স্ত্রীকে প্রহার করা কি ইসলামে জায়েজ?

স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা কি ইসলামে জায়েজ?

স্ত্রীকে মারধর করা কি ইসলামে জায়েজ?

স্ত্রীকে প্রহারের বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সংশয়। এদের মধ্যে একপক্ষ কখনো কুরআন এর বাংলা পড়ে না, তাফসির পড়ে না। এক পক্ষ বলে বেড়ায় এটা অসম্ভব হতেই পারে না।
এগুলো নিয়েই আজকের সংক্ষিপ্ত এই লেখাটা ।

সমাজআল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা পুরুষদের নেতা বানিয়েছেন। নারীদের উপর পুরুষদের কর্তৃত্ব দিয়েছেন।

কুরআনে রয়েছে –
وَالْمُطَلَّقَاتُ يَتَرَبَّصْنَ بِأَنفُسِهِنَّ ثَلاَثَةَ قُرُوَءٍ وَلاَ يَحِلُّ لَهُنَّ أَن يَكْتُمْنَ مَا خَلَقَ اللّهُ فِي أَرْحَامِهِنَّ إِن كُنَّ يُؤْمِنَّ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَبُعُولَتُهُنَّ أَحَقُّ بِرَدِّهِنَّ فِي ذَلِكَ إِنْ أَرَادُواْ إِصْلاَحًا وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ وَاللّهُ عَزِيزٌ حَكُيمٌ

আর তালাকপ্রাপ্তা নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েয পর্যন্ত। আর যদি সে আল্লাহর প্রতি এবং আখেরাত দিবসের উপর ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ যা তার জরায়ুতে সৃষ্টি করেছেন তা লুকিয়ে রাখা জায়েজ নয়। আর যদি সদ্ভাব রেখে চলতে চায়, তাহলে তাদেরকে ফিরিয়ে নেবার অধিকার তাদের স্বামীরা সংরক্ষণ করে। আর পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের উপর অধিকার রয়েছে, তেমনি ভাবে স্ত্রীদেরও অধিকার রয়েছে পুরুষদের উপর নিয়ম অনুযায়ী। আর নারীরদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ হচ্ছে পরাক্রমশালী, বিজ্ঞ।
সূরা আল বাক্বারাহ – Surah Al-Baqara
আয়াত নং-২২৮

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –
“ঐ সব লোক কখনো মুক্তি পেতে পারেনা যারা নারীদের তার শাসনকত্রী বানিয়ে নেয়”।
(বুখারী শরীফ)

নারীদের উপর একজন পুরুষের মর্যাদা লাভের আরেক কারণ হলো – পুরুষরা নারীদের উপর তাদের মাল খরচ করে থাকে যা আল্লাহ তাদের উপর দায়িত্ব দিয়েছেন।

হযরত ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত-
“নারীদেরকে পুরুষদের আনুগত্য করতে হবে, তার কাজ হলো সন্তানাদির রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং স্বামীর অবর্তমানে তার সম্পদের হেফাজত করা।

আরেক হাদিসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন –
“উত্তম ঐ নারী যখন তার স্বামী তার দিকে তাকায় তখন সে তাকে সন্তুষ্ট করে, যখন কোনো নির্দেশ দেয় তখন সে তা পালন করে এবং যখন সে বিদেশ গমন করে তখন সে নিজেকে নির্লজ্জতাপূর্ণ কাজ হতে নিরাপদ রাখে ও স্বীয় মালের হিফাজত করে।”
অতঃপর তিনি এই আয়াত (২:৩৪) পাঠ করেন।

মুসনাদে আহমদে রয়েছে, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন – রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
” যখন কোনো নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে, রমজানের রোজা রাখবে, স্বীয় গুপ্তাঙ্গের হিফাজত করবে এবং স্বামীকে মেনে চলবে, তাকে বলা হবে যেকোনো দরজা দিয়ে চাও জান্নাতে প্রবেশ করো।”

আমাদের সমাজে অনেক মহিলাই রয়েছে যারা প্রায় সময় অবাধ্য হয়ে যায়। আর একজন নারী অবাধ্য হলে একটা পরিবারের কি অবস্থা হয় তা আমরা সকলেই জানি। একজন নারী যেমন একটা পরিবারকে জান্নাত বানাতে পারে তেমনি পুরো একটা পরিবারের শান্তিও একজন নারী একাই নষ্ট করতে পারে। সেই সমস্ত অবাধ্য নারীদের বাধ্য করার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাদের কিছু রাস্তা বলে দিয়েছেন।

তিনি সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে বলেছেন –

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاء بِمَا فَضَّلَ اللّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنفَقُواْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِّلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللّهُ وَاللاَّتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَاهْجُرُوهُنَّ فِي الْمَضَاجِعِ وَاضْرِبُوهُنَّ فَإِنْ أَطَعْنَكُمْ فَلاَ تَبْغُواْ عَلَيْهِنَّ سَبِيلاً إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلِيًّا كَبِيرًا

পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট্য দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও, তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হয়ে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপর শ্রেষ্ঠ।
সূরা আন নিসা – Surah An-Nisaa
আয়াত নং-৩৪

“পুরুষরা নারীদের তত্ত্বাবধায়ক, এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের একের উপর অন্যকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং যেহেতু তারা নিজদের সম্পদ থেকে ব্যয় করে।

সুতরাং পুণ্যবতী নারীরা অনুগত, তারা লোকচক্ষুর অন্তরালে হিফাযাতকারিনী ঐ বিষয়ের যা আল্লাহ হিফাযাত করেছেনে। আর তোমরা যাদের অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, বিছানায় তাদেরকে ত্যাগ কর এবং তাদেরকে (মৃদু) প্রহার কর। এরপর যদি তারা তোমাদের আনুগত্য করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমুন্নত মহান।”

হযরত হাসান বসরী (রঃ) বলেন,
“এক স্ত্রীলোক নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে এসে স্বীয় স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, তার স্বামী তাকে থাপ্পর মেরেছে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিশোধ নেওয়ার হুকুম দিয়েই ফেলেছেন এমন সময় এই আয়াত নাজিল হয়। সুতরাং প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বিরত রাখা হয়।

সেসব স্ত্রীলোক, যারা স্বামীদের আনুগত্য করে না কিংবা যারা এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। আল্লাহ্ তা’আলা সংশোধনের জন্য পুরুষদেরকে যথাক্রমে তিনটি উপায় বাতলে দিয়েছেন। অর্থাৎ স্ত্রীদের পক্ষ থেকে যদি নাফরমানী সংঘটিত হয় কিংবা এমন আশংকা দেখা দেয়, তবে প্রথম পর্যায়ে তাদের সংশোধন হল যে, নরমভাবে তাদের বোঝাবে। যদি তাতেও বিরত না হয়, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের বিছানা নিজের থেকে পৃথক করে দেবে।

যাতে এই পৃথকতার দরুন সে স্বামীর অসন্তুষ্টি উপলব্ধি করে নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে পারে। তারপর যদি তাতেও সংশোধন না হয়, তবে মৃদুভাবে মারবে, তিরস্কার করবে। আর তার সীমা হল এই যে, শরীরে যেন সে মারধরের প্রতিক্রিয়া কিংবা যখম না হয়।

কিন্তু এই পর্যায়ের শাস্তি দানকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেননি, বরং তিনি বলেছেনঃ ‘ভাল লোক এমন করে না’।
[আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা আমাদের সুন্দর একটা পদ্ধতি বলে দিয়েছেন। স্ত্রী অবাধ্য হলে প্রথমে তাকে নরম ভাবে বুঝানোর জন্য বলা হয়েছে। অনেকে স্বামীর এই নম্রতায় সহজেই বাধ্য হয়ে যায়, স্ত্রীরা অনেক স্বামীভক্ত থাকে। কিন্তু এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে বিছানা আলাদা করার কথা বলা হয়েছে। এর মানে এই নয় যে স্ত্রীকে অন্য কক্ষে পাটিয়ে দিবে। বরং না এই শাস্তি টা পরিবারের আড়ালেই দিতে হবে যাতে স্ত্রীর অন্যদের সামনে অসম্মান না হয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের আড়ালে এগুলো করতে হবে।

এ ক্ষেত্রে একই বিছানায় দুজন মাঝখানে বালিশ একটা দিয়ে ঘুমাতে পারে। বিছানা এমন একটি স্থান যেখানে স্বামী স্ত্রী একসাথে ঘুমালে তাদের শারীরিক স্নায়ু গুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা অধিক মিলনে আগ্রহী হয়ে উঠে। তাই এই শাস্তিটাই অনেকের জন্য বেশি হয়ে যাবে, তারা নরম হতে বাধ্য হবে।
কিন্তু কখনো যদি এতেও সম্ভব না হয় তাহলে আল্লাহ বলেছেন মৃদু প্রহার করতে।


পিতা মাতা যেমন সন্তানকে আদব শেখাতে শাসন করে এইটাও সেরকম মানষিকতা নিয়েই করতে হবে। প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দ্যেশ্য নিয়ে নয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়াও প্রয়োগ করতে হবে প্রথম দুই প্রক্রিয়া প্রয়োগের শেষে।

কখনোই স্ত্রী অবাধ্য হলো আর এসেই মারপিট শুরু করা যাবে না।

এক সাহাবী রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের কারো উপর তার স্ত্রীর কি হক আছে?

রাসূল বললেনঃ তুমি খেতে পেলে তাকেও খেতে দেবে, তুমি পরিধান করলে তাকেও পরিধেয় বস্ত্র দেবে, তার চেহারায় মারবে না এবং তাকে কুৎসিৎও বানাবে না, তাকে পরিত্যাগ করলেও ঘরের মধ্যেই রাখবে।
[আবু দাউদ]

অন্য বর্ণনায় রয়েছে – এতেও যদি কাজ না হয় তাহলে শাসন গর্জন করো এবং মেরে পিটেও সরল পথে আনো।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ভাষণে বলেছেন – “নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। তারা তোমাদের সেবিকা ও অধীনস্থা। তাদের উপর তোমাদের এই হক যে, যাদের যাতায়াতে তোমরা অসন্তুষ্ট তাদেরকে তারা আসতে দেবে না। যদি তারা এরুপ না করে তবে তোমরা তাদের যেন-তেন প্রকারে সতর্ক করতে পারো।

কিন্তু তোমরা তাদেরকে কঠিন রূপে প্রহার করতে পারো না, যে প্রহারের চিহ্ন প্রকাশ পায়। তোমাদের উপর তাদের হক এই যে তোমরা তাদেরকে খাওয়াবে ও পড়াবে এবং এমন প্রহার করা উচিত নয়, যার চিহ্ন অবশিষ্ট থাকে, কোনো অঙ্গ ভেঙে যায় কিংবা কোনো অঙ্গ আহত হয়।


অতএব এমন ভাবে প্রহার করতে হবে যাতে কোনো চিহ্ন প্রকাশ না পায়। কিন্তু এটাও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পছন্দ করেন নি।
কিছু বর্ণণায় রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যারা স্ত্রীদের প্রহার করে তারা ভালো মানুষ নয়।

অতএব সম্পূর্ণ বক্তব্যের উপসংহার দেয়া যায় এভাবে- যে সকল নারী স্বামীর অবাধ্য হবে তার সংশোধনের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তিনটি ব্যবস্থা দিয়েছেন-
১. তাদেরকে সদুপদেশ ও নসীহত করে বুঝাতে হবে।
২. সাময়িকভাবে বিছানা আলাদা করে দেবে। বুদ্ধিমতী মহিলার জন্য এটাই যথেষ্ট।এতেও কাজ না হলে:
৩. হালকা মৃদু প্রহার করবে।তবে প্রহার যেন জুলুমের পর্যায়ে চলে না যায়। অনেক গণ্ডমুর্খ পুরুষ প্রহার করতে গিয়ে স্ত্রীদেরকে মেরেও ফেলে যা শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম

উল্লিখিত তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরও যদি কোন ফল না হয়, তাহলে চতুর্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, স্বামী-স্ত্রী উভয়পক্ষকে দু’জন বিচারক নিয়োগ করতে হবে। তারা উভয়ে নিষ্ঠাবান ও আন্তরিকতাপূর্ণ হলে তাদের সংশোধনের প্রচেষ্টা অবশ্যই ফলপ্রসূ হবে। আর যদি তাদের প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে তালাকের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেয়ার অধিকার তাদের আছে।

এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন এ অধিকার শর্ত সাপেক্ষে অর্থাৎ তাতে শাসকের পক্ষ হতে আদেশ বা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের অনুমতি থাকতে হবে।
তবে অধিকাংশ আলিম সমাজের মতে কোন শর্ত ছাড়াই তাদের এ অধিকার আছে।

যে সকল তাফসির থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে -তাফসির ইবনে কাসির, তাফসির ফি যালিলিল কুরআন, ফাতহুল মাজিদ।আল্লাহ আমাদের সঠিকটা বুঝার ক্ষমতা দিন।

সংগ্রহীত এবং সংকলিত – বিয়ে : অর্ধেক দ্বীন (অফিসিয়াল)

Exit mobile version