Writing

সিক্রেটস অব সাদাকা

ধনীরা দান করবে, গরীবরা হাত পাতবে’ আমাদের মধ্যে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠিত। ফলে, দানের প্রসঙ্গ আসলে আমাদের অনেকের মনে হয়- আগে ধনী হই, তারপর দান করবো। দান করার সাথে ধনী হবার সম্পর্ক ততোটা নেই, যতোটা আমরা চিন্তা করি।

এটা ঠিক যে, দানের কোয়ান্টিটির ক্ষেত্রে ধনীরা অনেক এগিয়ে থাকবে। একজন ধনী চাইলেই ১০ লক্ষ টাকা দান করতে পারবে, একজন গরীব ১০০০ টাকা দান করতে হিমশিম খাবে। ‘বেশি দান’ করার সাথে সামর্থ্যের প্রশ্ন থাকলেও শুধুমাত্র দানের সাথে সামর্থ্যের সম্পর্ক এতোটা নেই; অন্তত ইসলাম আমাদেরকে এটা শেখায়।

ইসলামে যেসব ইবাদাতের রেঞ্জ অনেক ব্যাপক, তার মধ্যে কয়েকটি হলো সাদাকা, যিকির, ধৈর্য। আপনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, এটাকে ‘নামাজ’ বলতেন পারবেন না। আপনি রাতে বাড়িতে ঘুমাচ্ছেন, এটাকে আপনি ‘রোজা’ বলতে পারবেন না। কিন্তু, নিত্যকার স্বাভাবিক কাজগুলো যদি ইসলামের বিধানমতো হয়, তাহলে হাসি মুখে কথা বলা, ঘুমানো, খাওয়া, কারো জন্য অপেক্ষা করা ইত্যাদি স্বাভাবিক কাজ সাদাকা, ধৈর্য, যিকিরের আওতাভুক্ত হতে পারে।

একজন মুসলিমের দিকে হাসিমুখে তাকানো, রাস্তা থেকে কাঁটা সরানো, গাছ লাগানো, স্ত্রীর সাথে ইন্টার্কোর্স, কাউকে উত্তম উপদেশ দেয়া ‘সাদাকা’র অন্তর্ভুক্ত। আমরা সাদাকা বলতে যেভাবে শুধু আর্থিক দানের কথা বুঝাই, ইসলাম সাদাকাকে শুধুমাত্র আর্থিক দানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইসলামে সাদাকার পরিধি ব্যাপক।

আমরা শুধুমাত্র আর্থিক দানের কথাই বলি। মানুষকে অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা বা নিজে একজন দাতা হওয়ার দায়িত্ব ইসলাম শুধুমাত্র একজন ধনীকে দেয়নি। এমন না যে, ধনীরা দাতা হতে পারবে, গরীবরা পারবে না। যাকাত দেয়া, হজ্জ করা, কুরবানি দেয়া চাইলেই একজন গরীব করতে পারে না। তার সামর্থ্য না-ও থাকতে পারে। কারণ, এসবে হাজার-হাজার টাকা, লক্ষ টাকার প্রয়োজন। কিন্তু, একজন গরীবও চাইলে দাতা হতে পারে। Non-Monetary সাদকায় তো গরীব অংশগ্রহণ করতেই পারে (যেমন: পরিবারের পেছনে ব্যয় করা, হাসিমুখে কথা বলা), পাশাপাশি Monetary সাদকায়ও একজন গরীব অংশগ্রহণ করতে পারে।

আমাদের সমাজের একজন গরীব লোকের কথা চিন্তা করুন। হতে পারে সে রিক্সাচালক, দিনমজুর, মাঝি, মাছওয়ালা। আপনার কি মনে হয়, সে তার সারা জীবনে কোনোদিন কাউকে ২ টাকা বা ১০ টাকা দান করতে পারবে না? একজন ছাত্রের কথাই চিন্তা করুন, যাকে মা-বাবা স্কুলে যাবার সময় ৫/১০ টাকা দেন। সে কি সারা বছরে ১০ টাকা দান করতে পারবে না? ছোটোবেলায় আমাদের এমনও হতো, টিফিনের টাকা লাগতো না। কেউ আমাদেরকে খাওয়াতো বা টিফিন পিরিয়ডে স্কুল ছুটি হয়ে যেতো। ফলে, ঐদিনের টাকা হাতে জমা থাকতো।

তারমানে এটা খুবই সম্ভব যে, একজন দিনমজুর বা একজন ছাত্র বছরে অন্তত ১০ টাকা দান করতে পারবে।

নবিজীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সময়ে কয়েন ছিলো দিনার-দিরহাম। নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সর্বনিম্ন কিছু দিয়ে দানের উদাহরণ দিতে গিয়ে দিনার-দিরহামের উদাহরণ দেননি; উদাহরণ দিয়েছেন একটি খেজুরের। তখনকার সময়ে কটা খেজুরের মূল্য কতো হবে? ২ টাকা? ৫ টাকা? আচ্ছা, ধরেই নিলাম ১০ টাকা। স্বাভাবিকভাবে সাধারণ একটা খেজুরের দাম তো এর বেশি হবার কথা না।

নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে আত্মরক্ষার জন্য বললেন, অন্তত একটা খেজুর দিয়ে হলেও যেনো আমরা সাদাকা করি; আমরা যেনো দান করি। আমাদের সময়ের অর্থমূল্যে ধরে নিলাম ১০ টাকা।

তাহলে, দান করার জন্য আমাদেরকে কোটিপতি হতে হবে, মাসে ৭০ হাজার, ৮০ হাজার উপার্জন করতে হবে এমনটা কিন্তু নয়। এটা ঠিক যে, যারা ধনী, তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি দান করতে পারবে। তাদের দানের কোয়ান্টিটি অনেক বেশি হবে। কিন্তু, আল্লাহ চাইলে আমরা ‘কোয়ালিটি’ দিয়ে এগিয়ে যেতে পারি।

মনে করুন, আপনি আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবেন। ২ দিনের মধ্যেই টাকা জমা দিতে হবে। আপনার হাতে ১০,০০০ টাকা নেই। আপনি এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে কোটিপতি বন্ধুর কাছে গেলেন। সে আপনার সবকিছু শুনে ১,০০০ টাকা দিলো। সে চাইলে কিন্তু ১০,০০০ টাকা দিতে পারতো।

আরেকদিনের ঘটনা। আপনি দুইদিন ধরে ভালো মতো কিছু খাননি। আপনি প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত। আপনার এক বন্ধু, যার নিজের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না। আপনার কষ্টের কথা শুনে হোটেলে নিয়ে গিয়ে ১০০ টাকার ডাল-ভাত-ভাজি খাওয়ালো। দুইদিন পর এই সামান্য খাবার পেয়েই আপনি খুব খুশি হলেন।

স্বাভাবিকভাবে ধনী বন্ধুর ১,০০০ টাকা পেয়ে আপনি যতোটা না খুশি হবেন, তারচেয়ে গরীব বন্ধুটির আন্তরিকতা দেখে, তার কাছ থেকে ১০০ টাকার খাবার খেয়ে আপনি বেশি খুশি হবেন।

দানের ব্যাপারে আমরা আশান্বিত হতে পারি এই ভেবে যে, দানের সওয়াবের অঙ্ক আল্লাহ করবেন। স্কুলের মুনাফার মতো এই অঙ্ক না। এই অঙ্কে আল্লাহ সবকিছু বিবচনা করবেন। আমার পকেটে ২০০ টাকা থাকার পরও আমি ১০০ টাকা দান করেছি, আরেকজনের ব্যাংকে ২ লক্ষ টাকা থাকা সত্ত্বেও সে ২০০ টাকা ব্যয় করেছে। দুনিয়াবী হিশেবে ২০০ টাকার দানকারী দ্বিগুণ দান করেছে। কিন্তু, সওয়াব দেবার ক্ষেত্রে আল্লাহ ‘দান করার সামর্থ্য’ ও ‘দানকৃত অর্থ’ দুটোই বিবেচনা করবেন।

আল্লাহ দানের সওয়াব অনেকগুণ দিবেন। কোনটাতে কতো গুণ দিবেন, সেটা আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। দানের পরিমাণে সওয়াব কতো গুণ বাড়বে সেটার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আলেমগণ দুটো বিষয় সামনে নিয়ে আসেন। সেগুলো হলো:

• সামর্থ্য অনুযায়ী দানকৃত অর্থের পরিমাণ
• যাকে দান করা হয়েছে তার প্রয়োজনের মাত্রা

আপনার সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সময় আপনার চাচা যদি ১,০০০ টাকার একটি নোট দেন, সেটার ভ্যেলু আপনার কাছে একরমক। আর শহরে গিয়ে মানিব্যাগ চুরি হবার পর যখন বাড়ি ফেরার মতো টাকা আপনার হাতে থাকবে না, তখন যদি কেউ আপনাকে ২০০ টাকার একটা নোট দেয়, সেটার ভ্যেলু আপনার কাছে কেমন হবে?

আল্লাহ দানের সওয়াব কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দিতে পারেন। আর যারা একটু বুদ্ধিমান, তারা দানের খাত বুঝে দান করে মনে মনে দু’আ করে- আল্লাহ তার দান কয়েক গুণ বাড়াতে পারেন। ব্যাংকের হিশেব দেখুন। কোনো ব্যাংক যদি বলে ৫ বছরে মূলধন দ্বিগুণ হবে, তাহলে ফিন্যান্সের সহজ সূত্র দিয়ে বলে দেয়া যায়- সুদের হার ১৪.৪%। আরেক ব্যাংক যদি আরো কম সময়ে বলে, তাহলে হয়তো গ্রাহক ঐ ব্যাংকে টাকা রাখবে।

দান করার ক্ষেত্রেও ‘চালাক’ দাতা দানের সওয়াবের হার বাড়াতে চায়। আমি পরিচিত অনেককেই চিনি, যারা শিক্ষার্থীদের পেছনে দান করে। অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী পড়ালেখার খরচ চালাতে পারে না। গ্রামের মাদ্রাসায় হাফেজ হতে তিন, সাড়ে তিন বছর লাগে। দাতা একজন সেই ছাত্রের ৩ বছরের দায়িত্ব নেন। কয়েকদিন আগে এরকম একজনের তিন বছরের খরচ হিসেব করে দিলাম। ১ লক্ষ ৩০ হাজার হলো। সেই লোকের দান কতো গুণ বাড়বে সেটা আল্লাহ জানেন। তবে, আশা করা যায় তার মাধ্যমে যিনি কুরআনের হাফিজ হবেন, তার সারাজীবনের তেলাওয়াতের সওয়াব তিনি পাবেন।

নবিজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দান করার জন্য আমাদেরকে অনেক উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন- উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম। উপরের হাত দাতার, নিচের হাত গ্রহীতার।

আমি আমার ব্যক্তিগত জীবনে দান করার অনেক উপকার প্রত্যক্ষ করেছি। এমনও হয়েছে, আগামী সপ্তাহে মোটা অঙ্কের কিছু টাকা লাগবে। টাকা আসার সোর্স আছে, আসবে কিনা নিশ্চিত নই। তখন হাতে থাকা কিছু টাকা দান করলাম। ওমা! টাকা দান করে বাসায় ফিরতে না ফিরতে শুনি এক সপ্তাহ পরের টাকার চিন্তা ম্যানেজড। এসব ঘটনা একবার, দুইবার হলে ভাবতাম ‘কো-ইনসিডেন্ট’। এগুলো রিপিটেডলি হয়। দান করলে টাকা না কম যে বেড়ে যায়, সেটা যারা নিয়মিত দান করে তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন।

আপনার হাতে ১০,০০০ টাকা থাকা লাগবে না। ১০ টাকাও যদি থাকে, আপনি খুশিমনে কাউকে দান করে দেখুন কেমন লাগে। পরিবারের পেছনে ব্যয় করাও সাদাকার অন্তর্ভুক্ত। আর কাউকে না পান, পরিবারের জন্য কিছু কিনে নিয়ে আসেন।

আপনি যদি বিপদে থাকেন, দান করে দেখুন ম্যাজিকের মতো ফল পেতে পারেন।

ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
“বিপদের সময় সাদাকার প্রভাব এতো বেশি যে, সেটা কল্পনার বাইরে। এমনকি কোনো ফাসিক, যালিম কিংবা কাফিরকেও যদি সাদাকা করা হয়, সেটা থেকেও ফল পাওয়া যায়।”

লিখেছেন

Picture of আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

আরিফুল ইসলাম (আরিফ)

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার কলম তাকে উজ্জীবিত করেছে স্বীয় বিশ্বাসের প্রাণশক্তি থেকে।
অনলাইন এক্টিভিস্ট, ভালোবাসেন সত্য উন্মোচন করতে এবং উন্মোচিত সত্যকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button