অতি সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কথা বেশ ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে শাইখ যুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী রচিত ও উমেদ থেকে প্রকাশিত ‘এখন যৌবন যার’ বইটিতে বিষয়টি নিয়ে কিছু আলোচনাও রয়েছে। কথাটি হল, “যিনা একটি ঋণ যা অবশ্যই পূরণ করা হবে।” শাইখের বইয়ে ব্যাপারটা আরও কঠিনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আবার মদীনা ভার্সিটি পড়ুয়া একজন শাইখ এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কিছু দালিলিক আলোচনাও করেছেন। চলুন আমরাও এ ব্যাপারে কিছু আলাপ করি।
শাইখ নকশবন্দীর এই আলোচনার ভিত্তি কী?
শাইখের আলোচনার মূলভিত্তি হল একটি হাদিস। জাবির ইবনু আব্দিল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন,
بَرُّوا آبَاءَكُمْ تَبَرَّكُمْ أَبْنَاؤُكُمْ وَعِفِّوا عَنْ نِسَاءِ النَّاسِ تَعِفَّ نِسَاؤُكُمْ
“তোমরা তোমাদের পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর, তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের সাথে উত্তম আচরণ করবে। তোমরা অন্যের নারীদের প্রতি শালীন আচরণ কর, তোমাদের নারীগণও শালীন আচরণ পাবেন। ”
[মুসতাদরাকু হাকিম, ৭২৫৯। ইমাম হাকিম সহিহ বললেও ইমাম যাহাবি হাদিসটিকে দুর্বল বলেছেন। হাদিসটির সকল সনদই দুর্বল।]
আলী রা. বর্ণিত আরেক হাদিসে রাসুল সা. বলেছেন,
لَا تَزْنُوا فَتَذْهَبْ لَذَّةُ نِسَائِكُمْ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَعِفُّوا تَعِفَّ نِسَاؤُكُمْ إِنَّ بَنِي فُلَانٍ زَنَوْا فَزَنَتْ نِسَاؤُهُمْ
“তোমরা যিনা করো না। যিনা করলে তোমাদের নারীদের মধ্য হতে আপন স্বামীর প্রতি অনুরাগ হারিয়ে যাবে। তোমরা অন্যের নারীদের প্রতি শালীন আচরণ কর, তোমাদের নারীগণও শালীন আচরণ পাবেন। অমুক সম্প্রদায়ের পুরুষরা যিনায় লিপ্ত হয়েছে। আর এতে তাদের নারীগণও যিনায় লিপ্ত হয়েছে। ”
[আবু বকর আশ-শাফিঈ: গীলানিয়্যাত, ১০০০। এই হাদিসটির সনদও দুর্বল।]
এ ধরণের আরও কিছু হাদিস আছে। এসব হাদিসের সবক’টির সনদই দুর্বল। শুধু দুর্বল না। বেশ দুর্বল। তবে মুহাদ্দিস ও দাঈ আলিমগণ নসীহত ও সতর্কতার ক্ষেত্রে নিজ নিজ গ্রন্থে এসব বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।
‘যিনা হল ঋণ’ কথাটা আসলে কার?
অনেকের মতেই এটি ইমাম শাফিঈ রহ.-এর কবিতার অংশ। খোদ সালিহ আল মুনাযযিদ হাফিজাহুল্লাহ তার মাওকাউল ইসলাম গ্রন্থে এদিকে ইঙ্গিত করেছেন
[মাওকাউল ইসলাম, ৬/৭৮৮]
তবে কোনো নাম উল্লেখ না ইমাম সুয়ুতী রহ. প্রথমে উল্লিখিত হাদিসটির আলোচনায় একটি কবিতা উল্লেখ করেন। যার মধ্যে এই পংক্তিটিও রয়েছে,
إن الزِّنَا دَيْنٌ فَإنَّ أَقْرَضْتَهُ … كان الْوَفَا مِنْ أَهْلِ بيتِك فَاعْلَمِ
যিনা হল ঋণ, যদি তুমি তাতে জড়াও, তবে জেনে রেখো, তোমার পরিবার-পরিজনকে এর দায় নিতে হবে।
[জামিউল কবীর, ৫/৬১৮]
কথা হল, কবিতা সবসময়ই ব্যাখ্যা দাবী করে।
ঋণ পরিশোধের পদ্ধতি ও দায়
ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে যে জিনিস ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে, তা দিয়েই পরিশোধ করতে হবে বিষয়টা এমন নয়। মানুষ দোকানে বাকি খায়। বাকিতে কাপড় কেনে। অনেক কিছু করে। এগুলো সবই ঋণ। এসব ঋণ সে অর্থ দিয়ে পরিশোধ করে। অনেক সময় অর্থের ঋণ জায়গা সম্পত্তি, বস্তু বা শ্রম দিয়েও পরিশোধ করে।
আবার অপরিণামদর্শী পুত্র, পিতা বা ভাইয়ের ঋণের দায় ও অসম্মান অনেক সময় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিতে হয়। দায় না নিলেও কটুক্তি ও অসম্মান এমনিতেই চেপে বসে।
এক্ষেত্রে এসে কথাটা কুরআনের আয়াত বিরোধি মনে হতে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزۡرَ أُخۡرَى
"একজনের (অপরাধের) বোঝা আরেকজন বহন করবে না।"
[সূরা ফাতির:১৮]
এখানে আয়াতটির ব্যাখ্যায় গেলে দেখবেন, মূলত এই দায় না নেয়ার বিষয়টি আখিরাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পার্থিব জীবনে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। তবে আয়াতের চুড়ান্ত উদ্দেশ্য হল আখিরাত।
[তাফসীরু ইবনি কাসির, ৬/৪৭৯]
দুনিয়াতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে একের অপরাধের বোঝা অন্যকে কিছুটা হলেও বহন করতে হয়। এটাও একটা পরীক্ষা। একজন জারজ সন্তানের যিনার কোনো দায় নেই। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে তার মা বাবার অপরাধের কিছুটা দায় ভোগ করতে হয়। যেমন ইমামতির ক্ষেত্রে। ফকিহগণ জারজ সন্তানের ইমামতির ক্ষেত্রে মতভেদ করেছেন। অনেকেই মাকরুহ বলেছেন। এখন দুনিয়ার জীবনে পরীক্ষা হিসেবে এই গ্লানি তাকে নিতে হচ্ছে।
[মাওসূআতুল ফিকহিয়্যা, ৪৫/২১৭-২১৮]
পুরুষের যিনার ঋণ ঘরের পূত-পবিত্র নারী কেনো পরিশোধ করবে?
এর ব্যখ্যা কী?
এর ব্যাখ্যা প্রথমে ইমাম ইবনু তাইমিয়ার কাছ থেকে জেনে নেই। তিনি লিখেছেন,
“একজন পুরুষ যখন অন্য পুরুষের নারীর (মা-বোন, মেয়ে ইত্যাদির) সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য পুরুষও এই ব্যভিচারির ঘরের নারীদের সাথে যিনায় লিপ্ত হতে চায়।” অর্থাৎ একজন যিনাকারীর বন্ধু বান্ধব এই আশায় বা সুযোগের সন্ধানে থাকে। তিনি আরও বলেন, “ব্যভিচারী পুরুষের স্ত্রী ব্যভিচারী হওয়ার বিষয়টা কয়েকরকম হতে পারে। যেমন- সে যদি মনে করে, স্বামী যদি অন্য নারীর সাথে যিনা করতে পারে তাহলেও আমিও পারি। আর একে যদি সে নিজের জন্য হালাল মনে করে তাহলে ঈমান চলে যাবে। তবে সরাসরি যিনায় লিপ্ত না হয়ে চোখ-কান ইত্যাদির যিনায় লিপ্ত হলে এই হুকুম প্রযোজ্য নয়। তবে নিজে গুনাহগার হবে।”
[মাজমূউল ফাতাওয়া, ৩২/১২১]
অধমের মতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমনটা হয় না। বরং এটা যিনার চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্ষতির দিক তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে। তবে ইবনু তাইমিয়া রহ.-এর প্রথম উক্তিটি কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। যিনার ঋণ যিনা দিয়ে শোধ না করলেও ঘরের নারীদের এ জন্য বেশ বিব্রত হতে হয়। মাকে কথা শুনতে হয়। স্ত্রীকে কটুক্তি শুনতে হয়। বোন-মেয়েদের বিয়ে শাদির প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অপমানজনক পরিস্থিতির মুখোমুখী হতে হয়। আর পরিবারে দীন না থাকলে বা ঘরের নারীদের মধ্যে দীন ও চারিত্রিক পবিত্রতার বোধ না থাকলে বিষয়টা শাইখের আলোচনার বাস্তবতা পর্যন্ত গড়াতে পারে। এরকম অনেক উদাহরণ আছে।
তাই এই কথা মনে রাখতে হবে যে দাঈ ও নসীহতকারী আলিমগণ বিস্তৃত বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতা সামনে রেখে কথা বলে থাকেন। অভিজ্ঞতালদ্ধ এসব কথাবার্তা যেমন সবার ক্ষেত্রে, মুত্তাকী ও দীনদারদের ক্ষেত্রে তেমন প্রযোজ্য নয়, আবার সমাজের চিত্র অনুযায়ী একেবারে ফেলে দেয়ার মত নয়।
ইসলামী শরীয়ত একজন যিনাকারীর ঘরের নারীদেরকে বা নারীদের সাথে যিনা করার অনুমতি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বা একে সমর্থন করারও প্রশ্ন আসে না। বা যিনার পরিণাম এমন হবেই হবে ব্যাপারটা তাও না। পুরো ব্যাপারটা হল, যিনার কুফল যিনাকারীর পরিবারকে আক্রান্ত করার আশঙ্কা প্রকাশ। যার শুরুটা মনোমালিন্য, ঝগড়া, বিবাদ থেকে শুরু করে বিচ্ছেদ, পারিবারিক সম্মানহানি এমনকি পরিবারে যিনা ছড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত ঘটতে পারে। একজন দীনি ইলম রাখা মানুষের এই বিষয়টা বুঝতে কঠিন হওয়ার কথা নয়।
মদীনা ইউনিভার্সিটির শাইখের ফাতওয়া প্রসঙ্গেঃ
শাইখ তার লেখায় যা বলেছেন, তা মূলত তিনি ইসলাম ওয়েব থেকে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গুগলকে জিজ্ঞাসা করলে প্রথমেই ইসলাম ওয়েবের এই লেখাটি পেশ করে। এ ছাড়া কিছু ভিডিও-ও আছে। তবে গুগল থেকে নেয়ার ক্ষেত্রে আরেকটু ঘাটাঘাটি করলে তিনি হয়তো আরও বিস্তারিত কিছু আলোচনার সুযোগ পেতেন। সম্ভবত ব্যস্ততার কারণে বিষয়টা নিয়ে এত মাথা ঘামাননি।
আল্লাহু আ’আলামু বিস সাওয়াব।
সংগ্রহীত