তোমার জন্য আমি দায়ী

গোয়াল ঘরে রাখা পরিত্যক্ত ভাঙ্গা খাটটায় পান্তা ভাত নিয়ে ষাটোর্ধ্ব দুজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ইফতারের অপেক্ষা করছেন। পাশের ঘরেই মুড়ির সাথে ডালের বড়া আর পিয়াজু মিশিয়ে ভোজন সভার আয়োজন করা হয়েছে। অবশ্য ইফতারি না বলে ভোজন সভা বলার একটা কারণ আছে। কারণটা হলো সভায় উপস্থিত তারা কেউই রোজাদার না। পাঁচ জনের সমাবেশে একজন শাশুড়ী আর বাকি তিনজন শফিকের স্ত্রী আর দু ছেলে আশিক এবং আরমান।

আজানের ধ্বনি শুনতে সবাই কান পেতে অপেক্ষা করছে। এমনকি গোয়ালের কোণে ভাঙা খাট থেকে শফিকের মা বাবাও পান্তা ভাত নিয়ে আজানের অপেক্ষায় সময় পার করছেন। ছেলেকে বিয়ে করানোর দুই বছর পর থেকে তারা আলাদা থাকেন। শফিক তার স্ত্রী’র পরামর্শে গোয়াল ঘরের একপাশে ছোট করে একটু জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে তার মা-বাবাকে থাকতে দিয়েছে। ছেলের সাথে সংসারে তাদের ঠাঁই হয়নি। যদিও এক সময় এই সংসারে তাদের পূর্ণ দাপট ছিল। কারণ এই সংসারটা তাদেরই হাতে গড়া। সময়ের পরিক্রমায় তা আজ আপন ছেলের হাতে ধরা দিয়েছে। এই অপয়া সংসারে তারা সারা জীবন কট্টর কর্মী হয়ে কাজ করেছিলেন। এতটাই কট্টর ছিলেন যে, নিজের একমাত্র ছেলেকে পড়ালেখা শেখানো বা মানুষ বানানোর কোন চিন্তা তাদের মাথায় কাজ করলো না।

সকাল হতে সন্ধ্যা অবধি হাল-চাষ আর কায়কারবার নিয়েই তারা ব্যতিব্যস্ত থাকতেন। কিভাবে জমাজমি আর টাকা-পয়সা বাড়ানো যায় সেই চিন্তায় সবসময় মনযোগী ছিলেন। দীর্ঘ সময় একা একা পরিশ্রম চালিয়ে গেলেও শফিকের বয়স যখন ছয় কিংবা সাত, তখন থেকে ছেলেকেও নিজের সঙ্গী করে নিয়েছিলেন তার বাবা। কালের কুচক্রে সেই ছেলেই আজ তাদেরকে এতোটা কঠিন পরিস্থিতি নামিয়ে দিয়েছে। আজকাল তাদের নতুন সংসারে দুজন বৃদ্ধ মানুষ ঝামেলাই বটে। বৌমা তো তাদের একদমই সহ্য করতে পারে না। ইফতারিতে একমুঠো পান্তাভাতও যেন তাদেরকে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দেওয়ার মতন। প্রতিদিন এমনি ভাব ভঙ্গিমায় ভাত গুলো দিয়ে আসে শাহানা। মাঝেমধ্যে আরমান ছেলেটা লুকিয়ে এসে দাদা-দাদীকে এটা সেটা দিয়ে যায়। তার মা বুঝতে পারলে দু পক্ষের-ই ঝামেলা আছে। ছেলের পিঠেরও ছাল তুলবে, বুড়া-বুড়িকেও খটমট করে শাসিয়ে যাবে। সেজন্য দাদা-দাদী প্রতিবারই আরমানকে আসতে নিষেধ করেন। কিন্তু আরমান তাদের কথায় কান দেয় না।

শাশুড়ী রোজা রেখেছেন ভেবে কাওকে আজানের আগে ইফতারিতে হাত দিতে দিচ্ছে না শফিক। মুরুব্বি মহিলা আজই বেড়াতে এসেছেন। রোজা তো অবশ্যই রেখেছেন। ওনার সামনে এরা আগে থেকে খাওয়া শুরু করলে বেয়াদবি হবে। চরম অন্যায়ও বটে। বরং আজান হোক, সবাই একসাথে শুরু করা যাবে।

কিন্তু রাহেলা বানু রোজা রাখেননি। তিনি রোজা রাখতে পারেন না। রোজা রাখলে নাকি ওনার অনেক কষ্ট হয়, শুধু এইটুকু কারণে তিনি রোজা ছেড়ে দেন। এখানে আসার পর মেয়েকে এব্যাপারে জামাইয়ের কাছে কিছু বলতে নিষেধ করে দিয়েছেন। এটা তার মান ইজ্জতের ব্যপার।

শাহানা মায়ের কথা রেখেছে। বলেছে

“এইটা নিয়া তোমার চিন্তা করতে হইবো না। রোজা হইলো তোমার। তোমার ইচ্ছা হইলে রাখবা, না হইলে নাই। কেডা কি কইতো?

স্বামীর কাছে মায়ের রোজার ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে শাহানা। বলেছে
“রোজা রাইখা মুরুব্বি মানুষ এতোটা পথ আইতাছে, ভালো কিছু দিয়া ইফতারি করানো উচিৎ না?
মায়ের জন্য এইটুকু মিথ্যা কথা তার কাছে স্বাভাবিক বিষয়। শুধু স্বাভাবিক নয় বরং মর্তবার কাজ।
অন্যদিনের তুলনায় আজকের ইফতারির আয়োজনটা একটু বড় ছিল। শফিক বাজার থেকে ইফতারি এনে শাহানাকে বলেছিল

“আম্মা আব্বাকেও দিয়া আইসো।

তখন শাহানা বললো.

” তুমি না কইলেও আমি দেই।
বিকেলে রাহেলা বানু তার মেয়েকে বলেছিলেন
“লেবুর শরবতে ঠান্ডা পানিটা একটু বেশি দিস তো মা।

মায়ের কথা রাখতে দু বাড়ি পরে ছোটখাট পরিচয়ের এক পড়শি থেকে ফ্রিজের পানি এনে রেখেছিল শাহানা। তারপর লেবুর সাথে কড়া মিষ্টি দিয়ে শরবত করলো। ইফতারির শুরুতে চকচকে কাঁচের গ্লাসে শরবত ঢেলে মায়ের সামনে উপস্থিত করলো শাহানা। রাহেলা বানুর চেহারাটা খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠলো। মেয়েটা তার যারপরনাই লক্ষী। বেড়াতে আসলে মায়ের জন্য সবকিছুই উজাড় করে দেয়। বিয়ের আগে তো এতটা মা দরদী ছিল না। রাহেলা বানু মনে মনে বললেন, ক’দিন পরপরই তোর কাছে আসতে হবে রে মা। তোর যত্নগুলো আমার খুব প্রয়োজন।

শাহানার কাণ্ডগুলোতে শফিকের দিলে কিছুটা দাগ কেটেছে। মেয়ে তার মা’কে শরবত ঢেলে দিচ্ছে। খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়াচ্ছে। যেন মা তার ছোট বাচ্চাকে শাসন করে খাবার খাওয়াচ্ছে। না খেলে মুখে তুলে দিচ্ছে। কি মায়া, কি মমতা। শফিকের হঠাৎ মনে পরলো তার মায়ের কথা। ছেলেবেলায় একবার বাবার পকেট থেকে কিছু টাকা সরানোর অপরাধে তার বাবা তাকে দু’দিন খাবার দিতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু মা’টা ছিল ভীষণ অন্যরকম। কিভাবে যেন লুকিয়ে লুকিয়ে তার জন্য খাবার রেখে দিত। যেখানে রান্নার চালগুলো তার বাবা হিশেব করে তার মায়ের হাতে দিত, তারপর রান্না হতো। সেখানে তার জন্য মা কিভাবে লুকিয়ে খাবার রাখতো তা বুঝার মতো বয়সও তখন শফিকের ছিল না।

শফিক অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করলো তার চোখে পানি। কি অবাক কাণ্ড! চোখের পানি গোপন করে শাহানাকে জিজ্ঞেস করলো.
“আম্মা-আব্বারে ইফতারি দেওনাই?
চেহারাটা মলিন করে শাহানা বললো
” অনেক্ষণ আগেই তো দিয়া আইলাম।
“কি দিছো?
” আমরা যা খাইতাছি তাইতো দিছি। আর কি দিব?
কিছু বলতে যেয়েও শফিক আর মুখ খুলতে পারলো না।
ইফতারি শেষ হওয়ার আগেই সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

শাহানা জিজ্ঞেস করলো.
“সন্ধ্যা বেলা কই যাও?
” যাই না।

ঘর থেকে বেরিয়ে গেল শফিক। বেরিয়ে গোয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজার বাহির থেকে উঁকি দিয়ে দেখলো মা-বাবা নামাজে। পাশে পুরনো একটি প্লেটের তলায় পানি মেশানো কিছু ভাত রাখা। শফিক বুঝতে পারলো শাহানা তখন মিথ্যা বলেছে। সে তার মা-বাবাকে ইফতারি দেয়নি। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর শফিক দেখতো পেল তার মা নামাজ শেষ করে মোনাজাতের মাঝে তার জন্যই কেঁদে কেঁদে দোয়া করছেন। বলছেন.

‘মাবুদ গো, তুমি আমার পোলারে ভালা রাইখো। তারে কোন অসুখ বিসুখ দিও না। আল্লাহ, আমগোরে যতো ইচ্ছা কষ্ট দেও, কিন্তু আমার পোলারে তুমি কষ্ট দিও না। তুমি তারে আমাদের মতো অবস্থায় কোনদিন ফালাইয়ো না। একথা বলে তিনি লাগাতার কেঁদেই যাচ্ছেন।

শফিকের চোখ-মুখ পানিতে ভেসে যেতে লাগলো। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী মনে হতে লাগলো নিজেকে। মনে মনে ভাবতে লাগলো– তার মতো কুসন্তান পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর নেই। মা-বাবার সাথে যে অন্যায় সে করেছে তা খুবই মারাত্মক। খুব কাঁদতে লাগলো শফিক। তার বুঝ ফিরে এসেছে।

যে সন্তান মা’কে এতো কষ্ট দেওয়ার পরও সেই মা তার সন্তানের জন্য এভাবে দোয়া করে, সে মায়ের জন্য জীবন দিয়ে দিলেও সামান্যই হবে। শফিকের ইচ্ছে করছে দৌড়ে গিয়ে মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইতে। কিন্তু এটা তার জন্য একেবারেই কম হয়ে যাবে। উপযুক্ত শাস্তি হবে না। তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিৎ।

শফিক চলে গেল বাজারে। কিছুক্ষণ পর ভালো কিছু খাবার, মায়ের জন্য শাড়ি আর বাবার জন্য লুঙ্গি পাঞ্জাবি কিনে বাড়িতে ফিরলো। শাহানা এসব দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো

“এইসব কার?
“পরে জানবা। অহন তারাতাড়ি গোসত পোলাও পাকাও।
” কেন। কোন মেহমান আইবো নাকি?
“হ, মেহমান আইবো।
“ও আরমানের বাপ, কি কও। রোজার দিন রাইতের বেলা কিসের মেহমান?
” এতো কথা কইয়ো না তো। তোমারে কইছি মেহমান আইবো রান্না করতে। যাও রান্না করতে যাও।

শাহানা কিছুই বুঝতে পারলো না। মনে মনে হাজারো প্রশ্ন আর বিরক্তি নিয়ে রান্না ঘরে প্রবেশ করলো। শফিক তার মা-বাবার জন্য নিয়ে আসা কাপড়গুলো হাতে নিয়ে গোয়াল ঘরের দিকে যেতে লাগলো। ঘর থেকে গোয়ালের দূরত্ব ত্রিশ গজের বেশি হবে না। কিন্তু আজ শফিকের কাছে পথটা অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। দরজার পাশে গিয়ে বুক কাঁপতে শুরু করলো। মায়ের সামনে গিয়ে কিভাবে দাঁড়াবে সে! খুব অপরাধবোধ কাজ করছে ভিতরে।

অবশেষে গোয়ালে প্রবেশ করলো শফিক। দেখলো, খাটের ওপর পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে বাবা-মা। ধীরে ধীরে মায়ের কাছে এসে দাঁড়ালো। অতঃপর হাতের ওপর স্পর্শ করতেই শফিকের দেহটা বিদ্যুৎের শকডের মতো একটা ঝাঁকি খেয়ে গেল। চোখগুলো তার বড়বড় হয়ে গেল। বাবার দেহে হাত রেখেও একই অনুভূতির দেখা পেল।

কিছুক্ষণ পর শফিক ঘর থেকে বের হয়ে এলো হতাশা আর গভীর তিক্ততার বোঝা নিয়ে। শফিকের চোখ মুখ দুটোই শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু বুকের ভিতরে কেউ একজন চেপে ধরে রেখেছে। কাঁদতে দিচ্ছে না।

আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। ভরা পূর্ণিমা। চারপাশে অগণিত তারকা মিটিমিটি হাসছে। যেন মা তার সন্তানদের নিয়ে উঠোনের মাঝে খেলতে বসেছে। শফিকের দৃষ্টি গেল রান্নাঘরে। শাহানা রান্না নিয়ে ব্যাস্ত। চেহারায় বিরক্তির রেখাটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।

আচ্ছা, শাহানা কি জানে– যে মেহমানদের জন্য সে ব্যস্ত হয়ে রান্না শুরু করেছে সেই মেহমানরা কোনদিন তার ঘরে মেহমান হতে আসবে না?

লিখেছেন

মফস্বলে জন্ম, মফস্বলেই বেড়ে উঠা। লেখালেখি শখের একটি অংশ কেবল। তবুও দ্বীন নিয়ে লিখতে চাই সবটুকু দিয়ে। হতে পারে শখটা একদিন আকাশ ছুঁবে ইনশা আল্লাহ।
যবে লুকাইব ভুবন ছাড়িয়া খুঁজিস না কেহ হে আপন,
ভুলে যাইস তোরা আমারো কীর্তি মাটি খুঁড়িয়া দিস দাফন।

Exit mobile version