Writing

ইসলামের ইতিহাসে দ্বন্দ্ব ও সমালোচনা

আমাদের দেশে কোনো মতবাদকে রিফিউট করার সময় সুন্দর করে একটি ট্যাগলাইন দেয়া হয়- ‘দাঁতভাঙ্গা জবাব’। কেউ কোনো বিষয়ে একটি মন্তব্য করলে, আরেকজন এসে সেটার দাঁতভাঙ্গা জবাব দেন।
ইসলামের ইতিহাসেও সমালোচনা, পাল্টা সমালোচনার অনেক ঘটনা পাওয়া যায়। কোনো মতবাদ লালন করার কারণে ভিন্ন মতের কেউ কথা দিয়ে জবাব দিয়েছে, কেউ হত্যা করে জবাব দিয়েছে। যাকে হত্যা করা হয়, পরবর্তীতে দেখা যায় ইতিহাস তাকে ‘নায়ক’ হিশেবে স্থান দিয়েছে। নিজেদের মতবাদ রক্ষায় যারা হত্যা করেছিলো, তাদেরকে পাওয়া যায় সেই মহান ব্যক্তির আলোচনার ফুটনোটে। ইতিহাসের এমন কিছু ঘটনা নিয়ে আজকের এই আলোচনা।

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের সময় আব্বাসীরা ছিলো শাসনক্ষমতায়। আব্বাসী শাসক মুতাযিলা আকীদাকে গ্রহণ করে এবং জনগণের ওপর সেই মতবাদ চাপিয়ে দেয়। আলেমগণকে তারা বাধ্য করে সেই ভ্রান্ত আকীদা মেনে নিতে। শাসকের অত্যাচারের ভয়ে অনেক আলেম চুপ থাকেন। গুটিকয়েক আলেম শাসকের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। তারা কোনোভাবেই মুতাযিলা আকীদা মেনে নেননি। সেই হাতেগোনা কয়েকজন আলেমের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল।

তাঁকে অত্যাচার করা হয়, দীর্ঘদিন কারাগারে রাখা হয়। এক শাসকের মৃত্যুর পর আরেক শাসক আসেন, তবুও তার ওপর অত্যাচার কমে না; বরং বাড়তে থাকে। আল-মামুন, আল-মু’তাসিম, আল-ওয়াসিক তিনজন শাসক তাঁর ওপর তিনটি ভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন করেন। তবুও ইমাম আহমদ তাঁর অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি। চতুর্থ শাসক এসে রাষ্ট্রীয়ভাবে মুতাযিলী মতবাদ ত্যাগ করেন। ইমাম আহমদ শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সুন্নীয়তের পতাকা উড়ান। তাঁর দৃঢ় অবস্থানের কারণে জয়ী হয় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামআতের আকীদা।
ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের সমসাময়িক একজন মুহাদ্দিস ছিলেন আলী ইবনে আল-মাদিনী। তিনি বলেন,
“আল্লাহ দুজন মানুষের মাধ্যমে ইসলামকে রক্ষা করেছেন। রিদ্দার সময় আবু বকররে (রা:) মাধ্যমে, আর মেহনার সময় আহমাদ ইবনে হাম্বলের মাধ্যমে।”

নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন:
“জামআত হলো যা হক হয়, সেই অনুযায়ী চলা; যদিও তুমি একাই সেটার অনুসারী হও।”
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) মেহনার সময় ইমাম আহমদের অবস্থানকে উল্লেখ করেন একটি জামআত হিশেবে। যদিও সে সময় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল অনেকটাই একা ছিলেন।

ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম ইবনে তাইমিয়া জীবনে কারাবরণ করেন কমপক্ষে পাঁচবার। একজন মুজতাহিদ হিশেবে তিনি এমন কিছু বলতেন, যা তাঁর সময়ের অনেক আলেমের সাথে মিলতো না। ফলে তারা শাসককে প্ররোচনা দিতেন। তালাকের ভিন্ন ফতোয়া দেয়ায় তাঁকে ৫ মাস ১৮ দিন গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিলো!
তাঁর মতো স্কলারের চিন্তা সময় অতিক্রম করে কথা বলে। ফলে, তাঁর যুগের কিছু মানুষের কাছে তাঁর চিন্তা-ভাবনা মনে হতো Heresy, ইসলামের সাথে যায় না! অথচ সময়ের সাথে সাথে তিনি হয়ে উঠেন জীবন্ত। কারাগারে ইন্তেকাল করা ইমাম বর্তমান সময়ের ‘রেফারেন্স স্কলার’।

সেই যুগে তাঁর পক্ষের মানুষ যেমন ছিলো, বিপক্ষের মানুষও ছিলো। বর্তমান সময়েও আছে। যারা তাঁকে পছন্দ করে, তাদের অনেকে তাঁকে মাযলুম, শহীদ মনে করে। যারা তাঁকে পছন্দ করে না, তাদের কেউ কেউ এখনো মনে করে তাঁর সাথে এমনটাই হওয়া উচিত ছিলো!

ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম বুখারীর সময়ে আলেমগণের কাছে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের আকীদার ধারা ছিলো সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং জনপ্রিয়। কয়েক যুগ আগে তারা ইমাম আহমদের সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করেছে। ‘কুরআন আল্লাহর কালাম’ এটা তখন প্রতিষ্ঠিত।
ইমাম বুখারীর জনপ্রিয়তা দেখে তাঁর সমসাময়িক অনেক আলেম ঈর্শ্বান্বিত ছিলেন। তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন কিভাবে তাঁকে অপদস্থ করা যায়। তাঁকে নানা জটিল প্রশ্ন করা হতো, তিনি সেগুলোর উত্তর দিতেন। আকীদা সংক্রান্ত একটি প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কুরআন আল্লাহর কালাম কিন্তু আমরা যে তেলাওয়াত করি, সেটা সৃষ্ট’। তাঁর এই কথা তরঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়- তিনি ইমাম আহমদের আকীদার স্কুল অব থটের বাইরে কথা বলছেন।

ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া আয-যুহরী নামে সমরকন্দের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর পেছনে উঠেপড়ে লাগেন। তাঁকে সমরকন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য করেন। ইমাম বুখারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়- ‘তাঁর আকীদায় সমস্যা!’

ইমাম বুখারী তাঁর জন্মভূমিতে গেলে সেখানে আরেক শাসক যুহরী ছিলেন। তিনিও ইমাম বুখারীর বিরুদ্ধাচরণ করেন তার কথা না মানায়। পবিত্র কুরআনের পর যে গ্রন্থ মুসলিম বিশ্বের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য, সেই গ্রন্থের রচয়িতাকে তাঁর যুগের কিছু আলেম, শাসক সহ্য করতে পারেনি। নিরুপায় হয়ে ইমাম বুখারী আল্লাহর কাছে দু’আ করেন-
“হে আল্লাহ! এই বিস্তৃত পৃথিবী আমার জন্য সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। অতএব, আপনি আমাকে উঠিয়ে নিন।”
দু’আর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন।

ইমাম আন-নাসাঈ (রাহিমাহুল্লাহ)

‘সিহাহ সিত্তা’ বা ‘কুতুবে সিত্তাহ’ ইসলামের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ছয়টি হাদীসের গ্রন্থ। সেই ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে একটি হলো ‘সুনানে আন-নাসাঈ’। গ্রন্থের লেখক ইমাম ছিলেন ইমাম আন-নাসাঈ। তিনি জীবনের পড়ন্ত বিকেলে দামেস্কে যান। দামেস্ক ছিলো উমাইয়্যাদের রাজধানী। সেখানে গিয়ে দেখতে পান লোকজন আলী (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করছে, কটুক্তি করছে। তখন তিনি আলী (রা:) ও আহলে বাইয়াতের মর্যাদা নিয়ে একটি বই লিখেন- ‘খাসাইসু আলী’। পরবর্তীতে সাহাবীদের ফযিলত নিয়ে লিখেন- ‘ফাযাইলুস সাহাবা’। কিন্তু, সেই বইয়ে মুআবিয়া (রাদিয়াল্লাহু আনহু) সংক্রান্ত কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দেননি। ফলে শুরু হলো তাঁর বিরুদ্ধে প্রোপ্যাগান্ডা।

দামেস্কের বিখ্যাত ‘জামে উমুবি’ মসজিদে দারস দেবার সময় লোকজন তাঁর সাথে তর্ক শুরু করে। তাঁকে ‘শিয়া মনোভাবাপন্ন’ আলেম বলে তারা তুলে ধরে। মুআবিয়া (রা:) –এর ব্যাপারে তাঁকে জেরা করতে থাকে। সন্তুষজনক জবাব না পেয়ে তারা ইমামকে মসজিদে মারধর করে। এককথায় যাকে বলে গণপিটুনি। তিনি বেশ আহত হোন। কিছুদিন বা কয়েক মাস পর সেই ধকল কাটাতে পারেননি। তিনি ইন্তেকাল করেন।
সুন্নী ইমামগণ যার সঙ্কলিত হাদীসের কিতাবের রেফারেন্স দেন, তাঁকে মারা হয় ‘শিয়া’ অভিযোগে!

ইমাম ইবনে আকিল (রাহিমাহুল্লাহ)

হাম্বলী মাজহাবের সবচেয়ে খ্যাতিমান ইমাম হিশেবে প্রথম সারিতে ইমাম ইবনে আকিলের অবস্থান। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পূর্বে হাম্বলী মাজহাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফিগার ছিলেন তিনি। হাম্বলী মাজহাবের স্কলার হওয়া সত্ত্বেও তিনি সব প্রশ্নে হাম্বলী মাজহাবের অন্ধ অনুসারী ছিলেন না।

একজন গবেষক হিশেবে তিনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাম্বলী মাজহাবের কিছু আইনের সাথে দ্বিমত করতেন।
ফিক্বহ ও আকীদায় তাঁর সাথে কয়েকজনের মতপার্থক্য দেখা দেয়। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। পরিস্থিতি এমন নাজুক হয়, মানুষ তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হয়। একপর্যায়ে চাপের মুখে তাঁকে স্বীকারোক্তি করতে হয়, তিনি আর সে মতের অনুসারী নন।
জোর-জবরদস্থি করে একজন গবেষককে কি দমিয়ে রাখা যায়?

ইমাম ইবনে ফুরাক (রাহিমাহুল্লাহ)

ইমাম ইবনে ফুরাক ছিলেন আশ’আরী আকীদার অনুসারী। তাঁর বিরুদ্ধে প্রোপ্যাগান্ডা ছড়ায় কারামিতারা। তারা সুলতান মাহমুদ আল-গজনবীকে বিচার দেয়, ইবনে ফুরাক নবিজীকে (সা:) ‘নবী’ হিশেবে স্বীকার করেন না। এটা ছিলো তাঁর বক্তব্যের চেরি-পিকিং। তিনি এটা বলেননি, কিন্তু তাঁর কথা থেকে তারা এমন মিনিং বের করে বিচার দেয়।
সুলতান মাহমুদ আল-গজনবী এটা শুনে ক্ষ্যেপে যান। ইবনে ফুরাককে তলব করেন। তিনি সুলতানের কাছে গিয়ে পুরো ঘটনা ব্যাখ্যা করেন, তিনি বুঝান তাঁর কথাকে কিভাবে ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। সুলতান ইমামের কথা শুনে মুগ্ধ হোন, তাঁকে পুরষ্কৃত করেন।

যারা সুলতানের কাছে বিচার দিলো, তারা দেখলো হিতে বিপরীত হচ্ছে। ফলে যাত্রাপথে তারা একজনকে বললো ইমাম ইবনে ফুরাকের পানিতে যেনো বিষ মেশানো হয়। ঈর্ষান্বিত সমালোচকদের ক্রোধ জয়ী হয়। বিষ মেশানো পানি খেয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।

অ্যামেরিকান লেখক মার্ক টোয়েন বলেন:
“A lie can travel half way around the world while the truth is putting on its shoes.”
অর্থাৎ, সত্য যখন সবে জুতো পরছে, মিথ্যা ততক্ষণে অর্ধেক পৃথিবী পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

যারা সবসময় অন্যের সমালোচনা করাকে নিজেদের ধ্যান-জ্ঞান হিশেবে নিয়েছেন, ইতিহাস তাদেরকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে। যে মুহাদ্দিস ইমাম বুখারীর ওপর ঈর্ষান্বিত হয়েছেন, তাঁর জীবনের অনেক কীর্তি থাকা সত্ত্বেও তার নাম নেয়া হয় ইমাম বুখারীকে নিয়ে আলোচনার সময়। নিজেদের মতবাদ প্রতিষ্ঠায় যারা ইমাম আন-নাসাঈকে মেরেছিলো, ইমাম ইবনে তাইমিয়াকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলো, তাদের কয়জনকে ইতিহাস স্মরণ করেছে?
যারা মানসম্মত কাজ মানুষের সামনে হাজির করেছেন, যাদের কাজে ইখলাস ছিলো, ইতিহাসে তারা ঠিকই অমর হয়ে আছেন।

‘On Inquisitions and Refutations In Our History’ লেকচার অবলম্বনে

[elementor-template id=”6787″]

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button