গাছের পাতা ও গাছের চামড়া খেয়ে ক্ষুদা নিবারণ

ব্যচেলার জীবন যেমনি আনন্দের হয়, তেমনি বেদনার স্মৃতিও থাকে কিছু। ক্লাস সেভেন থেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি দিই। শহরে এসে নানান অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। তার মধ্যে বড় অভিজ্ঞতা ছিল না খেয়ে থাকা। কত বেলা যে না খেয়ে থাকা লাগছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
আমাকে একদম কড়া গণনায় খরচের টাকা দিত। স্বভাব চরিত্র বেশি সুবিধার ছিল না বিধায়, টাকার অভাবে রাখতো। পরিবার ভাবতো হাতে বেশি টাকা থাকলে অভ্যাস বেশি খারাপ হয়ে যাবে। তা অবশ্যই খারাপ ভাবেনি।

মাসের শুরুটা ছিল আমার জন্য বড়োই আনন্দের কারণ প্রতি মাসের এক তারিখ টাকা হাতে আসতো। হাতে টাকা আসলে শুরু হয়ে যেতো রেস্টুরেন্টে যাওয়া। ভালো ভালো খাবার খাওয়া। এদিক সেদিক ঘুরতে যাওয়া। মাসের তারিখ যতই শেষের দিকে যাইতো মজ মাস্তি, খাবার-দাবার, আনন্দ ফুর্তি, ঘুরাফেরা সব কমিয়ে আসতো। প্রতি মাসের শেষ দশদিন আমার জন্য বড়োই বেদনার ছিল।

মাসের বিশ তারিখের দিকে আসলে পকেটের এক বেহাল অবস্থা হয়ে যেতো। একটাই টেনশন কাজ করতো তখন, এই দশদিন কিভাবে কাটিয়ে উঠবো? তখন এক বেলা খেতাম, আরেক বেলা উপোস থাকতাম। মাঝে মধ্যে দু’বেলাও না খেয়ে থাকতাম। কিন্তু এভাবে আর কত! খুব নিরাশ লাগতো জীবনের প্রতি। এমন ভাবে কি আর চলা যায়? ভাবতাম মনে মনে আমার মতো হতভাগা পৃথিবীতে মনে হয় আর কেউ নাই। এ কেমন জীবন! ধিক্কার জানাতাম নিজের প্রতি।

আল্লাহর উপর পুরো নিরাশ হয়ে পড়তাম। যে রাতে না খেয়ে ঘুমাতাম, সেই রাতে বিড়বিড় করে বলতাম আল্লাহকে তোমার কি দয়া হয় না আমার প্রতি? এই যে না খেয়ে ঘুমাচ্ছি?
ঘটনাটি ইসলাম শুরুর দিকের। চার সপ্তাহ বা তার চেয়ে কম সময়ের ভেতর মক্কার কুরাইশরা চারটি বড় ধরনের ধাক্কা খেল। হামজা (রা.) ও ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব একত্রিত হয়ে আল্লাহর রাসুলকে রক্ষার ব্যাপারে একমত হলো। কুরাইশরা এতে অস্থির হয়ে উঠল।

তারা বুঝতে পেরেছিল যে এখন মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাবে না। এর আগে তারা চেয়েছিল মুহাম্মদ (সা.)-কে হত্যা করতে। কিন্তু সেই চিন্তা থেকে এখন সরে এসেছে। কেননা মক্কায় ভয়াবহ রক্তপাত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাই তারা নির্যাতনের একটি নতুন পথ আবিষ্কার করল। এটি ছিল ইতিপূর্বে গৃহীত সব পদক্ষেপের চেয়ে বেশি মারাত্মক। তারা আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা.)-কে অবরুদ্ধ করে ফেলল। অবরোধনামা কাবার দেয়ালে টাঙ্গিয়ে দিল। তিন বছর তিনি অবরুদ্ধ জীবন যাপন করেন। এটা ছিল মহানবী (সা.)-এর নবী হিসেবে আবির্ভাবের সপ্তম বছরের ঘটনা।
এ অবরুদ্ধ জীবনে পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে উঠল।

খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নবীজি (সা.) গাছের পাতা ও চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করতেন। ক্ষুধার কষ্ট এত মারাত্মক ছিল যে ক্ষুধার্ত নারী ও শিশুর কান্না আবু তালেব ঘাঁটির বাইরে থেকে শোনা যেত। তাঁদের কাছে কোনো খাদ্য পৌঁছার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। যা কিছু পৌঁছত সেসব গোপনীয়ভাবেই পৌঁছাত। নিষিদ্ধ মাসসমূহ ছাড়া প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য তাঁরা ঘাঁটির বাইরে বের হতেন না। বাইরে থেকে মক্কায় আসা জিনিস কেনার চেষ্টা করেও অনেক সময় তাঁরা সক্ষম হতেন না। কারণ কুরাইশরা সেসব জিনিসের দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত।

হাকিম ইবনে হাজাম ছিলেন খাদিজা (রা.)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র। মাঝে মাঝে তিনি ফুফুর জন্য গম পাঠাতেন। একবার গম পাঠানোর উদ্যোগ নিলে আবু জেহেল বাধা দেয়। কিন্তু আবুল বাখতারি হাকিম ইবনে হাজামের পক্ষাবলম্বন করে গম পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন।

এদিকে আবু তালেব সব সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। রাতে সবাই শুয়ে পড়ার পর তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে বলতেন, যাও, তুমি এবার তোমার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ো। তিনি এ কথা এ জন্যই বলতেন, যাতে কোনো গোপন আততায়ী থাকলে বুঝতে পারে যে তিনি কোথায় শয়ন করেছেন। এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আবু তালেব তাঁর প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের শোয়ার স্থান বদলে দিতেন। ভ্রাতুষ্পুত্রের বিছানায় নিজের পুত্র, ভাই বা অন্য কাউকে শয়ন করাতেন। প্রিয় ভাতিজা আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রাত কাটাতেন।

এ ধরনের কঠিন অবরোধ সত্ত্বেও রাসুলুল্লাহ (সা.) ও মুসলমানরা হজ্বের সময় বাইরে বের হতেন। হজ্বের উদ্দেশ্যে আসা লোকদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।
এ অবস্থায় পুরো তিন বছর কেটে যায়, এরপর নবুয়তের দশম বর্ষে মহরম মাসে দলিল (অবরোধনামা) ছিন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে অত্যাচার-নির্যাতনের অবসান ঘটে। কুরাইশদের মধ্যকার কিছু লোক এ ব্যবস্থার বিরোধী থাকায় তারাও অবরোধ বাতিল করার উদ্যোগ নেয়।

এই অমানবিক অবরোধ সম্পর্কিত প্রণীত দলিল বিনষ্ট করার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন বনু আমের ইবনে লুয়াই গোত্রের হিশাম ইবনে আমের। হিশাম রাতে চুপিসারে খাদ্যদ্রব্য পাঠিয়ে আবু তালেব ঘাঁটির অসহায় লোকদের সাহায্য করত। তিনিই এ অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বারবার দেনা-দরবার করেন। একবার এ নিয়ে আবু জেহেল ও অন্যদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। তখন মুতয়াম বিন আদি অবরোধনামা ছিঁড়ে ফেলে। ছিঁড়তে গিয়ে দেখল, আল্লাহর নাম লেখা অংশ বাদে বাকি অংশ সত্যি সত্যি পোকা খেয়ে ফেলেছে।

পরে অঙ্গীকারপত্র ছিঁড়ে ফেলা হলে বয়কটের অবসান হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) ও অন্য সবাই শাবে আবু তালিব থেকে বেরিয়ে এলেন। কাফিররা এ বিস্ময়কর নিদর্শনে আশ্চর্য হয়, কিন্তু তাদের মনোভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।
[“বুখারি প্রথম খণ্ড, পৃ. ২১৬, ৫৪৮ জাদুল মায়াদ দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ. ৪৬, ইবনে হিশাম প্রথম খণ্ড পৃ. ৩৫০-৩৫১, ৩৪৭, ৩৭৭, রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭০]

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন নিজের না খাওয়া দিন গুলোর কথা চিন্তা করি তখন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়। আমি না খেয়ে থাকতাম হয়তো পুরো মাসে কয়েক বেলা। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় আমার গাছের পাতা খাওয়া লাগেনি। কখনো গাছের চামড়া খাওয়ার চিন্তা তো বহু দূরের কথা। আরও একে একে তিনটি বছর।

আমরা অনেকে ভালো খাবার না পাওয়াতে কত হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু এটা আমরা চিন্তা করি না কখনো তো গাছের পাতা ও গাছের চামড়া খাওয়া লাগেনি।

লিখেছেন

হে আল্লাহ সেই সম্মানোত্তরে অন্তর্ভুক্ত করে দাও যে সম্মান তুমি দিয়েছ তোমার প্রিয় মুমিনদের

Exit mobile version