Writing

বোতল ভাঙার দিন! পর্ব : ২

আমরা আজ কুরআনের দ্বিতীয় সুরা – সুরা বাকারায় এসে পৌঁছেছি। ওমর ইবনে খাত্তাবের (রা:) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হাদীস রয়েছে। ইসলামের আগে তিনি একজন মদ্যপায়ী ছিলেন, বস্তুত অনেক সাহাবীই তখন মদ পান করতেন। ওমর (রা:) যখন আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালার কাছে ফিরে আসেন, তখন তিনি আন্তরিকভাবে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তিনি যেন অতীতের সব কিছু ছেড়ে আসেন।

আপত্তিকর যে কোনো কিছু তিনি আল্লাহ এবং তাঁর রাসুলের (ﷺ) জন্য ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। এজন্য ওমর (রা:) অকপটভাবে আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালাকে তাঁর জন্য কিছু বিষয় স্পষ্ট করার অনুরোধ করেছিলেন। আমরা অনেকেই ওমরের (রা:) দু’আর সাথে কুরআনের কিছু আয়াত নাযিল হওয়ার সম্পর্ক জানি। সুনান আত-তিরমিজি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি ওমর (রা:) আল্লাহর কাছে দু’আ করতেন –

اللهُمَّ بَيِّنْ لَنَا فِى الْخَمْرِ بَيَانًا شَافِيًا
হে আল্লাহ! আমদেরকে মদ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিন।

তাই যখন তিনি প্রথমবার দু’আ করলেন তখন আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা সুরা বাকারার ২১৯ নাজিল করলেন।

یَسۡـَٔلُوۡنَکَ عَنِ الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِؕ قُلۡ فِیۡهِمَاۤ اِثۡمٌ کَبِیۡرٌ وَّ مَنَافِعُ لِلنَّاسِ ۫ وَ اِثۡمُهُمَاۤ اَکۡبَرُ مِنۡ نَّفۡعِهِمَا ؕ

তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বল, এ দু’টোয় রয়েছে বড় পাপ ও মানুষের জন্য উপকার। আর তার পাপ তার উপকারিতার চেয়ে অধিক বড়।
[২:২১৯]

এই পর্যায়ে কিন্তু মদকে নিষিদ্ধ করা হয়নি। তাই ওমর (রা:) আবারও একই দু’আ করলেন, তিনি আন্তরিকভাবে জানতে চাইলেন মদ হারাম কিনা। এমন নয় যে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তিনি তা হালাল করতে চাইছিলেন। তিনি আল্লাহর কাছে স্পষ্টভাবে জানতে চাইলেন মদ কি সবসময়ের জন্য হারাম, নাকি নির্দিষ্ট কিছু সময়ের জন্য?

এরপর আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা সূরা নিসার ৪৩ নম্বর আয়াত নাযিল করলেন –

اَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡرَبُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡتُمۡ سُکٰرٰی حَتّٰی تَعۡلَمُوۡا مَا تَقُوۡلُوۡنَ
হে মুমিনগণ, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তোমরা সালাতের নিকটবর্তী হয়ো না, যতক্ষণ না তোমরা বুঝতে পার।
[৪:৪৩]

কেন আল্লাহ বলছেন حَتّٰی تَعۡلَمُوۡا مَا تَقُوۡلُوۡنَ – যতক্ষন না আপনি নিশ্চিত হোন যে আপনি বুঝতে পারছেন আপনি কি বলছেন?

কারণ একবার সাহাবীগণ নামাজ পড়ছিলেন এবং যে সাহাবী নামাজের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি মাতাল ছিলেন, এবং তখন ছিল মাগরিবের সময়। নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি একটা আয়াতের সাথে আরেক আয়াত মিশিয়ে ফেলছিলেন, এক সুরা থেকে আরেক সুরায় চলে যাচ্ছিলেন। এজন্য আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা মাতাল অবস্থায় নামাজ পড়া নিষিদ্ধ করলেন।

এবার সাহাবীগণ নামাজের বেশ আগেভাগেই মদ পান করা শুরু করলেন অথবা দেরী করে এশার নামাজের পরে। এবারও ওমর (রা:) একই দু’আ করলেন – হে আল্লাহ মদের বিষয়টি আমাদের জন্য পরিষ্কার করে দিন। তখন আল্লাহ সুবহানা তা’য়ালা সুরা মায়েদার ৯১ নাম্বার আয়াত নাযিল করলেন –

اِنَّمَا یُرِیۡدُ الشَّیۡطٰنُ اَنۡ یُّوۡقِعَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃَ وَ الۡبَغۡضَآءَ فِی الۡخَمۡرِ وَ الۡمَیۡسِرِ وَ یَصُدَّکُمۡ عَنۡ ذِکۡرِ اللّٰهِ وَ عَنِ الصَّلٰوۃِ ۚ فَهَلۡ اَنۡتُمۡ مُّنۡتَهُوۡنَ
শয়তান শুধু মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করতে চায়। আর (চায়) আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে তোমাদের বাধা দিতে। অতএব, তোমরা কি বিরত হবে না?
[৫:৯১]

এই আয়াতে আল্লাহ যখন বললেন তোমরা কি বিরত হবে না, তখন ওমর (রা:) বলেন: আমরা বিরত হলাম, আমরা বর্জন করলাম! ওমর (রা:) খুশি হলেন এই ভেবে যে তাঁকে এই দু’আ আর করতে হবে না।

কিছু সাহাবী এসে তখন রাসুলকে (ﷺ) বললেন: ইয়া রাসুলুল্লাহ, কিছু সাহাবী তো যুদ্ধে মারা গেছেন – যারা শহীদ, আবার কেউ কেউ তাদের বিছানাতেই মারা গেছেন – যারা ছিলেন ধার্মিক, কিন্তু তারা তো মদ পান করতেন, তাদের কি হবে? এরপর আল্লাহ সূরা মায়েদার ৯৩ নাম্বার আয়াত নাযিল করলেন –

لَیۡسَ عَلَی الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ جُنَاحٌ فِیۡمَا طَعِمُوۡۤا
যারা ঈমান এনেছে ও নেক আমল করেছে তারা অতীতে যা আহার করেছে তাতে কোন পাপ নেই।
[৫:৯৩]

এখন আমি এখানে যা উল্লেখ করতে চাই তা সত্যিই তাৎপর্যপূর্ণ। ওমর ইবনে খাত্তাব (রা:) সত্যের সন্ধান করছিলেন, তিনি কোন ফাঁক বা সুবিধা খুঁজছিলেন না। কারণ আল্লাহ ও রাসুলের (ﷺ) প্রতি তাঁর ভালবাসা মদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা থেকে অনেক বেশি ছিল।

এর প্রমাণও সহিহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ওমর (রা:) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন: হে মানুষ মদ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এই নিষেধ এখন স্পষ্ট। এখন কেউ যেন না বলে এটা এই উৎস থেকে এসেছে বা ঐ উৎস থেকে এসেছে। তিনি বলেন: আঙ্গুর, খেজুর, মধু, গম, বা বার্লি যেই উৎস থেকেই আসুক না কেন মদ নিষিদ্ধ। তিনি আরো বলেন: মদ মানুষের মনকে নেশাগ্রস্ত করে, তাই তা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করতে হবে।

অনেক সময় মানুষ বিভিন্ন নেশাদ্রব্যের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে। মদ না হলেও যদি তা নেশার সৃষ্টি করে, তবে তা خمر ওমরের ইবনে খাত্তাবের (রা:) মত আমাদেরও সেই আন্তরিকতা থাকা উচিত যাতে আমরা সত্যকে জানতে এবং তা অনুসরণ করতে পারি। নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে গেলে চলবেনা। আল্লাহর কাছে আমরা প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদেরকে সত্যের সাধনায় সেই আন্তরিকতা দান করেন। আল্লাহুম্মা আমীন!

বোতল ভাঙার দিন!
পর্ব : ২
কুরআনের মানুষ

মূল: ড. ওমর সুলাইমান
অনুবাদ: ফাহমিনা হাসানাত

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture