Writing

বাবাকে নিয়ে ২দিন ডাক্তারের কাছে

এক.

বাবাকে নিয়ে দুইদিন ডাক্তারের কাছে দৌঁড়ঝাপ করেছি ইবনে সিনায়। জ্যামের শহর তাই সময় বাঁচাতে, কষ্ট কমাতে ধানমন্ডির এক হাসপাতেলেই যাই। সেই হসপাতালে যেতে হলে ধানমন্ডি লেক হয়ে রিক্সা করে যাই।

ধানমন্ডি লেক কপোত-কপোতীর মিলনমেলা, আর বিকাল কিংবা সন্ধ্যাবেলায় ত সেটা আরও বেশি আড্ডাখানা হয়ে যায়। শহুরে মানুষ তাই পোশাক যাচ্ছে তাই পরে, ছেলে-মেয়ে একসাথে আড্ডা দেয়। বাবা গ্রামীণ পরিবেশে অভ্যস্ত, এসব নোংরামি গ্রামীণ জীবনে নেই। তাই মাঝে মাঝে ভাবি আমার সবুজবীথিতে সাজানো গ্রামটাতেই চলে যাই।
বাবা বললেন, — ‘এদের কি বাবা-মা নেই? সন্তান রাতবীরাতে কোথায় থাকে, কি করে খবর নেয় না?’

‘বাবা, কর্পোরেট দুনিয়ার বাবা-মাদের এসব নিয়ে চিন্তা নেই। ছেলে-মেয়ের স্বাধীনতার বিষয়ে তারা অনেক উদার।’
‘ঠিক আছে স্বাধীনতার বিষয়ে উদার, কিন্তু এসব বিষয়েও।’
‘হুম। তাদের কাছে ছেলে-মেয়ের ফ্রেন্ড সার্কেল কোন ম্যাটার না।’
‘তাই বলে এই বয়সে একটা মেয়ে রাত বিরাতে একটা ছেলের সাথে এভাবে ঘুরবে।’
‘বাবা, এগুলো এখানে নরমাল।’

‘আচ্ছা বাদ দাও। তুমিও ত আট বছর ধরে ঢাকায় থাক, তুমি কেন এমন হলে না। কই তোমার ত এসব নেই।’
‘দেখ বাবা পারিবারিক শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সুশিক্ষা সেটা নয় যেটা আমার চরিত্রকে ধ্বংস করে বরং সুশিক্ষা সেটা যেটা আমাকে মানুষ হতে শিখায়, পশু হতে নয়।’
‘তার চেয়ে বড় কথা কি জানো।’
‘কি?’
‘সেটা হচ্ছে আমি ঢাকা আসার পর থেকেই দ্বীনি পরিবেশে ছিলাম, তাই আমি এরকম বখে যাই নি।’

দুই.

আমি আসলে কোথাও নিজের পরিচয় দিতে চাই না। সবসময় নিজেকে আড়াল রাখতেই পছন্দ করি। কেননা হয়তোবা পরিচয় দিলে যাকে পরিচয় দিচ্ছি তিনি বিব্রতবোধ করবেন। তাই ডাক্তারের চেম্বারেও ঠিক সেরকমই ছিলাম, যদিও ডাক্তার সাহেব আমার পরিচিত মানুষ। অনেক আগে তার সাথে সরাসরি কয়েকবার দেখা ও কথা হয়েছিল। হয়তোবা মাস্ক পরার কারনে চিনতে পারেন নাই। কিন্তু বাবা বললেন— ‘স্যার আমার ছেলে মেডিকেলে পড়ে।’ স্যার আমার দিকে তাঁকিয়ে বললেন — ‘কোন ইয়ারে পড়, কোন মেডিকেলে পড়?’

— ‘স্যার অমুক মেডিকেল, অমুক ইয়ার।’
— ‘ভালো। তোমাদের মেডিকেল ত নামকরা মেডিকেল।’
— ‘জ্বি স্যার।’

যথারীতি খুব সুন্দর করেই বাবাকে স্যার দেখে দিলেন। ভিজিট দিতে যাব,
স্যার বলল — ‘তুমি যখন চেম্বার করবে আমার পরিবারের কেউ কিংবা কোন ডাক্তার বা মেডিকেল স্টুডেন্ট তোমার কাছে গেলে কি ভিজিট রাখবে।’
— ‘না স্যার।’

তাহলে আমি কিভাবে ভিজিট রাখি তোমার কাছে। স্যার বাবার সকল টেস্টে ৩৫% ডিসকাউন্ট লিখে দিলেন। সালাম দিয়ে বাসার উদ্দেশ্য বের হচ্ছি হসপিটাল থেকে। তখন ঘড়িতে ঠিক রাত ১২:২০ মিনিট।

তিন.

আমি মেডিকেল স্টুডেন্ট বলেই স্যার বাবাকে এতো সময় নিয়ে দেখেছে কিংবা ছাড় দিয়েছে বিষয়টা ঠিক তেমন নয়। স্যার প্রতিটি রোগীকেই যথেষ্ট সময় নিয়ে দেখেন, তাই ত হসপিটালে যখন দারোয়ান ছাড়া কেউ থাকে না তখনও স্যার রোগী দেখেন। ধানমন্ডি লেক হয়ে বাসায় ফিরছি, যাওয়ার সময় সন্ধ্যার কোলাহলে ঢাকা ছিল এই লেক আর তখন তারিখ ছিল ১১/৬/২২, আর আসার সময় ঘড়িতে ১২:৩০ মিনিট তারিখ হয়ে গেল ১২/৬/২২। কি অদ্ভুত কয়েকঘন্টার ব্যবধানে তারিখ পাল্টে গেল, কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

বাবা বললেন— ‘তুমিও যখন ডাক্তার হবে মানুষের সাথে স্যারের মতো ভালো আচরণ করবে। কোন মানুষও যেন তোমার কাছ থেকে খারাপ আচরণ কিংবা মনকষ্ট না পেয়ে যায়। সে যদি ছেড়াকাপড় কিংবা ময়লাযুক্ত কাপড় পরেও তোমার চেম্বারে আসে তবুও তুমি তাকে ধমক দিয়ে কথা বলবে না। আর গরিব, দুঃখীর জন্য তুমি ফ্রি সেবা দিবে। এই পৃথিবী ছেড়ে যখন তুমি বিদায় নিবে তখন যেনো এরকম কিছু মানুষ থাকে যারা তোমার মৃত্যুতে হাত তুলে দোয়া করবে। যেমন আজ আমি তুমি স্যারের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তার জন্য মন থেকেই অটোমেটিক দোয়া করছি!’

একসময় বাবার হাত ধরে আমি রাস্তা পার হতাম, আজ বাবা আমার হাত ধরে রাস্তা পার হয়। একসময় বাবা আমাকে সাথে নিয়ে অপরিচিত জায়গায় যেত আর আজ আমি বাবাকে নিয়ে অপরিচিত জায়গায় যাই। সময়ের আবর্তনে কতোকিছুই না বদলায়!

জীবনের সমীকরনটাও ঠিক এরকম! আজ আমায় নিয়ে সবাই উচ্ছ্বসিত, কিন্তু যখনি নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ঘড়ির কাটাটা সময় বদলাবে, মানুষগুলো চেহারা পাল্টাবে আর আমিও হারিয়ে যাব। হয়তো-বা ব্যস্ত এই নগরী আমায় দিনের আলোয় মনে রাখবে কিন্তু মাটিতে দাফনের সাথে সাথে রাতের আঁধারে ভুলে যাবে। সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে আসবে, আবারও ঝিঁঝির বহর নামবে, পূর্নিমার আলোয় আলোকিত হবে ধরনী, প্রেয়সী বিচ্ছেদ ভুলে হবে আবার সংসারী, কোলাহলে ঢেকে যাবে সব কিন্তু আমার শূন্যতা কেউ যে আর অনুভব করবে না। জীবন বড়ই অদ্ভুত! তাই না…

জীবন থেকে নেয়া
পর্ব : ১৫

লিখেছেন

নেওয়াজ আরিফ

আমি এক মুসাফির, অল্প কিছু দিনের ভ্রমণে এসেছি এই ধরায়, সময় ফুরিয়ে গেলে চলে যাবো আপন ঠিকানায়…

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture