Writing

সত্য প্রীতি বনাম ব্যক্তি প্রীতি

ক’দিন আগেই তারা পরাজিত হয়ে এসেছে এক অসম যুদ্ধে মুসলিম মুজাহিদদের নিকটে। বদরের প্রান্তরে। বদর যুদ্ধে। বদরের সেই পরাজিত শক্তি মুশরিকরা প্রতিশোধ গ্রহনের মানসিকতায় বন্য হায়েনার মতো উন্মাদ হয়ে আছে। তাদের চোখে-মুখে হিংসা-ক্রোধ-ক্ষোভের উত্তাল লেলিহানশিখা বিরাজিত। মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সল্লামের নব-প্রতিষ্ঠিত ইসলামি রাষ্ট্র, এবং সে-রাষ্ট্রের সফলতা ও অগ্রযাত্রা তারা কোনো ক্রমেই মানতে পারছে না। মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রকে সমূলে নাশ করার নানান ফন্দি-ফিকির তারা এঁটে যেতে লাগলো।সেই ধারাবাহিকতায় তারা ওহুদের প্রান্ত্ররে জুড়ে দেয় সম্মুখ-সমরে যুদ্ধ।

সব সৈনিকদের একত্রিত করলেন মদিনার রাষ্ট্রপ্রধান আল্লাহর প্রিয় হাবীব। সকল মুজাহিদদের উদ্দেশ্য করে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন তিনি। বীর মুজাহিদ সেনাপতি ও সৈনিকগণ তাঁদের প্রিয় নেতার কথামালা-দিকনির্দেশনা উতকর্ণ হয়ে শ্রবণ করতে লাগলেন। কে হবে তীরন্দাজ, কে বা কারা হবে পদাতিক কিংবা ঘোড়সাওয়ার — একে একে সবাইকে সবার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে লাগলেন। গিরিপথে সার্বক্ষণিক প্রহরীর দায়িত্ব দিলেন পঞ্চাশজন তীরন্দাজকে।

বেজে উঠলো যুদ্ধের দামামা। ঝাঁপিয়ে পড়লো মুশরিকরা মুসলিমদের ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলিম বীরযোদ্ধারা মুশরিকদেরকে বীরবিক্রমে প্রতিরোধ করে হারিয়ে দেয়। মুসলিম বীর মুজাহিদদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে মুশরিক বাহিনী। যে যার মতো হন্য হয়ে পালায়ন করতে থাকে।

মুশরিকদের পিছু হটা দেখে মুসলিমদের মনে উত্তাল আনন্দের দামামা বেজে ওঠলো। সেই আনন্দ এসে আছড়ে পড়লো — যেকোনো পরিস্থিতিতে গিরিপথ থেকে সরে না এসে নিয়োজিত থাকার নির্দেশনা প্রাপ্ত — গিরিপথে পাহারারত পঞ্চাশজন তীরন্দাজদের ওপরেও। আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আ’লাইহি ওসাল্লামের নির্দেশনা ভুলে গিয়ে আনন্দের উদ্দীপনায় তাঁরা গণিমত সংগ্রহে নেমে পড়লো। কিন্তু তাঁদের নেতৃত্বে থাকা আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর তাঁদের নিষেধ করলেন। আল্লাহর রাসুলের নির্দেশ স্মরণ করিয়ে দিলেন। তবুও তাঁরা সেই বারণ উপেক্ষা করে নেমে পড়লেন।
[আর-রাহীকুল মাখতুম-৩০৫ পৃষ্ঠা]

পেছন থেকে তৎকালীন মুশরিক সেনাপতি জেনারেল খালিদ বিন ওয়ালিদ বিষয়টি লক্ষ্য করলো। মুসলিমদেরকে গণিমতের মাল সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত থাকতে দেখে আতর্কিত হামলা চালিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। খালিদের এমন আক্রমন দেখে মুশরিক বাহিনী আনন্দে আঁটখানা হয়ে পড়ে। তীব্র গতিতে তারাও হামলে পড়ে মুসলিম বাহিনীর ওপর। খুন আর জখম করতে থাকে তারা মুসলিম মুজাহিদদের। নিশ্চিত বিজয় হাতছাড়া হয়ে যেতে আর কী লাগে?

হয়েও গেলো সুনিশ্চিত বিজয়টি হাতছাড়া। খালিদের ব্যাপক হামলায় পর্যুদুস্ত হয়ে পড়লো মুসলিম বাহিনী! রক্ষা পেলেন না আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম-ও।
একে একে আহত আর শাহাদাতের সরাব পান করছে মুসলিম বাহিনী। ময়দানে যুদ্ধ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম নিজেও।
মানবতার বন্ধু, মায়ার মহানবি মুহাম্মদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লামকে কাফিররা হত্যা করতে পেরেশান হয়ে আছে। একের পর এক আক্রমণ চালিয়ে নবিজিকে হত্যা করতে যারপরানই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা।

উতবাহ বিন আবু অক্কাস। এই হতভাগা মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’স্বল্লামকে দেখেই হিংস্র গতীতে পাথর দ্বারা আঘাত করলো। পাথরের আঘাতে একপাশে ঢলে পড়লেন প্রিয় নবিজি। সেই আঘাতে তাঁর ডান পাশের ওপর-নিচের চারটে দাঁত ভেঙ্গে যায়। কোত্থেকে তেড়ে এসে আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী। এসেই আঘাত করে নবিজির কপাল বরাবর। ঘোড়সাওয়ারী বনী হারিছ গোত্রের ইবনে কামিয়াহ। আল্লাহর রাসুলকে পরখ করলেন। প্রিয় নবিজির দেহ মুবারকের কাঁধ বরাবর জালিম ইবনে কামিয়াহ তরবারি দিয়ে আঘাত করে। খুব জোরেশোরেই সেই আঘাতটি করলো এই জালিম !
[আর-রাহীকুল মাখতুম-৩০৯ পৃষ্ঠা]

ভীষণ রকম আহত রাসুল্লাহ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম। বিপর্যস্ত মুসলিম বাহিনী। এর মধ্যে চারদিকে কাফিররা রটিয়ে দিলো যে মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লামকে আমরা নিহত করে ফেলেছি!
[তাফসীরে আহসানুল বায়ান]
এমন সংবাদে ভীষণ রকম হতাশায় পড়ে গেলো মুসলমানগণ। দিকদ্বিক দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে সবাই। ভেঙ্গে গেলো তাঁদের মনোবল পুরোপুরিই। হারিয়ে গেলো তাঁদের অবশিষ্ট্য সাহস এবং ধৈর্যও। দুঃখ-বেদনায় তাঁরা ভারাক্রান্ত হয়ে প্রবল পেরেশানিতে পড়ে গেলেন।

মুহাম্মাদ স্বল্ললাহু আলাইহি ও’সাল্লাম মারা যাবেন, পৃথিবী থেকে চলে যাবেন—এটা যেনো তাঁরা মোটেও মেনে নিতে পারছেন না। তাঁরা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি এই মানুষটিকেই ভালোবাসে!
এখন সেই মানুষটাকে হারাবার যে পীড়ন, যেই দুঃখ— সেই দুঃখ আর পেরেশানি থেকে তাঁরা যুদ্ধের সারঞ্জম রেখে দিয়ে কেউ কেউ চলে যতে লাগলেন এদিক-ওদিক। যাকে সামনে পায় তাকেই তারা জিজ্ঞেস করে তাঁদের প্রিয় নেতা-প্রিয় নবি সম্পর্কে— তিনি কি বেঁচে আছেন নাকি সত্যিই নিহত হয়েছেন। হঠাৎ কেউ একজন আল্লাহর নামের কসম করে বলে ওঠলো —‘‘যদি মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম সত্যিই নিহতই হয়ে থাকে, তা হলে আমি আমার সকলকে আমার বংশধরদের হাতে সোপর্দ করে দেবো। এই সুযোগে মুনাফিকরাও থেমে নেই। তারাও মুসলমানদের ঈমানহারা করার কোশেশ করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে না।

তারাও রসিয়ে রসিয়ে আগুনে ঘি ঢালার মতো আচরণ করতে লাগলো। বলতে লাগলো যে— মুহাম্মাদ যদি নবিই হবে তা হলে মারা গেলো ক্যান!! চলো আমরা পূর্ব-ধর্মে ফিরে যাই! কেউ কেউ আওয়াজ তুললো—আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই’র ( মুনাফিক নেতা ) কাছে ফিরে চলো, সে-ই আমাদেরকে মুশরিক নেতা আবু সুফিয়ান থেকে নিরাপত্তা নিয়ে দিবে!!’’
[তাফসীরে তাবারী-৬ষ্ঠ খণ্ড]

সংশয়ক্লিষ্ট-রোগাক্রন্ত মুসলিমদের অন্তরের অবস্থা আল্লাহর অগোচরে নয়। নাযিল করলেন ওহী। জানিয়ে দিলেন তিনি তাঁর প্রিয় হাবিবকে ! অবতীর্ণ হলো সেই আয়াতে কারিমা, যেখানে বলা হয়েছে ‘‘মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম আল্লাহর রাসুল ছাড়া কিছুই না। তাঁর পূর্বেও তো বহু নবি-রাসুল অতিক্রান্ত হয়েছে। তিনি যদি মারা যান, কিংবা নিহত করে ফেলা হয় তাঁকে ; তা হলে তোমরা কি তোমাদের পূর্বেকার অবস্থায় ফিরে যাবে ?

আর মুহাম্মদ একজন রসূল বৈ তো নয়! তাঁর পূর্বেও বহু রসূল অতিবাহিত হয়ে গেছেন। তাহলে কি তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন অথবা নিহত হন, তবে তোমরা পশ্চাদপসরণ করবে? বস্তুতঃ কেউ যদি পশ্চাদপসরণ করে, তবে তাতে আল্লাহর কিছুই ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না। আর যারা কৃতজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সওয়াব দান করবেন।
[সূরা আল ইমরান:১৪৪]

তিনি শুধু একজন রাসুল, এছাড়া আর কিচ্ছু না। তাঁর মর্যাদার কারণ, তাঁকে অনুসরণ করার কারণ হচ্ছে তিনি রিসালাত প্রাপ্ত, ওহী প্রাপ্ত। আল্লাহর মনোনীত একজন বান্দা ও রাসুল। এটিই তাঁর বড় বৈশিষ্ট্য যে, তিনি রিসালাতের গুণে গুণান্বিত । তিনি মানবীয় গুণাবলির ঊর্ধ্বে নন এবং এমনও নন যে, তিনি আল্লাহর গুণের কোনো কিছু প্রাপ্ত হয়েছেন ফলে তাঁকে মৃত্যু গ্রাস করবে না।
[তাফসীরে আহসানুল বায়ান]

তিনি নিয়ে এসেছেন আমাদের জন্য সত্য, নিয়ে এসেছেন আলো, এনেছেন আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক আমাদের জন্য মমনোনীত তো জীবনব্যবস্থা—দ্বীনুল ইসলাম। কিন্তু এ-সত্য, এই দ্বীন কোনো ব্যক্তি নির্ভর নয়। গোত্র কিংবা গোষ্ঠি নির্ভরও নয়। আল্লাহ যেনো আমাদের বলছেন যে; এখন এ-সত্য তথা সত্যের প্রতি প্রেম যদি তোমাদের জন্য কোনো ব্যক্তি নির্ভর হয়, তোমাদের জন্য আল্লাহর দ্বীন যদি শুধু মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লামের ব্যক্তিত্বের সাথেই সম্পর্কিত হয়, তোমাদের ইসলাম যদি এতোটাই দুর্বল ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে যে —তিনি পৃথিবী থেকে বিদেয় হবার সাথে সাথেই যদি তোমরা পূর্বেকার সেই কুফুরীর দিকে ফিরে যেতে চাও, যেই কুফুরীকে পরিত্যাগ করে তোমরা ইসলামের আলয় আশ্রয় গ্রহণ করেছো, তা হলে আল্লাহর এই মহান দ্বীন তোমাদের কোনো-ই প্রয়োজন অনুভব করছে না।
[তাফহীমুল কুরআন]

ওহুদের ময়দানে এই যখন অবস্থা, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত যখন সকলের মন-মনন-ঈমান, তখন আনাস বিন নযর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সকলকে স্মরন করিয়ে দিলেন যে, মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাইহি ও’সাল্লাম তো স্রেফ আল্লাহর একজন রাসুল কেবল। তিনি সকলকে বলতে লাগলেন— আল্লাহর রাসুল যদি নিহতই হয়ে থাকে, তাহলে তাঁর আল্লাহ তো নিহত হন নি।

যদি আল্লাহর রাসুল নিহতই হয়ে থাকে, তোমরা বেঁচে থেকে কী করবা তা হলে? তিনি যে দ্বীনের জন্য জীবন দিয়েছেন তোমরা সেই দ্বীনের জন্য তোমাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখো। সেই জিহা-দ সংগ্রামে তোমরা লড়াই করো। শহিদ হও।
[তাফসীরে তাবারী- ৬ষ্ঠ খণ্ড]

ইসলাম এসেছে আল্লাহর রাসুলের মাধ্যমে। আমাদের দুনিয়া-আখিরাতের মুক্তির জন্য, মানবতার স্বস্তি ও নিরাপত্তার জন্যই মুহাম্মাদ স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদেরকে ইসলাম নামক এক মহা নিয়ামাত দিয়ে ধন্য করেছেন। তিনি চলে গেলেই যদি ইসলামের পথ থেকে সরে গিয়ে কুফুরীর পতাকা তলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়, তা হলে ইসলামে আসার মানেটা কী? সে-জন্য আল্লাহ কিন্তু আমাদের সতর্ক করেছেন। কড়া ধমক দিয়েছেন!

এখন আমরা যারা আমাদের কোনো প্রিয় মানুষ, প্রিয় শাইখ, প্রিয় আলিম বা প্রিয় নেতার মৃত্যুতে, কিংবা তাঁদের কোনো বিচ্যুতিতে মন খারাপ করে, হতাশ হয়ে, কষ্ট পেয়ে যদি ইসলামের পথ থেকে সরে যাই, আন্দোলনে-আমলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ি, তাহলে সেই কাজটা কতোটুকু যৌক্তিক এবং শরীয়া সম্মত?

আমরা যদি কোনো নেতা, কোনো ইমাম, কোনো আলিমকে বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে ভালোবাসি, সেই ভালোবাসাটা তো নিচক ইসলামের জন্যই। ইসলামের মানদণ্ডের বাহিরে গিয়ে আমি কিভাবে সেই মানুষকে চিন্তা করতে পারি? তাঁদের কারো প্রস্থানে কিংবা কারো ব্যক্তিগত জীবনের ভুলের জন্য যদি আমি আল্লাহর দ্বীনের পথ ছেড়ে দিই সেটা কি আদৌ ঠিক কাজ হবে? উচিত হবে? ইসলামের কনসেপ্টের সাথে তা কি আদৌ যায়?

যেখানে স্বয়ং আল্লাহর রাসুলের মর্যাদা আর আনুগত্য হচ্ছে আল্লাহর আনিত দ্বীনের জন্য, রিসালাতের বাহক হবার জন্য; সেহেতু আমরা যাদের বা যে সমস্ত ইসলামি নেতৃত্ব কিংবা ব্যক্তিবর্গ ও আলিমদের ভালোবাসি, তাঁদেরকে তো সেই রাসুলের আনিত দ্বীনের জন্যই বাসবো। তাই না? এখন তাঁরা কেউ যদি সেই দ্বীন-বহির্ভূত কিছু করে ফেলে, তা হলে সে অভিমানে দ্বীনের কাজ ছেড়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয়?

যেসমস্ত ইসলামি ব্যক্তিবর্গ, আলিম-ওলামা কিংবা কোনো ইসলামি সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যদি জালিমদের জুলুমের স্বীকার হয়ে শহিদ হয়, দুনিয়া থেকে চিরকালের তরে বিদেয় হয়ে যায়—তা হলে আমাদের কি তাদের রেখে যাওয়া যে স্বপ্ন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য, তাঁদের অসামপ্ত কাজের আঞ্জাম দেওয়ার জন্য কর্মতৎপরতা আরো দ্বিগুন-তিগুন গতিতে বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়? নাকি সেই পথ, সেই আদর্শ থেকে হারিয়ে যাওয়াটাই সমাধান?

তার মানে কি প্রিয়জন বিয়োগের বেদনায় আমরা ব্যথিত হবো না? রক্তে মাংসে গড়া মানুষ বলেই তো মানুষের ভেতর দুর্বলতা ঘুরতে থাকে দুর্নিবার ! আমরা তো দেখেছি এই দুর্বলতা আল্লাহর রাসুলের সাহাবিদেরও ভেতরও হয়েছে স্বয়ং উমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে তা।
ওহুদের তো মিথ্যে রটনা ছিলো, কিন্তু যেদিন সত্যিই আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর মায়া পরিত্যাগ করে দুনিয়া থেকে চলে গেলো, সেদিন বিষয়টি উমর ইবনুল খত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর কানে যাবার সাথে সাথেই তার কলিজায় ধরে গেছে যেনো!

তিনি তা মেনে নিতে পারেন নি! ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন তিনি। তরবারি হাতে নিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন — যে ব্যক্তি বলবে মুহাম্মদ স্বল্লালাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকাল করেছে, আমি তার মস্তিষ্ককে দ্বিখণ্ডিত করে দেবো! এতো শক্তিমান আর কঠিন হৃদয়ের মানুষ উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, সেই বাস্তবতায় তিনি এতোটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে, আল্লাহর রাসুলের ইন্তিকাল তিনি মানতেই পারলেন নি প্রথমদিকে।

যেহেতু আসহাবে রাসুলদের মতো উচ্ছ মাকামের মানুষদেরও এমন দুর্বলতা হয়েছে বা এসেছে, সেহেতু আমাদের মতো মানুষের মধ্যেও বিরহ-ব্যথা, কষ্ট ও হতাশা আসাটা একেবারেই স্বাভাবিক। আমাদের মতো মানুষদেরও এরকম কিছুতে, মনটা ভেঙ্গে খানখান-টুকরো টুকরো হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা যেনো সেই ব্যথাতুর মন থেকে আল-কুরআনের পথ, ইসলামের পথ থেকে দূরে সরে না যাই, সে শিক্ষাটাও আল্লাহ তাঁর রাসুলের জীবনীর মাধ্যমে, কুরআনের এই আয়াতের মাধ্যমে দিয়েছেন।

আরো একটা শিক্ষা আমরা পাই এখান থেকে যে, পরবর্তী যাঁরা ইসলামের ধারক-বাহক হবেন, ইসলামের পূর্ণ বুঝ যাঁর বা যাঁদের আছে, পরবর্তীতে নেতৃত্বের জোয়াল যাঁর বা যাদের কাঁধে আসবে, তাঁরা ইসলামের প্রকৃতরূপ, শিক্ষা-বুঝটা যেনো অন্যদের সামনে উপস্থাপন করে। যেভাবে করেছেন ওহুদের প্রান্তরে আনাস বিন নযর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, আর আল্লাহর রাসুলের ইন্তেকালের পরে আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু।

আল্লাহর রাসুল স্বল্লালাহু আলাইহি ইন্তিকালে যখন সাহাবায়ে কিরাম, এবং স্বয়ং উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুও শোকে মূহ্যমান, মেনে নিতে পারেন নি এমন বাস্তবতা, আবু বাকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তখন কৌশল অবলম্বন করেন, রসুল (সাঃ)-এর মিম্বারে দাঁড়িয়ে যান—”আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসূল। তাঁর পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসূল বিগত হয়েছে। যদি তিনি মারা যান অথবা তাঁকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে?

আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোন ক্ষতি করতে পারে না। আর আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন।” এই আয়াত তেলাওয়াত করে শোনান। সাথে আরো একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন —

إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُم مَّيِّتُونَ
নিশ্চয় তোমারও মৃত্যু হবে এবং তাদেরও মৃত্যু হবে।
[সূরা আল-যুমার:৩০]

সাথে তিনি ছোট্ট করে একটি বক্তৃতা করেন, সেখানে তিনি বলেন “যারা মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইবাদাতকারী ছিলো, তারা জেনে রাখো, মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকাল করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদাতকারী, তারা নিশ্চিত জেনে রাখো, আল্লাহ চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।”
[সহীহ বুখারী-৩৬৬৮]

সাঈয়িদুনা আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহুর এই সান্ত্বনা এবং বাস্তবিত্তিক বক্তৃতা, দায়িত্বশীল সূলভ সেই কাজের পরে সাঈয়িদুনা উমর ইবনুল খত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কীভাবে কতোটা দ্রুত প্রভাবিত হয়েছেন, কতোটা কার্যকরী ছিলো তা দেখুন— ইবনু ‘আব্বাস রা্দ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আল্লাহ্‌র কসম! আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু তা পাঠ করার পূর্বে লোকেরা যেনো জানতো না যে, আল্লাহ তা’আলা এরূপ আয়াত অবতীর্ণ করেছেন।

এরপর সমস্ত সহাবি তাঁর থেকে উক্ত আয়াত শিখে নিলেন। তখন সবাইকে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম। আমাকে সা’ঈদ ইবনু মুসাইয়্যাব (রহঃ) জানিয়েছেন, ‘উমার রা্দ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন, আল্লাহ্‌র কসম! আমি যখন আবু বকর রা্দ্বিয়াল্লাহু আনহু-কে উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতে শুনলাম, তখন ভীত হয়ে পড়লাম এবং আমার পা দু’টো যেন আমার ভার নিতে পারছিলো না, এমনকি আমি মাটিতে পড়ে গেলাম যখন শুনতে পেলাম যে, তিনি তিলাওয়াত করছেন যে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইন্তিকাল করেছেন।
[সহীহ বুখারী- ৪৪৫৪]

এখন আমরা যারা সত্যের অনুসারণকারী, দ্বীনের অনুগামী, আমরা ব্যক্তির থেকে বেশি প্রাধান্য দেবো সত্যকে, আদর্শকে। ব্যক্তির প্রতি মায়া-ভালোবাসা অবশ্যই থাকবে, কিন্তু সেই মায়া সেই টান যেনো আমাদেরকে সত্য থেকে টলাতে না পারে, অভিমান হোক বা অভিযোগ—সে-সব হতে যেনো আমরা আল্লাহর পথ ছেড়ে না দিই। সাথে আরো একটা বিষয় মনে রাখতে পারি, তা হোলো—আমরা তো মানুষ, মানবিক দুর্বলতা মানুষেরই থাকবে। সেহেতু আমাদের যাঁরা দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ আছেন, তাঁদের উচিত তাঁরা যেনো ওহুদের ময়দানে আনাস বিন নযরের যেই ভূমিকা ছিলো, আল্লাহর রাসুলের ওফাতের পর আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহুর যে ভূমিকা ছিলো—সেই কালজয়ী দায়িত্বশীল ভূমিকা গ্রহণ করতে পারি। দোষারোপ করে কিংবা পাল্টা অভিযোগ তুলে যেনো কাউকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে ঠেলে না দিই। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন। আ-মী-ন!

সত্য প্রীতি বনাম ব্যক্তি প্রীতি

সুরা আলে-ইমরানের ১৪৪ নাম্বার আয়াতের আলোকে

লিখেছেন

একটা সুন্দর ইনসাফপূর্ণ ইসলামি সমাজের স্বপ্ন দেখি। সত্য বলে যা বুঝি, ইসলামের শিক্ষা যা জানি, বুঝি – তা অন্য ভাইবোনদের সঙ্গে শেয়ার করি।
বারবার ভুল করি। কিন্তু সব ভুল থেকে নিজেকে সংশোধন করে সুপথগামী হতে চাই।
অনেক মানুষের দু’আ এবং ভালোবাসাসহ জান্নাতুল ফেরদৌসের সবুজ আঙ্গিনায় পাখি হয়ে উড়তে চাই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture