Writing

শিশুশিক্ষার সূচনা হোক ঘর থেকেই

মানুষের শিক্ষাপর্ব মূলত অনানুষ্ঠানিকভাবেই আরম্ভ হয়। যখন থেকেই সে চোখ মেলে, কান খোলে এবং কিছু বুঝতে শুরু করে; তখন থেকেই তার শেখা আরম্ভ হয়ে যায়। এ কাজে তাকে সাহায্য করে তার ইন্দ্রিয়শক্তি; যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিগতভাবে গচ্ছিত রেখেছেন। প্রাকৃতিক ও পারিপার্শ্বিক শিক্ষাই হলো মানুষের আসল শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নয়। যে যুগে শিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি, তখনো দুনিয়াতে শিক্ষিত ও জ্ঞানী মানুষ ছিল। কোনো নবীই দুনিয়ার কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেননি। তথাপি তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন শিক্ষিত ও জ্ঞানী। তাদের চাইতে কেউ বড় শিক্ষিত কখনো হতো না। এ জন্যই তাঁরা মানবতার শিক্ষকরূপে প্রেরিত হতেন।

এজন্য প্রতিটি শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ ও প্রতিবেশকে সুশিক্ষা উপযোগী করে গড়ে তোলা জরুরী, যেন তারা শুরু থেকে আদর্শ মানুষ রূপে গড়ে ওঠে।

শিক্ষাসনদকে আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ করার রীতি এই সেদিন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমের এক বিশাল ষড়যন্ত্র লুকায়িত রয়েছে। তাদের প্রণীত শিক্ষার সাঁচে ফেলে মূলত এমন একশ্রেণীর লোক তৈরি করা তাদের উদ্দেশ্য, যারা হবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকলাঙ্গ, পশ্চিমের মানসিক দাসবৃত্তিতে লিপ্ত ও চরম ভোগবাদী। তারা শিক্ষিত ও অশিক্ষিত নির্ধারণের মাপকাঠি নিজেদের বিকৃত রুচি-অভিরুচি ও অভিপ্রায়কে নির্ধারণ করেছে; মানবিক ও আদর্শিক দৃষ্টিকোণকে নয়। তারা নিজেদের দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষিত হওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট ছক ও কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে এবং একে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি ব্যবহার করে সারা দুনিয়ার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে।

ঔপনিবেশিক যুগে এসে তারা মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোতে এর বিস্তার ঘটিয়ে মুসলমানের মধ্যে মোল্লা-মিষ্টারের কঠিন বিভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তারা তাদের প্রণীত এ শিক্ষানীতির বাইরে কাউকে শিক্ষিত বলতে নারাজ। চাই সে লোক যতবড় জ্ঞানীই হোক না কেন।

ফলে দ্বীনি শিক্ষায় শিক্ষিত কেউ তাদের মাপকাঠিতে শিক্ষিত নয়, যদি তার কাছে আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদ না থাকে। পক্ষান্তরে পশ্চিমা ধাঁচের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাগুজে সনদধারীকে শিক্ষিত বলা হচ্ছে, বাস্তবক্ষেত্রে সে যতবড় জাহিলই হোক না কেন। জীবনের জরুরী শিক্ষাবঞ্চিতকেও তারা কেবল পশ্চিমা-শিক্ষার সনদধারীকে শিক্ষিত বলে স্বীকৃতি দেয়। এনিয়ে তাদের বড়াই অহংকারের শেষ নেই।

আভিজাত্যবোধ ও ঠুনকো অহমিকায় যেন তাদের মাটিতে পা পড়ে না। ফলে প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে যে শিক্ষাগ্রহণের এক বিশাল জগত রয়েছে; সেদিকে ওদের নজর দেওয়ার কোনো সময় নেই। শিশুরাও স্কুলের বই-শ্লেট, খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদনের চাপাচাপিতে সে দিকে সময় দেওয়ার সুযোগই পায় না; এবং অভিভাবকেরাও এর কোনো গুরুত্ব অনুধাবন করে না। শেষপর্যন্ত এক ব্যাগ ডিগ্রি আর কয়েক ফাইল সনদ নিয়ে ভার্সিটি ছাড়লেও সে অশিক্ষিতই রয়ে যায়। এজন্য দেখা যায়, যে যুগে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এত প্রভাব ছিল না, সেযুগেও মানুষের জীবন অনেক বেশি মার্জিত ও পরিশীলিত ছিল। তারা এ আধুনিক শিক্ষিতের চেয়ে অনেক বেশি ভদ্র, সভ্য ও আদর্শবান ছিল।

পক্ষান্তরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই ভরা জোয়ারে সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিতদের অনেকের ন্যূনতম মানবিকতা, ভদ্রতা, মনুষ্যত্ব ও আদব-কায়দাও তাদের মধ্যে নেই। পত্রিকায় এমন প্রতিবেদনও বেরিয়েছে, শিক্ষিতরাই সবচে’ অমানুষ। এটা মূলত একচোখা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর একতরফা নির্ভরতার কুফল।

এজন্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু করার পূর্বে প্রত্যেক শিশুর মানবিক সুকুমারবৃত্তির যথাযথ পরিচর্যার জন্য তার ঘরে ও পরিবারে সে ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। কারণ, প্রত্যেক মানবসন্তান তার পরিবেশ-প্রতিবেশ থেকেই জীবনের প্রথম ও প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করতে শুরু করে। পরিবেশ-প্রতিবেশ যেমন হয়, তথা এ শিশুর ঘর-পরিবার-সমাজ যেমন হয়ে থাকে, যেখানে সে বেড়ে ওঠে; শিশু সেভাবেই গড়ে ওঠে। শিশুর কাঁচা বিবেক ও কচি মন ঠিক সেভাবেই গড়ে ওঠে, যেভাবে সে পরিবেশ-প্রতিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

এজন্য শিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশকে সুন্দর, পাপমুক্ত ও নির্মল করতে বলা হয়েছে। শিশুর সামনে যেকোনো আচরণ করতে নিষেধ হয়েছে; যদিও শিশু তখন সবকিছু বোঝার যোগ্য হয়ে উঠেনি। কারণ, শিশুটি তখন না বুঝলেও যেকোনো আচরণকে সে স্মৃতিতে সংরক্ষিত করে রাখে। যখন তার বুঝ-বুদ্ধির বয়স হবে, তখন স্মৃতিতে সংরক্ষিত চিত্রকে বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে বুঝতে চেষ্টা করবে। হাদীস শরীফে পিতা-মাতাকে সংযত আচরণ ও ঘরোয়া পরিবেশকে সুন্দর করার তাগিদ দিতে গিয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন—مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلَّا يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَا تُنْتَجُ البَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ، هَلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ

“প্রত্যেক মানবসন্তানই ফিতরত তথা ইসলামের স্বচ্ছ ধারণা নিয়ে জন্ম লাভ করে। কিন্তু তার পিতামাতা তাকে ইহুদী, নাসারা কিংবা অগ্নীপুজক বানায়। যেমন প্রতিটি জন্তুই দাগমুক্ত শরীরে জন্ম নেয়। তোমরা কি তার দেহে কোনো কাটা-ছেড়ার দাগ দেখ?।”

বস্তুত আদর্শ মানুষ তৈরিতে মানবশিশুর বেড়ে ওঠার পরিবেশ সুন্দর হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আদর্শ সন্তান গড়তে আদর্শ পরিবেশের বিকল্প নেই। পরিবেশ-প্রতিবেশই মানুষের মন-মেজাজ, কর্ম ও চরিত্র নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবেশই একটি নিষ্পাপ শিশুকে পাপের গহীন গর্তে নিক্ষিপ্ত করে; অথবা ঈমান ও আখলাকের সোপান বেয়ে তরতর করে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে সহায়তা করে। এ জন্য পরিবার ও সমাজের পরিবেশ সুন্দর ও পরিশীলিত করার তাগীদ ইসলামে সর্বাগ্রে। মাতৃকোড়কে শিশুর প্রথম পাঠশালা এজন্য বলা হয়েছে।

বস্তুত শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর না করে ঘরকে সু‌শিক্ষা উপযোগী করে গড়ে তোলাই সময়ের অন্যতম দাবী।

লিখেছেন

‌শিক্ষকতা, দাওয়াহ, লেখা‌লে‌খি, সস্পাদনা, খুতবা প্রদান

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture