Writing

উম্মে আইমান – বারাকা বিনতে সা’লাবা (রা:)

আজ আপনাদের এমন এক মহীয়সী নারীর গল্প বলবো যিনি রাসুলের (সা:) জন্মের মুহূর্ত থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর সাথে ছিলেন। এই বিশেষ সম্মানের দাবিদার উম্মে আইমান ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না। খাদিজা (রা:) রাসূলকে (সা:) জেনেছেন রাসুলের (সা:) বিশের কোঠায়, আয়েশা (রা:) রাসূলকে (সা:) জেনেছেন তার প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতে। এই সম্মানিতা নারী, উম্মে আইমান, রাসুলের (সা:) জন্মের সময় তাকে কোলে নিয়েছেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে ছিলেন, এমনকি তার মৃত্যুর পরেও তিনি বেঁচে ছিলেন।

রাসুলের (সা:) জন্মের প্রায় ১৩ বছর আগে ৫৫৭ সালের দিকে উম্মে আইমান জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আবিসিনিয়ার বাসিন্দা ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন আবিসিনিয়ার একজন দাসী ছিলেন। জাহিলিয়াতের যুগে সুক আল-উকাদে একটি বাজার ছিল যেখানে দাস বেচাকেনা হতো। এটা ছিল মক্কার একটি বিখ্যাত বাজার। উম্মে আইমান যখন খুব ছোট ছিলেন তখন রাসুলের (সা:) পিতা আবদুল্লাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব তাকে ক্রয় করেছিলেন এবং তিনিই ছিলেন একমাত্র দাসী যাকে সেই পরিবারে আনা হয়েছিল।

রাসুলের (সা:) পরিবারে তখন আবদুল্লাহ, তার স্ত্রী আমিনা বিনতে ওহাব এবং এই ছোট্ট মেয়ে- বারাকা বিনতে সা’লাবা (রা:) ছিলেন। এই ছোট্ট বারাকাই হলেন উম্মে আইমান। বিয়ের পরে রাসূলের (সা:) পিতা আবদুল্লাহ সিরিয়া অর্থাৎ আশ-শামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। তৎকালীন মক্কায় দুটি বাণিজ্য পথ ছিল: শীতকালে ইয়েমেন এবং গ্রীষ্মকালে সিরিয়া।

আবদুল্লাহ যখন শাম রাজ্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তখন তিনি জানতেন না যে তার স্ত্রী আমিনা গর্ভবতী। এর কয়েক মাস পর আমিনা একটি স্বপ্ন দেখলেন। স্বপ্নে তিনি তার পেট থেকে একটি আলো বের হতে দেখলেন যা মক্কার পাহাড় এবং উপত্যকাগুলি থেকে শুরু করে শাম রাজ্য পর্যন্ত আলোকিত করে তুলেছিল। তিনি তার হাবশী দাসী বারাকাকে এই স্বপ্নের কথা বললেন এবং এ ব্যাপারে সে কি ভাবছে তা জানতে চাইলেন।
বারাকা বললেন,
“আশা করি এটি আশীর্বাদ প্রাপ্ত এক সন্তানের সুসংবাদ। আমি তো কেবল এটাই ভাবছি।”

উম্মে আয়মান লক্ষ্য করলেন যে আমিনা আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, তাই তিনি ধারণা করলেন যে এটি গর্ভাবস্থার লক্ষণ। তিনি যা ধারণা করেছিলেন তাই সত্যি হলো, আসলেই আমিনা তখন গর্ভবতী ছিলেন।
গর্ভবতী অবস্থায় আমিনা কয়েক মাস বিছানায় শুয়ে কাটালেন। তার স্বামী আবদুল্লাহর প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রতি মুহূর্তে তিনি ব্যাকুল হয়ে থাকতেন। আব্দুল্লাহর কোন খবর আছে কিনা জানার জন্য তিনি প্রতিদিন বারাকাকে এমন জায়গায় পাঠাতেন যেখানে আশ-শাম থেকে লোকেরা ফিরে আসে।

বারাকা আমিনার সাথে সময় কাটাতেন এবং আবিসিনিয়ার গল্প শুনিয়ে তিনি তাকে আনন্দ দিতেন। প্রতিদিন তিনি আবদুল্লাহর ফিরে আসার খোঁজে বেরিয়ে পড়তেন। অবশেষে, তাকে বলা হল যারা আশ-শাম গিয়েছিল তারা সবাই ফিরে এসেছে, কিন্তু আবদুল্লাহ কাফেলা নিয়ে ফিরে আসেনি, অর্থাৎ রাসুলের (সা:) পিতা আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করেছেন।

আমিনার স্বামী আবদুল্লাহ যে আশ-শামে বাণিজ্য পথে মারা গেছেন সেই সংবাদ দেওয়ার দায়িত্ব বালিকা বারাকার উপর ন্যস্ত হয়েছিল। তিনি সেই কঠিন সময়ে আমাদের রাসূলের (সা:) মাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আমিনার গর্ভাবস্থায় সার্বক্ষণের সাথী ছিলেন তিনি। যেদিন মুহাম্মদের (সা:) জন্ম হলো সেদিন আমিনার সাথে ঘরে একমাত্র বারাকা নামের এই অল্পবয়সী মেয়েটিই ছিল।

উম্মে আইমান অর্থাৎ এই ছোট্ট বারাকা প্রথম রাসুলকে (সা:) কোলে নিয়েছিলেন। তিনি বলেন,
“রাসুলের জন্মের সময় আমি একটি নূর দেখতে পেলাম যা পুরো ঘরকে আলোকিত করেছিল, আমি তখন বললাম এই হল আপনার স্বপ্নের ব্যাখ্যা।”

তিনি নবী রাসূলকে (সা:) প্রথম কোলে নিয়েছিলেন, তাকে পরিষ্কার করেছিলেন এবং তার মা- আমিনা বিনতে ওহাবের কোলে দিয়েছিলেন।

আমিনা বিনতে ওহাব কিভাবে ইন্তেকাল করেছেন সে সম্পর্কে বিভিন্ন বর্ণনা রয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে তিনি তার স্বামীর কবর যিয়ারত করতে যাওয়ার পথে ইন্তেকাল করেন।
রাসুলের (সা:) জন্মের সময় বারাকা উপস্থিত ছিলেন, এবার রাসুলের (সা:) উপস্থিতিতে তার মা আমিনার মৃত্যুর সময়ও তিনি তার সাথী হলেন।

রাসুল (সা:) তখন ৬ বছরের ছোট বালক, তিনি কখনো তার পিতা আব্দুল্লাহকে দেখেননি, কারণ তার জন্মের আগেই তার পিতা গত হয়েছেন। এবার তিনি তার মায়ের মৃত্যু দেখলেন। আমিনা ফিসফিস করে বারাকাকে বললেন,
“আমি এখন মারা যাচ্ছি, তুমি মায়ের মতো তার যত্ন নিও এবং নিশ্চিত করো যে এর চেয়ে বেশি দুঃখ সে যেন জীবনে না পায়।”
আমিনার মৃত্যুর সময় বারাকার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর এবং তিনিই একমাত্র মহিলা যাকে রাসূল (সাঃ) মাতৃরূপে চিনতেন। আমিনার মৃত্যুর পর রাসুলের (সা:) দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার দায়িত্ব নিলেন। কিন্তু তিনিও রাসূলের (সা:) মাত্র নয় বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এবারও, বারাকা রাসুলের (সা:) দাদার মৃত্যুতে তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং সারা জীবন তার সাথেই কাটিয়ে দিলেন।

বস্তুত রাসূল (সা:) বারাকাকে (রা:) উত্তরাধিকার সূত্রে দাসী হিসাবে পেয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি তাকে মুক্ত করে দিয়েছিলেন। রাসুল (সা:) যখন খাদিজাকে (রা:) বিয়ে করেন, তখন তিনি বারাকাকে (রা:) খাদিজার (রা:) সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে,
আমার নিজের মায়ের পরে তিনি আমার আরেক মা।”

রাসূল (সা:) সবসময় তাকে এভাবেই সম্বোধন করতেন, যা ইঙ্গিত করে বারাকা (রা:) কেবল একজন দাসী ছিলেন না, বরং আমাদের রাসূলের (সা:) কাছে তিনি ছিলেন এক সম্মানিতা ব্যক্তিত্ব।

এতটাকাল বারাকা (রা:) কিন্তু বিয়ে করেননি রাসূলের প্রতি তার নিষ্ঠার কারণে। তিনি রাসূলের (সা:) যত্ন নিয়েছেন, তার সেবা করেছেন। রাসুল (সা:) নিজের বিয়ের পর বারাকাকে বললেন,
“আমি তো বিয়ে করেছি, এবার আপনিও নিজের বিয়ের কথা ভাবুন।”
উত্তরে বারাকা বলেছিলেন, কখনোই না,
“ইয়া রাসুলুল্লাহ আমি আপনার সাথে এবং খাদিজার (রা:) সাথেই থাকব।”

এবার রাসুল (সা:) বললেন,
“আপনি তো আমার জন্য আপনার যৌবনের মূল্যবান সময় বিসর্জন দিয়েছেন, আমার সেবা-যত্ন করেছেন, এখন আপনার উচিত বিয়ে করে আপনার নিজের জীবন শুরু করা।”
বারাকা (রা:) ছিলেন তখন মুক্ত, তিনি কারো দাস বা সম্পত্তি ছিলেন না, এছাড়া রাসুলের (সা:) সাথে থাকার জন্য তিনি বাধ্য ছিলেন না। এরপরও তিনি রাসুলের (সা:) সাথে থাকার জন্য জোরাজুরি করতে লাগলেন।

খাদিজা (রা:) আরও জোর দিয়ে বললেন,
“আমি আপনার বিয়ের জন্য সেরা পুরুষদের প্রস্তাব নিয়ে আসব এবং আপনার বিয়ের সমস্ত খরচ আমি বহন করব।” খাদিজা (রা:) দরিদ্র মহিলাদের বিয়ের এবং মোহরের খরচ বহন করতেন। বারাকা (রা:) তখন খুব সুন্দর একটি কথা বলেছিলেন:
“আমি কখনও তাকে ছেড়ে যাইনি এবং সে কখনও আমাকে ছেড়ে যায়নি। আমি সর্বদা তার পাশে ছিলাম।”

তাদের পীড়াপীড়িতে বারাকা ( রা:) বিয়ে করতে রাজি হন। খাদিজা (রা:) মদীনার আল-খাজরাজ গোত্রের উবাইদ ইবনে যায়েদ নামের এক লোকের সাথে বারাকার বিয়ের প্রস্তাব আনেন এবং তাদের বিয়েও হয়। ইসলামের পূর্বে অর্থাৎ রাসুলের (সা:) ওহী প্রাপ্তির আগেই তাদের বিয়ে হয়েছিল। উবাইদের সাথে বারাকার একটি পুত্র হয় যার নাম আইমান। এজন্যই তাকে উম্মে আইমান নামে ডাকা হয় যার অর্থ আইমানের মা।

আয়মান (রা:) ইসলামকে দেখার, বিশ্বাস করার এবং শহীদ হিসেবে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক অর্জন করেছিলেন। তবে, বারাকার (রা:) স্বামী ইসলামের পূর্বেই মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর পর বারাকা (রা:) আবারও রাসূল (সা:) এবং খাদিজার (রা:) সংসারে ফিরে আসলেন।

ওহী লাভের পর রাসূল (সা:) সর্বপ্রথম খাদীজার (রা:) কাছে ছুটে এসেছিলেন এবং তার কাছে সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, পরিবারের সকল সদস্য এই পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলের (সা:) উপর ঈমান আনার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় মহিলা ছিলেন উম্মে আইমান (রা:)। রাসুলের (সা:) বার্তা শোনার সাথে সাথেই তিনি তার প্রতি ঈমান আনেন। যারা রাসূলকে (সা:) ভালোবাসতেন এবং তার চরিত্র সম্পর্কে জানতেন, তাদের সবার মত তিনিও তাকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলেন।

রাসূল (সা:) লক্ষ্য করলেন যে আইমানের জননী বিধবা উম্মে আইমানের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে তিনি বলেছিলেন,
“যে ব্যক্তি কোন জান্নাতী নারীকে বিয়ে করতে চায়, সে যেন উম্মে আয়মানকে বিয়ে করে।”

উম্মে আইমানের অজানা বংশ, সম্পদের অভাব, বয়স এবং বৈধব্য সত্ত্বেও, রাসুল (সা:) তাকে জান্নাতনারী হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।

ধারণা করুন তো কে স্বেচ্ছায় উম্মে আইমানকে বিয়ে করেছিলেন?
যায়েদ ইবনে হারিসা (রা:), যিনি ছিলেন তার থেকে ২০ বছরের ছোট। তিনি বলেছিলেন,
“যদি তিনি জান্নাতনারী হন, তাহলে আমি তাকে বিয়ে করতে চাই, কারণ তিনি জান্নাতি হলে আমিও জান্নাতী হবো।” রাসুলের (সা:) ওহী প্রাপ্তির পরে তাদের বিয়ে হয়েছিল। তাদের সংসারে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান- উসামা ইবনে যায়েদ (রা:), যিনি রাসূলের মৃত্যুর সময় ১৭ বছর বয়সে উপনীত হয়েছিলেন।

যায়েদের (রা:) পটভূমিও প্রায় একই রকম, কারণ তাকেও একই বাজার থেকে কিনেছিলন হাকিম ইবনে হেজাম এবং পরে তিনি তাকে হস্তান্তর করেন তার ফুফু খাদিজার (রা:) কাছে। আর খাদিজা (রা:) পরবর্তীকালে তাকে উপহার হিসেবে দান করেন রাসূলকে (সা:)। রাসূল (সাঃ) তাকে মুক্ত করেন এবং পালক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।

অন্যদিকে, উম্মে আইমান (রা:) ছিলেন রাসুলের (সা:) মায়ের মত। সুবহানাল্লাহ, সন্তান ধারণের বয়স পেরিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও তাদের বিয়ে হয়েছিল। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাদের একটি পুত্র সন্তান দান করেছিলেন যার নাম উসামা ইবনে যায়েদ। তিনি পরিচিত ছিলেন হিব্বু রাসূলিল্লাহ ইবনে হিব্বি রাসুলিল্লাহ অর্থাৎ রাসুলের (সা:) প্রিয়জনের পুত্র রাসূলের (সা:) প্রিয়জন। সুবহানাল্লাহ, বাবা এবং পুত্র দুজনই ছিলেন রাসুলের (সা:) প্রিয়জন

তাদের গল্পটি সত্যিই অনন্য। দুজনেই অসাধারণ উপায়ে রাসুলের (সা:) জীবনে এসেছিলেন। তাদের পুত্র, উসামা ইবনে যায়েদকে রাসূল (সা:) খুব ভালোবাসতেন। শৈশবে উসামা রাসুলের (সা:) পিঠে চড়তেন এবং হাসান, হুসাইন, জয়নব এবং উমামার (রা:) সাথে তিনিও তার কোলে বসতেন।

রাসুল (সা:) নির্দেশ দিয়েছিলেন তার মৃত্যুর পরে উসামাকে (রা:) যেন মুসলিম সেনাবাহিনীর সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এ প্রসঙ্গে কিছু সাহাবীর আপত্তি ছিল এই কারণে যে একজন যুবক কিভাবে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবে। কিন্তু রাসুল (সা:) বিশ্বাস করেছিলেন তার পিতার মতো উসামাও (রা:) এই দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন, উসামা (রা:) ছিলেন বারাকা (উম্মে আইমান) এবং যায়েদ ইবনে হারিসা (রা:) এর পুত্র।

উম্মে আইমান (রা:) হিজরত করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে এবং হিজরতের সেই যাত্রা ছিল তার জন্য খুবই কঠিন। একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় তার জীবনে ঘটে যাওয়া কিছু অলৌকিক ঘটনার পরিচয় মিলে যা তার পরবর্তী জীবনেও প্রভাব ফেলেছিল। রাসূলের (সা:) হিজরতের সময় তার বয়স ছিল ৭০ এর কাছাকাছি। যাত্রাপথে তিনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন যেখানে পান করার জন্য কোন পানি তিনি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার কাছে মনে হচ্ছিল তৃষ্ণায় বুঝি তিনি মারা যাবেন। রাসুলের (সা:) জীবনেও এরকম ঘটনা ঘটেছিল। এক যাত্রাপথে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় উম্মে মা’বাদের বাড়িতে তিনি অলৌকিকভাবে তৃষ্ণা নিবারণ করেছিলেন।

উম্মে আইমানও (রা:) একই রকম অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তিনি বর্ণনা করেছেন সেই দিনের কথা। তিনি ছিলেন অসম্ভব তৃষ্ণার্ত, এভাবে দিন গড়িয়ে সূর্য অস্ত যায়। তখন তিনি আকাশ থেকে তার মাথার উপর একটি বালতি নেমে আসতে দেখেন, বালতিটি ছিল একটি দড়ি দিয়ে বাধা যার উপরিভাগ তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, “ওয়াল্লাহি, আমি সেই বালতি থেকে পানি নিলাম, তা থেকে পানি পান করলাম, বালতির ভিতরে তখনও পানি ছিল। তৃষ্ণা মেটানোর পর বাকি পানি আমি আমার শরীরে ঢেলে দিলাম যাতে আমি ঠান্ডা হতে পারি।”

উম্মে আইমান (রা:) বলতেন,
সেদিনের পর থেকে তিনি সবচেয়ে গরম দিনেও রোজা রাখতেন, সূর্যের নীচে তাওয়াফ করতেন এবং সারা জীবনে তিনি আর কখনও পিপাসার্ত হননি। রোজা তার জন্য সবচেয়ে সহজ ইবাদত হয়ে ওঠে, কারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তাকে আল্লাহর রাসূলের (সা:) পথে সেই কঠিন যাত্রায় আকাশ থেকে পানি সরবরাহ করেছিলেন।

যখন তিনি মদিনায় পৌঁছালেন, তখন তাঁর পা ফুলে গিয়েছিল এবং মুখমণ্ডল ছিল ধুলোয় ধূসরিত। রাসূলুল্লাহ (সা:) তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
হে আমার মা, নিশ্চয়ই আপনার জন্য জান্নাতে একটি স্থান রয়েছে।” এভাবে দ্বিতীয়বার নবী (সা:) তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন।

উম্মে আইমান রাসুলের (সা:) প্রতিটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। যুদ্ধে তিনি রাসুলুল্লাহকে (সা:) অনুসরণ করতেন। আনাস (রা:) বলেন যে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতেন, মায়ের মতো রাসুলের (সা:) দিকে নজর রাখতেন যাতে তিনি আহত না হন। যুদ্ধের পর তিনি আহতদের যত্ন নিতেন, সাধ্যমত নিজের কাপড় দিয়ে তাদেরকে ব্যান্ডেজ করতেন।

উহুদের যুদ্ধে যারা তরবারি হাতে নিয়ে রাসূলকে (সা:) রক্ষা করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। এই যুদ্ধে অনেকেই রাসূলকে (সা:) রেখে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু রাসুলের (সা:) মাতৃসম এই মহীয়সী নারী যুদ্ধের সময় কেবল তার পাশেই ছিলেন না, বরং তাকে রক্ষা করার জন্য তরবারিও ধরেছিলেন।

উম্মে আইমানের জীবন রাসূলের (সা:) জীবনের সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিল। যখন রাসুল (সা:) উম্মে আইমানকে (রা:) দেখতেন তিনি বলতেন, “এটাই আমার পরিবারের অবশিষ্ট সমগ্র।” তিনিই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি সারা জীবন রাসুলের (সা:) সাথে ছিলেন।

রাসূল (সা:) প্রতিদিন উম্মে আয়মানকে দেখতে যেতেন, এবং এই দেখা-সাক্ষাতের এক পর্যায়ে তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “হে আমার মা, আপনি কেমন আছেন?” তার উত্তরটা একবার শুনুন: তিনি বললেন, “যতক্ষণ ইসলাম ভালো, আমি ভালো, যতক্ষণ আপনার বার্তা সুরক্ষিত, আমিও ঠিক আছি।” সুবহানাল্লাহ, খুব সুন্দর কথা! এই কথায় রাসূলের (সা:) এবং তার উদ্দেশ্যের প্রতি উম্মে আইমানের নিষ্ঠার পরিচয় ফুটে ওঠে।

এমনকি উম্মে আইমানের বয়স যখন ৭০ এর কোঠায় তখনও তিনি রাসূলের (সা:) কাছে তার শারীরিক অসুবিধা ও অসুস্থতার কোন অভিযোগ করেননি, মক্কার জন্য ব্যক্ত করেননি কোন ব্যাকুলতা। তিনি রাসূলকে (সা:) আশ্বস্ত করেছিলেন যতক্ষণ ইসলাম সমৃদ্ধ থাকবে ততক্ষণ তিনিও সন্তুষ্ট থাকবেন। তার কথায় রাসূল (সা:) সান্ত্বনা খুঁজে পেতেন, কারণ তিনি জানতেন মাতৃসম এই মহিলা সারা জীবন তার বার্তার প্রতি অবিচল থেকেছেন, এবং যে কোন পরিস্থিতিতে তাকে সমর্থন করতে প্রস্তুত ছিলেন।

রাসুলের (সা:) সাথে উম্মে আইমানের আচরণ ছিল অত্যন্ত মাতৃসুলভ। সহীহ মুসলিমের এক মজার বর্ণনায় আনাস (রা:) বলেন:
রাসুল (সা:) যখন তার কাছে যেতেন, তখন উম্মে আইমান (রা:) তার সামনে খাবার নিয়ে আসতেন। রাসুল (সা:) খেতে না চাইলে তিনি জোর করে তাকে খাওয়াতেন, তার সামনে খাবার রেখে জোরাজোরি করতেন এবং বলতেন “খাও, খাও, খাও”, ঠিক যেমন একজন মা করে থাকেন। রাসূলের (সা:) সাথে তার সম্পর্ক এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিল।

একজন শান্ত স্বভাবের মহিলা হওয়া সত্ত্বেও রাসুলের (সা:) সাথে ছিল তার সহজ আন্তরিক সম্পর্ক। সীরার বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায়, তিনি সহজাত রসিকতায় রাসূলকে (সা:) হাসাতে পারতেন। তিনি আবিসিনিয়ার (বর্তমান ইথিওপিয়া) বাসিন্দা হওয়ায় আরবি তার মাতৃভাষা ছিল না। ফলে মাঝে মাঝে উচ্চারণে ভুল করতেন, আর সেই পরিস্থিতি থেকেই অনেক সময় মজার মুহূর্ত তৈরি হতো।

একবার, “আসসালামু আলাইকুম” (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক) বলার পরিবর্তে তিনি ভুলবশত “সালাম লা আলাইকুম” (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত না হোক) বলে ফেলেন। এই কারণে রাসুল (সা:) তাকে কেবল “আসসালাম” বলার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

হুনাইনের যুদ্ধে সাহস যোগাতে উম্মে আইমান (রা.) পেছন থেকে মুজাহিদদের উদ্দেশে “ثَبَّتَ الله أقدامكم” (থাব্বাতাল্লাহু আকদামাকুম – ‘আল্লাহ তোমাদের পা দৃঢ় করুন’) বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চারণের সময় ث (থা)–এর পরিবর্তে س (সিন) উচ্চারণ করে “سَبَّتَ الله أقدامكم” বলেছিলেন, যার কোনো প্রাসঙ্গিক অর্থ হয় না। রাসুলুল্লাহ (সা.) এ কথা শুনে মৃদু হাসলেন এবং মজা করে বললেন, “চুপ করুন উম্মে আইমান, আপনার জিহ্বা রুক্ষ”। এমনকি যুদ্ধের মত গুরুগম্ভীর পরিস্থিতিতেও রাসুল (সা:) তার সাথে হালকা মেজাজে কথা বলতেন, রসিকতা করতেন।

রাসুল (সা:) এবং উম্মে আইমান (রা:) সম্পর্কে একটি বিখ্যাত এবং মজার গল্প আছে। উম্মে আইমান (রা:) রাসুলের (সা:) কাছে এসে বললেন, “আমাকে একটি বাহন দিন।” তিনি একটি উট বা অন্য কোনও বাহন চান – বোঝাতে চেয়েছেন। রাসুল (সা:) রসিকতার সাথে উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি তাকে বহন করার জন্য একটি উটের বাচ্চা নিয়ে আসবেন।

উম্মে আইমান (রা:) এ কথা শুনে বললেন যে উটের বাচ্চা তাকে বহন করতে পারবে না, এবং তিনি তা চানও না। রাসুল (সা:) মজা করে জোর দিয়ে আবারো বললেন, “আমি কেবল আপনাকে একটি উটের বাচ্চার উপরই বহন করাব।” হতবাক হয়ে, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কেন তিনি তাকে একটি উপযুক্ত উট দেবেন না। রাসুল (সা:) তখন ব্যাখ্যা করলেন, “হে উম্মে আইমান, এমন কোন উট আছে কি যা অন্য উটের বাচ্চা নয়?” তাদের আলাপচারিতার সময় রাসুল (সা:) প্রায়শই তার সাথে হাসতেন, ঠাট্টা করতেন, এবং আন্তরিকতার সাথে তাকে মা বলে ডাকতেন।

উম্মে আইমান (রা:) ছিলেন সেই মহিলা যার দিকে তাকিয়ে রাসুল (সা:) সান্ত্বনা পেতেন। তিনিও সর্বদা স্নেহ ও ভালোবাসায় ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেন। কঠিন এবং গুরুতর মুহূর্তগুলিতে তিনি অবিচলভাবে রাসুলের (সা:) পাশে দাঁড়িয়েছেন।

ইবনে আব্বাস (রা:) বর্ণনা করেন, একবার রাসুলের (সা:) এক ছোট্ট সন্তান অসুস্থ ছিল, তিনি তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। শিশুটি তার কোলে মারা গেল। এই হৃদয়বিদারক মুহূর্তে উম্মে আয়মান (রা:) উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সা:) কাঁদতে শুরু করলেন এবং তাকে দেখে উম্মে আইমানও (রা:) কাঁদতে লাগলেন। রাসুল (সা:) অশ্রুসিক্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হে উম্মে আয়মান, আপনি কাঁদছেন কেন?” তিনি উত্তর দিলেন “হে আল্লাহর রাসূল (সা:), আপনি কাঁদছেন তাই আমি কাঁদছি, আপনি কাঁদবেন আর আমি কাঁদবো না, তা কি করে হয়?”

রাসূলুল্লাহ (সা:) তাকে আশ্বস্ত করলেন, এবং বললেন এটা রহমত। তিনি বোঝাতে চাইলেন, এই কান্না আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি আপত্তি নয়; এটি সন্তানের প্রতি গভীর মমতা ও মানবিক করুণার প্রকাশ। তিনি উম্মে আইমানকে এ কথা বলেছিলেন যাতে তিনি তার অনুভূতি বুঝতে পারেন। এরপর তিনি তাকে বললেন,
“মুমিনের ব্যাপার আশ্চর্যজনক। অবশ্যই তার সকল বিষয় তার জন্য কল্যাণময়।”

এটা ইঙ্গিত করে যে একজন মুমিন আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তুষ্ট থাকে এবং এবং আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেন তা সে সানন্দে গ্রহণ করে। তিনি আরও বলেন, “যখন তার আত্মা বের করা হয়, তখনও সে আল্লাহর প্রশংসায় থাকে”। এমনকি সন্তানের মৃত্যুতেও তিনি উম্মে আইমানের (রা:) কাছে এ কথা নিশ্চিত করেছিলেন যে তার অশ্রু ছিল করুণার বহিঃপ্রকাশ, আল্লাহর সিদ্ধান্তের প্রতি সন্দেহ বা অসন্তুষ্টি নয়।

রাসূলের (সা:) ইন্তেকালের সময় উম্মে আইমানের (রা:) অবস্থাটা একবার কল্পনা করুন। যেই মুহূর্তে তিনি রাসুলকে (সা:) কোলে নিয়েছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তার পুরো জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল- রাসুলের (সা:) সেবা এবং ভালোবাসায় জড়িয়ে ছিল তার জীবন।

প্রিয় নবীর (সা:) ইন্তেকালের মুহূর্ত তাকে নিজ চোখে দেখতে হয়েছে। রাসুলের (সা:) ইন্তেকালের পর উম্মে আইমান (রা:) সম্পূর্ণ নীরব হয়ে পড়েন, সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। রাসূলের (সা:) দাফনের সময় সাহাবিরা যখন কান্না ও শোকে ভেঙে পড়ছিলেন, উম্মে আইমান নিঃশব্দে দূর থেকে মদিনার সেই মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করছিলেন।

রাসুলের (সা:) জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত উম্মে আইমান (রা:) ছিলেন তার সার্বক্ষণের সঙ্গী, আজ তিনি হাজার হাজার মানুষকে তার জন্য শোক প্রকাশ করতে দেখলেন। তিনি দূর থেকে চুপচাপ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলেন। রাসুলের (সা:) মৃত্যুর পর তিনি বেশি কথাবার্তা বলতেন না এবং রসিকতাও করতেন না।

উম্মে আইমান (রা:) একে একে প্রত্যক্ষ করেন তার প্রিয়জনদের মৃত্যু। প্রথম স্বামী মারা যাওয়ার পর উম্মে আইমান (রা:) তার প্রথম সন্তান আইমান আল-হাবাশির হুনায়নের যুদ্ধে শহীদ হওয়ার কষ্ট সহ্য করেন। পরবর্তীতে দ্বিতীয় স্বামী যায়েদ ইবন হারিসা (রা:) মুতার যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। এরপর তিনি প্রত্যক্ষ করেন প্রিয় নবী মুহাম্মদের (সা:) ইন্তেকাল। এমনকি তাঁর দ্বিতীয় পুত্র উসামা ইবন যায়েদ (রা:)-এর মৃত্যুর ঘটনাও তিনি জীবিত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেন।

উম্মে আইমান (রা:) দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। রাসুলের (সা:) সময় থেকে শুরু করে খলিফা আবু বকর (রা:) ও উমরের (রা:) খিলাফতকাল পর্যন্ত তিনি বহু মহান ব্যক্তিত্ব ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোর প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে ছিলেন।

সহীহ বুখারী হাদিসে এসেছে, রাসুলের (সা:) ইন্তেকালের পর আবু বকর (রা:) ও উমর (রা:) উম্মে আইমানের (রা:) সাথে দেখা করতে যান। তারা জানতেন, তিনি ছিলেন আল্লাহর রাসুলের ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় একজন সাহাবিয়া। রাসুলের (সা:) জীবদ্দশায় যেভাবে তারা উম্মে আইমানকে (রা:) সম্মান করতেন, সেই সম্পর্ক ও মর্যাদার প্রতি ভালোবাসা থেকেই তারা তার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলেন। এই ঘটনা রাসুলের (সা:) সঙ্গে তাদের গভীর আধ্যাত্মিক সম্পর্ক এবং তার প্রিয়জনদের প্রতি তাদের আন্তরিক ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ।

সাক্ষাতের সময় তারা যখন উম্মে আইমানকে (রা:) কাঁদতে দেখলেন, তারা মনে করলেন— রাসূলের (সা:) বিচ্ছেদের দুঃখেই দুঃখেই বুঝি তিনি কাঁদছেন। তাই তারা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,
“আল্লাহ তার জন্য আখিরাতে যা প্রস্তুত করেছেন, তা এই দুনিয়ার চেয়ে অনেক উত্তম।”

উম্মে আইমান (রা:) গভীর আবেগে উত্তর দিলেন,
আমি রাসুলের (সা:) চলে যাওয়ায় কাঁদছি না, বরং কাঁদছি এ কারণে যে তার ইন্তেকালের সাথে আসমান থেকে ওহীর ধারা থেমে গেছে।” একবার চিন্তা করে দেখুন, কি গভীর তাকওয়া! আল্লাহর নাজিলকৃত ওহীর অবসানকে কত বেশি বেদনা হিসেবে তিনি অনুভব করেছিলেন।

তার অশ্রুতে রাসুলের (সা:) মাধ্যমে অবতীর্ণ ঐশী নির্দেশনার প্রতি গভীর আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়। উম্মে আইমানের (রা:) এই অনুভূতি আবু বকর (রা:) ও উমরকে (রা:) গভীরভাবে স্পর্শ করে, এবং তারাও অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। এই ঘটনাটি ছিল নবীর (সা:) ইন্তেকাল ও ওহীর যুগ সমাপ্তির জন্য একসাথে শোক প্রকাশের এক হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত।

এই ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে উম্মে আইমানের (রা:) ঈমান কতটা দৃঢ় ছিল। তিনি সত্যিই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মানবজাতিকে পথ দেখানোর জন্য রাসুলের (সা:) ভূমিকা কত বড়। এই ঘটনায় আবু বকর (রা:) ও উমরের (রা:) আধ্যাত্মিক গভীরতাও ফুটে ওঠে। তারা উম্মে আইমানের (রা:) দুঃখে শরিক হয়েছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন, নবীর (সা:) ইন্তেকাল শুধু তাদের জন্য নয়—পুরো মুসলিম উম্মত এবং ইসলামের জন্যও এক বিশাল ক্ষতি।

উম্মে আইমান (রা:) আবু বকরের (রা:) মৃত্যুর পরেও বেঁচে ছিলেন এবং তিনি উমরের (রা:) হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছিলেন। উমর বিন আল-খাত্তাবের (রা:)-এর মৃত্যুর প্রায় ২০ দিন পর তিনি মারা যান এবং তাকে রাসূলের (সা:) মসজিদের পাশে অবস্থিত আল-বাকী’ কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ইবনে আসাকির একটি সুন্দর বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে,
যখন উম্মে আইমানকে (রা:) দাফন করা হয়, তখন তাকে এমনভাবে কবর দেওয়া হয় যেনো তার কবরটি সরাসরি রাসুলের (সা:) কবরের সঙ্গে একই সরলরেখায় থাকে। তিনিও রাসুলের (সা:) মত আল বাকি কবরস্থানে কিবলামুখী অবস্থায় শায়িত আছেন, সুবহানাল্লাহ!

ইসলামের ইতিহাসে উম্মে আইমানের (রা:) স্থান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তার প্রতি রাসুলের (সা:) সম্মান থেকে এটাই প্রতিফলিত হয় যে ইসলাম সাম্য ও মানবিক মর্যাদার শিক্ষা দেয়। রাসুল (সা:) ঘোষণা করেছিলেন,
“কোনো আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের কিংবা কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই—শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তাকওয়ার ভিত্তিতে।”
এই ঘোষণার মাধ্যমে উম্মে আইমানের মর্যাদাকেও তিনি উন্নীত করেছিলেন। গোত্র, বর্ণ, লিঙ্গ বা দারিদ্র্য—কোনো কিছুই তাঁর মর্যাদাকে ক্ষীণ করতে পারেনি। রাসুল (সা:) তাকে নিজের মায়ের মত সম্মান দিয়েছিলেন এবং মুসলিম সমাজকেও শিখিয়েছিলেন তাকে সম্মানের চোখে দেখতে।

উম্মে আইমানের (রা:) প্রতি রাসুলের (সা:) মনোভাব ছিল ভালোবাসা ও মর্যাদায় পরিপূর্ণ, যা তার ব্যক্তিগত সাক্ষ্যের মাধ্যমেও সুস্পষ্ট। রাসুলের (সা:) সাথে তার সংযোগ ও অনুরাগ ছিল সুগভীর, এবং তার ত্যাগও ছিল অনন্য। রাসুলের (সা:) খেদমত করতে গিয়ে তিনি কখনো কোনো কষ্ট বা অসুবিধার অভিযোগ করেননি, বরং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে তার সেবার মধ্যে মহৎ উদ্দেশ্য ও সম্মান নিহিত আছে, এবং সেই উপলব্ধিই তাকে দৃঢ় ও ধৈর্যশীল করে তুলেছিল।

উম্মে আইমানের (রা:) চরিত্রে আমরা দেখতে পাই মানবিকতা, গভীর ভালোবাসা ও স্নেহ, আর রাসুলের (সা:) প্রতি অবিচল আনুগত্য। আমাদের নিজেদেরকে জিজ্ঞেস করা উচিত—আমরা যখন দ্বীনের পথে কাজ করি ও নানা পরীক্ষার মুখোমুখি হই, তখন কি আমরাও তার মতো বলতে পারবো, “যতক্ষণ ইসলাম ঠিক আছে, ততক্ষণ আমিও ভাল আছি”?এই অটল অঙ্গীকারের দৃষ্টান্ত খাদিজার (রা:) জীবনে পাওয়া যায়, আর সেই একই দৃঢ়তা দেখা যায় এই অসাধারণ নারী বারাকা – উম্মে আইমানের (রা:) জীবনেও।

আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করি—তিনি যেন উম্মে আইমানের( রা:) প্রতি সন্তুষ্ট হন, তার মর্যাদা উন্নীত করেন এবং রাসুলের (সা:) প্রতি তার স্নেহ ও ত্যাগের জন্য তাকে সর্বোত্তম প্রতিদান দান করেন। আমরা যেন জান্নাতুল ফিরদাউসের সর্বোচ্চ স্তরে তার সাথে এবং রাসূলের (সা:) মিলিত হতে পারি। আল্লাহুম্মা আমীন।

মূল: ডঃ‌ ওমর সুলাইমান

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button