শুধুই তোমাকে চাই

এতোটা ভালো কাউকে বাসিনি, যতোটা তাকে বেসেছি। এতোটা আপন কাউকে ভাবিনি যতোটা তাকে ভেবছি। রাতের পর নিদ্রাহীন কাটিয়ে দিয়েছি শুধুই তার জন্য। তাকে পাবার জন্য। তাকে ভালোবাসার জন্য। ভুল বুঝাটা বিদূরিত করে তাকে বোঝাবার জন্যে। তাকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখবার জন্য। কিন্তু কোনো উপোয়ে, কোনো মাধ্যমে, কোনোভাবেই সে বুঝতে চায়নি। বুঝেনি। কোনোভাবেই সে আমাকে পাত্তা দেয়নি। গোনায় ধরেনি। মোটেও মূল্যায়ন করেনি। তার অব্যাহত অবহেলায় আমার চক্ষুদ্বয় হতে অনবরত ঝরেছে অশ্রু-শ্রাবণ।

আমার এই অনবরত অশ্রুপাতন তাকে টলাতে পারেনি। আমার ব্যথাহত মনের ভেতর থেকে বেয়ে পড়া অশ্রুবৃষ্টি তার কাষ্টকঠিন মনটাকে গলাতে পারেনি। আমি সবভাবেই তার কাছে ব্যর্থ। পরাজিত। সবভাবেই…

রাতজাগা অসংখ্য সব স্মৃতিগুলোকে আমি বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি। ভালোবাসাটাকে সতেজ রাখতে চেয়েছি। কিন্তু সে বাঁচতে দেয়নি সুখের স্মৃতিগুলোকে। প্রীতিগুলোকেও। কিন্তু আমার সকল চেষ্টা, আমার সকল তদবির, আমার সকল অনুনয়- বিনয় তার কাছ থাকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আমি তার কাছে কিছুই চাইনি। কোনো স্বার্থ হাসিলের ধান্ধা করিনি। শুধুই তাকে চেয়েছি। শুধুই তাকে! তার ভালোবাসাকে।

তাকে নিয়ে মনের মাধুরি মিশিয়ে সবুজ-সতেজ স্বপ্ন দেখেছি। সুখে-দুঃখে আজীবন একই আলয়ে জীবনকে যাপন করার স্বপ্ন দেখেছি। তার হাতটা ধরে ক্ষুদ্র এই জীবনটা পার করে দিতে চেয়েছি। কিন্তু আমি পারি নি। আমি হেরে গিয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবে চেয়েছি তার বুকে ঠাই পেতে। কিন্তু সে চেয়েছে যেকোনোভাবেই আমাকে সরিয়ে দিয়ে আলাদা হয়ে যেতে! আমার চাওয়া হেরে গিয়েছে। তার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে।

সেই যে আমার মনটা ভেঙে গিয়েছে, আজ অবধি জোড়া লাগেনি। সে আঘাতে কলিজাটা যে জখম হয়েছে, আজতক সে জখমটা সেরে ওঠেনি। সুস্থ-স্বাভাবিক হয় নি। এই ক্ষুদ্র জীবনে কারো পাতে ভরসা করে, সাহস করে কলিজাটা পেতে দিইনি; তার পাতে পেতে দিয়েছি কলিজাটা। কিন্তু দু’চখে তার বিনিময়ে নেমেছে শুধুই দুঃখের শ্রাবণ।

আমি খুব হাসিখুশি আর ভীষণ উৎফুল্ল ছিলাম। অথচ মানুষটার অব্যাহত অবহেলায় আমার হাসিখুশি মনটা ভেঙে খানখান হয়ে গেছে। টুকরো টুকরো হয়ে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। কাউকে ভালোবেসে এতোটা কষ্ট পেতে হয় তা আমার জানা ছিলো না। কাউকে ভালোবেসে মৃত্যুর চাইতেও কঠিন যন্ত্রণায় হৃদয়টা দগ্ধ করতে হয়, তা জানা ছিলো না। কিন্তু এখন জেনেছি। এখন বুঝেছি।

মানুষ কী জন্য আত্মহত্যা করে এখন আমি হাড়েহাড়ে উপলব্ধি করতে পারি। আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরায়-উপশিরায় সেই বোধ ও বুঝ আজকে এসেছে। এখন এসেছে। আমি বুঝতে শিখেছি, মানুষ মরে যেতে আত্মহত্যা করে না। মানুষ তার কষ্টকে সহ্য করতে না পেরে নিজেকে নিজেই শেষ করে দেয়। আমারও প্রতিটা মূহুর্তেই সেই ইচ্ছে জাগে। সেই কষ্ট জাগে।

মানুষ নাকি কান্না করলে তার হৃদয় হালকা হয়। কিন্তু আমি কাঁদতে চাই চিৎকার করে। অথচ আমার বুক ফেটে চৌচির হয়ে যায়, তবুও কান্না আসে না। কেনো চিৎকার করে যে কান্নাটা আসে না, আর আমার কলিজাটাও হালকা হচ্ছে না তা আমি আজো বুঝতে পারছি না।

দিন যায় প্রভাত আসে। প্রভাতের রঙিন আলোয় সারা ভূবণ হাসে। আমি হাসি না। আমি হাসতে চেষ্টা করি মন থেকে, কিন্তু পারছি না। আমার হাসি শেষ। আমার সকল আনন্দ শেষ। আমি হরহামেশাই চেষ্টা করি মানুষটাকে ভুলে যেতে, কিন্তু তা আমি একদমই পারছি না। অনেক ওয়াজ শুনি। অনেক আলোচনা শুনি। অনেক কাজকর্ম করি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। একেবারে কিচ্ছু না। আমি শান্তিই পাচ্ছি না। একটুও না……

এক সময় কতো কতোজনকেই আমি ফিরিয়ে দিয়েছি। কারো আবেগ আমাকে গলায়নি। টলায়নি আমার কাষ্ঠকঠিন মনটাকে। কিন্তু মানুষ হিসেবে কখনো আমি খুব দুর্বলতা অনুভব করলেও শেষ অবধি নিজেকে ফিরিয়ে রেখেছি। তখন মাঝেমধ্যে সে-সব কারণে নিজেকে ভীষণ নিষ্ঠুরই মনে হতো। কিংবা কখনো কখনো খুব বেশিই ভালো মনে হতো। এখন মনে হয় কারো না কারো আবেগের অবমূল্যায়নে আমার এই দশা। এই পরিণতি।

কেউ যেনো দুষ্ট আবেগের জলে ঝাঁপ না দেয়, দুষ্ট আবেগের জোয়ারে না ভাসে, সে বিষয়ে আমি কতোজনকে কতোভাবেই না মোটিভেট করেছি। কিন্তু এখন মনে হয় আমি নিজেই নিজের দুষ্টু আবেগের পালে হাওয়া দিয়ে জীবন্ত লাশ হয়ে পড়ে আছি। কী করবো, কী করবো না। কিছুই বুঝতে পারতেছি না। আমার আশেপাশের মানুষগুলো, আমার পরিবেশ আমাকে বুঝতে চাবে না। বুঝতে চায় না। বুঝেও না। এবং যার জন্য আজ আমার এমন করুণ দশা সে নিজেও বুঝতে চায় না, চাবে না এবং চাচ্ছেও না আমাকে একটুখানিও বুঝতে। আমার বুকটা মনে হয় কেউ চুরচুর করে ফেলেছে ভেঙে ভেঙে।

আমি কিচ্ছু করতে পারছি না, পড়াশোনা, কাজকর্ম —কিচ্ছু না। সকলের সামনে হাসি। খাই। কথাও বলি। কিন্তু আমি জীবন্ত একটা লাশের মতো। মনের সুখ নেই। শান্তি-স্বস্তিও নেই। কী করবো আমি ? কোথায় যাবো!! আমি আমার জন্য, জীবনের জন্য কিছুই চাই না। তাকে বলেছি —আমি শুধুই তোমাকে চাই। শুধুই তোমাকে ! কিন্তু জানিনা সে কী জন্যে, কোন কারণে আমাকে চায় না। চাচ্ছেনা। বারংবারই ফিরিয়ে দিচ্ছে আমাকে। বারংবার……

তার থেকে প্রত্যখাত হতে হতে আমারও কেনো যেনো জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এসেছে। এরপর আমি প্রতিজ্ঞা করেছি আর কোনোদিন যাবো না তার কাছে। মনের আঙিনায় ভুলেও আনবোনা তার স্মৃতি। কখনোই অনুভব করবোনা তার প্রীতি। আসলে যতোবারই হেরে গিয়েছি আমি আমার ভালোবাসার দাবির কাছে, ততোবারই আমি এই প্রতিজ্ঞা করেছি। কিন্তু কেনো যেনো আমার বেহায়া প্রবৃত্তিটা বাঁধ মানেনা। সে প্রতিবার-ই হেরে যায়। শুধুই হেরে যায়। বারংবারই পরাজিত হয়ে যায়।

আমি বুঝে উঠতে পারিনা কী জন্য এতো প্রত্যাখ্যাত হয়েও তাকেই মনে পড়তে হবে!? কেনো এতো ইমোশনাল আমাকেই হতে হবে!! নিজেকে মনে মনে নীরবতার কোলাহলে সঁপে দিয়ে প্রশ্ন করি— কেনো ভালোবাসার সমুদ্রে আমাকেই সাঁতার কাটতে হবে? আমাকেই হাবুডুবু খেতে হবে? আমি কি খুবই অগুরুত্বপূর্ণ আত্মমর্যদাহীন কিছু কিংবা কেউ? আমার জন্য কি সারা পৃথিবীতে ভালোবাসার মানুষের অভাব পড়েছে? কতো কতো মানুষই তো আমাকে পেতে চায়, আমাকে ভালোবাসতে চায়। কিন্তু তবুও কেনো বারংবারই অপমান আর অবহেলার গ্লানি আমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে তার জন্যে তার পেছেনে?
কেনো খোঁজ খবর আমাকেই নিতে হবে?

সে তো আমার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্যে কখনো নক করেনি-কল করেনি। কেনো আমাকে যে অব্যাহত অবহেলা করে, অমর্যাদা করে তাকে আমার নিজ থেকেই আগে ম্যাসেজ করতে হবে? কল করতে হবে? কী জন্য এতো পাগল আর এতো ব্যাক্তিত্বহীন হয়ে পড়ছি আমি দিনকে দিন ?? এই যে কিছুক্ষণ আগেও তো পুনরায় ম্যাসেজ আমিই করেছি তাকে। প্রতিটি সময় আমিই করি।

আমি মন থেকে এখন এখন তাকে পুরোপুরিই ভুলে যেতে চাই। চেষ্টা করি। ঘৃণা আসলে হয়তো তা সম্ভব হতো। কিন্তু তা-ও কেনো যেনো আসে না। তাকে না পাওয়ার কষ্টে আমার মাঝেমধ্যেই মন চায় মরে যেতে। পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে। কয়েকবার ভেতর ভেতর ইচ্ছে জেগেছে যে আত্মহত্যা করি। নিজেকে খুন করে ফেলি। আসলে আমি স্রেফ মরে যেতেই নিজেকে খুন করতে বা আত্মহত্যা করতে চাইনি কিংবা চাই-ও না। আমি এই কলিজা ভাঙা কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে, রেহাই পেতেই আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। মরে যেতে চেয়েছি।

আমার কেনো যেনো মনে হয়, পৃথিবীর কোনো মানুষ-ই স্রেফ মরে যেতেই আত্মহত্যার মতো ভয়ংকার এক পাপের সীদ্ধান্তগ্রহন করেনা। সবাই-ই কষ্ট থেকেই বাঁচতে চায়।
অথচ এই আত্মহত্যা করা মানেই আরো ভয়বহরকমের কষ্টে নিজেকে নিক্ষেপ করা। অনন্ত এক কষ্টে নিজেকে নিজ হাতে সঁপে দেয়া।
আল্লাহর কুরআন থেকে জানতে পারি বিষয়টি। আল্লাহ তাঁর পবিত্র কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন—

“আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। এবং যে কেউ জুলুম করে, অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, অবশ্যই আমি তাকে অগ্নিদগ্ধ করবো, আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।”
[সূরা আন-নিসা : ২৯-৩০]

কুরআন থেকে আল্লাহর আরো নির্দেশ হলো— ‘

‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’’
[সূরা আল-বাকারা: ৯৫ ]

অথচ আমি তা-ই করতে চাইছি। মনে মনে সে আকাঙ্ক্ষা-ই পোষণ করেছি।
হাদীসে নাববী থেকে জানতে পারি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ-কাজটি থেকে নানাভাবে বারণ করেছেন। এ থেকে মানুষকে সতর্ক করেছেন। যেমন, সাবিত বিন যিহাক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোনো বস্তু দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, কিয়ামতের দিন তাকে সে বস্তু দিয়েই শাস্তি প্রদান করা হবে।”
[বুখারি : ৫৭০০]

সহীহ বুখারি অধ্যয়ন করে আমরা আরো জানতে পারি, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম বলেছেন—
“যে ব্যক্তি নিজেকে পাহাড়ের ওপর থেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামে যাবে। সেখানে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে নিক্ষেপ করতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে ব্যক্তি বিষপান করে আত্মহত্যা করবে, সে তার বিষ তার হাতে থাকবে। জাহান্নামে সর্বদা সে ওইভাবে নিজেকে বিষ খাইয়ে মারতে থাকবে অনন্তকাল ধরে। যে কোনো ধারালো অস্ত্র দ্বারা আত্মহত্যা করেছে তার কাছে জাহান্নামে সে ধারালো অস্ত্র থাকবে যার দ্বারা সে সর্বদা নিজের পেটকে ফুঁড়তে থাকবে।”
[ সহীহ বুখারি : ৫৪৪২]

“তোমাদের পূর্বেকার এক লোক আহত হয়ে সে ব্যথা সহ্য করতে পারেনি। তাই সে একখানা চাকু দিয়ে নিজের হাত নিজেই কেটে ফেলে। এর পর রক্তক্ষরণে সে মারা যায়। আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নিজেকে হত্যা করার ব্যাপারে বড় তাড়াহুড়া করে ফেলেছে। তাই আমি তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিলাম।’’
[ সহীহ বুখারি : ৩২৭৬]

“যে ব্যক্তি ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে সে দোজখে অনুরূপভাবে নিজ হাতে ফাঁসির শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর যে বর্শার আঘাত দ্বারা আত্মহত্যা করে, দোজখেও সে নিজেকে সেভাবে শাস্তি দেবে। আর যে নিজেকে নিক্ষেপ করে আত্মহত্যা করবে, কিয়ামতের দিন সে নিজেকে উপর থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করবে।”
[সহীহ ইবন হিব্বান : ৫৯৮৭]

আল্লাহর কুরআন এবং রাসুলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ও’সাল্লামের হাদিসের নির্দেশনা পড়ার পর এখন ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি এখন এইরকম ভালোবাসা আর চাই না। যে আমাকে ভালোবাসেনা, তাকেও চাইনা। এই যে প্রেম-ভালোবাসা, এটা একটা বুকভাঙা প্রতারণাপূর্ণ শব্দের নাম, এবং মানসিক শান্তি-স্বস্তি ও ঈমান ভঙ্গ হওয়া জিনিসপত্রের নাম। সত্যিই মনে হয় পৃথিবীতে এসব প্রেম-ভালোবাসা বলতে কিছুই নেই। এগুলো শুধু একটু অভ্যেস আর অভিনয়ের নাম। আমরা সবাই অভিনেতা। সবাই স্বার্থপর। কষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সবাই সবকিছুই ভুলে যেতে পারে। একেবারে সবাই। সবকিছুই…

এই যে, আমিও ভুলে যেতে পারলে তাকে আর নক করতাম না। নিজের মনের তুমুল টান অনুভব করেছি বলেই নিজেকে কতো নীচুস্তরে নিয়ে গিয়েছি! একটা মানুষের হাত-পা ধরে ক্ষমা চাইতে বলেছি। হৃদয়ের যন্ত্রণা দূর করতে, মানসিক তৃপ্তি পেতে ভালোবেসেছি। এই তো, আমিও তো স্বার্থপর! আমার ভালো লেগেছে বলেই এগিয়ে এসেছি। প্রাধান্য দিয়েছি। ছোটো হয়েছি। নিজেকে ছোটো করেছি। যদি তাঁর প্রতি আমার মনটা না ঝুঁকতো, তাহলে হয়তো আমার সাথেও কেউ এমন করলে আমিও কৌশলে এই-সেই বলে এড়িয়ে যেতাম। হয়তো সরাসরি কোনো বিষয় বলতাম না। কিন্তু মন থেকে মায়া না জাগলে আমিও তো সেইম কাজটা করতাম। কিন্তু এখন আমিও জাস্ট আমার মনের পুজারি! স্বার্থপর আরকি!!

তার এমন অজস্র অবহেলা পেয়ে নফসকে এখন তার থেকে মুক্ত রাখতে আমি নানাভাবে সময় কাটাই। অনুপ্রেরণা খুঁজি। আমার করণীয় অন্বেষণ করি। নিজের মনকে-ঈমানকে একটু দৃঢ় করতে আমি অনেক লেকচার শুনি। বই পড়ি। এখনও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার একটা বই হাতে বসে আছি আমার পঁচে যাওয়া রূহের একটু চিকিৎসা করতে। নিজেকে পরিপূর্ণ পাপমুক্ত করতে। বইটিতে একটা কথা পড়েছি, যা যেনো আমার অন্তরের অবস্থাটাই বর্ণনা করেছে। ফুটিয়ে তুলেছে। আর ত হলো এই—
“ প্রেম-ভালোবাসা এমন রোগ, যা নফসের ভীষণ প্রিয়; যদিও এসব তার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে মানুষ এমন কিছু বিষয়কে অপছন্দ করতে শুরু করে, যা তার জন্য উপকারী।”
[ রূহের চিকিৎসা : ৭০]

সে তো আর আমার বিয়ে করা বউ না। তার সাথে কথা বলা, রাত জাগা, এসব তো আমার জন্যে ক্ষতিকর-ই বটে। তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলা, রাত না জেগে দ্রুত ঘুমিয়ে পড়া— এগুলো সবই আমার জন্যে তো উপকারী-ই। কিন্তু কথিত এই প্রেম আমাকে তা করতে বারণ করে। এটা আমাকে রাতজাগা বিরহী ডাহুকে পরিণত করে দিয়েছে। জেগে জেগে এখন আমি বিরহের গান শুনি। নাটক দেখি। অথচ আল্লাহর নির্দেশের স্পষ্ট লঙণ এসব। এসবে তিনি ক্রোধান্বিত হন।
আমার জন্যে সাজেশন দিয়ে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ লিখেছেন—
আল্লাহকে ক্রোধান্বিত করে, এমন কিছুতে আসক্ত হলে তার ওপর আবশ্যক হলো নিজের মধ্যে আল্লাহর ভয় জাগ্রত করা।[ ৭৪]
কিন্তু আল্লাহর ভয় যেনো আমার অন্তর থেকে হাওয়া হয়ে হারিয়ে গেছে। আল্লাহর ভয় যদি আমার ক্বলবে থাকতো, তা হলে আমি তো কোনো মেয়ের জন্যে এমন পাগল হয়ে পাগলাটে আচরণ করতাম না। আমার জন্যে হালাল না, হালাল হবার সম্ভাবনাও নেই—এমন একটা মানুষের জন্যে মনটা এরকম আসক্ত হয়ে পড়ে থাকতো না। অথচ,
আমার অন্তরকে সৃষ্টি করা-ই হয়েছে আল্লাহকে ভালোবাসার জন্যে। আল্লাহকে ভালোবাসা-ই হলো অন্তরের আসল স্বভাব। [ ৭৬ ]
কিন্তু আমি করছি সেই স্বভাবের বিরুদ্ধাচারণ।

এই যে এখনই একটা সীদ্ধান্ত নিয়েছি আর কখনোই আমি নিজ থেকে কোনো ম্যাসেজ বা কল করবো না তাঁকে। সে রাস্তাও রাখবোনা। কারণ, তার কারণেই আমি উদ্যোমহীন হয়ে পড়েছি। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছি। বিষণ্ণ হয়ে পড়েছি। তাকে কেন্দ্র করেই রাতের পর রাত নিদ্রাহীন কাটিয়েছি। এসব নানাবিধ কাওরণে আমি শাররীকভাবেও ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছি। এবং-কী নিজেকে নিজে খুন করতেও চাইছি আমার আল্লাহর নির্দেশ ভুলে। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার কথাগুলো কী জীবন্ত মনে হয়। তিনি যথার্থই বলেছেন—

কারো অন্তরে যদি আল্লাহর ভয় থাকে, হৃদয়টা তাঁর দ্বীনের জন্যে একনিষ্ঠ থাকে, তাহলে সেখানে কোনো মাখলুকের ভালোবাসা স্থান পেতে পারেনা। আসক্তি তো পরের বিষয়। আর যদি কারো দিল অন্য কারো প্রেমে আসক্ত হয়ে যায়, তাহলে সেই অন্তর থেকে ধীরে ধীরে রব্বের ভালোবাসাটাও হারিয়ে যেতে থাকে। [ ৭৭]

যার ফলে সে যেকোনো পাপাচারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে থাকতে পারে। গোমরাহি-আর পাপাচারে হৃদয়টাকে কলুষিত করে ডুবিয়ে রাখতে পারে। আমিও কী ভীষণ রকম কলুষিত হয়ে পড়েছি। যে সময়টা তার জন্যে কেঁদে কাটিয়েছি, তার পেছেন ব্যয় করেছি, সে সময় আর সে কান্নাটা যদি আমি আমার রব্ব আল্লাহর জন্যে আর তাঁর দরবারে কান্না করে কাটিয়ে দিতে পারতাম; তাহলে নিশ্চয়ই আমি তাঁর প্রিয় হয়ে যেতাম। তাঁর জান্নাত আমার জন্যে অবশ্যই বরাদ্দ হয়ে যেতো।

যাইহোক, আমার আল্লাহ আমাকে সেই যে ভয়ংকর গোমরাহি আর পাপাচার, সেটা থেকে হেফাজত করেছেন। মুক্ত রেখেছেন। যেই আল্লাহ আমাকে এমন ভয়ানক আসক্তি আর গোমরাহি থেকে হেফাজত রেখেছেন, আমি এখন তাঁকেই চাই। আমি এখন তাঁকেই ভালোবাসি। এখন আর কাউকে চাওয়ার মানসিকতা কাজ করেনা। এখন কাজ করে শুধুই আমার রব্বকে পাবার মানসিকতা। কারণ তিনি আমাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এনে দিয়েছেন।

মরা থেকে আমার দেহে প্রাণের সঞ্চার করেছেন। আমি যদি সুইসাইড করতাম, তা হলে আমি আজ এতো সুন্দর পৃথিবীর আলো-বাতাস আর দেখতে পারতাম না। তিনিই আমাকে জীবন বাঁচাতে কতো শত-সহস্র ফুল-ফল দিয়ে দুনিয়াটাকে সুশোভিত-সুরভীত করে রেখছেন। সঠিক পথে যেনো জীবন পরিচালনা করতে পারি, সেজন্যে তিনি দিয়েছেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। তাই তো আমআর হৃদয়ে আজ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় শুধুই তোমাকে চাই। শুধুই তোমাকে চাই…

লিখেছেন

একটা সুন্দর ইনসাফপূর্ণ ইসলামি সমাজের স্বপ্ন দেখি। সত্য বলে যা বুঝি, ইসলামের শিক্ষা যা জানি, বুঝি – তা অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে শেয়ার করি।
বারবার ভুল করি। কিন্তু সব ভুল থেকে নিজেকে সংশোধন করে সুপথগামী হতে চাই।
অনেক মানুষের দু’আ এবং ভালোবাসাসহ জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ আঙ্গিনায় পাখি হয়ে উড়তে চাই।

Exit mobile version