Writing

ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ)

ইসলামে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থার রীতিনীতি পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত আছে। ইসলাম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান প্রদান করে। রাসূলের (সা:) পরবর্তী সময়ে যুগে যুগে অনেক মহামনীষীর আগমন হয়েছিল। তারা ছিলেন আমাদের পথপ্রদর্শক। দিকভ্রান্ত উম্মাহকে সঠিক পথের দিশা দেখাতে তাদের ভূমিকা ছিলো অতুলনীয়।

ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম চার জন ইমাম। রাত্রির নিকষ অন্ধকারে যখন ছেয়ে যায় চারিপাশ, জ্বলজ্বলে তারাগুলো তখন আকাশ থেকে হাতছানি দিয়ে আমাদের পথ দেখায়। ঠিক তেমনি চার ইমাম আমাদের মুসলিম উম্মাহের পথের দিশারী। তারা রেখে গিয়েছেন ইলমের এক অফুরন্ত ভান্ডার। তাদের জীবনে জ্ঞান সাধনা, আমল, ইখলাস, আল্লাহর নিয়ামতের শোকরগুজারী, দানশীলতা, ঈর্ষণীয় সবর- আমাদের জন্য গাইডলাইন কিংবা অনুপ্রেরণা। তাই, আমরা তাদের জীবনী পড়বো, জানবো এবং স্বীয় জীবনে প্রতিফলিত করবো ইন শা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন।
আমীন।

আলী (রা:) তার খিলাফতের রাজধানী কূফাতে নিয়ে যান। কূফা হয়ে উঠে ইলম অর্জনের অন্যতম স্থান। নওরোজ অনুষ্ঠান চলছে। এক ধনী ব্যক্তি তার ছেলেকে নিয়ে গেলেন আলীর (রা:) কাছে। আমীরুল মু’মিনীনের কাছে যাওয়ার পর তারা তাকে এক ধরণের মিষ্টান্ন উপহার দেন, যা ছিলো বেশ উন্নতমানের এবং কেবল অভিজাত বংশীয় লোকেরাই এটি খরিদ করবার সামর্থ্য রাখতো।

উপহার হিসেবে তা গ্রহণ করেন আলী (রা:)। তাদের উপর খুশী হয়ে আলী (রা:) তাদের জন্য দোয়া করে দেন, যেনো তাঁর এবং তাঁর বংশধরদের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হয়।

নবীর (সা:) জামাতা ও আমীরুল মু’মিনীন দু’আ করেছেন। দু’আ যে কল্যাণকর তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই দু’আর ফলপ্রসূ হিসেবে ইবনে সাবিতের ঘরে জন্ম নিলো এক ফুটফুটে শিশু যার নাম নু’মান ইবনে সাবিত (রাহিমাহুল্লাহ)।

ইমামে আযম! ইমামদের আলোকবর্তিকা। নু’মান ইবনে সাবিত (রাহিমাহুল্লাহ) হলেন তিনি যিনি সারা মুসলিম বিশ্বে ‘আবু হানিফা’ (রাহিমাহুল্লাহ) নামে প্রসিদ্ধ। উম্মাহর এই অন্যতম মনীষী ইরাকের কুফা নগরীতে ৮০ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেন।

আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) পূর্বপুরুষেরা বেশ সম্পদশালী ছিলেন। যার কারণে তাকে তেমন স্ট্রাগল করতে হয়নি জীবনে। তৎকালীন সময়ে ধনী পরিবারের সন্তানেরা বিস্তৃতভাবে শিক্ষালাভের সুযোগ পেতো। তিনিও সেই সুযোগ লাভ করেছিলেন। শৈশবেই তিনি কোরআন হিফজ এবং এর আলোকে আনুষঙ্গিক শিক্ষা অর্জন করেন।

আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) বাবা ছিলেন একজন নামকরা ব্যবসায়ী। যিনি অত্যন্ত মূল্যবান এবং উন্নত গুণগত মানের সিল্কের ব্যবসায় করতেন। এদিকে আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) ধীরেধীরে বড় হচ্ছেন। মা- বাবা, দাদা, উস্তাজের কাছ থেকে অনেক কিছু শিক্ষালাভ করেছেন তিনি। পারিবারিক ব্যবসায়ে বাবার পরে ছেলেই হাল ধরবেন সেটাই স্বাভাবিক। তাই বড় হবার পর আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) তার বাবার ব্যবসার দেখাশোনার তার কাঁধে বহন করে নিলেন। ব্যবসা করতে করতে ভালো মুনাফা অর্জন তো করতেনই সাথে এই কাজে তিনি বেশ দক্ষ হয়ে উঠলেন। এভাবেই একজন সাধারণ তরুণ হিসেবে বেড়ে উঠছিলেন আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ)। জীবন সময়ের সাথে সাথে অতিবাহিত হতে থাকে।

প্রতিদিনের ন্যায় আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বাজারে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাকে থামালেন সেই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইমাম আশ- শা’বী (রাহিমাহুল্লাহ)। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কোথায় যাচ্ছো?” উত্তরে আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) জানালেন তিনি বাজারে যাচ্ছেন। আশ-শা’বী তাঁকে বললেন, “আমি বাজারে যাওয়ার চাইতে বিদ্বান, জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাহচর্যে থাকা উত্তম মনে করি। তোমার মাঝে আমি দূরদর্শিতা ও শাণিত বুদ্ধির ছাপ দেখতে পাচ্ছি। তুমি জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথে সময় কাটাও, নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে।” এই কথা শুনে আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) মনে বয়ে গেলো এক ঝড়! হৃদয়ে প্রবেশ করলো সূর্যের আলোকরশ্মি। কী শুনলেন আশ-শা’বির কাছ থেকে! তিনি কী সত্যি যোগ্য কেউ! আশ-শা’বীর কথাগুলো আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) মনে ভাবান্তর ঘটালো। এই উপদেশ তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে গেলো। তিনি দৃঢ়চিত্তে জ্ঞানসাধনা করবার সংকল্প করলেন।

তৎকালীন সময়ে জ্ঞানার্জনের জন্য তিনটি তরীকা সবচেয়ে প্রচলিত ছিলো।

১. ইলমুল কালাম।
২. হাদীসশাস্ত্র।
৩. ফিকহ।

কুফায় বিভিন্ন মতাদর্শী (শিয়া, মুতা’জিলা, খাওয়ারেজী) মানুষের বসবাসের কারণে সেই অঞ্চলে ইলমুল কালামের চর্চা বেশি হতো। অর্থাৎ দর্শনশাস্ত্রের প্রয়োগের মাধ্যমে আক্বীদার শিক্ষা প্রদান করা হতো। ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) ইলমুল কালাম নিয়ে উৎসুক হলেন। তিনি কিছু সময়ে সেটায় অতিবাহিত করলে তাঁর কাছে এ বিষয়ের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ইতিবাচক মনে হয়নি।

আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) তখনও ইলমুল কালামের চর্চা ছেড়ে দেননি। একদিন এক মহিলা তাঁর কাছে তালাক সংক্রান্ত একটি প্রশ্ন জানবার উদ্দেশ্যে এলেন। ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে হাম্মাদ ইবন আবি সুলাইমানের (রহিমাহুল্লাহ) কাছে গিয়ে এই বিষয়ে ফতোয়া জেনে আসতে বললেন এবং সাথে বলে দিলেন যে, তিনি যেনো জেনে এসে তাকে এ সম্পর্কে অবগত করেন। যথারীতি সেই নারী উত্তর জেনে এসে তাকে জানালেন। তা শুনে আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বলে উঠলেন, ‘ইলমুল কালাম পড়বার আর প্রয়োজন নেই।’

ইলমুল কালামে মন না বসায় তিনি তারপর চিন্তাভাবনা করে ফিকহশাস্ত্রকে জ্ঞান লাভের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেন। ঐদিন থেকে তিনি হাম্মাদ ইবন আবি সুলাইমানের (রহিমাহুল্লাহ) হালাক্বায় বসতে লাগলেন। এভাবেই তাঁর ফিকহ চর্চার যাত্রা শুরু। বলাবাহুল্য যে, ইলমুল কালামে তিনি বেশ পারদর্শীতা অর্জন করেছিলেন। যা পরবর্তীতে ফিকহ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে যুক্তি তর্কের চিন্তাভাবনায় তাঁকে আরো দক্ষ ও বিচক্ষণ করে তুলেছিলো।

উস্তাদ হাম্মাদ ইবন আবি সুলাইমানের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) প্রায় ১৮ বছর শিক্ষা লাভ করেন। এই উস্তাদ ছিলেন তাঁর ফিকহ সংক্রান্ত জ্ঞানলাভের সর্বোত্তম প্রেষণাদাতা। তিনি তাঁকে যেকোন পরিস্থিতির আলোকে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সমাধান এতো ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন যার কারণে আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) ফিকহের প্রতি আরও বেশী ভালোবাসা জন্মে যায়।

১০ বছর উস্তাদ হাম্মাদের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে শিক্ষা অর্জনের পর একবার ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) মনে চিন্তার উদয় হলো যে, আমি যদি সারাজীবন উস্তাদের ছাত্র হয়ে থাকি তাহলে আমি শিক্ষক হবো কবে! আসলেই তো ভাববার বিষয়!

এ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে আজ রাতে উস্তাদকে জানাবেন যে, তিনি নিজে একটি হালাক্বা করবেন। রাতে যখন তিনি কথা বলতে গেলেন, উস্তাদ হাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) নিজ থেকেই তাকে কিছুদিনের জন্য তাঁর হালাক্বার দায়িত্ব নিতে বললেন। কারণ তাঁকে এক জরুরি কাজে বসরায় যেতে হচ্ছে। এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি!

আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে সুযোগ এসে গেলো! উস্তাদের অনুপস্থিতিতে কয়েক মাস তিনি হালাক্বা পরিচালনা করলেন। এসময় লোকেদের দ্বারা যেই প্রশ্নগুলো উত্থাপিত হয়েছিলো, সবগুলো প্রশ্ন এবং একইসাথে এ প্রশ্নের আলোকে তাঁর নিজস্ব জবাব তিনি লিখে রাখেন।

উস্তাদ হাম্মাদ (রাহিমাহুল্লাহ) ফিরে আসলে তিনি তাঁকে প্রশ্নোত্তর গুলো দেখে দিতে বলেন। ৬০টি প্রশ্নের মধ্য থেকে উস্তাদ ৪০টির সাথে সহমত পোষণ করেন এবং বাকি ২০টি ব্যাপারে ভিন্ন মতামত দেন। অতঃপর ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) বুঝতে পারলেন, তাঁর এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে! তিনি আরও গভীরভাবে শিক্ষালাভে মনোযোগ দেন। এভাবে তিনি শিক্ষার্জন করতে করতে উস্তাদ হাম্মাদের (রাহিমাহুল্লাহ) মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর ছাত্র হিসেবে কাটিয়ে দেন।

শিক্ষকের মৃত্যুর পর একমাত্র একজন ছাত্র তার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। হ্যাঁ, তিনি হলেন ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ)।

ইমাম আবু হানিফা (রহিমাহুল্লাহ) প্রধানত কোরআনের আয়াতের ভিত্তিতে ফিকহ সংক্রান্ত মাস’আলা প্রদান করতেন। এরপর সেইসব হাদীসকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করতেন, যেগুলো রাসূলের (সা:) বাণী হিসেবে সর্বাধিক বিশুদ্ধ সূত্র দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে। আর যখন কোন হাদীস, অন্য কোন শক্তিশালী হাদীস বা সরাসরি কোরআনের আয়াতের সাথে কিঞ্চিত হলেও সাংঘর্ষিক হতো- তিনি তা বর্জন করতেন। অতঃপর কোন হাদীসও যদি পাওয়া না যায়, তিনি সাহাবীদের থেকে পাওয়া সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতটি ই অবলম্বন করতেন। এটিই ছিলো তাঁর অনুসৃত পন্থা। এবং এ কারণে তিনি তাঁর সময়ে এবং পরবর্তী সময়গুলোতে বহুবিধ সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন।

ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) শিক্ষাদান পদ্ধতি ছিলো চমৎকার। তিনি নিজে শাণিত বুদ্ধির অধিকারী ছিলেন এবং ছাত্রদেরও সেভাবেই গড়ে তুলেছিলেন। ফিকহ শিক্ষাদনের সময় যেকোন একটি বিষয়ে ছাত্রদের মতামত প্রথমে শুনতেন। তারপর তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত মত প্রদান করতেন। নিজ মতের স্বপক্ষে এমন সব যুক্তি দাঁড় করাতেন, ছাত্রদের মনে বদ্ধমূল ধারণা হতো যে এটিই সবচেয়ে সঠিক। পরক্ষণেই তিনি আবারো ছাত্রদের মতটিকে শুদ্ধ এবং যৌক্তিক বলে দাবী করতেন। এবং সেই মতের সাপেক্ষে সব যুক্তি খন্ডন করতেন। এভাবেই চলতো তাদের অনুশীলন!

তাঁর ছাত্রদের প্রতি তিনি ছিলেন অনেক যত্নশীল। এমনকি ছাত্রদের আর্থিক অসুবিধে হলেও তিনি তাদেরকে সাহায্য করতেন। প্রয়োজনে সমস্ত খরচ বহন করতেন।

ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) অনেকবার হজ্জ করেছিলেন। জ্ঞানের অন্বেষণে তিনি বহু জায়গায় ভ্রমণ করতেন। তিনি নিজের ফতোয়া উপস্থাপন করতেন। তাঁর ফতোয়ার সমালোচনা গভীর মনোযোগের সাথে শ্রবণ করতেন। অতঃপর পর্যালোচনা করে, দূর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করতেন। প্রায়ই তিনি বসরায় যেতেন। যখন তাঁর কাছে কোন একটি হাদীস উপস্থাপন করা হতো, তিনি হাদীসে বিদ্যমান মূল অভিমত গুলো নির্ণয় করতেন এবং বিশদ ব্যাখ্যা বের করতেন। এরপর তিনি সেই হাদীস থেকে উসূল বা মূলনীতি নির্ধারণ করতেন। এভাবেই তিনি ফিকহ চর্চা করতেন।

তাঁর নিজস্ব ভাষায়,

“কোন হাদীস অনুসন্ধানকারী যদি ফিকহ সংক্রান্ত জ্ঞানার্জন না করে; তাহলে তার অবস্থা সেই ঔষধ প্রস্তুতকারীর মতো, যার কাছে ঔষধ প্রস্তুতের সমস্ত উপকরণ রয়েছে কিন্তু সে জানেনা ঔষধ কিভাবে বানাতে হয়। অর্থাৎ হাদীস অনুসন্ধানকারী ব্যক্তি তাঁর কাছে থাকা হাদীসের মূল্য সম্বন্ধে অবগত নন, যতোক্ষণ না কোন ফক্বীহর শরণাপন্ন হন।”

ব্যবসায়ী হিসেবে এবং ব্যক্তিগত জীবনে লোকেদের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) মধ্যে চারটি অনন্য গুণ ছিলো, যা তাকে একজন ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছিলো। নির্লোভ, বিশ্বস্ততা, উদারতা বা মহানুভবতা এবং ধর্মপ্রাণ।

একবার আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) একজন মহিলার কাছ থেকে বেশ দামী একটি সিল্ক কাপড় খরিদ করছিলেন। সেই মহিলা মূল্য হিসেবে ১০০ দিরহাম চাইলে তিনি এতে আপত্তি জানান। এবং মূল্য বাড়িয়ে চাইতে বললেন। এভাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি করে যখন দাম ৪০০ দিরহামে পৌঁছুলো, মহিলাটি বললেন, “আপনি কি আমায় উপহাস করছেন? এই কাপড়টির দাম এত বেশি কিভাবে হতে পারে!”

মহিলার কথা শুনে আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) এক ব্যক্তিকে ডেকে এ কাপড়ের প্রকৃত মূল্য জানতে চাইলে তিনি জানান, এর দাম ৪০০ দিরহামের চাইতেও বেশি। অতঃপর তিনি ৫০০ দিরহাম মূল্য পরিশোধ করে কাপড়টি খরিদ করলেন। বিক্রেতার মূল্য সম্পর্কে অজ্ঞতার সুযোগ তিনি নেননি। বরং তাকে তার সঠিক প্রাপ্য বুঝিয়ে দেয়াকেই তিনি কর্তব্য মনে করতেন।

কখনো কখনো অস্বচ্ছল বা বন্ধু কেউ তার ক্রেতা হলে তিনি নিজস্ব লভ্যাংশ না নিয়ে পণ্য বিক্রয় করতেন। একবার তাঁর এক বন্ধু এক বিশেষ ধরণ ও গুণগত মানের সিল্ক ক্রয় করতে আসলেন, যেটি সেই মূহুর্তে তাঁর কাছে ছিলো না। বন্ধুকে জানালেন, সেই কাপড়টি হাতে এলে তিনি দিয়ে আসবেন। এক সপ্তাহ পরে, বন্ধুকে তিনি কাপড়টি দিতে গেলেন। বন্ধু মূল্য জানতে চাইলে তিনি এক দিরহাম পরিশোধ করতে বললেন। বিস্মিত হয়ে তার বন্ধু বললেন, ‘আমি আশা করিনি যে তুমি আমাকে এভাবে উপহাস করবে! এটির দাম ১ দিরহাম কিভাবে হয়? ’ আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরে বললেন, ‘আমি দুটি কাপড় ক্রয় করেছিলাম ২০ দিনার এক দিরহাম দিয়ে। অন্য কাপড়টি ২০ দিনার দিয়ে বিক্রয় করেছি। তাই তোমার কাছ থেকে আমি ১ দিরহাম ই রাখবো।’

পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে তিনি নির্দিষ্ট কিছু মূলনীতি অবলম্বন করতেন। কখনো নিজ পণ্যের প্রশংসা করতেন না। তাঁর ব্যবসায়ীক পার্টনার ছিলেন হাফস ইবন আব্দুর রহমান। যদিও তিনি বয়সে ইমাম আবু হানিফার চাইতে বড় ছিলেন, তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ, প্রজ্ঞাবান একজন ব্যক্তি। তাই তাঁকে জ্ঞানসাধনায় পূর্ণ মনোযোগ দেবার সুবিধে করে দেবার জন্য তিনি একা ই ব্যবসা পরিচালনা করতেন এবং আবু হানিফাকে (রাহিমাহুল্লাহ) প্রয়োজনীয় সাপোর্ট দিতেন।

ইমাম আবু হানিফা (রাহিমাহুল্লাহ) ছিলেন অধিক দানশীল। আল্লাহ তাঁকে প্রভূত সম্পদের মালিক করেছিলেন। তিনি আল্লাহর পথে প্রচুর পরিমাণে দান করতেন। তাঁর পিতা তাঁর জন্য ২,০০,০০০ দিরহাম রেখে যান।

আলী (রা:) থেকে উদ্ধৃত এক বর্ণনা অনুসারে আবু হানিফা মনে করতেন, একজন মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য ৪০০০ দিরহামের বেশি অর্থ প্রয়োজন নেই। সবসময় তিনি এই কথার উপর আমল করতেন। তাই তিনি সবসময় তার সঞ্চিত অর্থ হিসেব করে রাখতেন। যখনই তা ৪০০০ দিরহামের চাইতে বেশি হয়ে যেতো, তিনি অতিরিক্ত অর্থসম্পদ আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান করে দিতেন। তার আরো একটি অনন্য অভ্যেস ছিলো, যা তাঁর দানশীলতার মাত্রা সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা দিতে পারবে।

জানা যায় যে, ইমাম আবু হানিফা যখন ই পরিবারের কোন প্রয়োজনে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতেন, ঠিক একই পরিমাণ অর্থ তিনি আল্লাহর রাস্তায় দান করতেন। সুবহানাল্লাহ!

প্রতিদিন পুত্রের কাছে ১০ দিরহাম দিতেন এবং তাঁকে বলতেন, কোন অভাবী লোক খুঁজে তাকে দিয়ে দিতে। এভাবে তিনি পুত্রের মাঝে অল্প বয়সেই সাদাক্বা দেবার অভ্যাস গড়ে তোলেন। প্রতি জুম’আয় ইমাম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ তাঁর মৃত বাবা মায়ের নামে সাদাক্বায়ে জারিয়াহ হিসেবে ২০ দিনার (সেসময়ের স্বর্ণমুদ্রা) দান করতেন।

আল্লাহ ইমাম আবু হানিফাকে প্রভূত সম্পদের মালিক করেছিলেন। এবং তিনি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের প্রতি সবসময় শোকরগুজার ছিলেন ও সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকতেন।

একবার তিনি পথ দিয়ে চলার সময় বিশ্রাম নেবার জন্য একটি বাড়ির পাশের গাছের ছায়ায় বসলেন। কিছুক্ষণ পর সাথীদের কাছে জানতে চাইলেন তারা এ বাড়ির মালিকের পরিচয় সম্বন্ধে জানেন কিনা। বাড়ির মালিক ছিলেন এমন একজন, যিনি ইমাম আবু হানিফার থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এ কথা শোনামাত্র ই তিনি ছায়া থেকে উঠে সরে দাঁড়ালেন। সবাই অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, “আমি ভয় পাচ্ছি, আল্লাহ আমার এই ছায়ার সুবিধা নেয়ার কাজটুকু ঋণের সুদ হিসেবে না আবার গণ্য করেন! ”

শা’মের (বর্তমান সিরিয়া) একজন ইমাম, ইমাম আল আউযাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)। তিনি বৈরুতে থাকতেন। ইমাম আবু হানিফাকে (রাহিমাহুল্লাহ) নিয়ে তিনি কিছু ভুল তথ্য শুনেছিলেন। আবদুল্লাহ ইবন আল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) কুফা ভ্রমণ শেষে ফিরে এলে তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া খোরাসানী! কে এই লোক যে কুফায় সব বিদ’আতের প্রচলন করছে? শুনলাম তার নাম আবু হানিফা?’

আবদুল্লাহ আল মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। তিনি বাড়ী ফিরে গেলেন এবং ইমাম আবু হানিফার (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে শুনে আসা ফতোয়া গুলো সব লিপিবদ্ধ করলেন। এরপর তিনি ইমাম আউযা’ঈয়ের (রাহিমাহুল্লাহ) কাছে গিয়ে এসমস্ত ফতোয়া উল্লেখ করলেন। ইমাম উযা’ঈ বিস্মিত হলেন এবং তাঁকে বললেন, ‘নিঃসন্দেহে ইনি একজন বিজ্ঞ, দূরদর্শী, উঁচুমানের ফক্বীহ। তুমি অবশ্যই তার থেকে শিখবে।’

এবার আবদুল্লাহ ইবন মুবারক (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁকে জানালেন যে, এই ফতোয়াগুলো ইমাম আবু হানিফার (রহিমাহুল্লাহ) দ্বারা প্রদত্ত! তা শুনে তিনি আল্লাহর কাছে পূর্বের ভুল ধারণার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

লিখেছেন

আল্লাহর কাছে জবাবদিহির ভার লঘু করতে কিছুটা লিখালিখির চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে অনুবাদ সাহিত্য বিশেষ পছন্দ।
আকাশে পরিচিত হতে চাই💙
জমিনে না হয় অপরিচিত ই থাকলাম…

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture