দশ মাস দশ দিন

অসহ্য অসহনীয় যন্ত্রণা। সারা শরীর হতে ঝর ঝর করে পরছে ঘাম। ‘ইয়া আল্লাহ’ বলে চিৎকার করে কিন্তু কি ভেবে যেন আবার ধৈর্য ধরে থাকে রাবেয়া আন্টি।
দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে থাকে আরো কিছুক্ষণ। হঠাৎ ধাত্রী মা বলে উঠে, “অবস্থা ভালো না, হাসপাতালে নিয়ে যান।”
এমনই সময় প্রকৃতির পরিস্থিতিও অনুকূলে নেই। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। রাত আড়াইটা। শরিফ আঙ্কেল কি করবেন বুঝতে না পেরে, সেই বৃষ্টিতেই বের হয়ে গেলেন গাড়ির সন্ধানে। রাস্তার অবস্থা ও খুব খারাপ। ইতস্ততার সাথে পাশের এক সিএনজি চালকের ঘরে গেলেন। বাহির হতে সজোরে ডাকছেন

“সাহাব ভাই !সাহাব ভাই! আছেন? আমি শরিফ বলছি! ভাই জান আমার বাচ্চার মায়ের অবস্থা তেমন ভালো না ভাই। তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।ভাই দয়া করে একটু আসুন না, বড্ড উপকার হবে যে ভাই!

( ঘুম মাখানো চোখে বিরক্তির সাথে বের হয়ে এলো সাহাব) কি ভাই এত বৃষ্টির মধ্যে, ডাকাডাকি করছেন যে! কি হয়েছে শরিফ ভাই!

সাহাব ভাই! খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে। বাচ্চার মায়ের অবস্থা ভালো না। একটু আসুন না ভাই!
(অনিচ্ছা সত্ত্বেও) আচ্ছা ঠিক আছে চলুন।
খুব কষ্ট করে কাঁদা মাটি পেরিয়ে, সিএনজিতে করে হাসপাতালে নেওয়া হলো রাবেয়া আন্টিকে।
ইমারজেন্সি রোগী। তড়িঘড়ি করে অপারেশন রুমে ঢোকানো হলো রাবেয়া আন্টি কে। সে কি অসহনীয় যন্ত্রণা। ধৈর্যের বাঁধ যেন প্রায় ভেঙে যাচ্ছিল। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পরেও, কিছু হলো না। ভিতরের রুম হতে একজন নার্স এসে শরিফ আংকেলকে বলল-

রোগীর অবস্থা ভালো না। দ্রুত অপারেশন করাতে হবে। আপনি রিসিপশন রুমে গিয়ে কিছু ফরমালিটি মেনটেন করে আসুন।
আমতা আমতা স্বরে চোখ মুখ বড় করে কিছু না বলেই আধদৌড় হয়ে রিসিপশন রুমের দিকে ছুটে গেলেন শরিফ আঙ্কেল। ফরমালিটি মেইনটেইন করে, তিনি এখন হাসপাতালে করিডরে এপাশে হতে ওপাশ‌ হাঁটছেন। কপালে গুড়ি গুড়ি ঘামের উপস্থিতি, আঙ্গুলের সাহায্যে তসবিহ পাঠ করছেন।

১৫ মিনিট পর নার্স এসে খবর দিলো ,
স্বাগতম। আপনার পুত্র সন্তান হয়েছে। মায়ের এবং পুত্রের অবস্থা খুবই দুর্বল। দোয়া রাখবেন।
শুকরিয়ায় চোখের কোণে জল টলোমলো করছে শরিফ আঙ্কেলের। তিনি আর দ্বিতীয়বার না ভেবে সোজা চলে গেলেন হাসপাতালের নিচ তলা ভবনে। অযু করে যেখানে নামাজের ব্যবস্থা আছে সেখানে গিয়ে, শুকরিয়া সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। নীরবে কাঁদতে লাগলেন, পুত্র সন্তান এবং স্ত্রীর সুস্থতার জন্যে। রাব্বি আল্লাহর কাছে চাইতে লাগলেন।….

শরিফ আঙ্কেল সালাত আদায় করে বের হতেই দেখে, একজন বৃদ্ধা আনমনা হয়ে হুইল চেয়ারে বসে আছেন। কেমন যেন মায়াবী ছিল সেই বৃদ্ধার চাহনি। আশেপাশে তার কেউ নেই। শরিফ আঙ্কেলের মনে হল- মনে হয় উনার সন্তানেরা উনাকে এখানে রেখে, কোথাও গিয়েছেন। কিন্তু তিনি এ কথাটি ভাবতে না ভাবতেই দেখলেন একজন নার্স এসে ওনাকে অনেকটা অযত্নের সাথে হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ১৪ নং কেবিনের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। সাথে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন “আপনাকে না কতবার মানা করেছি একা একা বের না হতে।”
শরিফ আঙ্কেলের এই চাহনি দেখে, পাশের এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন।

কি ভাই কি দেখছেন এভাবে!

(আমতা আমতা করে ঐ বৃদ্ধার দিকে ইশারা করে) দেখুন ভাই! কেমন ব্যবহার করছে। ওই বৃদ্ধাটার কি কোন সন্তান এখানে নেই!
-না ভাই ওনার কোনো সন্তান এখানে নেই। উনাকে বৃদ্ধাশ্রম হতে এখানে আনা হয়েছে।তিন ছেলে দুই মেয়ে উনার। ছেলেমেয়ে সব দেশের বাইরে থাকে। উনার স্বামী মারা গিয়েছেন আজ প্রায় চার বছর। দেখাশুনার জন্য একজন কেয়ারটেকারও রাখা হয়েছিল। কিন্তু একা একা ঘরে যেন বারবার অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তাই ছেলেমেয়েরা বৃদ্ধাশ্রমের এডমিট করে দিয়ে গেছেন।

( একটু চমকে গিয়ে, ভ্রু কুঁচকে) হায় ,আল্লাহ! আপনি কে হোন ভাই ঐ বৃদ্ধার?

(মুচকি হাসির সাথে) আমি মোঃ হাসানাত। ওই বৃদ্ধাশ্রমের একজন কর্মী। কারো অসুখ হলে নিজ দায়িত্বে হাসপাতাল অব্দি নিয়ে আসি এবং রোগীর হাসপাতালে যাবতীয় দেখাশোনা করি। তবে এই বৃদ্ধার প্রতি যেন এক বিশেষ মায়া কাজ করে। উনার ছেলেমেয়েরা আমাকে মাঝে মাঝে কল দেয়, তাদের মায়ের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য।তাই পাশে থাকি সবসময়।

(একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে) কি এক অদ্ভুত প্রীতি! দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরে ,আজ মা হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমের অধিবাসী।

হা হা হা… .। (কিছুটা আক্ষেপের হাসি বটে)। তা ভাই আপনি এখানে, আপনার কি কেউ এখানে ভর্তি হয়েছেন?

হ্যাঁ ভাই। আল্লাহর অশেষ রহমতে আজ আমার এক পুত্র সন্তান হয়েছে। মা – ছেলে উভয় খুব দুর্বল। এখনো ছেলেকে নিজ চোখে দেখতে পারিনি। আল্লাহ সহায়।

মাশাআল্লাহ। একদম চিন্তা করবেন না ভাই। আল্লাহ খুব দ্রুত সুস্থতা দান করবেন ,ইনশাআল্লাহ।

ইনশাআল্লাহ।
-এই যা… । আপনার নামটাই জানা হলো না।
-আমি মোঃ শরিফুল ইসলাম। আপনি চাইলে আমাকে শরিফ বলে সম্বোধন করতে পারেন ভাই।

হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে শরিফ আঙ্কেল। তার সন্তান হয়েছে প্রায় একঘন্টা হতে চলল, কিন্তু এখনো বাচ্চা এবং স্ত্রীকে নিজ চোখে পর্যবেক্ষণ করতে পারলেন না। হঠাৎ একজন নার্স এসে বললো-

মা এবং শিশুকে ১৬ নং কেবিনে শিফট করা হবে। আপনি ঐখানে গিয়ে দেখতে পারবেন।
-(শরিফ আঙ্কেল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ে)
কিছুক্ষণ পর… .।
১৬নং কেবিনে ঢুকে শরিফ আঙ্কেল রাবেয়া আন্টিকে-

আসসালামু আলাইকুম।

ওয়ালাইকুমুস সালাম।
-খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না বুঝি?
-আলহামদুলিল্লাহ, না। আমার সন্তানকে দেখার পর এইসব যন্ত্রণাদায়ক কষ্ট মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গিয়েছে।
(মুচকি হাসে শরিফ আঙ্কেল) কিন্তু দুচোখের কোণে লুকিয়ে রাখতে চাওয়া জল টলমল করছিল। রাবেয়া আন্টি তা খেয়াল করতেই বলে উঠে –

আপনি কাঁদছেন কেন? আমরা তো আল্লাহর রহমতে সুস্থ আছি!

(মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে) কই না এমনি। আলহামদুলিল্লাহ।

আপনি কি এখনো আমাদের সন্তানকে দেখেননি?

(শরিফ আঙ্কেল না সূচক মাথা নাড়ে)

(দোলনার দিকে ইশারা করে) আপনার পুত্র সন্তান ঠিক দেখতে আপনার মতই হয়েছে।
আস্তে আস্তে হেঁটে শরিফ আঙ্কেল দোলনার পাশে গেলেন। শরিফ আঙ্কেলের দৃষ্টি পড়ে ফুটফুটে সেই বাচ্চার প্রতি। মুহুর্তেই কোলে তুলে নেন।চুমু খেতে লাগলেন। এবার যেন চোখের জল আর লুকিয়ে রাখতে পারলেন না শরিফ আঙ্কেল। অঝোরে কাঁদতে লাগলেন আর সন্তানের কানের পাশে করে মুখ টেনে পাঠ করেন-

আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার

আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ… .।
ক্ষণ পরে রাবেয়া আন্টি শরিফ আঙ্কেল কে জিজ্ঞেস করে-

কি ব্যাপার ! আপনি আজকে এই ভাবে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন কেন? আপনি কি কোন কারণে নারাজ!আপনি কি খুশি হননি আমাদের পুত্র সন্তান হয়েছে দেখে?

কি যে বলো রাবেয়া। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহর দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া। আল্লাহ আমাদের পুত্র সন্তান দান করেছেন। আমি কিভাবে খুশি না হয়ে থাকতে পারি।
-তাহলে এ কিসের কান্না!

জানতে চাও?

হুম!

আমার এই কান্নার কারণ দুটি। প্রথমত এই কান্না শুকরিয়ার। দ্বিতীয়ত এই কান্না হারানোর ভয়ের।
-দ্বিতীয় কারণটি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
-জানো আজকে নামাজ পড়ে বের হওয়ার সময় একজন বৃদ্ধা… .।(মূলত সে বৃদ্ধার কাহিনীটি রাবেয়া আন্টির সামনে পেশ করে শরিফ আঙ্কেল)

(আবেগমিশ্রিত স্বরে)আল্লাহ ক্ষমা করুন। আল্লাহ আমাদের সন্তানকে আরোগ্য দান করুন। আমাদের পুত্র সন্তানকে ইসলামের পথে কবুল করুন আমিন।

কেন এমন হয় বলোতো! তারা কি তাদের জান্নাত কে অবহেলা করছে নয় কি!
-হায়! তারা যদি বুঝতো , তারা যদি জানতো তাহলে বোধহয় তাদের মাকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দিত না।

হুম…

সকাল সাড়ে নয়টা। রাবেয়া আন্টিকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে শরিফ আঙ্কেল দাঁড়িয়ে আছেন। একজন নার্স এসে সে ওষুধ গুলো নিয়ে রাবেয়া আন্টিকে ড্রেসিং রুমে নিয়ে গেলেন।
শরিফ আঙ্কেল বাহিরে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার দেখা হয়ে যায় মোঃ হাসানাত এর সাথে।
হাসানাত: আসসালামুআলাইকুম ভাই। কেমন আছেন! আপনার পুত্রসন্তানের কি অবস্থা?
শরিফ: ওয়ালাইকুমুস সালাম ভাই। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছেন।
হাসানাত: আলহামদুলিল্লাহ। জানেন ভাই একটা খুশির সংবাদ আছে।
শরিফ: তাই, তা আমি কি জানতে পারি কি সেই খুশির সংবাদ।
হাসানাত: আপনাকে বলার জন্যই ভাই খুঁজে বের করলাম। ওই যে গতকাল আপনি যে বৃদ্ধাকে দেখলেন, তার সন্তানেরা আসছেন আজকে। তাদের মাকে দেখার জন্য।
শরিফ: হায়, মাশাআল্লাহ। তারা কি তাদের মাকে নিয়ে যেতে আসছে?
হাসানাত: সেটা ঠিক জানিনা। তবে আজকে আমাকে ফোন করে জানানো হলো তারা আজকে আসছেন। হাসপাতালে নাকি তারা আসবেন।
শরিফ: আচ্ছা‌। তো বৃদ্ধা’মা টির কি অবস্থা?
হাসানাত: আলহামদুলিল্লাহ ভাইজান। তিনি যখন শুনেছেন তাঁর বাছাধনেরা আসছেন নাতি নাতনীদের নিয়ে, মুহূর্তে যেন তিনি সতেজ হয়ে গিয়েছেন ‌। এবং তারা কি আসছে !তারা কি আসছে! এই বলে
উদ্বিগ্ন হয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে থাকে।
শরিফ: হা হা… .। আল্লাহ উনাকে সুস্থতা দান করুন। আমীন। (কিছুক্ষণ আনমনা হয়ে কি ভেবে যেন) আচ্ছা ভাইজান! আমি যদি আপনাকে একটি জিনিস দেই ,আপনি কি তা বৃদ্ধ সেই মায়ের ছেলেমেয়েদের হাতে দিতে পারবেন!
হাসানাত: আরে ভাই কেন নয়! অবশ্যই পারবো। তবে কি জিনিস দিতে চান আপনি?
শরিফ: আজ দুপুরে নামাজের স্থানে আপনার সাথে দেখা হবে ইনশাল্লাহ। তখনই জানতে পারবেন।
হাসানাত: (একটি সুন্দর হাসির সাথে) আচ্ছা ভাই ঠিক আছে।

দুপুর ১টা ৩০. নামাজ আদায়ের পর, হাসানাত শরিফ আংকেলের জন্যে অপেক্ষা করছেন। নামাজ শেষ করে শরীফ আঙ্কেল হাসানাতের দিকে আসেন। এবং পকেট হতে একটি খাম বের করে,

এই নিন ভাই! এটাই দেওয়ার ছিলো আপনাকে।
-কি ভাই এটা! (খামটিতে হাতে নিয়ে)
-একটি চিরকুট আছে এতে। বৃদ্ধার যখন সকল ছেলে মেয়েরা একসাথে এসে জড়ো হবেন। আপনি তখন তাদের সবার বড় ছেলেকে এই খামতি দিবেন।

আচ্ছা ভাইজান বুঝেছি।
-(কিছুটা মুচকি হাসির সাথে) আচ্ছা ভাই তাহলে আজকে আসি। আজ আমার স্ত্রী এবং সন্তানকে রিলিজ দেয়া হয়েছে। ইনশাআল্লাহ আসরের পরে চলে যাবো। দোয়া রাখবেন ভাই।

আলহামদুলিল্লাহ। জি ভাই অবশ্যই। আপনিও দোয়া রাখবেন আমার জন্য।
-ইনশাআল্লাহ । যথার্থ।

দুপুর ৩ টা ৪০। বৃদ্ধার এক এক করে সন্তানরা আসছেন। অল্পক্ষণ পরেই তারা সবাই এসে তাদের মায়ের কেবিনে জড়ো হলেন। কেউ কেউ তাদের মা’কে চুমু দিচ্ছেন। নাতি-নাতনি গুলো তাদের দাদিকে পেয়ে খুনসুটি করছে। মুহুর্তের মধ্যে যেন সুস্থ হয়ে গেলেন এমন। এরই মাঝে তার ছোট ছেলে বলে উঠলেন-
-উফ… এখানে অনেক গরম।
পাশ থেকে ছোট বোন বলে উঠলো-

“ইয়েস! ইউ আর রাইট”! আই ফিল সো মাচ হেজিটেট। এন্ড দিস এনভায়রনমেন্ট ইস সো মাচ আনহেলদি।
সাথে সাথে পাশ থেকে তার স্বামী বলে উঠলো-

কুল ডাউন! আর কিছুক্ষণই তো। “দেন ও’ই উইল গো আওয়ার রিয়াল রেসিডেন্স।
খন পরে হাসানাত রুমে প্রবেশ করলো। এবং তাদের উদ্দেশ্য করে বললো-

এখানে তো অনেক বেশি গরম! চলুন হাসপাতালে ওই মাঠটিতে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। এতে আপনাদের মায়ের ও অনেক ভালো লাগবে।
বড় ছেলে: ঠিক বলেছ হাসানাত। চলো তবে সেখানেই যায়।
কিছুক্ষণ পর সবাই সেখানে জড়ো হলো। হাসানাত তাদের সবার উদ্দেশ্য করে বলে, আপনাদের জন্য একটি চিরকুট আছে। একজন অপরিচিত ব্যক্তি তা দিয়ে গেলেন। এবং বললেন এটি যেন সকলের সামনে খুলে পড়া হয়। এবং চিঠিটি যেন বড় ছেলেকে দেওয়া হয়।এই বলে, বড় ছেলের দিকে চিঠিটি বাড়িয়ে দিলেন হাসানাত।
সবাই অনেকটা আগ্রহের সাথে, চিঠিটে কি লেখা আছে তা জানার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। এবং বড় ছেলে (ভ্রু কুঁচকে আগ্রহের সাথে) খাম থেকে চিরকুটটি বের করে –
মেজো ছেলে: জোরে জোরে পড়ো ভাইয়া।
(হাঁ সুচক মাথা নেড়ে)-
জনাব জনাবা,
আসসালামুআলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ। আশা করি আল্লাহর অশেষ রহমতে আপনারা সকলেই ভাল আছেন। শুরুতেই বলে দেই, আমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি। আমার পরিচয় দিলেও হয়তো আপনারা আমাকে চিনবেন না। তাই আমার পরিচয় দিলাম না। আপনাদের থেকে বেশি সময় নেবো না। কয়েকটি মাত্র কথা ছিল আপনাদের সকলের প্রতি, আর সেই কথাগুলো পেশ করার জন্যই আমার হাতে লেখা এক অপরিচিত চিঠি।
শুরুতেই বলতে চাই আপনারা অনেক সৌভাগ্যবান। কেননা ধরণীর এই বুকেতে আপনাদের “জান্নাত” !মানে আপনাদের মা এখনো বেঁচে আছেন আল্লাহর অশেষ রহমতে। কিন্তু অত্যন্ত আফসোসের সাথে বলতে হয় যে, আপনারা হতভাগার ন্যায় সেই “জান্নাত” কে অবহেলা করছেন। আপনাদের নিজেদের থেকে দূরে রেখে সেই “জান্নাত” কে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় দিলেন। অথচ ১০ মাস ১০ দিন করে,করে আপনাদের পাঁচ-পাঁচটি সন্তানকে লালন পালন করেছিলেন আপনাদের সেই “জান্নাত”।ওরুফে আপনাদের মা।
যিনি আপনাদের এই সুন্দর দুনিয়া দেখালেন, আপনাদের লাক্সারিয়াস ঘরেও এখন সেই মায়ের জায়গা হয় না। অথচ আপনাদের মা এর চোখের দিকে তাকিয়ে কেন যেন মনে হয়েছিল -“তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল আপনাদের মতো সন্তানকে পেটে ধরে উনার অর্ধবছর ,আপনাদের পেছনে লালন-পালন করে কাটিয়ে দেওয়া।”
আচ্ছা আপনারা তো মুসলিম! নামাজ কালাম ঠিকই পড়েন হয়তো! অন্তত শুক্রবারে হলেও মসজিদে যান! ধরে নিলাম। আচ্ছা এখন যদি আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি! আপনারা কেন মসজিদে যান?
প্রতিউত্তরে হয়তো আপনারা সকলে বলবেন, “জান্নাতে যাওয়ার আশায়। “
আর আমি আপনাদের সেই উত্তর অনুমান করে বলছি,”আপনার জান্নাত কে আপনি বৃদ্ধাশ্রমের তালা বন্দি করে রেখে, মসজিদে গিয়ে কি তালাশ করেন?”
আপনারা কি উত্তর হাদীসটি কখনো শুনেন নি! হাদীসে এসেছে-
নবী করিম (সা.) বললেন:আমি মিম্বারে ওঠার সময় হজরত জিবরাইল (আ.) এলেন, আমি যখন মিম্বারের প্রথম ধাপে পা রাখি, তখন হজরত জিবরাইল (আ.) বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা বলেছেন, যারা পিতা-মাতা উভয়কে বা একজনকে বার্ধক্য অবস্থায় পেয়েও তাঁদের খেদমতের মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে পারল না, তারা ধ্বংস হোক।’ তখন আমি {রাসুল (সা.)} সম্মতি জানিয়ে বললাম, আমিন!
আল্লাহুম্মা মাগফিরিলি। আপনাদের হৃদয় কি কম্পন সৃষ্টি হচ্ছে না!
শুনুন তবে । আল্লাহ সুবহানাতায়ালা আমাদের উপর উদ্দেশ্য করে কি বলছেন-
‘আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। জননী সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট করে গর্ভে ধারণ করেন এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে; সুতরাং আমার (আল্লাহর) প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে।’
(সুরা-৩১ লুকমান, আয়াত: ১৪)
সুবহানাল্লাহ। আমরা নিশ্চয়ই হয়তো এই হাদীসটি শুনেছি থেকেছি-
রাসূল (সা) বলেছেনঃ বেহেশ্‌ত হচ্ছে মায়েদের পায়ের নিচে।
( কানযুল উম্মালঃ ৪৫৪৩৯, মুনতাখাবে মিযানুল হিকমাহঃ ৬১৪ )
এখনো কি তবে, আপনাদের সেই জান্নাতকে বৃদ্ধাশ্রম এর সে চার দেওয়ালে বন্দী ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখবেন!
আমার কিছু কিছু লেখায় ক্ষোভ প্রকাশের জন্য জানায় “অফ ওয়ান”।
ইতি,
গুরাবা।
নিস্তব্ধ চারিপাশ। মেয়ে ২টি চক্ষু জল মুছছে।বাকি দুই ছেলে চক্ষুর সাথে যুদ্ধ করছে যেন জল গড়িয়ে না পড়ে। এদিকে বড় ছেলেটি মায়ের খুব কাছে দিয়ে হাটু গেড়ে বসে , মায়ের দুটি পা খুব করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে থাকে।
বড় ভাইয়ের এই কান্না দেখে, বাকি চার ভাইবোন তাদের নিজেদের থামাতে পারলো না। তারাও গিয়ে তাদের মা’কে জড়িয়ে ধরে। এবং চুমু খেতে থাকে।
তাদের এমতাবস্থায় দেখে তাদের মা তাদের কাঁদতে নিষেধ করেন। তাদের চোখের জল মুছে দেন।
এরই মাঝে বড় ছেলে বলে উঠে বাকিদের উদ্দেশ্য-

তোমরা কি ভেবেছো আমি এখনও জানি না। তবে আমি আমার “জান্নাত “কে ফেলে কোথাও যাবো না। যেখানেই যাব আমার মা আমার জান্নাত কে সাথে নিয়ে যাবো।
বড় ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে, বাকি চার ভাই বোন বলে উঠলো –
-বাহ রে! এটা কি তোমার একার জান্নাত? (সবাই মাকে জড়িয়ে ধরে বলে)
এটা আমাদের ও জান্নাত।
আমাদের মাকে আমাদের সাথেই নিয়ে যাব।

এবং তারা সবাই বিনীত হয়ে তাদের মায়ের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। এবং তাদের মা তাদের সকলকে কপালে চুমা দেয়।
এদিকে হাসানাত বাবু তার চোখের জল আটকে রাখতে না পেরে, দৌড়ে দৌড়ে ১৬ নং কেবিনের দিকে ছুটে আসতে থাকে।
এসে দেখে, প্রায় অনেকক্ষণ আগে শরিফ ভাই হসপিটাল থেকে চলে গিয়েছেন।
একরাশ কৃতজ্ঞতা যেন জমে রয়েছিল শরিফ আঙ্কেলের প্রতি।
এবং বৃদ্ধা ছেলে-মেয়ের কৌতূহল রয়ে যায়, সেই পরিচিত গুরাবার প্রতি।

লিখেছেন

Exit mobile version