।এমন মানসিকতার সন্তানই তো সবার ঘরে ঘরে থাকা উচিত।চলো!আমরা আর দেরি না করে আগামী সপ্তাহে তোমার ছুটির দিনে-ই তোমার চাচার বাসায় বেড়াতে যাই।কেমন?

–মা শা আল্লাহ!অনেক খুশি হলাম,বাবা।কতোটা খুশি হয়েছি তা আমি আপনাকে বলে বুঝাতে পারবো না।আলহামদুলিল্লাহ!আর হ্যাঁ,আগামী সপ্তাহে আমার ছুটির দিনে গেলে মন্দ হবে না। আমরা যদি চাচাকে না জানিয়ে যাই সেক্ষেত্রে বড়ো চাচার জন্য এক বিশাল সারপ্রাইজ হবে। আর সারপ্রাইজ মানেই তো আনন্দের, খুশির।এছাড়া,এমন সারপ্রাইজে চাচা নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবেন।

–সাকির,তোমার এই সারপ্রাইজের সাথে আরেকটি সারপ্রাইজ যোগ করা যায়।

–একটু কৌতূহলী মন নিয়ে সাকির বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,আপনার আবার কী সারপ্রাইজ, বাবা?

–আরে!ঐ যে,তোমার চাচার প্রিয় খাবার আছে না,কলিজার ভুনা!

–সাকির একটু হেসে বলল,ও হ্যাঁ বাবা!তাহলে তো আরও ভালোই হলো।এখন তো দেখছি সারপ্রাইজের উপর সারপ্রাইজ।এভাবে সাকির তার বাবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে চেয়ার থেকে উঠে নিজ রুমের দিকে চলে গেলো।

এক সপ্তাহ পর……

আগের রাত বশির মিয়ার ঘুম আসছিল-ই না। এতো বছর পর বড়ো ভাইয়ের বাসায় এতোসব সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির হয়ে কখন যে ভাইয়ের চেনা মুখখানা দেখবেন সেসব চিন্তা নিয়েই প্রহর গুনছিলেন।চোখের পাতায় ভাইয়ের আগের স্মৃতি ভেসে উঠছিলো।এমনকি এতোদিন ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ না রাখার জন্য মনের মধ্যে তীব্র অনুতাপ কাজ করছিলো।

যাইহোক,পরদিন সকাল দশটায় রওনা দিলেন। এতো বছর পর ভাইয়ের বাড়ি যাবেন তাই সকাল সকাল বের হবেন বলে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন।সাকিরও তার বড়ো চাচার বাড়ি যাবে বলে আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিল।সেও বেশ এক্সাইটেড!

অবশেষে,বশির মিয়া তার বড়ো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলেন।হঠাৎ বাসার গেইটের সামনে গাড়ির হরণ শুনতে পেয়ে তার বড়ো ভাই আমজাদ মিয়া বেশ নড়েচড়ে বসলেন।কিছুটা অবাক হয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলেন যে,এতো সকাল সকাল কে আবার আসলো!

বাসার দরজা খুলে একটু বের হয়ে গেইটের সামনে আসতেই দেখলেন বহুদিন ধরে না দেখা সেই চিরচেনা মুখ।ভাইকে দেখেই জড়িয়ে ধরে প্রচন্ড আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়লেন।এক ভাই আরেক ভাইকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরলেন যেনো হারানো এক রত্ন ফিরে পেলেন।আর এভাবেই নিমিষেই মাঠি চাপা পড়ে গেলো ভাইয়ে ভাইয়ে থাকা দ্বন্দ্ব নামক এক মন্দ জিনিসের।

এদিকে পাশে থেকে বাবা-চাচার এমন আবেগপূর্ণ দৃশ্য দেখে সাকিরও নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারলো না।হাত দিয়ে চক্ষুদুটো মুছতে মুছতে ভাবতে লাগলো, সত্যিই আপন সম্পর্কগুলো এমনি হয়।আপন সম্পর্কগুলোতে যতোই ফাটল থাকুক,যতোই দূরত্ব থাকুক এক পাশ থেকে একটু শিথিলতা অবলম্বন করলেই তা নিমিষেই শেষ হয়ে যায়,ফিরে পায় মায়ার বন্ধন।

ভাতিজার দিকে লক্ষ্য করে এবার চাচা বললেন, আর তুমিও তো চাচার একটু খোঁজ খবর নিতে পারতে, বাসায় আসতে পারতে।এভাবে অভিমানী স্বরে সাকিরকে তার চাচা একটু ঝাড়ি দিলেন।অতঃপর সাকিরও তার চাচাকে সুন্দর করে সালাম দিতে দিতে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

এদিকে,ঘরে প্রবেশ করে বশির মিয়ার হাতে থাকা টিফিন দেখে বড়ো ভাই বললেন এসব কেনো কষ্ট করে আনতে গেলে,বশির!ভাইয়ের বাসায় আসতে আবার এসব-ওসব আনা লাগে না কি!

পরক্ষণেই,কিচেনে নিয়ে টিফিন খুলতেই অবাক করা দৃষ্টি দিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন।হয়তোবা, ভাবছিলেন এতোকিছুর পরও ভাইয়ের মনে রাখা সেই প্রিয় খাবারটির কথা।তারপর ড্রয়িং রুমে এসে আবারও ভাইকে জড়িয়ে ধরে ভেজা কন্ঠে বললেন,ভাই আমার!তুমি আমার পছন্দের খাবারও নিয়ে এসেছো।যে ভাই এতো বছরেও তোমার খবর নেয়নি সে ভাইয়ের এমন পছন্দের খাবারও তুমি মনে রেখেছো,পাঁক করেও নিয়ে এসেছো।আবারও চোখদুটো মুছতে মুছতে এবং মনে মনে ভাইয়ের সাথে এতোদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার অপরাধ উপলব্ধি করতে করতে কিচেনের দিকে গেলেন।এরপর কিভাবে ভাইকে আপ্যায়ন করা যায় সেটাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

এদিকে বাবার দিকে তাকিয়ে সাকির বলল,কী বাবা!আপনাকে আমি আগে বলেছিলাম না,চাচা আমাদেরকে দেখে অনেক খুশি হবেন।এখন তো তা বাস্তবেই দেখতে পাচ্ছেন।

–হ্যাঁ, বাবা! তুমি যেমন তোমার চাচার প্রতি সু-ধারণা রেখেছিলো তেমন আজ তার বাস্তব ফলও পেয়েছি।তোমাকে আল্লাহ নেক হায়াত দান করুন, বাবা। তোমার উসিলায়ই তো এতো কিছু হলো।

–আমার জন্য দোয়া করবেন, বাবা। এগুলো সবই আল্লাহর দয়া।

অবশেষে বাবা-চাচাকে মিল করাতে পেরে সাকির মহান আল্লাহর দরবারে মনে খোলে বলল,সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তা’য়ালার। আলহামদুলিল্লাহ!বাসায় ফিরে আল্লাহর কাছে শুকরিয়াস্বরুপ দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করার মনস্থির করে রাখলো।

কিছু কথাঃ

গল্প শেষ হল বটে কিন্তু আমাদের শিখার অনেক কিছুই থাকলো।এক সাকিরের এমন কিছু কথাই যদি একটি আপন সম্পর্ককে আবার জোরা লাগাতে পারে।তবে আমরা কেনো আমাদের সাথে বিচ্ছিন্ন থাকা আপন সম্পর্কগুলোকে জোরা লাগাতে পারবো না!নিশ্চয়ই পারবো।কেবল প্রয়োজন নিজের আন্তরিক ইচ্ছা।আমরা চাইলেই আমাদের মা-বাবা অথবা যাদের সাথে এরকম সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে তাদেরকে বোঝানোর দায়িত্ব নিতে পারি।সাকিরের মতো বিনয়ের সাথে কোরআন হাদীসের বাণীর পাশাপাশি নীতিকথা শুনিয়ে দ্বন্দ্বের আগুনে জল ঢালতে পারি।আর শুরুতেই সফল হবো কী হবো না এমন চিন্তা মাথায় না এনে অন্তত নিজের স্থান থেকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করে যেতে পারি।

এখন আমরা নিজেরাই যদি হিংসুটে মনোভাব নিয়ে বসে থাকি তবে কিভাবে হবে!অবশ্য এই মনোভাব পরিবর্তনের জন্য দ্বীনের সংস্পর্শে থাকা প্রয়োজন।কেননা একজন মানুষ দ্বীনের সংস্পর্শে থাকলে মহান রাব্বুল আলামিনকে চিনতে শিখে, আল্লাহর দেওয়া হুকুম-আহকাম মানতে শিখে। তখন আত্নীয়ের হক তথা মানুষের হক সম্পর্কেও সচেতন থাকে।ফলে তখন আর মনের মধ্যে হিংসা অহংকার ইত্যাদি এগুলোর কিছুই ঠাঁই পায় না। কেবল ঠাঁই পায় তাকওয়া।আর তাকওয়াই মানুষকে সর্বোচ্চ সফলতায় পৌঁছে দেয়।

লিখেছেন

পরকালীন তথা স্থায়ী জীবনের লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। নিজে হেদায়েতের ওপর অটল থাকার পাশাপাশি অন্যেদেরকেও হেদায়েতের দিকে আহবান করা তথা পথ হারাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই আমার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture