গিবত থেকে বিরত থাকা এবং গিবতের কাফফারা
গিবত থেকে বিরত থাকার লাভ এবং গিবতের আলোচনাকে প্রতিহত করার অসামান্য পুরস্কার
গিবত থেকে বিরত থাকার ফজিলত
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি (আল্লাহর) কোনো বান্দার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৪৮৯]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৭৪৬]
তবে, কারও উপর জুলুম হলে, সে এটি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে এমন কারও সাথে তার জুলুমের বিবরণ দিতে পারবে, যে এর বিচার করার ক্ষমতা রাখে। কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেন, ‘‘মন্দ কথার প্রচারণা আল্লাহ পছন্দ করেন না; তবে যার উপর জুলুম করা হয়েছে (তার ব্যাপারটি ভিন্ন)। আর আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’ [সুরা নিসা, আয়াত: ১৪৮]
তবে, মানহানির উদ্দেশ্যে সাধারণভাবে সবার কাছে বলে বেড়াতে পারবে না। কারণ হাদিসে এসেছে, ‘‘প্রত্যেক মুসলিমের রক্ত, সম্পদ ও মর্যাদা অপর মুসলিমের জন্য হারাম।’’
[ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৪৩৫]
গিবত প্রতিহত করার পুরস্কার
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গিবত প্রতিরোধ করে, তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা আল্লাহর হক (অর্থাৎ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহর)।’’
[ইমাম আহমাদ, আল-মুসনাদ: ২৭৬৫০; শায়খ আলবানি, সহিহুত তারগিব: ২৮৪৭; হাদিসটি সহিহ]
নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি অপর মুসলিমকে এমন স্থানে ত্যাগ করে, যেখানে তার সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয় এবং তার মর্যাদা বিনষ্ট করা হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করা হতে বিরত থাকবেন, যেখানে সে নিজের সাহায্য কামনা করবে। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন স্থানে সাহায্য করবে, যেখানে তার মর্যাদা বিনষ্ট করা হয় এবং তার সম্মান ভূলুণ্ঠিত হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে সাহায্য করবেন, যেখানে সে নিজের সাহায্য প্রত্যাশা করবে।’’
[ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান: ৪৮৮৪; হাদিসটির সনদ দুর্বল]
অন্য হাদিসে এসেছে, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যে তার (মুসলিম) ভাইয়ের মান-সম্মানের উপর আঘাতকে প্রতিরোধ করে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা তার মুখমণ্ডল হতে জাহান্নামের আগুনকে প্রতিহত করবেন।’’ [ইমাম তিরমিযি, আস-সুনান: ১৯৩১; হাদিসটি সহিহ]
গিবত করতে আমাদের ভালো লাগলেও এর শাস্তি মারাত্মক। আবার, এ থেকে বেঁচে থাকার পুরস্কারও অসাধারণ। আমরা যদি স্রেফ অপ্রয়োজনীয় কথা কমিয়ে দিতে পারি, তাহলে ইনশাআল্লাহ গিবত থেকে অনেকাংশে বাঁচতে পারবো। যখন আমাদের প্রয়োজনীয় আলোচনা থাকে না, তখনই অন্যের বিষয়ে রসিয়ে রসিয়ে আলাপ জমাই আর মানুষের সম্মানহানি করি।
গিবতের কাফফারা (প্রায়শ্চিত্ত)
কারও গিবত করলে, এর ক্ষতিপূরন, কাফফারা এবং প্রায়শ্চিত্ত কীভাবে দিতে হবে?
যেহেতু গিবতের মাধ্যমে ব্যক্তির সম্মান ও মর্যাদা নষ্ট হয়, তাই গিবত করা সর্বসম্মতিক্রমে হারাম। কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা গিবত করাকে ‘‘মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়া’’র সাথে তুলনা করেছেন! মুহাক্কিক আলিমগণের মতে, গিবত করা মানে বান্দার অধিকার নষ্ট করা। আর, বান্দার অধিকার নষ্টের গুনাহ এত মারাত্মক যে, এসব গুনাহ বান্দা নিজে ক্ষমা না করা পর্যন্ত আল্লাহ ক্ষমা করেন না। তাই, যার গিবত করা হয়েছে, তার কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। তবে, ব্যক্তি মারা গেলে বা তাকে পাওয়া না গেলে, তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে।
[মোল্লা আলি কারির ‘মিরকাতুল মাফাতিহ’, ইমাম নববির ‘আল-আযকার’ এবং মুফতি তাকি উসমানির ‘ইসলাহী মাজালিস’]
আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আরবরা সফরে গেলে একে অপরের খেদমত করতো। আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর সাথে একজন লোক ছিলো, যে তাদের খেদমত করতো। একবার তারা ঘুমিয়ে পড়েন। অতঃপর জাগ্রত হয়ে লক্ষ করেন যে, সে তাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করেনি (বরং ঘুমিয়ে আছে)। ফলে একে অপরকে বলেন, ‘‘এ তো এমনভাবে ঘুমায়, যেন বাড়িতে (নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে)!’’ অতঃপর তারা তাকে জাগিয়ে বলেন, ‘‘তুমি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে তাঁকে বলো যে, আবু বকর ও উমর আপনাকে সালাম জানিয়েছেন এবং আপনার নিকট খাবার চেয়েছেন।’’ (সে গেলো, তখন) রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘যাও, তাদেরকে আমার সালাম প্রদান করে বলবে যে, তারা খাবার খেয়ে নিয়েছে।’’ (একথা তাদেরকে বলার পর) তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে নবিজির নিকট এসে বলেন,
‘‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা আপনার নিকট খাবার আনতে একে পাঠালাম। অথচ আপনি তাকে বলেছেন, তারা খেয়ে নিয়েছে। আমরা কোন্ খাবার খেয়েছি?’’ তিনি বলেন, ‘‘তোমাদের ভাইয়ের মাংস (খেয়েছো)! যাঁর হাতে আমার প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের উভয়ের দাঁতের মধ্যে তার মাংস দেখতে পাচ্ছি।’’ তখন তারা বলেন, ‘‘আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।’’ তিনি বলেন, ‘‘বরং সে-ই তোমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুক।’’
[ইমাম যিয়াউদ্দিন মাকদিসি, আল-মুখতারাহ: ১৬৯৭; শায়খ আলবানি, সিলসিলা সহিহাহ: ২৬০৮; আলবানি (রাহ.) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন, তবে কতক মুহাক্কিক হাদিসটিকে মুনকার ও ত্রুটিযুক্ত বলে সাব্যস্ত করেছেন (fahmalhadeeth-com)]
অনেক আলিমের মতে, যদি মাফ চাইতে গিয়ে নতুন করে আরও ঝামেলা, মনোমালিন্য বা ফিতনা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, তবে মাফ চাওয়া জরুরি নয়। বরং সে এর প্রায়শ্চিত্ত বা কাফফারা হিসেবে কিছু কাজ করবে।
(১) যার কাছে ওই ব্যক্তির গিবত করা হয়েছে, তার কাছে গিয়ে তার ভালো গুণগুলো বলবে।
(২) যার গিবত করা হয়েছে, তার জন্য বেশি বেশি মাগফিরাতের দু‘আ করবে।
(৩) সে মৃত্যুবরণ করলে, তার মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে কিছু সাদাকাহ করবে।
আশা করা যায়, হাশরের ময়দানে সে এসব দেখার পর গিবতের জন্য আল্লাহর কাছে বিচারপ্রার্থী হবে না। এগুলোর পাশাপাশি অবশ্যই আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে।
তবে, যারা নিজেদের আখিরাতের ব্যাপারে অধিক সচেতন, তাদের উচিত গিবতের জন্য দুনিয়ায় থাকতেই ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। বিশুদ্ধ হাদিসের আলোকে এটাই প্রকৃত সমাধান এবং অধিক গ্রহণযোগ্য মত। তবে, মাফ চাইতে গিয়ে কী বলে গিবত করা হয়েছিলো, সেটা বিস্তারিত বলা জরুরি নয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘যদি কেউ (গিবত, গালি বা অপমান করে) কারো মর্যাদা নষ্ট করে অথবা অন্য কোনোভাবে কারো প্রতি জুলুম করে থাকে, তবে সে যেন কিয়ামতের পূর্বে আজই তার থেকে মুক্তি নিয়ে নেয়। কারণ সেই দিন কোনো দিনার-দিরহাম (অর্থের বিনিময়) থাকবে না।
যদি তার নেক আমল থাকে, তবে তার জুলুমের পরিমাণ অনুসারে নেক আমল নিয়ে নেওয়া হবে (এবং মজলুমকে এর দ্বারা বদলা দেওয়া হবে)। আর যদি তার নেক আমল না থাকে, তবে তার সাথির (যার অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে) পাপ নিয়ে তার কাঁধে চাপানো হবে।’’
[ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ২৪৪৯]