স্বামীর ইসলাম গ্রহণ ছিলো যে নারীর মোহরানা

রুমাইসা বিনতে মিলহান (রাদিয়াল্লাহু আনহা) তাঁর দশ বছরের ছেলেকে সাথে নিয়ে বসতেন আর বলতেন, ‘বলো বাবা, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। ছেলে মায়ের সাথে সাথে কালিমার সাক্ষ্য দিতো। ছেলেকে এভাবে ‘কানপড়া’ দেওয়া বাবার পছন্দ না। তিনি মা’কে সাফ জানিয়ে দিলেন- আমার ছেলেকে এভাবে নষ্ট করো না। কিন্তু রুমাইসা (রা:) ছেলেকে কালিমা শেখানোর পাশাপাশি স্বামীকেও ইসলামের দাওয়াত দিতেন।
স্বামী ইসলামের দাওয়াত তো গ্রহণ করতেন না, উল্টো ইসলামের দাওয়াত শুনলে ক্ষেপে যেতেন। শেষমেশ বউয়ের উপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। পথিমধ্যে তার শত্রু তাকে হত্যা করে ফেলে।

স্বামী মারা যাবার পর রুমাইসা (রা:) সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর বিয়ে করবেন না। ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন। তবে ছেলে যদি চায়, তাহলে সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন।

কিছুদিন পর তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন যায়িদ ইবনে সাহিল নামে মদীনার এক ধনকুবের। তার আরেক নাম ছিলো আবু তালহা। একে তো তিনি ছিলেন ধনী, তারউপর সাহসী। তখনকার সময়ে পাত্র নির্বাচনে সাহসিকতা প্রাথমিক বিবেচনায় নেওয়া হতো। যায়িদ ইবনে সাহিলের মদীনায় একটি সুন্দর বাড়িও ছিলো। বাড়িটি এতোটাই সুন্দর ছিলো যে সবাই এই বাড়িটির প্রশংসা করতো।

সবকিছু বিবেচনায় যায়িদ ইবনে সাহিল বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তার মতো সু-পাত্রকে রুমাইসা (রা:) প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। কিন্তু রুমাইসা (রা:) যায়িদকে প্রত্যাখ্যান করে বসেন। রুমাইসা (রা:) বলেন,

‘তোমার মতো মানুষ, যে কিনা এখনো একজন কাফের, তাকে আমি কিভাবে আমার স্বামী হিশেবে গ্রহণ করবো?’

যায়িদ ভাবলেন, হয়তো রুমাইসা (রা:) অন্য কাউকে বিয়ে করবেন বলে তার প্রস্তাবে রাজি হচ্ছেন না। তিনি অভিমানের সুরে বললেন, ‘কী এমন আছে, যা আমাকে বিয়ে করতে তোমাকে বাধা দিচ্ছে? সেটা কি সোনা-রুপা?’

‘সোনা-রূপা?’
যায়িদের কথা শুনে রুমাইসা (রা:) অপমানবোধ করলেন। তিরস্কার করে বললেন,

‘আল্লাহর কসম! হে আবু তালহা, আমি আল্লাহ আর তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শপথ করে বলছি, তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো তাহলেই কেবল আমি তোমাকে স্বামী হিশেবে গ্রহণ করবো। আমাকে সোনা-রূপা কিচ্ছু দেওয়া লাগবে না। তোমার ইসলাম গ্রহণকেই আমি আমার মোহরানা হিশেবে ধার্য করবো।’

আবু তালহা বুঝতে পারলেন তার ধন-সম্পদের প্রতি রুমাইসার (রা:) কোনো লোভ নাই। রুমাইসাকে (রা:) বিয়ে করতে হলে তাকে ইসলাম গ্রহণ করতে হবে। বিয়ে করার জন্য পিতৃধর্ম ছেড়ে দেবেন কিনা সেটা নিয়ে যখন যায়িদ চিন্তা করছেন, তখন সুযোগ পেয়ে রুমাইসা (রা:) তাকে বললেন, ‘হে আবু তালহা, তুমি কি জানো না যে, যে ইলাহর তুমি ইবাদাত করো সেটি মাটির তৈরি?’

রুমাইসার (রা:) সাথে সুর মিলিয়ে আবু তালহা বললেন, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক’। রুমাইসা (রা:) বলে চললেন, ‘একটা গাছের পূজা করতে তোমার লজ্জা করে না?
যেখানে গাছটির এক অংশ আগুনে জ্বালিয়ে রুটি বানিয়ে খাও। হে আবু তালহা! তুমি ইসলাম গ্রহণ করে নাও, তাহলে আমি সন্তুষ্টচিত্তে তোমাকে আমার স্বামী হিশেবে গ্রহণ করে নেবো। আর মোহরানা হিশেবে আমি তোমার কাছে আর কিছুই চাবো না।’

রুমাইসার (রা:) এবারের কথাগুলো আবু তালহাকে নাড়া দিলো। রুমাইসাকে (রা:) বলে গেলেন, তিনি প্রস্তাবটি বিবেচনা করে দেখবেন। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আবু তালহা ঘোষণা করলেন- আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদান রাসূলুল্লাহ। ছেলের অনুমতি নিয়ে রুমাইসা (রা:) আবু তালহাকে (রা:) বিয়ে করেন। মদীনার মুসলমানরা এই বিয়েকে তাঁদের দেখা সবচেয়ে মূল্যবান বিয়ে বলে উল্লেখ করেন।

তাঁদের এক ছেলে সন্তান হলে তারা তাঁর নাম রাখেন আবু উমাইর। ছোটো ছোটো পা ফেলে ছেলেটি যখন হাঁটতো, বাবা-মা’র মন তখন জুড়িয়ে যেতো। ছেলেটি ছিলো বাবার খুবই আদরের। ছেলে অসুস্থ থাকাবস্থায় একদিন আবু তালহার (রা:) বাইরে যাবার প্রয়োজন হয়। অসুস্থ ছেলেকে রেখে কিভাবে বাইরে যাবেন সেটা নিয়ে তিনি চিন্তায় ছিলেন।

রুমাইসা (রা:) স্বামীকে বললেন, “তুমি তোমার কাজে যেতে পারো, ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। আমি তাঁর যত্ন নেবো।” স্ত্রীর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে আবু তালহা (রা:) ছুটলেন তাঁর কাজে। কিন্তু কাজ থেকে তাঁর ঘরে ফেরার আগেই ছোট্ট ছেলে আবু উমাইর মারা যায়। রুমাইসা (রা:) ছেলের দাফনের ব্যবস্থা করেন আর বাড়ির অন্যান্য লোকদেরকে বলেন, আবু তালহা (রা:) ঘরে ফিরলে তাঁকে যেন ছেলের মৃতুসংবাদ কেউ না দেয়, তিনি নিজেই দিবেন।

সফর শেষে আবু তালহা (রা:) যখন ঘরে ফিরেন তখন প্রথমেই জিজ্ঞেস করেন তাঁর অসুস্থ ছেলে এখন কেমন আছে। রুমাইসা (রা:) স্বামীকে বললেন, ‘তুমি তাঁকে যে অবস্থায় রেখে গিয়েছিলে, এখন তাঁর চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে’। আবু তালহা মনে মনে ভাবলেন, ছেলে তো তাহলে ভালোই আছে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করার পর রুমাইসা (রা:) স্বামীর কাছে যান বেশ পরিপাটি হয়ে।

আদরের ছেলের মৃত্যু সংবাদের ধাক্কা যাতে স্বামী সহ্য করতে পারেন সেজন্য খুব সাবলীলভাবে তিনি স্বামীকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা আবু তালহা, যদি কেউ তোমার কাছে কোনো জিনিস গচ্ছিত রাখে, তারপর কিছুদিন পর সেই জিনিস ফেরত নিতে আসে, তুমি কি তাকে সেই জিনিসটি দিতে অস্বীকৃতি করবে?’ আবু তালহা বললেন, ‘না, কক্ষণো না’। এবার রুমাইসা (রা:) স্বামীকে আসল খবরটি দিলেন- ‘তাহলে তোমাকে বলছি, ছেলের ব্যাপারে তোমাকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে। সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে’।

ছেলের মৃত্যুর ধাক্কা আবু তালহা (রা:) সামলে নিলেও স্ত্রীর প্রতি ক্ষোভ জন্মালো, কেন তিনি এমন আচরণ করলেন। সকালে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে স্ত্রীর গত রাতের আচরণের কথা বললে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁদেরকে বলেন,

“আশা করা যায়, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের এ রাতে বরকত দিবেন।”
[সহীহ বুখারী: ১৩০১]

সেই রাতে রুমাইসার (রা:) গর্ভে আল্লাহ এক বরকতময় সন্তান প্রেরণ করেন। যার নাম ছিলো আব্দুল্লাহ (রা:)। আব্দুল্লাহর (রা:) নয়জন সন্তান ছিলেন কুর’আনের ক্বারী।
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হিজরত করে যখন মদীনায় যান, তখন মদীনাবাসীরা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) পছন্দের গিফট নিয়ে গেলো। রুমাইসার (রা:) প্ল্যান ছিলো অন্যরকম। তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ছেলে, যেই ছেলেকে বড় করার জন্য একসময় তিনি সংকল্প করেছিলেন আর বিয়েই করবেন না, সেই ছেলেকে নিয়ে যান রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে।

রাসূলের (সাল্লাল্লাহুই আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে গিয়ে অনুরোধ করেন, তাঁর দশ বছর বয়সী ছেলেকে যেন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সেক্রেটারি হিশেবে গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রুমাইসার (রা:) কথা রাখেন। রুমাইসার (রা:) পুত্র, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সেক্রেটারি সেই ছোটো ছেলেটি ছিলেন আনাস ইবনে মালিক (রা:)।

রুমাইসা (রা:) এবং আরো কিছু আনসার মহিলাকে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যুদ্ধে নিয়ে যেতেন। যুদ্ধের সময় তাঁদের দায়িত্ব ছিলো মুজাহিদদের পানি সরবরাহ করা।
[সহীহ মুসলিম: ১৮১০]

উম্মু সুলাইম (রুমাইসার আরেক নাম) ভালো খাবার রান্না করলে সেটি তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পাঠাতেন। একদিন ছেলে আনাস (রা:) এসে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর দূর্বল কণ্ঠস্বর শুনে বুঝলাম তিনি ক্ষুধার্ত। ঘরে কোনো খাবার আছে?

উম্মু সুলাইম (রা:) কিছু যবের রুটি বানিয়ে আনাস (রা:) কে দিয়ে বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে দিয়ে আসতে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আনাস (রা:) কে দেখে বললেন, আবু তালহা তোমাকে পাঠিয়েছে?
আনাস (রা:) বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বুঝতে পারলেন, তাহলে তো খাবারের জন্যই হবে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মিটিং-এ উপস্থিত সকল সাহাবীকে নিয়ে ছুটলেন আবু তালহার বাড়িতে। এতো মানুষকে একসাথে দেখতে পেয়ে আবু তালহা (রা:) ভড়কে যান। স্ত্রীকে বললেন, হে উম্মে সুলাইম! রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তো অনেক লোক নিয়ে আসছেন। আমাদের ঘরে তো এতো লোকের খাবার নাই। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল থেকে উম্মু সুলাইম (রা:) জবাব দিলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-ই ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘরে ঢুকে উম্মু সুলাইম (রা:) কে রুটি আনতে বলেন। উম্মু সুলাইম (রা:) রুটি নিয়ে আসলে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দু’আ পড়ে বললেন, দশজন করে আসতে বলো। এভাবে দশজন দশজন করে এসে আশি জন সাহাবী তৃপ্তিভরে আহার করলেন।
[সহীহ বুখারী: ৫৩৮১]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মাঝে মাঝে উম্মু সুলাইম (রা:) এর বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম নিতেন। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘুমালে উম্মু সুলাইম (রা:) রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঘাম সংগ্রহ করে ‘সুক্কা’ নামের সুগন্ধীর একটা বোতলে রাখতেন। ঘুম থেকে উঠে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) জিজ্ঞেস করতেন, একি করছো?

উম্মু সুলাইম (রা:) তখন বলতেন, এটা হচ্ছে আপনার ঘাম, এটা আমি আমার সুগন্ধীর সাথে মেশাই, আর এ তো সব সুগন্ধীর সেরা সুগন্ধী।
[সহীহ মুসলিম: ৫৯৪৯]

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মু সুলাইমের (রা:) এই কাজ দেখে হাসতেন।
[সুনানে আন-নাসাঈ: ৫৩৭১]

রুমাইসা (রা:) ছিলেন জান্নাতনারী। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মি’রাজের রাতে জান্নাতে গিয়ে এক মহিলার কণ্ঠস্বর শুনতে পান। তিনি জানতে চাইলেন, এটি কার কণ্ঠস্বর?
তাঁকে বলা হলো, কণ্ঠস্বরটি আনাসের মায়ের (রুমাইসা/গুমাইসা)।
[সহীহ মুসলিম: ২৪৫৬]

লিখেছেন

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Exit mobile version