Writing

নব দম্পতির পরিকল্পনা

বৃষ্টির রাত। সারাদিন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। এমন রাতে হঠাৎ পেছন থেকে এসে কাপড় গোছানোরত অবস্থায় থাকা স্ত্রী হুমায়রার চোখে হাত রেখে রায়হান বলল, বলো তো, হুমায়রা! আমি তোমার জন্য কী এনেছি?

– তা কীভাবে বলবো, আমি তো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।
– আহহা, গেজ করো না।
– কী এনেছো তা বুঝতে পারছি না তো।

অতঃপর রায়হান তার স্ত্রীর চোখ থেকে হাত নামিয়ে তার হাতে একটি মচমচে শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, এই দেখো! আমি তোমার জন্য কী এনেছি।

হুমায়রা ব্যাগ খুলে বললো, মা শা আল্লাহ! অনেক সুন্দর তো। এই ড্রেস এখন কিনতে গেলে কেন! কদিন আগে ঈদে না দুই-দুইটা ড্রেস কিনে দিলে।

– ওমা, এটা কোনো কথা হলো! আমার স্ত্রীর জন্য কেনাকাটা করতে ঈদ লাগে নাকি। আজ পারি না বলে, না হয় প্রতি মাসে তোমাকে নিয়ে অন্তত একবার হলেও শপিং করতাম। আমার প্রিয়তমা স্ত্রী তো বটেই সবকিছুর পর তুমি আমার সন্তানের জননী বলে কথা।

– তুমি বলেছো, এতেই আমি অনেক খুশি।

বিছানার দিকে তাকিয়ে রায়হান বলল, আমাদের ছোট্ট বাবুটা তো ঘুমিয়ে আছে। দেখো, কী কিউট লাগছে আমাদের বাবুটাকে, মা শা আল্লাহ! আচ্ছা, হুমায়রা! বিয়ের প্রথম বছরের মাথায় তো মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তান দান করেছেন। এই ছেলের পড়াশোনা নিয়ে তোমার ভাবনা কী? বড়ো হলে তাকে কোথায় ভর্তি করাবে?

হুমায়রা চোখ কপালে তুলে মাথায় হাত রেখে অবাক স্বরে বলল, হায় আল্লাহ! এতো আগেই তার পড়াশোনা নিয়ে তোমার চিন্তা হচ্ছে। সবে তার বয়স এক মাসও হলো না। আর এখনি তার পড়াশোনা নিয়ে তোমার চিন্তা।

– বুঝলাম তো! তবুও আগেভাগে পরিকল্পনা করে রাখা ভালো। তখন সেই পরিকল্পনা মোতাবেক আগানো যাবে। তাছাড়া, সন্তান বড়ো হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকবো কি-না তা তো আমি জানি না। তাই আমি চাচ্ছিলাম এখনই এ ব্যাপারে তোমার সাথে পরামর্শ করে রাখা দরকার। আমি সে পর্যন্ত বেঁচে না থাকলে অন্তত আমার থেকে পাওয়া কোনো পরামর্শ তুমি হয়তো কাজে লাগাতে পারবে। সেই চিন্তা থেকে আগে থেকেই কথাগুলো বলে রাখার প্রয়োজন অনুভব করছি।

হুমায়রা খানিকটা মাথা ঝুঁকে ফ্লোরের নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, মনটাই খারাপ করে দিলে কিন্তু। তোমার মতো অন্তর শীতলকারী স্বামীর অনুপস্থিতি আমি ভাবতেই পারি না। আমি সবসময় দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমার স্বামীকে নেক হায়াত দান করেন। প্রয়োজনে আমার থেকে কিছু হায়াত নিয়ে হলেও যেন উনার হায়াত বাড়িয়ে দেন।

হুমায়রা এমন কথা বলতে না বলতেই তার মুখে হাত রেখে রায়হান বলল, ও হুমায়রা! এভাবে বলতে নেই। জানি, আমার মতো অযোগ্যকে তুমি অনেক ভালোবাসো তবুও এভাবে বলতে নেই। আল্লাহ তোমাকেও নেক হায়াত দান করুন। আমিন! তো, কোথায় ভর্তি করাতে চাও সেটা বললে না যে?

– কোথায় আবার! এই তো স্কুলেই ভর্তি করাবো। আমি চাই আমার ছেলে একজন ডাক্তার হোক। তাকে ডাক্তার বানানো আমার স্বপ্ন।

– দেখো হুমায়রা! এটা অবশ্যই ভালো একটি স্বপ্ন। ডাক্তার না হলে রোগীর সেবা করবে কে? ডাক্তার হলে আমাদের ছেলে অনেক মানুষের সেবা করতে পারবে। সে বিবেচনায় সেটা তো ভালোই – বলাই বাহুল্য। ডাক্তার কিংবা অন্যান্য পেশার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করা যায় না। তুমি তোমার ছেলেকে ডাক্তার বানাতে চাও কিংবা অন্য কিছু বানাতে চাও -এটা চাইতেই পারো। তাছাড়া, আমি মনে করি মা হিসেবে তুমি তোমার সন্তানের উপর সবচেয়ে বেশি অধিকার খাটানোর দাবি রাখো। কারণ আমার এই ফুটফুটে সন্তানের পেছনে আমি বাবার যতোটানা অবদান আছে তার চেয়ে বহুগুণ অবদান আছে তুমি মা-র।

ও আমার প্রিয়তমা, হুমায়রা! তুমিই মাসের পর মাস পেটে ধারণ করে আমার পরম আকাঙ্ক্ষিত এই সন্তান জন্ম দিয়েছো, আমি নয়। তুমিই আমার এই কলিজার টুকরোকে জন্ম দিতে গিয়ে অনেক অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করেছো, অসম্ভব প্রস্রব বেদনা সহ্য করেছো, আমি নয়। তুমিই আমার সমস্ত ভালোবাসায় ভরপুর এই আদরের বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য সকল ব্যস্ততাকে আগলে রেখে সবসময় প্রস্তুত থাকো, আমি নয়। এগুলোর কোনো কিছুই আমাকে করতে হয়নি। তাই সন্তানের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মা হিসেবে তোমার মতামত প্রাধান্য পাওয়ার সবচেয়ে বেশি দাবি রাখে। সন্তানের বাবা হিসেবে আমি কেবল তোমার কাছে কিছু কথা বলতে চাই। কথাগুলো শুনে তুমিই সিদ্ধান্ত নেবে যে, কী করা উচিত-কেমন?

– কেবল আমার কথাই কতো সুন্দর বলে গেলে। তুমি যদি আমার পাশে না থাকতে, আমাকে সার্পোট না দিতে, আমার ভরণপোষণ চালিয়ে না নিতে তাহলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। সন্তান জন্মদানে তোমার অবদান কখনোই ভুলার নয়। বুঝলে, কিছু কিছু মানুষ কখনোই নিজের অবদানকে সামনে আনতে চায় না। কেবল আড়ালেই রাখতে চায়। আর সেখানেই তাদের যতো সুখ। তেমনি একজন মহান মানুষের পাশে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেজন্য আমি নিজেকে অনেক বেশি ভাগ্যবতী মনে করি। আলহামদুলিল্লাহ! যাইহোক, সন্তানের পড়াশোনা নিয়ে তুমি কী বলতে চাও, বলো।

– আমার প্রিয়তমা স্ত্রী! দেখো, এই দুনিয়াতে আমাদের অবস্থান খুবই সামান্য সময়ের জন্য। যেকোনো মুহূর্তেই আমাদের যে কারো মৃত্যু চলে আসতে পারে। তখন চিরস্থায়ী জিন্দেগী আখিরাতের জীবন শুরু হয়ে যাবে। সেজন্য আমাদেরকে ঠিক সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে যেভাবে প্রস্তুতি নিলে আমাদের আখিরাতের জীবন সুন্দর হবে।

আমি চাচ্ছি আমার সন্তানকে এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে যে শিক্ষায় সে দুনিয়া ও আখিরাতে লাভবান হবে। দুনিয়ায় হয়তো ঐভাবে লাভবান হতে পারবে না তবে আখিরাতে সে শতভাগ লাভবান হবে সেটা সুনিশ্চিত।

এবার তুমিই বলো, তুমি তোমার ছেলেকে কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে? কেবল দুনিয়ায় লাভবান হওয়া যায় এমন শিক্ষা নাকি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জায়গায় লাভবান হওয়া যায় এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে?

– অবশ্যই আমি চাই আমার সন্তান দু জায়গায়ই লাভবান হোক। স্থায়ী বিবেচনায় আখিরাতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হোক সেটাই কাম্য। তবে তুমি কোথায় ছেলেকে ভর্তি করাতে চাচ্ছো?

– দুনিয়া ও আখিরাতে সফলকাম হওয়া যায় এমন শিক্ষা তো কেবল একটি জায়গায় দেওয়া হয়। আর সেটি হচ্ছে মাদ্রাসা নামক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। আমি আমার ছেলেকে ওখানেই ভর্তি করাতে চাই।

– কিন্তু মাদ্রাসায় ভর্তি করালে তার ক্যারিয়ারের কী হবে?

– দেখো হুমায়রা, ক্যারিয়ার বলতে আমাদের সমাজে রিজিকের কথাই মোটাদাগে বোঝানো হয়। আল্লাহকে রিজিকদাতা জেনে রিজিক নিয়ে চিন্তিত থাকা মানে আল্লাহর রিজিকদাতা গুণের প্রতি নড়বড়ে বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ যা কোনো জান্নাত প্রত্যাশীর কাজ হতে পারে না।

আমাদেরকে কেবল হালালভাবে রিজিকের চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আর সে চেষ্টা চালাতে গিয়ে কোনোভাবেই নিজের স্থায়ী জীবনকে উপেক্ষিত রেখে অস্থায়ী জীবনকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। আল্লাহই রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন। যার জন্য যতোটুকু রিজিক বরাদ্দ আছে সে ততোটুকুই ভোগ করতে পারবে, এর বেশি নয়। বেশি চেষ্টা করলে বেশি রিজিক পাবো ব্যাপারটি তো মোটেও সেরকম নয় বরং দিনশেষে বরাদ্দটুকুই পাবো। সুতরাং শুধু শুধু রিজিক নিয়ে এতো এতো পেরেশানি করার কোনো মানে হয় না। রিজিক নিয়ে চিন্তা করা মানে হতাশা নামক কঠিন এক ব্যাধির আমদানি করা যা সকল অস্থিরতার উৎস।

ও হুমায়রা! তোমাকে আগেই বলেছি, দুনিয়ার জীবন অস্থায়ী এক জীবন। ফলে এ অস্থায়ী জীবনটা কোনোমতে পার করে গেলেই হলো। আমাদের সকল চিন্তা স্থায়ী জগতকে ঘিরে হওয়া উচিত। স্থায়ী জগতের সবকিছুই স্থায়ী। এজন্য স্থায়ী জগতে কীভাবে সুখী হওয়া যায় সেই ভাবনা নিয়ে অস্থায়ী জগতে চলা উচিত।

আমি চাই আমার সন্তান তার জীবনের শুরুতে এমন শিক্ষা পেয়ে বেড়ে উঠুক যে শিক্ষায় সে তার রবকে চিনবে, যে শিক্ষা তার রবের অনুগত হয়ে থাকতে সাহায্য করবে, যে শিক্ষা তার অন্তরে রবের ভয় তথা তাকওয়া সৃষ্টি করবে সর্বোপরি যে শিক্ষা মৃত্যু পর্যন্ত সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল অবিচল রাখবে। আর এসব শিক্ষা সাধারণত কোনো স্কুল-কলেজে দেওয়া হয় না। এসব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা গুরুত্বের সাথে দেওয়া হয় দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে। আর সেটা হতে পারে মাদ্রাসা।

আমি চাই না আমার সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে। এটা আমার জন্য প্রকৃত অর্থে গর্বের বিষয় নয়। আমার জন্য গর্বের বিষয় হচ্ছে আমার সন্তানকে রবের একজন পাক্কা অনুগত বান্দায় পরিণত করে তোলা। সন্তানকে রবের অনুগত বান্দায় পরিণত করে তোলাই হচ্ছে আমার জন্য বড়ো গর্বের বিষয়। আমি আমার সন্তানকে বড়ো বড়ো ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার বানালাম কিন্তু সিজদাকারীর অন্তর্ভুক্ত করাতে পারলাম না তবে তোমার আমার চেয়ে বড়ো দূর্ভাগা পিতা-মাতা আর কে থাকবে, তুমিই বলো?

আমি আমার জীবনে এমন অনেক মানুষ দেখেছি যাদের সন্তান অনেক নামকরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পিএইচডি হোল্ডার হয়েছে বটে কিন্তু মা বাবার মৃত্যুর সময় কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে পাশে পর্যন্ত থাকে নি কিংবা পাশে থাকলেও সামান্য জানাজার নামাজটুকু পর্যন্ত পড়াতে পারে নি। একজন মা বাবার জন্য এর চেয়ে বড়ো দূর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে, ভেবে দেখো তো।

যদি তাদের অন্তরে আল্লাহভীতি থাকতো তাহলে তাদের জন্মদাতাদের বিদায় বেলায় তাদের ব্যস্ততাকে সামনে টেনে আনতে পারতো না। পক্ষান্তরে, যাদের ভেতর আল্লাহর ভয় রয়েছে তারা আল্লাহর বিধান মানতে গিয়েই মা বাবার খেদমতে নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখবে।

আচ্ছা, তুমি কি কখনো শুনেছো, কোনো মাদ্রাসার ছাত্র তার মা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখেছে? নিশ্চয়ই কখনোই শুনো নি এবং শুনবেও না। ইং শা আল্লাহ! কারণ এরা তাদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে এমন কিছুর শিক্ষা পায় যা তাদের অন্তরে আল্লাহর ভয় সৃষ্টি করে, সৃষ্টি করে আল্লাহর নিয়ামতে ভরপুর জান্নাত লাভের তীব্র আশা যা তাদেরকে দুনিয়াবিমুখ করে রাখে। পক্ষান্তরে, জেনারেল লাইনে পড়ুয়াদের অনেকেই তাদের বৃদ্ধ মা-বাবাকে তাদের শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে। কারণ এরা তাদের শিক্ষা জীবনের শুরুতে তাকওয়ার শিক্ষা পায় নি, তাদেরকে তাদের রবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। তাই তারা তাদের জন্মদাতার সাথে নির্দয় আচরণ করতেও দ্বিধা করে না।

– একদম ঠিকই বলেছো। এভাবে কখনো চিন্তা করা হয়নি। বিষয়টি সত্যিই আমার ভাবনার জগতে নাঁড়া দিয়েছে। আচ্ছা! কতো মানুষজন তো দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পড়েও ভালো মানুষ হতে পারে না। আমার জানাশুনা এমন অনেক মানুষ রয়েছে যারা ঐসব প্রতিষ্ঠানে পড়েও মানুষ হতে পারে নি।

– প্রথমত, হাতেগোনা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতেই পারে। তার মানে সবার ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে যাবে এরকম তো আর নয়। হুমায়রা, তুমি কি এটা ভেবেছো নাকি যে, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করানোকে আমি ভালো মানুষ হওয়ার মানদণ্ড মনে করছি? আমি কিন্তু মোটেও এমনটা মনে করছি না। কারণ ভালো মানুষ হওয়া অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তবে আমি কেবল এটা মনে করি যে, অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠান থেকে দ্বীনি প্রতিষ্ঠান ভালো মানুষ গড়ার জন্য অনেকগুণ এগিয়ে। কারণ এখানে আর যাই-হোক শুরুতেই আল্লাহকে ভয় করার শিক্ষা দেওয়া হয়, আল্লাহর সাথে বান্দার কানেকশন গড়ে দেওয়া হয়। আর এখানেই স্কুল কলেজের মতো অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যোজন যোজন পিছিয়ে। আল্লাহর ভয়ই একজন মানুষকে খাঁটি মানুষে পরিণত করে, সবার সাথে সৎ হয়ে চলতে সহায়তা করে, সর্বোপরি আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের তালিকায় যুক্ত হতে সাহায্য করে। ঠিক এই বিষয়টি দুনিয়াবী প্রতিষ্ঠানে প্রাধান্য পায় না। আর এখানেই আমার যতো দুঃখ।

দেখো হুমায়রা! হেদায়েতের মালিক একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা নিজেই বলেছেন, যাকে তুমি ভালোবাসো তাকে তুমি হেদায়েত দান করতে পারবে না, তবে হ্যাঁ, আল্লাহ তা’য়ালা যাকে চান তাকে অবশ্যই তিনি হেদায়েত দান করেন, তিনি ভালো করেই জানেন যে, কারা এ হেদায়েতের অনুসারী হবে। [সূরা আল কাছাছ: ৫৬] এজন্য কেউ কাউকে চাইলে হেদায়েত দিতে পারে না। আমরাও পারবো না। তবে আমরা বড়জোর হেদায়েতের রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারি। হেদায়েতের পথে থাকার জন্য যেমন পরিবেশে রাখা দরকার তেমন পরিবেশ করে দিতে পারি। আমাদের সন্তান কোন পথের পথিক হবে সেটা আমরা জানি না। তবে আমাদের উচিত আমাদের চেষ্টায় জায়গায় কোনো ত্রুটি না রেখে সন্তানদেরকে হেদায়েতের পথ দেখিয়ে দেওয়া, হেদায়েতের পথে চলতে সহায়তা করা এবং সবসময় আল্লাহর কাছে তাদের জন্য অশ্রু জড়িয়ে হেদায়েতের দোয়া চাইতে থাকা। এর বেশি কিছু হয়তো আমরা করতে পারব না। বাকিটুকু আল্লাহই করে দেবেন।

আমরা যদি সন্তানকে হেদায়েত পাওয়ার মতো শিক্ষা নিশ্চিত করি আর সেক্ষেত্রে (আল্লাহ নির্ধারণ না করুক) যদি সন্তান হেদায়েত প্রাপ্ত না-ও হয় তবে মা বাবা হিসেবে আমাদের অন্তত কোনো দায় থাকবে না। নতুবা আল্লাহর কাছে এর জন্য কঠিন জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ যখন মৃত্যুর পর জিজ্ঞেস করবেন তুমি তোমার সন্তানকে পরকালীন শিক্ষা দেও নি কেন, রবের পরিচয় তুলে ধরো নি কেন, কেন সন্তানকে হেদায়েতের পরিবেশে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করো নি তখন কিন্তু আমাদের জবাব দেওয়ার কিছুই থাকবে না। এগুলো ভাবতেও গাঁ কাটা দিয়ে উঠে। এছাড়া, সন্তানকে যদি হেদায়েত পাওয়ার শিক্ষা না দেওয়া হয় তাহলে এই সন্তানই কাল কিয়ামতের উত্তপ্ত ময়দানে মা বাবার বিপক্ষে দাঁড়াবে। তখন আমাদেরকে কতোটা অপমানিত হতে হবে তা কি তুমি ভাবতে পারো, হুমায়রা?

সন্তানকে হেদায়েত পাওয়ার শিক্ষা না দিলে সে দুনিয়ার জীবনে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারে যা মা বাবাকেই একসময় ভোগতে হবে। আমার জীবনে আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যারা তাদের সন্তানদেরকে নামীদামী ইংরেজি মিডিয়ামে পড়িয়ে উচ্চ শিক্ষিত করিয়েছে বটে কিন্তু রবের শিক্ষা না দেওয়ায় তাদের সন্তানেরা শেষ পর্যন্ত নিজ হাতে তাদের মা-বাবার জীবন কেড়ে নিয়েছে। কতোটা হিংস্র হলে, আল্লাহর ভয় থেকে তাদের অন্তরের অবস্থান কতো হাজার মাইল দূরে হলে কোনো সন্তান তার মা-বাবার প্রতি এতোটা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে তা কি ভাবা যায়?

আজকের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্তানদেরকে হেদায়েতের পরিবেশে রাখা হয় না বলে তারা দুনিয়াবী সর্বোচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও একসময় দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়, মানুষের ত্রাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই কুলাঙ্গার সন্তানেরা তাদের মা বাবাকে নৃশংসভাবে খুন করতে পর্যন্ত পিছপা হয় না। আর এসব যতোটানা দূর্ভাগ্যের বিষয়, এসব দেখে আমাদের শিক্ষা না নেওয়াটা তার চেয়ে আরও বেশি দূর্ভাগ্যের বিষয়।

দেখো, সন্তান হেদায়েতের ওপর চলবে কি চলবে না সেটা নিয়ে আমি ততোটা চিন্তিত নই যতোটা সন্তানের হেদায়েত পাওয়ার মতো পরিবেশ নিশ্চিত করা নিয়ে চিন্তিত। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবহেলা করলে আমাদেরকে বিভিন্নভাবে মাশুল দিতে হবে। সেটা দুনিয়া কিংবা আখিরাত হোক। এসব বিবেচনায় আমার কোনো সন্তানকে দুনিয়ার এই সামান্য সময়ের জীবনে স্কুল কলেজে ভর্তি করানোর পক্ষে আমি নই। কারণ এখানে আর যাই-হোক হেদায়েতের অনুকূলের পরিবেশ থাকে না। তাই পথ হারানোর ভয় প্রবল। তুমিই চিন্তা করে দেখো না, ফ্রি মিক্সিং থেকে শুরু করে ইসলাম পরিপন্থী সাহিত্য,এমন কিছু পড়াশোনা যা ইসলাম সাপোর্ট করে না, সাংস্কৃতিক বিষয় নাচ-গান, ছেলে-মেয়ে একত্রিত হয়ে বৈশাখীর মতো বিভিন্ন বেহায়াপনা দিবস পালন ইত্যাদি এতোসব খোলামেলা পরিবেশ যেখানে বিদ্যমান সেখানে আবার হেদায়েতের পরিবেশ কি ভাবা যায়?

আরে, তুমি আমি নিজেরাই তো ঐসব পরিবেশে পড়ে এসেছি। তাই এসব বিষয়ে আমাদের আরও ভালো বোঝার কথা। সেজন্য আমি জান্নাত পাওয়ার বিষয়কে সামনে রেখে জেনেশুনে আমার সন্তানকে ঐ রিস্কি পরিবেশ ঠেলে দিতে পারি না৷ এতে তার হক নষ্ট করা হবে। কারণ সন্তানের হেদায়েতের পরিবেশ নিশ্চিত করা প্রত্যেক মা বাবার প্রতি তার এক গুরুত্বপূর্ণ হক।

অনেক মানুষ চায় তার সন্তান বড়ো হয়ে ভালো পড়াশোনা করে দুনিয়ায় নামকরা কিছু হোক। সত্যি কথা বলতে কী, আমার এরকম কোনো ইচ্ছাই নেই। দুনিয়ার পড়াশোনায় যদি আমার সন্তান কোনো ভালো রেজাল্ট না-ও করতে পারে কিংবা দুনিয়ার মানদন্ডে ভালো কোনো অবস্থানে না-ও দাঁড়াতে পারে তাতেও আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ থাকবে না। কারণ আমার দুঃখ তো রবের অনুগত বান্দায় পরিণত করা না করা নিয়ে। সন্তানকে রবের একজন অনুগত বান্দায় পরিণত করতে পারলেই আমার চেয়ে বোধ হয় সুখী আর কেউ থাকবে না। দুনিয়ার কোনো মানুষের নিকট নয়, রবের নিকট নামকরা হতে পারাটাই তো চূড়ান্ত স্বার্থকতা। আহ! এই উপলব্ধিটাই যদি আমাদের সবার হতো তবে জীবনদর্শনটাই পাল্টে যেতো, তাই না হুমায়রা?

– হ্যাঁ, অনেক কিছুই এবার পরিস্কার হলো। তোমার কথাগুলো আমার ধারণাটাই পাল্টে দিলো। আমি ভেবেছিলাম, আমার সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এর মতো অনেক বড়ো কিছু বানাবো যা নিয়ে আমার গর্ব করার থাকবে। কিন্তু এখন তোমার ঐ কথাটিই আমার মাথায় বারবার ঘোরপাক খাচ্ছে যে, সন্তানকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানিয়ে কী লাভ যদি তাকে সিজদাকারীর অন্তর্ভুক্ত করানো না যায়। আসলেই তো, দুনিয়ায় যশ খ্যাতি অর্জন করা গর্বের কোনো বিষয় নয়। গর্বের বিষয় হচ্ছে, সন্তানকে তার রবের সাথে সম্পর্ক গড়িয়ে দেওয়া। এর চেয়ে বড়ো বিষয় আর কিছুই হতে পারে না, কিছুই না।

– মা শা আল্লাহ! তাহলে ব্যাপারটি তুমি এবার ভালোভাবে বুঝতে পেরেছো-তাই তো?

– হ্যাঁ অবশ্যই! ভালোভাবে বুঝিয়ে বললে কারোর-ই না বোঝার কথা নয়। এভাবে যদি প্রত্যেক স্বামী তার স্ত্রীকে কিংবা স্ত্রী তার স্বামীকে সুন্দর ভাষায় বোঝাতো তাহলে তারাও নিশ্চয়ই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন না করে পারতো না। যাইহোক, আমি আমার সন্তানকে সে শিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে চাই যে শিক্ষা তার রবের সাথে কানেকশন তৈরী করে দেয় সর্বোপরি যে শিক্ষা তাকে রবের প্রিয় বান্দায় পরিণত করে। আর সেই তো প্রকৃত সৌভাগ্যবান, যে রবের অনুগত হওয়ার মাধ্যমে রবের সাথে সুসম্পর্ক করে তুলে। আর আমি আমার সন্তানকে এমনই একজন সৌভাগ্যবানদের কাতারে দেখতে চাই।

– হুমায়রা! তোমার কথাগুলো শুনে আমার অন্তরটা শীতল হয়ে গেলো। কারণ সন্তানের আসল শিক্ষক তার মা যখন এ ধরণের ইতিবাচক চিন্তা অন্তরে লালন করে তখন সন্তানকে সঠিক পথের পথিক বানানো বহুগুণ সহজ হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ! সন্তানকে ঘিরে থাকা আমাদের সকল নেক আশা আল্লাহ যেন কবুল করে নেন। আমিন!

– সুম্মা আমিন!

লিখেছেন

পরকালীন তথা স্থায়ী জীবনের লক্ষ্যে নিজেকে প্রস্তুত করার চেষ্টা করছি। নিজে হেদায়েতের ওপর অটল থাকার পাশাপাশি অন্যেদেরকেও হেদায়েতের দিকে আহবান করা তথা পথ হারাদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনাই আমার লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture