Writing

আসমাউল হুসনা আল হাসিব

আল্লাহ পবিত্র কুরআনে নিজেকে তিনবার আল-হাসিব হিসাবকারী, হিসাবরক্ষক, যথেষ্ট বলেছেন। তিনি জগতের সবকিছুর হিসাব রাখেন এবং এমনকি ক্ষুদ্রতম কাজের প্রতিদান তিনি দেন। আল-হাসিব যথেষ্ট; কারণ তিনি তাঁর প্রতিটি বান্দার যত্ন নেন, তাদের উপকার করেন এবং ক্ষতি থেকে রক্ষা করেন। আল-হাসিব তার পূণ্যবান বান্দাদের অতিরিক্ত বিশেষ যত্ন নেন যারা তার উপর আস্থা রাখে, তাদের তিনি সমর্থন করেন ও বিজয় দান করেন।

হাসিব এর মূল ح-س-ب থেকে এসেছে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। প্রথম অর্থ হল হিসাব করা, গণনা করা এবং নিরূপণ করা। এই মূলের দ্বিতীয় অর্থ হল প্রদান করা এবং প্রাপককে প্রত্যাশা ছাড়াই দেওয়া। তৃতীয় অর্থ হল পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট হওয়া বা পরিমাপ ছাড়াই হওয়া।

এই মূলটি কুরআনে ১০৯ বার আটটি উদ্ভূত আকারে এসেছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হল তাহসাবান্না تَحۡسَبَنَّ – (“চিন্তা করা”), حَسۡبُنَا – হাসবুনা (“আমাদের জন্য যথেষ্ট”), এবং الحِسَاب আল হিসাব (“হিসাব”)।

ভাষাগতভাবে, হিসাব শব্দটি অ্যাকাউন্ট, বিল বা ব্যালেন্স নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়। আল-হাসিব শেষ বিচারের দিন হিসাব কায়েম করবেন, এবং তিনি মানবজাতির কাছে তাদের দাঁড়িপাল্লা উপস্থাপন করবেন যেখানে প্রতিটি কাজের বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হবে, এবং সবচেয়ে সঠিক, ন্যায়সঙ্গত এবং চিরন্তন উপায়ে প্রতিদান দেওয়া হবে।
আল-হাসিব নিজে বলেছেন –

اَلَیۡسَ اللّٰهُ بِکَافٍ عَبۡدَهٗ
আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন?
[৩৯:৩৬]
وَ اِذَا حُیِّیۡتُمۡ بِتَحِیَّۃٍ فَحَیُّوۡا بِاَحۡسَنَ مِنۡهَاۤ اَوۡ رُدُّوۡهَا ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ حَسِیۡبًا
আর যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে। অথবা জবাবে তাই দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ণ হিসাবকারী।
[৪:৮৬]

অর্থের দিক থেকে আল্লাহর আল-হাসিব নামটি আল-হাফিদ (সংরক্ষণকারী) এর কাছাকাছি। সমগ্র মহাবিশ্বের ভারসাম্য লক্ষ করলে বুঝা যায় যে ক্ষুদ্রতম পরমাণু থেকে শুরু করে বৃহত্তম গ্রহ পর্যন্ত – সবকিছুর সঠিক হিসাব রাখতে সক্ষম এমন একটি মহান শক্তি রয়েছে; সেই শক্তি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা। চাঁদ, সূর্য, মেঘ, ঋতুর পরিবর্তন এবং মহাবিশ্বের সমস্ত সিস্টেম নিখুঁতভাবে তাদের গতিপথে চলছে পৃথিবীতে আমাদের জীবনকে সর্বোত্তম উপায়ে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য যাতে আমাদেরকে যে কারণে সৃষ্টি করা হয়েছে তা আমরা সার্থক উপায়ে করতে পারি –আল-হিসাব এর উপাসনা।

اِنَّا کُلَّ شَیۡءٍ خَلَقۡنٰهُ بِقَدَرٍ
আমি সব কিছু সৃষ্টি করেছি নির্ধারিত পরিমাপে।
[৫৪:৪৯]
وَ مَاۤ اَمۡرُنَاۤ اِلَّا وَاحِدَۃٌ کَلَمۡحٍۭ بِالۡبَصَرِ
আর আমার আদেশ তো কেবল একটি কথা, চোখের পলকের মত।
[৫৪:৫০]

তাঁর ‘হাসবা’ এর গুণটি সত্যিই অলৌকিক।
আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

নিজেকে বিচার করুন।

اِقۡرَاۡ کِتٰبَکَ ؕ کَفٰی بِنَفۡسِکَ الۡیَوۡمَ عَلَیۡکَ حَسِیۡبًا
পাঠ কর তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট।
[১৭:১৪]

কিছু দৈনন্দিন অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন, উদাহরণস্বরূপ আপনি ঘুমাতে যাওয়ার আগে, উঠে বসুন এবং ‘মুহাসাবাহ’ অর্থাৎ সৎ আত্ম-সমালোচনা করুন। আপনাকে বিচারের জন্য ডাকার আগে নিজেই নিজের বিচার করুন। আপনার প্রধান দুর্বলতাগুলির একটি তালিকা তৈরি করুন এবং কিভাবে দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা যায় তার একটি বাস্তব পরিকল্পনা তৈরি করুন।

পাপ করার পর আল-হাসিবের কাছে ছয় ঘণ্টার মধ্যে তওবা করুন। নিজেকে বিচার করার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল অনুতপ্ত হতে হওয়া। আপনি যদি নাই জানেন আপনি কি ভুল করেছেন, তবে আপনি কিভাবে অনুতপ্ত হবেন? তাই আল মুহাসাবাহ এত গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল (ﷺ) আমাদের একটি সুন্দর সুযোগ সম্পর্কে বলেছেন: বাম কাঁধের লেখক ফেরেশতা একজন মুসলমানের গুনাহ ছয় ঘণ্টার জন্য নথিভুক্ত করতে বিলম্ব করেন। যদি সে তওবা করে (এই ছয় ঘণ্টার মধ্যে), এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তাহলে ফেরেশতারা সেই গুনাহ নথিভূক্ত না করে ছেড়ে দেন। যদি ওই ব্যক্তি তওবা না করে, ফেরেশতারা একক পাপ হিসাবে তা নথিভূক্ত করেন।
[আত-তাবারানী]

পাপ করার ঠিক আগ মুহূর্তে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে এটা আপনার আমল নামায় লিখা হবে, এবং জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিন অর্থাৎ শেষ বিচারের দিন আপনার সামনে তা উপস্থাপন করা হবে। কাজেই সেই ভয়ঙ্কর দিনে আপনার পাপ আপনার কাছে উপস্থাপন করা এড়াতে ছয় ঘন্টার মধ্যে অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ নিন।

আপনার লেনদেনে সৎ হন। এমনকি মানুষের দৃষ্টির অগোচরেও যদি আপনি আপনার লেনদেনে অসৎ হন, আল-হাসিব তা আপনার আমলনামায় যুক্ত করবেন। কাজেই আপনি যে কোনো লেনদেনে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে, এমনকি আপনার পরিবার এবং সন্তানদের মধ্যে কোন জিনিস ভাগ করার ক্ষেত্রে সর্বদা সৎ থাকুন।

হাসবুনাল্লাহ ওয়া নিয়ামাল ওয়াকিল বলুন। حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ এর অর্থ হল আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট, এবং তিনি সর্বোত্তম বিষয়ের নিয়ন্ত্রক। এটি সবচেয়ে শক্তিশালী বিবৃতিগুলির মধ্যে একটি যা আমাদের কুরআন ও সুন্নাহতে বলতে শেখানো হয়েছে। আপনি যদি আল-হাসিবের উপর আপনার পূর্ণ আস্থা রাখেন, শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির জন্য সমস্ত বিষয় তাঁর উপর ছেড়ে দিয়ে, তাঁর ফায়সালা মেনে নেন এবং তাঁর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করেন, আপনি জীবনের যে কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারবেন। ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, যখন (নবী) ইব্রাহীমকে (আ:) আগুনে নিক্ষেপ করা হয়েছিল, তখন তিনি বলেছিলেন: حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ -আল্লাহ (একা) আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম ব্যবস্থাপক
[আল-বুখারী]।

সালামের উত্তর দিন। আল-হাসিব এমনকি আমাদের সালামের হিসাবও রাখেন। তিনি ‘আজ্জা ওয়া জাল’ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন – ‘আর যখন তোমাদেরকে সালাম দেয়া হবে তখন তোমরা তার চেয়ে উত্তম সালাম দেবে। অথবা জবাবে তাই দেবে। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে পূর্ণ হিসাবকারী।’
[৪:৮৬]

সুতরাং যদি কোন মুসলিম আপনাকে সালাম দিয়ে অভিবাদন জানায়, তাহলে সালামের উত্তর আরও ভালো সালাম দিয়ে (ওয়া ‘আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু) অথবা অন্তত যে সালাম দেওয়া হয়েছে তার সমান দিয়ে দিন। অতএব, উত্তম সালাম বাঞ্ছনীয়, যদিও সমানভাবে ফিরিয়ে দেওয়া একটি বাধ্যবাধকতা।

আল-হাসিবের কাছে প্রার্থনা করুন।

আল্লাহ আল-হাসিবের কাছে চাওয়ার সময় উচ্চ লক্ষ্য স্থির করুন; শুধু জান্নাত চাওয়ার পরিবর্তে সর্বোচ্চ স্তরের জান্নাতুল ফেরদাউস বি গায়রি হিসাব- হিসাব ছাড়াই চান। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দৈনিক জিকির হল:

حَسْبِىَ اللّٰهُ لَآ اِلَهَ اِلَّا هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَ هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ
আল্লাহই আমার জন্য যথেষ্ট। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। আমি তাঁর উপর আমার ভরসা রেখেছি, তিনি মহান সিংহাসনের অধিপতি।

যে ব্যক্তি ফজরের নামাজের পর সকালে সাতবার এবং আসরের নামাজের পর সাতবার এ জিকির করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের সব দুশ্চিন্তা দূর করে দেবেন।
[মুসলিম]

হে আল্লাহ, আল হাসিব, আমরা জানি যে আপনি সঠিকভাবে পরিমাপ করেন এবং সব কিছুর হিসাব রাখেন। নিয়মিতভাবে নিজেদের হিসাব নেওয়ার জন্য আমাদেরকে পথনির্দেশনা দিন, আমাদেরকে তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করুন যারা আপনার হিসাবকে স্মরণ করে এবং আপনার কাছে ক্রমাগত অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসে এবং জীবনের সমস্ত পরিস্থিতিতে, সবসময় আপনার উপর আস্থা রেখে। আপনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং আপনিই আমাদের কাজের সর্বোত্তম নিয়ন্ত্রক। আমরা যেন সমগ্র বিশ্বজগতে আপনার আশ্চর্যজনক গুন ‘হাসাবা‘ কে উপলব্ধি করতে পারি সেজন্য আমাদের সাহায্য করুন। আমাদেরকে জান্নাতুল ফেরদাউস আল ‘আলায় বিনা হিসাব-নিকাশে প্রবেশ করার তৌফিক দান করুন, আল্লাহুম্মা আমীন!

আর আল্লাহই সবচেয়ে ভালো জানেন।

আল হাসিব

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture