Writing

মদীনার সমাজে শিশু কিশোর

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে সাহাবীরা সর্বপ্রথম হিজরত করেন আবিসিনিয়ায়। সাহাবীদের হিজরত শুরু হয় নবুওয়াতের চতুর্থ বছরের শেষের দিকে। খায়বার বিজয়ের পর আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী বেশিরভাগ সাহাবী মদীনায় হিজরত করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবীদের সাথে বসবাস করেন। অবশ্য খায়বার বিজয়ের আগেও কোনো কোনো সাহাবী মক্কা, মদীনায় চলে আসেন।

সাহাবীরা আবিসিনিয়ায় অবস্থান করেন প্রায় ১৬ বছর। এই ষোলো বছর আবিসিনিয়ায় অবস্থানকালে সাহাবীদের অনেক সন্তান সেখানে জন্মগ্রহণ করে। তারা আবিসিনিয়ার পরিবেশে বেড়ে ওঠে, সেখানকার ভাষাও তারা শিখে নেয়।

খালিদ ইবনে সাঈদ ইবনুল আ’স রাদিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন প্রথমদিকের ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীদের একজন। তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। আবিসিনিয়ায় তাঁর একজন কন্যা সন্তান জন্মলাভ করে। তাঁর নাম রাখেন- আমাতা বিনতে খালিদ; যদিও তিনি পরিচিত ছিলেন ‘উম্মে খালিদ’ নামে।

খায়বার বিজয়ের পর আবিসিনিয়া থেকে সাহাবীরা মদীনায় হিজরত করলে খালিদ ইবনে সাঈদ রাদিয়াল্লাহু আনহুও পরিবার নিয়ে মদীনায় হিজরত করেন। উম্মে খালিদ মা-বাবার মুখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নাম শুনতে পান। এবার তিনি স্বচক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে দেখতে পান। তিনি হয়ে যান সাহাবী। তখন তাঁর বয়স কতো হবে? ছয় বা সাত বছর।

একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কিছু কাপড় উপহার দেয়া হলো। কাপড়ের মধ্যে একটি ছিলো নকশাওয়ালা কালো চাদর। তিনি সাহাবীদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই চাদরটি কাকে দেবো?” সাহাবীরা ভদ্রতাবশত কোনো কথা বললেন না।

“উম্মে খালিদকে আমার কাছে নিয়ে এসো।”

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশে সাহাবী গেলেন উম্মে খালিদকে নিয়ে আসতে। নকশাওয়ালা সুন্দর চাদরটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজ হাতে উম্মে খালিদকে পরিয়ে দিলেন এবং তাঁর জন্য দু’আ করলেন- “ব্যবহার করো এবং পুরাতন করো।”

আরবরা ‘ব্যবহার করো এবং পুরাতন করো’ বাক্যটি ব্যবহার করতো ‘দীর্ঘজীবী হও’ অর্থে।

উম্মে খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দেয়া চাদরটি পরার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একনজর দেখে নিলেন চাদর পরে উম্মে খালিদকে কেমন মানিয়েছে। চাদরের নকশার দিকে তাকিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্তব্য করেন- “সানা, সানা ইয়া উম্মে খালিদ।”
[সহীহ বুখারী: ৫৮৪৫, সুনানে আবু দাউদ: ৪০২৪]

চাদরটিতে উম্মে খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহাকে খুব মানিয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন, “সুন্দর, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে উম্মে খালিদ।”

মজার ব্যাপার হলো, ‘সুন্দর’ বুঝাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরবি শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি বলতে পারতেন ‘জামিল’ বা ‘মা আজজামাল’। কিন্তু, তিনি আরবি শব্দ ব্যবহার না করে হাবশী শব্দ ব্যবহার করেন- ‘সানা’।

যেহেতু উম্মে খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহার জন্ম ও বেড়ে ওঠা আবিসিনিয়ায়, সেহেতু তিনি সেখানকার ভাষা জানেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাথে সেই ভাষায় কথা বলেন, যে ভাষার সাথে উম্মে খালিদ পূর্ব-পরিচিত। আবিসিনিয়ায় থাকাবস্থায় তিনি মানুষের মুখে মুখে এই ভাষায় কথা বলতে শুনেছেন। তাঁর কাছে ‘সানা’ শব্দটি হয়তো ‘জামিল’ শব্দের চেয়ে বেশি পরিচিত।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ছোট্ট এক মেয়ের সাথে তাঁর ভাষায় উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন, তখন সেই মেয়ের মনে কেমন অনুভূতি তৈরি হতে পারে চিন্তা করা যায়?

আমাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন ইউরোপ, অ্যামেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে। তাদের ছেলে-মেয়েরা বাংলার চেয়ে সাবলীলভাবে ইংরেজি, আরবি ভাষায় কথা বলে। মা-বাবার কাছে থাকার ফলে বাংলা ভাষা হয়তো তারা বুঝে, কথাও বলে; কিন্তু, স্কুলে গেলে বন্ধু-বান্ধবের সাথে তারা ইংরেজি, আরবি ভাষায় কথা বলে।

বিদেশ থেকে আমাদের কোনো আত্মীয় তার পরিবার নিয়ে দেশে আসার পর তার ছেলে-মেয়ের সাথে আমরা কোন ভাষায় কথা বলবো? ইংল্যান্ড থেকে আসা আত্মীয়ের ছোটো মেয়েকে যখন বলবেন ‘You are looking beautiful’ তখন সে অনেক খুশি হবে। আত্মীয়ের ছোটো ছেলেকে মুরগি দেখিয়ে বলুন ‘এটা Chicken’; দেখবেন খুব সহজেই সে আপনার সাথে মিশে যাবে। বিদেশী শিশুদের সাথে সহজে মিশে যাবার জন্য তার ভাষায় কথা বলাটা খুবই কার্যকরী।

আবিসিনিয়ায় শৈশব কাটানো উম্মে খালিদ রাদিয়াল্লাহু আনহা মদীনার পরিবেশে ছিলেন ‘বিদেশিনী’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উচ্ছ্বাস প্রকাশে উম্মে খালিদের সাথে তাঁর শৈশব কাটানো পরিচিত ভাষায় কথা বলেন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনায় প্রায় ১০ বছর বসবাস করেন, সেখানেই ইন্তেকাল করেন। তখন মদীনায় শিশু-কিশোর কারা ছিলো? কিভাবে তারা বেড়ে ওঠছিলো?
মদীনার সেইসব শিশু-কিশোরদের সাথে রাসূলুল্লাহর সম্পর্ক কেমন ছিলো? সাহাবীরা তাঁদের সন্তানদেরকে কিভাবে রাসূলুল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেন? মূলত এইসব বিষয় নিয়ে এই বই। বইটির অনুবাদ প্রায় শেষ। নাম- ‘মদীনার সমাজে শিশু-কিশোর’।

বইটিকে আলাদাভাবে ‘প্যারেন্টিং’ ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় না, তবে প্রত্যেকটি ঘটনার শিক্ষা কিভাবে বড়োরা ছোটোদের প্রতি প্রয়োগ করতে পারেন এই বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বইটি মূলত সীরাত ও ইতিহাস বিষয়ক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে, সাহাবীদের যুগে একটি নতুন প্রজন্ম গড়ে ওঠছে; যাদের বয়স দুই থেকে আঠারো-বিশ বছর। পুরো ক্যামেরা তাদের দিকে। একটি জেনারেশনকে কিভাবে গড়ে তুলতে হয়, তাদের ছোটোখাটো কাজগুলোকে কিভাবে এপ্রিশিয়েট করতে হয়, তারা কোনো ভুল করলে কিভাবে তাদেরকে সংশোধন করতে হয়, তাদেরকে কিভাবে দায়িত্ব দিতে হয় সেগুলো আমরা এই বইয়ের মাধ্যমে জানতে পারবো।

ইতিহাসধর্মী এই বইয়ের মূল ম্যাসেজ হলো- মদীনার সমাজে শিশু-কিশোরদেরকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়, আমাদের সমাজে আমরা কিভাবে শিশু-কিশোরদেরকে সেভাবে গুরুত্ব দিয়ে গড়ে তুলবো। আমাদের সমাজের শিশু-কিশোরদের জন্য কেমন প্ল্যান নেয়া যায় সেগুলোর আলোচনা প্রতিটি অনুচ্ছেদে রয়েছে।

লিখেছেন

Picture of আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture