নতুন বছরের নতুন দিনে নতুন ‘আমি’ কি হতে পেরেছি

[১]

আমরা অনেকেই নতুন বছরের নতুন দিনে নতুন কিছু করাতে ব্যস্ত আছি। কিন্তু চিরস্থায়ী জীবনকে কেন্দ্র করে কীভাবে জীবনকে সাজানো যায়, কীভাবে জীবনের মধ্যে নতুনত্ব আনা যায় সেগুলোর কোনো চিন্তাই যেনো আমাদের মস্তিষ্কে আসে না। তাই তো নতুন দিন হয়, নতুন মাস হয়, নতুন বছর হয় কিন্তু এই ‘আমি‘ আর নতুন হই না, নিজের মধ্যে আর কাঙ্খিত পরিবর্তন আনা হয় না। যেমন ছিলাম তেমনি রয়ে যাই। আর হয়তো এভাবেই আমরা একসময় হঠাৎ কবরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতো কঠিন এক পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে আবিস্কার করবো। এ নিয়ে আল্লাহ তা’য়ালা বলেছেন, এমনি করেই (ধীরে ধীরে) তোমরা কবরের কাছে গিয়ে হাজির হবে। [সূরা আত তাকাসুর:২]

দেখুন, নতুন একটি বছর চলে আসা মানে জীবন থেকে পাক্কা একটি বছর চলে যাওয়া, যে বছর জীবনে আর কোনদিন-ই ফিরে আসার নয়। ফলে নতুন আরেকটি বছর চলে আসাতে যেখানে আমাদের দুঃখ হওয়ার কথা, জীবন থেকে চলে যাওয়া এই সময় আর ফিরে পাবো না বলে নিজের করে আসা পাহাড় পরিমাণ গোনাহের কথা ভেবে আফসোস হওয়ার কথা সেখানে একদম প্রাণখোলে আনন্দ ফূর্তি, হাসি তামাশা ইত্যাদি করা কি চিরস্থায়ী জীবন নিয়ে চিন্তাশীল কোনো মানুষের কাজ হতে পারে?

নিজের গোনাহের কথা না ভেবে হাসি-তামাশায়, হৈ হুল্লোড় ইত্যাদি নানা ঢঙে লিপ্ত থাকার বিষয় কি এটা বোঝার জন্য যথেষ্ট নয় যে, আমরা আখিরাতের প্রতি চরমভাবে বিমুখ হয়ে আছি, চিরস্থায়ী জীবন নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তাই কাজ করছে না। অন্যথায়,আমাদের এতো গোনাহ থাকা সত্ত্বেও নতুন বছরের এই দিনে এতো আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠতে পারতাম না। একটু হলেও নিজেদের গোনাহের কথা চিন্তা করে এসব থেকে দূরে থাকতাম। নিজের মধ্যে অনুতাপ কাজ করতো।

আমরা যারা রবের দিকে প্রত্যাবর্তন না করে বিভিন্ন খেল তামাশায় লিপ্ত আছি, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন আমাদেরকে ভাবাচ্ছে না তাদের ব্যাপারে রব্বে কারীম বলেছেন, মানুষের জন্য তাদের হিসাব নিকাশের মুহুর্তটি একান্ত কাছে এসে গেছে অথচ তারা এখনো উদাসীনতার মাঝে নিমজ্জিত হয়ে সত্য বিমুখ হয়ে আছে। যখন তাদের কাছে তাদের মালিকের নতুন উপদেশ আসে তখন তারা শুনছে কিন্তু তারা (তখনও) নানারকম খেলাধূলায় নিমগ্ন থাকে। ওদের মন থাকে সবসময় অমনোযোগী। [সূরা আল আম্বিয়া:১-৩]

[২]

আজকে আমরা যারা হ্যাপি নিউ ইয়ার পালন করে আনন্দ-ফূর্তি করছি তাদের কি একটুও খেয়াল আছে যে, আমরা কবরের দিকে আরও একটি বছর এগিয়ে গেলাম। আর এই কবরের জন্য কি কোনো প্রস্তুতি আছে আমাদের? আমরা কি আখিরাতের পাথেয় হিসেবে কিছু জোগাড় করতে পেরেছি?

একজন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির জন্য বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের প্রতিটি দিন যেমন এই ভেবে দীর্ঘ নিঃশ্বাসের হয়ে থাকে যে, যতোই দিন গড়াচ্ছে ততোই মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া হচ্ছে ঠিক তেমনি আমাদেরও কি প্রতিটি দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাসের হওয়ার কথা নয়?
কেননা ঐ ব্যক্তির মতো আমরাও তো প্রতিনিয়ত মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। পার্থক্য শুধু ঐ ব্যক্তির কাছে এক প্রকার জানা হয়ে আছে বেঁচে থাকার চূড়ান্ত সময়সীমা আর আমাদেরটা অজানা। এখন আমরা কি ঐ ব্যক্তির কঠিন অবস্থানে নিজেদেরকে দাঁড় করিয়ে একটু চিন্তা করে নিজেদেরকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারি না?

দেখুন, হ্যাপি নিউ ইয়ার বললেই বছর হ্যাপি হয়ে যায় না। বছর হ্যাপি হতে হলে আগে বছরের মালিক মহান রাব্বুল আলামিনের অনুগত থাকার মাধ্যমে মালিককে খুশি করতে হয়। আর আল্লাহকে আমাদের উপর সন্তুষ্ট রাখতে পারলেই বছরটাও আল্লাহর রহমতে সুখের কাটবে। ইং শা আল্লাহ!

[৩]

আমরা নিজেদের পিছনে একটু চিন্তা শক্তি ব্যয় করি যে, এই ‘আমি‘ র তো একসময় কোনো অস্তিত্বই ছিল না আবার থাকবেও না। তাই এই মাঝের সময়টা আমার কী করা দরকার। এগুলো নিয়েই আমার ব্যস্ত থাকা দরকার। এছাড়া, মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে অসংখ্য অগণিত নিয়ামতের স্বাদ ভোগ করাচ্ছেন। আর আমরা আল্লাহর এতো এতো নিয়ামত ভোগ করেও আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে কীভাবে এতোটা অকৃতজ্ঞ হয়ে থাকতে পারি, একটু ভাবুন তো।

আমরা দুনিয়ার কারো উপকার করে বিনিময়ে পরবর্তীতে তার কাছ থেকে কোনো কিছু না পেলে তার প্রতি রাগ দেখাই, তাকে অকৃতজ্ঞ বলে আখ্যা দেই অনেক সময় যোগাযোগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেই। এখন আল্লাহ আমাদেরকে এতো এতো নিয়ামত ফ্রি-তে দিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও আমরা আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী ঠিকমতো সালাত আদায় করি না, পর্দা করি না, হালাল-হারাম মেনে চলি না অর্থাৎ আল্লাহর আদেশ নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলি না তবুও তো আল্লাহ তার নিয়ামতসমূহ আমাদের জন্য বন্ধ করে দেন না। আর আল্লাহ অসীম দয়ালু বলেই তো তা করেন না। এখন আমাদের প্রতি আল্লাহর এই অফুরন্ত দয়ার সুযোগ নিয়ে কি আমরা আল্লাহর অবাধ্য হতেই থাকবো? এই কি আমাদের বিবেকের বিচার?

আমাদেরও তো একটু বিবেক খাটানো উচিত, যে আল্লাহ আমাদেরকে একদম মায়ের পেটে অবস্থান কাল থেকে এখন অবধি আমাদেরকে তার অগণিত নিয়ামতের চাদরে ঢেকে রেখে চলছেন সে আল্লাহর নাফরমানী আমরা কীভাবে লিপ্ত থাকতে পারি? কীভাবে সে আল্লাহর অবাধ্য হয়ে চলতে পারি? দুনিয়ায় কাউকে যদি দুনিয়ার কোনো কিছুর জন্য অকৃতজ্ঞ বলতে পারি তবে আমরা কেমন কৃতজ্ঞ হলাম? রবের অবাধ্যতার মাধ্যমে আমরা কি রবের প্রতি অকৃতজ্ঞতাই প্রকাশ করছি না?

একটু বোঝার চেষ্টা করুন। জীবনটা হেসে খেলে পার করার জিনিস নয়। আল্লাহ এই জীবনকে যেমন খুশি তেমন ভাবে পার করার জন্য দেননি। নিজেকে জান্নাতের জন্য প্রস্তুত করতে দিয়েছেন। একদিন আল্লাহর সামনে আমাদের সবাইকে দাঁড়াতে হবে, দিতে হবে সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব।

ফলে আমাদেরকে এখনই জীবনের মানে বুঝতে হবে, খুঁজতে হবে জীবনকে পরিচালনা করার উপায়। আর সেই উপায় খুঁজতে হলে কোরআন হাদীসের দ্বারস্থ হতেই হবে, এগুলোর চর্চা অব্যহত রাখতে হবে। আর জীবন পরিবর্তনের জন্য এগুলোর কোনো বিকল্প নেই। কাজেই আসুন, নতুন বছরে আমরা কোরআন হাদীসের আলোকে বেশি বেশি নেক আমল করে নিজেদের মধ্যে নতুনত্ব আনার মাধ্যমে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হয়ে উঠার চেষ্টা করি। তাতে আমরা দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হবো।

লিখেছেন

পরকালীন তথা স্থায়ী জীবনের লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। নিজে হেদায়েতের ওপর অটল থাকার পাশাপাশি অন্যেদেরকেও হেদায়েতের দিকে আহবান করা তথা পথ হারাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই আমার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য।

Exit mobile version