Writing

আসমাউল হুসনা – আশ-শাকুর

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে আশ-শাকুর – সর্বাধিক প্রশংসাকারী, সর্বাধিক কৃতজ্ঞ, ভাল কাজের প্রতিদানদাতা – বলেছেন চারবার। তিনিই অল্পের বিনিময়ে প্রচুর দান করেন। আশ-শাকুর ক্ষুদ্রতম কাজের সীমাহীন প্রশংসা করেন; এর চূড়ান্ত উদাহরণ হল জান্নাতে তাঁর প্রতিশ্রুত অনন্ত সুখের পুরস্কার!

শাকুর এসেছে ش-ك-ر এর মূল থেকে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল উপকারের জন্য প্রশংসা করা বা উপকার স্বীকার করা, এবং দ্বিতীয় অর্থ হল কৃতজ্ঞ হওয়া এবং স্বীকৃতি প্রদান করা। তৃতীয় অর্থ হল প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন করা এবং সরবরাহ করা।

এই মূলটি কুরআনে ৭৫ বার ছয়টি উদ্ভূত রূপে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল شَكَرَ – শাকারা (কৃতজ্ঞ হওয়ার জন্য), الشّٰکِرِیۡنَ – আশ-শাকিরীন (কৃতজ্ঞ), সাগর مشكوراً – মাশকুরান (প্রশংসিত)।

ভাষাগতভাবে, شُكُرْ – শুকর অর্থ বৃদ্ধি করা, প্রশংসা করা এবং ভাল স্বীকৃতি দেওয়া। আরবীতে شَكُرْ – শাকুর এমন একটি প্রাণীকে বর্ণনা করার জন্যও ব্যবহৃত হয় যাকে সামান্য খাওয়ানো হয় কিন্তু বিনিময়ে প্রাণীটি অনেক ফেরত দেয়। ٱلْشَّكُورُ – আশ-শাকুরের و আমাদের দেখায় যে আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল অত্যন্ত কৃতজ্ঞ; তার প্রশংসা এবং পুরষ্কার আমাদের কল্পনাতীত।

একটি সুন্দর সমন্বয়: আশ-শাকুর এবং আল-গফুর

পবিত্র কুরআনে আল্লাহর নাম আশ-শাকুর যে চারবার উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে তা আল্লাহর নাম আল-গফুরের সাথে তিনবার যুক্ত হয়েছে। তিনি সর্বাধিক ক্ষমাশীল এবং প্রশংসাকারী; এমনকি যদি আমরা পাপ করেও থাকি, তবুও আমরা ক্ষমার জন্য এবং ভালো কাজের পুরষ্কারের জন্য তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারি। আশ-শাকুর বলেছেন –

لِیُوَفِّیَهُمۡ اُجُوۡرَهُمۡ وَ یَزِیۡدَهُمۡ مِّنۡ فَضۡلِهٖ ؕ اِنَّهٗ غَفُوۡرٌ شَکُوۡرٌ
যাতে তিনি তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দান করেন এবং নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে আরো বাড়িয়ে দেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী।
[সূরা ফাতির:৩০]

وَ مَنۡ یَّقۡتَرِفۡ حَسَنَۃً نَّزِدۡ لَهٗ فِیۡهَا حُسۡنًا ؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ شَکُوۡرٌ
যে উত্তম কাজ করে আমি তার জন্য এতে কল্যাণ বর্ধিত করি। আল্লাহ ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী।
[সূরা আশ-শুরা:২৩]

আল্লাহর নাম আশ-শাকুর মানে এই নয় যে তাঁকে কোন কিছুর জন্য কৃতজ্ঞ হতে হবে, কারণ আমাদের যা কিছু আছে তা তাঁর কাছ থেকে এসেছে। তিনিই সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ, কারণ তিনি আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে অনেক বড় পুরস্কার দেন। আশ-শাকুর এমনকি আমাদের নিয়তেরও প্রশংসা করেন।

আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

অন্যের কাছ থেকে কোনো কিছুর বিনিময়ে কিছু আশা করবেন না। আমরা প্রায়ই অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতির জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করি, এবং এমনকি যখন আমরা গোপনে ভাল করি তখনও আমরা আশা করি যে তারা যেন জানতে পারে যে আমরাই তাদের সাহায্য করেছি। আবার কখনও কখনও আপনার মনে ইচ্ছা জাগতে পারে লোকেরা আপনার ভালো নিয়তের কথা জানুক, যদিও আপনি কাজটি করতে ব্যর্থ হন।

وَ کَانَ اللّٰهُ شَاکِرًا عَلِیۡمًا
আল্লাহ পুরস্কার দানকারী, সর্বজ্ঞ।
[সূরা আন-নিসা:১৪৭]

আপনার ভাল কাজ বা নিয়তের কথা অন্য কেউ না জানলেও আল্লাহ কিন্তু ঠিকই জানেন, পুরস্কৃত করেন, এবং প্রশংসা করেন। অন্যদের সাহায্য করার জন্য আপনার সাধ্যাতীত চেষ্টা করুন, কিন্তু এর বিনিময় কোন প্রতিদান আশা করবেন না। আপনি অন্যদের সাহায্য করলে আশ-শাকুরও আপনাকে সাহায্য করার জন্য অন্য কাউকে পাঠাবেন।

ভালো কাজ করে যান তা যত ছোটই হোক না কেন। যে কোনো ভাল কাজ করতে কখনও দ্বিধা করবেন না, এমনকি যদিও আপনার মনে হয় কাজটি আপনার সমস্ত পাপের তুলনায় অনেক ছোট; যিনি পুরস্কার দেন তার ক্ষমতা সম্পর্কে একবার চিন্তা করুন।
রাসুল (ﷺ) বলেছেন: কোন ভালো কাজকে ছোট মনে করো না, এমনকি তা যদি হয় তোমার ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাৎ করাও। [সহীহ মুসলিম]।

একশত বার ‘সুবহানাল্লাহ‘ বলুন এবং এর বিনিময়ে আশ-শাকুর আপনাকে হাজার নেকী দান করবেন। শুধুমাত্র একটি মুদ্রা দিয়ে একটি পুরো গ্রাম কিনে ফেলার কথা কল্পনা করুন; আমাদের কোন কাজকেই আশ-শাকুরের অসীম পুরস্কারের সাথে তুলনা করা যায় না।

ধৈর্যশীল ও আন্তরিক হন এবং জান্নাতের কথা স্মরণ করুন। আমাদের কোনো কাজই কিন্তু হারিয়ে যায় না। কখনও কখনও আশ-শাকুর তাঁর প্রশংসার লক্ষণগুলিকে বিলম্বিত করেন, আমরা হাল ছেড়ে দিই কিনা তা দেখার জন্য। তাই আন্তরিক হোন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করুন, কারণ আপনি জানেন যে তিনি ইহকাল ও পরকালে আশ-শাকুর! রাসুল (ﷺ) বলেছেন: আল্লাহ বলেন, ‘আমি আমার পূণ্যবান বান্দাদের জন্য এমন সব নেয়ামত সামগ্রী তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি; কোনো কানও তার বর্ণনা কখনো শুনেনি। তাছাড়া কোনো মানুষ কখনো তা প্রত্যক্ষ করেনি; কোনো অন্তর কোনোদিন তা ধারণা করতে পারেনি।’ [আল-বুখারী, আত-তিরমিযী, ইবনে মাজাহ] তাই যে কোন কাজ করার আগে জান্নাতের কথা চিন্তা করুন।

অন্যদের সাহায্য করুন, আশ-শাকুরও আপনাকে সাহায্য করবেন।
রাসুল (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি এই দুনিয়ায় কোন মুমিনের দুঃখ দূর করবে, আল্লাহ তার আখেরাতের কিছু দুঃখ দূর করবেন। . . যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ-ত্রুটি গোপন করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। যতক্ষণ বান্দা তার ভাইকে সাহায্য করে ততক্ষণ আল্লাহ তাঁর বান্দাকে সাহায্য করবেন। [সহীহ মুসলিম] কাজেই আপনি যখন অন্য মুসলমানের কষ্ট উপশম করবেন, সাহায্য করবেন বা দোষ গোপন করবেন, আশ-শাকুর আপনাকে সাহায্য করবেন।

কৃতজ্ঞ হন, এবং আশ-শাকুর আপনাকে আরও দেবেন। আপনি কি জানেন যে আল্লাহর কোন নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা নিজেই একটি নেয়ামত?
আশ-শাকুর আমাদেরকে তাঁর আশীর্বাদ দান করেন যদিও আমাদেরকে তাঁর প্রয়োজন নেই, কিন্তু কখনও কখনও আমরা শুধুমাত্র তখনই তাঁকে ধন্যবাদ জানাই যখন আমাদের তাঁকে খুব প্রয়োজন হয়। কি পার্থক্য, তাই না?

তিনি আপনাকে যা দিয়েছেন তার জন্য শুকরিয়া আদায় করুন, এবং তিনি আপনাকে আরও বেশী দেবেন। আপনি কিভাবে আশ-শাকুরের প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন? আল-গাজ্জালী বলেছেন: মহান আল্লাহর নেয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সর্বোত্তম উপায় হল এই নেয়ামতগুলোকে তাঁর আনুগত্য করার জন্য ব্যবহার করা, তাঁর অবাধ্যতার জন্য নয়।

সকল প্রাণীর প্রতি সদয় হোন। আশ-শাকুর সেই কাজগুলি লক্ষ্য করুন যা কেবলমাত্র মানুষের জন্য নয়, সমস্ত প্রাণীর কল্যাণের জন্য করা হয়।
রাসুল (ﷺ) আমাদেরকে বলেছেন, যা আল-বুখারী এবং মুসলিম হাদিসে বর্ণিত: সেই ব্যক্তি সম্পর্কে যে একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করেছিল- فشكر الله له – এবং আল্লাহ ‘আজ্জা ওয়া জাল তার কর্মের প্রশংসা করেছিলেন এবং তার পাপ ক্ষমা করেছিলেন।

মানুষের প্রশংসা করুন। একটি সুন্দর সামাজিক দক্ষতা হল সবসময় অন্যের জীবনে আগ্রহ দেখানো; জিজ্ঞাসা করুন তাদের চাকরির ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে, তাদের অসুস্থ আত্মীয় এখন কেমন আছেন….. ইত্যাদি। অন্যের ব্যাপারে বিস্তারিত মনোযোগ দিতে চেষ্টা করুন, তাদের প্রশংসা করুন, এবং যখন তারা ভাল কিছু করে, তাদের প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দিন, এবং ভালো কাজকে অব্যাহত রাখতে তাদের উৎসাহিত করুন।

কৃতজ্ঞতা জানানোর সময় সর্বদা প্রথমে আলহামদুলিল্লাহ এবং তারপরে কাউকে “ধন্যবাদ” বলুন, কারণ কৃতজ্ঞতার বাস্তবতা হল সবকিছু আল্লাহর কাছ থেকে আসে!
রাসুল (ﷺ) আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন: যে ব্যক্তি মানুষের শুকরিয়া আদায় করে না সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে না। [আবু দাউদ]

আশ-শাকুরকে ডাকুন, উদাহরণস্বরূপ এই নামের কুরআনের একটি দু’আ হল –

وَ قَالُوا الۡحَمۡدُ لِلّٰهِ الَّذِیۡۤ اَذۡهَبَ عَنَّا الۡحَزَنَ ؕ اِنَّ رَبَّنَا لَغَفُوۡرٌ شَکُوۡرُۨ
আর তারা বলবে, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিয়েছেন। নিশ্চয় আমাদের রব পরম ক্ষমাশীল, মহাগুণগ্রাহী’।
[সূরা ফাতির:৩৪]

হে আল্লাহ, আশ-শাকুর, আমরা জানি যে আপনিই সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ। আমাদেরকে ভাল কাজ করতে সাহায্য করুন, আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা শুধুমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য অন্যদের সাহায্য করে এবং আমাদের কাজে আন্তরিকতা ও ধৈর্য দান করুন। আপনি আমাদের যা দিয়েছেন তার জন্য যেন আমরা প্রতিনিয়ত শুকরিয়া আদায় করতে পারি, এবং আপনার আনুগত্য করার জন্য এই সমস্ত আশীর্বাদ ব্যবহার করতে পারি — আমাদের সেই তৌফিক দান করুন। হে আশ-শাকুর, আমরা যেনো চূড়ান্ত পুরস্কারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারি — আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে চিরকাল জান্নাতে সুখ উপভোগ করতে পারি –আমাদের আশীর্বাদ করুন। আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আশ-শাকুর

Source: understandQuran

লিখেছেন

Picture of ফাহমিনা হাসানাত

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture