তাকদির বিষয়ে সংশয় নিরসন

আশা করি তাকদিরের মাসআলা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবেন। মানুষের মূল কাজ কি পূর্বনির্ধারিত?
এবং কাজটি পালনের নিয়মের ক্ষেত্রে মানুষ কি স্বাধীন?
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়—কোনো মানুষের জন্য যদি লেখা থাকে যে, সে একটি মসজিদ বানাবে, তবে সে অবশ্যই মসজিদ বানাবে। তবে কীভাবে বানাবে, সে ব্যাপারে সে স্বাধীন। এমনিভাবে, পাপ কাজ নির্ধারিত থাকলে, তা অবশ্যই করবে। কীভাবে করবে, তা নির্ধারিত নয়।

মোটকথা, মানুষের তাকদিরে যে সমস্ত কর্ম নির্ধারিত আছে, তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন—এই কথাটি কি ঠিক?

উত্তর: তাকদিরের মাসআলা নিয়ে বহু দিন যাবৎ মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এ কারণে মানুষ এ বিষয়ে তিনটি দলে বিভক্ত হয়েছে:

১. একদল বলে: সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য অনুযায়ী সংঘটিত হয়। এতে মানুষের কোনো ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নেই। তাদের মতে, প্রবল বাতাসে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া এবং স্বেচ্ছায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসা—উভয়টি সমান।

২. দ্বিতীয় দল বলে: মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণ স্বাধীন। আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির তারা অস্বীকার করে। তাদের মতে, মানুষ নিজে স্বাধীনভাবে কাজ করে, ভাগ্য বলে কিছু নেই।

৩. আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকিদা হলো:

তারা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদিরে বিশ্বাস করে এবং একই সঙ্গে কাজ বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বান্দার স্বাধীনতাকেও স্বীকার করে। অর্থাৎ বান্দার কাজ আল্লাহর নির্ধারণ ও বান্দার নির্বাচনের মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়।

ছাদ থেকে বাতাসে পড়ে যাওয়া ও সিঁড়ি দিয়ে নামার মধ্যে পার্থক্য আছে—প্রথমটি অনিচ্ছাকৃত, দ্বিতীয়টি ইচ্ছাকৃত। কিন্তু উভয়টি আল্লাহর ইচ্ছাতেই সংঘটিত হয়। কারণ, আল্লাহর রাজত্বে তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই ঘটে না।

তাকদির দিয়ে শরিয়তের আদেশ-নিষেধ অমান্য করার সুযোগ নেই। কারণ, পাপ করার সময় কেউ জানে না যে, তাকদিরে তা লেখা আছে কি না। মানুষ যখন স্বেচ্ছায় কোনো গুনাহর কাজে লিপ্ত হয়, তখন তাকেই দায়ী করা হবে। যেমন—কাউকে জোর করে মদ পান করানো হলে সে দায়ী হবে না।

একজন মানুষ যেমন আগুন থেকে দূরে থাকার বা নিরাপদ ঘর বাছাই করার ব্যাপারে সচেতন থাকে, তেমনি তার উচিত আখিরাতের শাস্তি থেকেও বাঁচার জন্য চেষ্টা করা। যদি কেউ নিজ ইচ্ছায় জাহান্নামের পথে চলে, তবে তাকে ধিক্কার জানানোই স্বাভাবিক।

প্রশ্নে প্রদত্ত উদাহরণটি—যেমন: কেউ যদি মসজিদ নির্মাণ করে কিন্তু নির্মাণ পদ্ধতি নির্ধারিত নয়—এই ধারণা ঠিক নয়। কারণ এতে বোঝানো হয়—কার্যপদ্ধতি শুধু বান্দার হাতে, আল্লাহর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ কার্য ও কার্যপদ্ধতি—উভয়ই আল্লাহর তাকদিরে নির্ধারিত। তবে বান্দাকে কোনো কাজে জোর করা হয়নি, যেমন কাউকে নিজের ঘর তৈরি বা মেরামতের জন্য বাধ্য করা হয় না।

তাকদির সম্পূর্ণ গোপন বিষয়—এটি কেবল ওহির মাধ্যমে নবিগণ জানতে পারেন। মানুষের সব কাজ তাকদিরে লেখা আছে। আল্লাহ যা চান, তাই ঘটে। বান্দা যখন কাজ করে, তখন সে মনে করে—সে নিজেই কাজটি করছে, কেউ তাকে বাধ্য করেনি। কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর সে উপলব্ধি করে—আসলে এটি আল্লাহর নির্ধারণ ছিল।

আল্লাহ বলেন:

أَلَمۡ تَعۡلَمۡ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِۚ إِنَّ ذَٰلِكَ فِي كِتَٰبٍۚ إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرٞ
“তুমি কি জান না, আল্লাহ জানেন যা আকাশে ও পৃথিবীতে আছে? নিশ্চয়ই তা একটি কিতাবে (লিপিবদ্ধ)। নিঃসন্দেহে তা আল্লাহর জন্য সহজ।” [হজ: ৭০]
وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا شَيَٰطِينَ ٱلۡإِنسِ وَٱلۡجِنِّ يُوحِي بَعۡضُهُمۡ إِلَىٰ بَعۡضٖ زُخۡرُفَ ٱلۡقَوۡلِ غُرُورٗاۚ وَلَوۡ شَآءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ
“এভাবেই আমি প্রতিটি নবীর জন্য শত্রু বানিয়ে দিয়েছি মানুষের ও জিনদের শয়তান, যারা একে অপরকে ধোঁকাবাজ অলংকৃত কথা কানে কানে বলে। আপনার রব যদি চাইতেন, তবে তারা এসব করত না। অতএব আপনি তাদেরকে ও তাদের মিথ্যাচারকে উপেক্ষা করুন।” [আন‘আম: ১১২]
وَكَذَٰلِكَ زَيَّنَ لِكَثِيرٖ مِّنَ ٱلۡمُشۡرِكِينَ قَتۡلَ أَوۡلَٰدِهِمۡ شُرَكَآؤُهُمۡ لِيُرۡدُوهُمۡ وَلِيَلۡبِسُواْ عَلَيۡهِمۡ دِينَهُمۡۖ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا فَعَلُوهُۖ فَذَرۡهُمۡ وَمَا يَفۡتَرُونَ
“এভাবেই তাদের অংশীদাররা অনেক মুশরিকের কাছে তাদের সন্তান হত্যা করা সুদৃশ্য করে তোলে—তাদের ধ্বংস করার জন্য এবং তাদের ধর্মকে তাদের জন্য বিভ্রান্তিকর করার জন্য। যদি আল্লাহ চাইতেন, তারা এসব করত না। অতএব আপনি তাদের ও তাদের মিথ্যাচারকে ছেড়ে দিন।” [আন‘আম: ১৩৭]
وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلَ ٱلَّذِينَ مِنۢ بَعۡدِهِم مِّنۢ بَعۡدِ مَا جَآءَتۡهُمُ ٱلۡبَيِّنَٰتُ وَلَٰكِنِ ٱخۡتَلَفُواْ فَمِنۡهُم مَّنۡ ءَامَنَ وَمِنۡهُم مَّن كَفَرَۚ وَلَوۡ شَآءَ ٱللَّهُ مَا ٱقۡتَتَلُواْ وَلَٰكِنَّ ٱللَّهَ يَفۡعَلُ مَا يُرِيدُ
“আল্লাহ যদি চাইতেন, তাদের পরবর্তী লোকেরা (যাদের কাছে সুস্পষ্ট নিদর্শন এসেছিল) তারা কখনোই পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ করত না। কিন্তু তারা মতবিরোধ করল—তাদের কেউ ঈমান আনল, কেউ কুফরি করল। আল্লাহ যদি চাইতেন, তারা যুদ্ধ করত না। কিন্তু আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন, তাই করেন।” [বাকারা: ২৫৩]

রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

«مَا مِنْكُمْ مِنْ نَفْسٍ مَنْفُوسَةٍ إِلَّا كُتِبَ مَكَانُهَا مِنَ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ…
فَقَالَ رَجُلٌ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَفَلَا نَتَّكِلُ عَلَى كِتَابِنَا وَنَدَعُ الْعَمَلَ؟
فَقَالَ: لَا، اعْمَلُوا، فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ…»
“তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার জান্নাত বা জাহান্নামে স্থান নির্ধারিত হয়নি।”
সাহাবি বললেন: “তাহলে আমরা কি তাকদিরের ওপর নির্ভর করে আমল ছেড়ে দেব?”
তিনি বললেন: “না, বরং আমল করো; প্রত্যেককে যে উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, সে কাজের জন্যই সহজ করে দেওয়া হয়।”

এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন:

فَأَمَّا مَنۡ أَعۡطَىٰ وَٱتَّقَىٰ ٥ وَصَدَّقَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٦ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡيُسۡرَىٰ ٧ وَأَمَّا مَنۢ بَخِلَ وَٱسۡتَغۡنَىٰ ٨ وَكَذَّبَ بِٱلۡحُسۡنَىٰ ٩ فَسَنُيَسِّرُهُۥ لِلۡعُسۡرَىٰ
“অতএব, যে দান করে, তাকওয়া অবলম্বন করে এবং উত্তম বিষয়কে সত্যায়ন করে—তাকে আমি সহজ করে দেব সুগম পথের জন্য। আর যে কৃপণতা করে, নিজের প্রয়োজন মনে করে না এবং উত্তম বিষয়কে অস্বীকার করে—তাকে আমি সহজ করে দেব কঠিন পথের জন্য।”
[আল-লাইল: ৫–১০]

তাকদিরে যা লেখা আছে, তা মানুষ জানে না। তাই তাকদিরের ওপর নির্ভর করে বসে না থেকে আমল করা আবশ্যক। যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, আল্লাহ তাদের জান্নাতের পথ সহজ করে দেন।

ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম – অধ্যায়: ঈমান [প্রশ্ন নং ৬১]
লেখক: ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সালিহ আল উসাইমিন রহ.
অনুবাদক: শাইখ আব্দুল্লাহ আল কাফী ও আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানি

Exit mobile version