সৌভাগ্যের রজনী

বানী ইসরাঈলের জনৈক ব্যক্তি ছিলেন যিনি সারা রাত নফল সালাত আদায় করতেন আর দিনের বেলা আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় শত্রুর মোকাবেলায় যুদ্ধ করতেন, তিনি এরূপ হাজার মাস করেছেন। এ কথা জেনে সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আমাদের বয়স তো মাত্র ৬০ থেকে ৭০ বছর। আমরা তো তাদের মত এত দীর্ঘ সময় ইবাদত করতে পারব না। তখন এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
[ইবনু জারীর, তথ্যসূত্র- তাফসীর ফাতহুল মাজিদ]

لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ
শবে-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
[সূরা কদর:৩]


(خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ) অর্থাৎ এ রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়ে উত্তম।

কিছু সৌভাগ্যবান মানুষ এই স্নিগ্ধ রাতে উজ্জ্বল আকাশ এবং দলবেঁধে আসা খোদার ফেরেস্তার সাথে মোলাকাত করতে পারে। কিছু সৌভাগ্যবান মানুষই এই সৌভাগ্যের রজনীর পূর্ন নেয়ামত কুড়িয়ে নিতে পারবে। এখন প্রয়োজন নির্ঘুম রাত জেগে এই মূল্যবান রজনী খুজে বের করা। মরুভূমিতে যদি হিরের নেকলেস হারিয়ে যায় তাহলে আমরা যেভাবে খুজবো তার চেয়েও বহু বহু গুণ গুরুত্ব দিয়ে খুজে বের করা দরকার এই ভাগ্য নির্ধারণের দিনটি।

হযরত উবাদা ইব্‌ন সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“নিশ্চয় লাইলাতুল কবদরের আলামত, তা হবে সাদা ও উজ্জ্বল, যেন তাতে আলোকিত চাঁদ রয়েছে, সে রাত হবে স্থির, তাতে ঠাণ্ডা বা গরম থাকবে না, তাতে সকাল পর্যন্ত কোন তারকা দ্বারা ঢিল ছোঁড়া হবে না। এ রজনীর আরো আলামত হলোঃ সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে সমানভাবে, চৌদ্দ তারিখের চাঁদের ন্যায়, তার কোন কিরণ থাকবে না, (দুর্বল রক্তিম আভা) সেদিন শয়তানের পক্ষে এর সাথে বের হওয়া সম্ভব নয়”।
[আহমদ: ৫/৩২৪]

এই শ্রেষ্ঠতম রাতে শ্রেষ্ঠ দোয়া হলো,
আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আমরা কত বড় বড় গুনাহের জাহাজ ঘাড়ে করে দুনিয়াতে বিচরণ করি তার কোন হিসাব নেই। তাই এই রাতটি আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। আল্লাহ আমাদের এই রাতটি দিয়েছেন এর জন্যই যেন আমরা গুনাহ গুলো কে মুছে ফেলতে পারি।

এ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে মহান আল্লাহর নিকট গোনাহ মাফের দোয়া শিখিয়েছিলেন। তাই উম্মতে মুহাম্মাদির উচিত প্রিয় নবী (সা.) এর শেখানো দোয়ার মাধ্যমে গোনাহ মাফের জন্য তাওবা করা। দোয়াটি হলো-

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عُفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুয়্যুন; তুহিব্বুল আফওয়া; ফাফু আন্নি।’
অর্থ : হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাশীল; ক্ষমা করতে ভালোবাসেন; অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন।
[তিরমিজি: ৩৫১৩]

পৃথিবীর সূচনালগ্নে নবীর উম্মতেরা হাজার বছর জীবিত ছিলো এবং ইমানদার হাজার বছর ইবাদত করেছে! আমরা শেষ নবীর উম্মত হিসেবে আমার জীবন কাল খুবই ছোট। কিন্তু আল্লাহ আমাদের হাজার বছরের ইবাদত থেকে বঞ্চিত করেন নি।

কোরআনের নাজিলের এই রাতটির ইবাদত হাজার মাসের চেয়ে উত্তম! ২৭শে রমাদানে লাইলাতুল ক্বদর নির্দিষ্ট নয়। রাসূলে পাক সঃ রমাদানের শেষ দশদিন ক্বদর খোঁজর জন্য বলে দিয়েছে। বিশেষ করে জোরদার করেছে, বেজোড় রাতের ইবাদতে।
“রমাযানের শেষ দশ দিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ করো”
[বোখারি: ২০২০, মুসলিম :১১৬৯]

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর পেলো কিন্তু ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটাতে পারলো না, তার মতো হতভাগা দুনিয়াতে আর কেউ নেই…”
[মুসলিম, হাদিস নং : ১১৬৭]

এই দশদিনে আমরা কি কি ইবাদত করবো.?

এক কথায় বলবো, আমরা ইবাদত বলতে যা যা বুঝি ও করি, সবটুকুই অত্যন্ত দরদ দিয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঢেলে দিবো। হতে পারে এটাই আমাদের জীবনের শেষ লাইলাতুল ক্বদরের ইবাদত।

ক. নফল নামাজ
১) আউওয়াবিন, ২) তাহাজ্জুদ ৩) সালাতুত তাসবিহ, ৪)তাওবার নামাজ।

খ. কোরআন তেলওয়াত করা
১) সুরা কদর,
২) সুরা দুখান,
৩) সুরা মুয্যাম্মিল,
৪) সুরা মুদ্দাচ্ছির,
৫) ইয়া-সিন,
৬) সুরা ত-হা,
৭) সুরা আর রহমান

এই সূরা গুলো বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পড়া যেতে পারে। তাছাড়া সম্ভব হলে কুরআনের আরো ফজিলতপূর্ণ সূরা গুলো পড়া।

গ. দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়া।
ঘ. তাওবা-ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা।
ঙ. দোয়া-কালাম, তাসবিহ-তাহলিল, জিকির-আজকার ইত্যাদি করা।
চ. নিজের জন্য, পিতা-মাতার জন্য, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও সব মুমিন মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।

এছাড়াও পছন্দ মত আরো অনেক ইবাদত আছে। সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে এই রাতে ঝাঁপিয়ে পরা উচিত।

মিশকাত শরিফে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেন,
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘যদি তোমরা কবরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত কর। রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, যদি কেউ ঈমানের সঙ্গে সাওয়াব লাভের খাঁটি নিয়তে লাইলাতুল কদর কিয়ামুল্লাইল বা তাহাজ্জুদে অতিবাহিত করে তবে তার পূর্ববর্তী সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে।
[বুখারি, হাদিস নং : ৬৭২]

রাসূল সঃ নিজে শেষ দশ দিন খুবই গুরুত্বের সাথে ইবাদত করতেন। আর অন্যদেরও গুরুত্ব দিতে বলতেন। আয়েশা রাঃ বলেন, রাসূল সঃ কোমরে কাপড় বেধে ইবাদতে নেমে পরতেন (বেশি বেশি প্রস্তুতি নিতেন)। তিনি তার পরিবার পরিজনদের জাগিয়ে দিতেন।
“রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ দশকে ইবাদতের মাত্রা এত বেশি বাড়িয়ে দিতেন—যেমনটি অন্য সময় করতেন না।
[আস সুনানুল কুবরা, হাদিস : ৮৩৫১; মুসলিম, হাদিস : ১১৭৫]

একমাত্র গাফেল ছাড়া কেউ সেচ্ছায় এই সৌভাগ্যপূর্ন রাতটি অবহেলা করবে না। এই রাতেই আগামী একবছরের ভাগ্যের ফায়সালা করা হয়।

“…আসলে আল্লাহ‌ ততক্ষণ পর্যন্ত কোন জাতির অবস্থা বদলান না যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা বদলে ফেলে..”
[সূরা রাদ: ১১]

রামাদান নিয়ে খুটিনাটি
[পর্ব-১৬]

পর্ব- “সৌভাগ্যের রজনী”

Exit mobile version