Writing

আমার ছোট্ট ঘরে

Table of Contents

আমার প্রথম কন্যাটা যেদিন হঠাৎ করে মারা যায় সেদিন আমি মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেন জানি আমার কান্না আসছিল না। মনে হচ্ছিল বুক বরাবর তীরের মতো কিছু একটা বিঁধে গেছে। ভীষণ রকমের ব্যথা লাগতে লাগলো। কাঁদতে পারলে হয়তো কিছুটা হালকা হয়ে যেত, কিন্তু কান্নারা সেদিন আমার থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আমি শক্ত কাঠের মতো অনেক্ষণ সময় শুধু মাটিতে গড়াগড়ি করেই পার করলাম। কাঁদতে পারলাম না। সবাই তখন বলছিল— সিয়াম ছেলেটা বোধহয় মেয়ের শোকে পাগল হয়ে যাবে।

ভারসাম্যহীন ছিলাম বলে কাফন দাফনের কোন কিছুতেই আমাকে শরিক করা হলো না। জানাযাটা পড়েছিলাম দুজনের ওপর ভর করে। সেদিন আমার কথা ছিল একটাই— আমার মায়াকে এনে দাও।

মায়ার আম্মুর অবস্থা ছিল আমার চেয়েও ভারি সূচনীয়। একমাত্র কন্যার মৃত্যু। তাও মাত্র দুই বছর বয়সে মায়া অনেকটা ফুটফুটে হয়েছিল। দেখে মনে হতো যেন চার পাঁচ বছরের বাচ্চা। কতো সুন্দর করে আম্মা, পাপা, দাদা, দাদু সবাইকে ডাকতো। দাদুর জন্য কিছু নিয়ে এলে তার হাতে দিতে হত। তারপর সে দৌড়ে গিয়ে দাদুর হাতে দিয়ে আসতো।

আম্মু কখনো বকা দিলে আমার কাছে ঠিক ঠিক নালিশ করে বলতো, ‘পাপা, আমাল আম্মা পতা, আম্মাকে তুমি বাজালে লাইখা আসো। যাতে আমাকে আল না মালে।
মায়ার সেই ঠোঁট ভাঙা কথাগুলো শুনে আমরা তখন দু’জনই হাসতাম।

এমন মেয়ের বিচ্ছেদে কোন পাষণ্ড মা’ও নিজেকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারার কথা না। মেহেরজান ও নিজেকে ঠিক রাখতে পারে নি। পারলে যেন সেও মেয়ের সাথে কবরে চলে যায়।

দু’দিন পর। আম্মু আমাকে অনেক জোরাজোরি করে খাবার টেবিলে বসিয়েছেন। আমি না খেলে তিনিও খাবেন না, তাই রাজি না হয়ে পারিনি। কিন্তু আমার মুখে খাবার যাচ্ছিল না। অনেক কষ্টে অল্প ক’টা ভাত মুখে দিলাম। দেখলাম আম্মু মেহেরজানকেও খাবার খেতে জোরাজোরি করে ব্যর্থ হলেন।

আনন্দ এবং ভালোবাসায় ভরপুর একটা সংসার হঠাৎ করেই নিরব হয়ে গেল। পুরো ঘরের কোথাও কোন হাসি নেই। নেই কোন দাদা নাতনির লুকোচুরি খেলা। সবটাই যেন শ্মশানে পরিণত হয়ে গেছে প্রায়। এভাবে চলে গেল প্রায় দশ বারোটি দিন। কারো মন থেকে মায়ার স্মৃতিগুলো সরতে চাচ্ছে না। মায়ার বিচ্ছেদে সবাই কাতর। বাবাকেও আজকাল বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখি বেশিরভাগ সময়।

এক চাঁদনি রাতে মেহেরজানকে নিয়ে ছাদের কোণে বেঞ্চিতে বসে জোছনা দেখছিলাম। মায়া চলে গেছে প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল। আকাশে অগণিত তারকা। মাঝখানটাতে ঝকঝকে চাঁদ। কি অপরূপ দৃশ্যের খেলা চলছে আকাশে। উপভোগ করছিলাম দুজনেই। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে মেহেরজান কোমল স্বরে জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলে ওঠলো..
“সিয়াম
“হুম
“চলো না আমরা আরেকটা বাচ্চা নেই?
কিছুটা অবাক হলাম আমি। মেহেরজানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

“কি কথা ছিল?
“কথা তো ছিল মায়ার সাত বছর হওয়ার আগ পর্যন্ত আর বাচ্চা নিব না। কিন্তু এখন তো আর মায়া নেই।
“আবার যদি একই ঘটনা ঘটে?
” মানে?

“ধরো আমরা আরেকটা বাচ্চা নিলাম। তারপর তুমি আবদার করবে সাত বছরের মধ্যে আর বাচ্চা নিবে না। ‘আল্লাহ না করুন’ এই বাচ্চার বয়স সাত হওয়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা তাকেও নিয়ে নিলেন। তখন কি আবার তুমি বলবে না যে, ‘চলো আমরা আরেকটা বাচ্চা নেই?
“তুমি এভাবে কথা বলছো কেন সিয়াম?
দু’জনে মিলেই তো আমরা সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলাম।

“মেহেরজান সিদ্ধান্তটা দু’জনে নিলেও আবদার তোমারই ছিল। আর আমি তোমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে কখনোও জোরাজোরি করবো না। তাই তুমি যা চেয়েছিলে, আমি তাতেই রাজি হয়েছিলাম।

” আমি তো ভালোর জন্যই বলেছিলাম। আমার চাচাতো বোনটার কথা তো জানো। লাগাতার চার চারটা বাচ্চা নিয়ে সংসারের কি অবস্থা করেছে। সবসময় বাচ্চাকাচ্চার মধ্যে অসুখ বিসুখ লেগে আছে। তাছাড়া কোথাও গিয়ে একটু সময়ের জন্য বেড়াতেও পারে না। এই জন্য আমি ভেবেছিলাম আমার একটা বাচ্চা থেকে আরেকটা বাচ্চার বয়সের দূরত্ব হবে সাত বছর। যেন নিজে নিজে সবকিছু করতে পারে। আর দু’জনের বেশি সন্তান নিব না। এতে ফ্যামিলি পরিপাটি থাকে। ঝামেলা থাকে কম।

কথাগুলো বলে মেহেরজান থামলো। কিছুক্ষণ সময় নিরবতা বয়ে গেল। মেহেরজান চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু কি ভাবছে? কে জানে।

আমি বলতে লাগলাম..

“শুনো মেহেরজান। আল্লাহ তায়ালা কোন মানুষকে রিযিক ছাড়া পাঠান না। সবার রিযিক আলাদা আলাদা। এমনকি অনেক সময় পরিবারে নতুন অতিথি এলে সেই পরিবারে আল্লাহ তায়ালা বারাকাহ বাড়িয়ে দেন। অসুস্থতা কোন অকল্যাণ নয়। এগুলোও আল্লাহ তায়ালার নেয়ামাহ। সন্তানের অসুস্থতার দ্বারা পিতা মাতার গুনাহ মাফ করা হয়।

আর সন্তান কখনই ঝামেলা বাড়ায় না। দুনিয়াতে অনেক মানুষ আছে যারা একটা বাচ্চার জন্য হাহাকার করে। কতো কান্নাকাটি করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে বাচ্চা দেন না। পরিবারে যদি বাচ্চা না থাকে সেখানে সুখ শান্তি থাকে না। সবকিছুতেই বিষাদ আর অসহায় লাগে। যেমনটা গত দেড় মাস আমরা ফেস করে আসছি।

আচ্ছা মেহেরজান, আজকে যদি আমাদের আরেকটা বাচ্চা থাকতো তাহলে আমরা কি এতটা নিঃস্ব হতাম? মায়ার জন্য কষ্ট হতো ঠিক, কিন্তু চোখ জুড়ানোর জন্য আরেকটা জায়গাও তো খুঁজে পেতাম। বলো পেতাম না?

‘মেহেরজান কাঁদছে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে এখন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। আমি জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, ‘কেঁদোনা, আল্লাহ তায়ালা সবকিছু ঠিক করে দিবেন।

অনেক্ষণ ধরে কলিং বেল বাজছে। ঘরের সবাই বোধহয় ব্যস্ত। ওঠে গিয়ে দরজা খুলে আশ্চর্য হলাম। একটা মহিলা কোলে দুই তিন মাসের বাচ্চা নিয়ে দাঁড়ানো। দরজা খুলার সাথে সাথেই বাচ্চাটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো

-সাহেব আমার বাচ্চাটারে বাচান। কয়েকজন মানুষ ওরে নিবার লাইগা আমার পিছনে লাগছে। একটু সময় আপনার বাসায় রাখেন, বিকালে আইসা আমি নিয়া যামু।

কাঁদো কাঁদো গলায় কথাগুলো বলে মহিলাটা দ্রুত চলে গেল। আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলো না।

বাচ্চা নিয়ে রুমে ডুকতে দেখে সবাই আমার দিকে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেসু দৃষ্টি সবার। আমি মেহেরজানের দিকে বাচ্চাটা এগিয়ে দিয়ে বললাম ‘বাচ্চাটা ধরো, আমি সব বলছি। তারপর সবকিছু খুলে বললাম।

মেহেরজান বাদে সবার ভিতরে উত্তেজনা কাজ করছে। সবচেয়ে বেশি আমার। এটা কোন পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হয় কি-না কে জানে। আর ষড়যন্ত্রই বা কে করবে। নাকি কোন বিপদ ডাকছে আমাকে। আমার কিছুটা ভয় লাগতে লাগলো। মনে মনে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে শুরু করলাম।

মেহেরজান বাচ্চা পেয়ে যেন আনন্দে আটখানা। একেকবার একেকটা খেলনা বের করে দিচ্ছে। সবগুলো মায়ার খেলনা। মনে হচ্ছে মায়া যেন মায়ের কোলে আবার ফিরে এসেছে। মেহেরজানের ছুটাছুটি দেখে বুঝা যাচ্ছে এই মুহূর্তে সে কতটা খুশি। ফ্রিজ থেকে দুধ বের করে গরম করে বাচ্চাকে খাওয়াতে লাগলো। ঠিক মায়াকে যেভাবে খাওয়াতো। মায়ার কথা মনে পড়তেই

আমার চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়ল। কিন্তু মেহেরজান খুব হাসিখুশি। তার চেহারায় কোন কষ্টের চাপ নেই।
বিকেলে মহিলাটা আবার আসলো। বললো পাশের বস্তিতেই তারা থাকে।
আমি বললাম ‘ তখন বাচ্চা রেখে এভাবে চলে গেলেন কেন?
“রাইখা গেছি বইলাই তো আমার বাজানডারে পাইছি। নাহইলে তো এতক্ষণে ওরা নিয়া যাইতো।
” কারা নিয়ে যাবে আপনার বাচ্চা?

“স্যার আমার স্বামী ভালা মানুষ না। এই বাচ্চাডারে সে বিক্রি কইরা দিতে চাইছিল। আমি দেইনাই বইলা গোপনে বিক্রি করছে। যাদের কাছে বিক্রি করছে আজকে সকালবেলা তারা আসছিল বাচ্চা নিতে। তারপর আমি নিয়া পালায়া আইছি।
“আপনার স্বামী বাচ্চা বিক্রি করছে কীজন্য?
” আমগো আরো তিনটা ছেলে আছে। এইটা মেয়ে হয়নাই বইলা বিক্রি করে দিছে। আচ্ছা আপনারাই কন তো, নিজের বাচ্চা যেমনই হোক এটা কি বিক্রি করার তো জিনিস?

মহিলার কথায় আমরা কেউ কিছু বলতে পারলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম
“এখন বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবেন?
” বাড়িতেই। এছাড়া আর কই যামু।
“আবার যদি নিতে আসে?

“আল্লার কাছে কমু। আল্লায় যেডা ভালো মনে করে হেইডাই হইবো। তবে মনে মনে ভাবছি— এহন কেউ আইলে দাঁ নিয়া খাড়ামু। যা করে আল্লাহই করবো।

বাচ্চা নিয়ে মহিলাটা চলে গেলেন। মা-বাবা দু’জনেই বলছিলেন— নিজের বাচ্চাকে বিক্রি করে দেয়, এমন পাষাণ মানুষও থাকতে পারে? ছিঃ ছিঃ

অর্ধরাত্রি পর্যন্ত মেহেরজান কান্না করে পার করলো। অনেকবার জিজ্ঞেস করেছি ‘কি হয়েছে, কেন কাঁদছো?

কিন্তু কোন উত্তর করেনি সে।
রাত প্রায় বারোটা। মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে আরো আগেই। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হঠাৎ পায়ের ওপর কারো স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকালাম। দেখি মেহেরজান আমার পা ধরে কান্না করছে।

আমি ওঠে বসলাম। মেহেরজানকে কাছে এনে চোখগুলো মুছে দিয়ে বললাম ‘কি হয়েছে বলো তো শুনি?
মেহেরজান কাঁদতে কাঁদতে বললো
“আমাকে তুমি মাফ করে দাও।

“তোমার অপরাধ থাকলে না মাফ করবো পাগলী। তোমার তো কোন অপরাধ নেই। তাহলে কিভাবে মাফ করবো?
” অবশ্যই আছে। আমার ভুলের কারণেই আজকে আমাদের কোল শুন্য। প্লিজ সিয়াম আমাকে মাফ করে দাও।
আমি মেহেরজানকে জড়িয়ে ধরে বললাম

“আমি তোমার প্রতি অনেক খুশি যে তুমি সঠিকটা বুঝতে পেরেছ। আলহামদুলিল্লাহ।

“তাহলে চলো না আমরা আরেকটা বাচ্চা নেই?
” তাই?
মেহেরজান লজ্জায় চোখদুটো বন্ধ করে বললো
“হুম।

বারান্দার বাইরে দাঁড়িয়ে আল্লাহ আল্লাহ ডাকছি। ভিতরে ভীষণভাবে ভয় কাজ করছে। কারণ ঘরে নতুন অতিথি আগমনের সময় ঘনিয়েছে। এ সময়টা সব বাবাদের জন্যই ভয়ের। কারণ প্রত্যেকটা মায়ের চিন্তা থাকে— আমি মরে গেলে মরে গেলাম, কিন্তু আমার সন্তানটা যেন বেঁচে থাকে। আর প্রত্যেকটা বাবার চিন্তা হলো— দুজনেই যেন বেঁচে থাকে। দুজনের একজনকে হারালেও বাবার প্রচণ্ড কষ্ট হয়। এই ভয়ের এখন চরম মুহূর্ত চলছে আমার।

একটু পর ভিতর থেকে মা বেড়িয়ে এলেন। মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে মা অনেক খুশি। বললেন ‘সিয়াম, বাবা তোর জমজ দুইটা পুলা হইছে।

কথাটা শোনার সাথে সাথে আলহামদুলিল্লাহ বলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো আমার। খুশির ছুটে চোখ থেকে দু’ফোটা পানি বেড়িয়ে এলো। ভিতরে গিয়ে দু’জনের কানে আজান এক্বামাত দিয়ে মেহেরজানের পাশে বসতেই একজন কান্না শুরু করে দিলেন। আমি ওনাকে থামাতে চাইলাম। আব্বু আব্বু বললাম, কিন্তু কোন কাজ হলো না। তারপর মেহেরজানের কোলের কাছে রাখতেই কান্না বন্ধ হয়ে গেল।

মেহেরজান আমাকে টিটকারি দিয়ে বললো

“দেখলে, আব্বুটা শুধু আমাকেই চিনে, তোমাকে চিনে না। কেন বলো তো?
” কেন?
“আব্বুটাকে আমি চেয়ে নিয়েছি যে।

লিখেছেন

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture