Q/AAbdullahil Hadi

সাণ্ডা ও গুইসাপ: পরিচয় পার্থক্য এবং ইসলামে শরিয়তের বিধি-বিধান

সাণ্ডা ও গুইসাপ কি এক‌ই প্রাণী?
সান্ডা কী? গুই সাপের সাথে এর পার্থক্য কী?
ইসলামের দৃষ্টিতে এই প্রাণীগুলো খাওয়া কি হালাল নাকি হারাম?
দয়া করে জানাবেন ইনশাআল্লাহ। কারণ ফেসবুকে এই বিষয়টি নিয়ে বর্তমানে অনেকেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন।

সাণ্ডা (الضب দব্ব, ইংরেজিতে Spiny-tailed lizard) এবং গুইসাপ (ইংরেজিতে Monitor lizard)—এই দুটি প্রাণী দেখতে কিছুটা মিল থাকলেও প্রকৃতি, বসবাস ও ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এদের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

নিম্নে অতি সংক্ষেপে সেগুলো তুলে ধরা হলো:

সাণ্ডা (الضب)

বৈজ্ঞানিক নাম: Uromastyx spp.

পরিচয়:

– এটি মরুভূমির শুষ্ক এলাকায় বসবাস করে।
– শরীর মোটা ও লেজে কাঁটার মতো স্পাইক থাকে।
– সাধারণত গাছপালা, বীজ ও ঘাস খায় (শাকাহারী)।

হুকুম:

সাণ্ডা খাওয়া হালাল। সুতরাং যার রুচি হয় সে খেতে পারে। কিন্তু কারো রুচি না হলে সে খাওয়া থেকে বিরত থাকবে। তবে কিছু আলেম তা মাকরুহ বা অপছন্দনীয় বলেছেন। (যেমন: শাইখ আলবানি)

সাণ্ডা বা الضب সম্পর্কে সহিহ হাদিস:

ইবন আব্বাস (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«دخلت أنا وخالد بن الوليد مع رسول الله صلى الله عليه وسلم بيت ميمونة، فَأُتِيَ بِضَبٍّ مَحْنُوذٍ فَأَهْوَى إلَيْهِ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم بِيَدِهِ، فقال بعض النِّسْوَةِ في بيت ميمونة: أخبروا رسول الله بما يريد أن يأكل، فرفع رسول الله صلى الله عليه وسلم يده، فقلت: أَحَرَامٌ هُوَ يَا رَسُولَ الله؟ قَالَ: لا، وَلَكِنَّهُ لَمْ يَكُنْ بِأَرْضِ قَوْمِي، فَأَجِدُنِي أَعَافُهُ، قال خالد: فَاجْتَرَرْتُهُ، فَأَكَلْتُهُ، وَالنَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَنْظُرُ» [متفق عليه]

“আমি ও খালিদ ইবন ওয়ালিদ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সঙ্গে মায়মুনা (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর ঘরে প্রবেশ করলাম।
তখন আমাদের সামনে একপ্রকার পুড়িয়ে রান্না করা সাণ্ডা (ضبّ) পেশ করা হলো।
রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা খাওয়ার জন্য হাত বাড়ালেন।
তখন মায়মুনার ঘরের কোনো একজন নারী বললেন, ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জানিয়ে দিন তিনি যা খেতে যাচ্ছেন, সেটি কী!’
এরপর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত সরিয়ে নিলেন।
আমি (ইবন আব্বাস রা.) বললাম: ‘হে আল্লাহর রসুল! এটি কি হারাম?’
তিনি বললেন: ‘না, তবে এটা আমার জাতির অঞ্চলে ছিল না। তাই আমার নিকট তা রুচিকর নয়।
খালিদ (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন:
‘তখন আমি সেটিকে টেনে নিলাম এবং খেতে লাগলাম আর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকিয়ে ছিলেন।’1

এই হাদিসের শিক্ষা:

এই হাদিস থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, সাণ্ডা (ضبّ) খাওয়া হারাম নয়। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে খেতে অপছন্দ করেছেন। কিন্তু নিষেধ করেননি।
সাহাবি খালিদ (রা.) তা খেয়েছেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বাঁধা দেননি।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল সাণ্ডা হালাল হওয়ার পক্ষে।

সাণ্ডা খাওয়ার ব্যাপারে কি হাদিসে কোন নিষেধাজ্ঞা এসেছে?

এ ব্যাপারে সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি ইমাম আব্দুল আজিজ বিন বায রহ. বলেন,
ما ورد في النهي فهو ضعيف، والصواب أنه حلال كما ثبت في الصحيحين
“নিষেধ সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে (যেমন: সুনানে আবু দাউদে সাণ্ডা খাওয়া নিষেধ হওয়া প্রসঙ্গে একটি হাদিস উল্লেখিত হয়েছে) তা দুর্বল (ضعيف)। এবং সঠিক কথা হলো—এটি হালাল, যেমন সহিহ বুখারি ও মুসলিমে প্রমাণিত।”

সাণ্ডা ও গুইসাপ পরিচয় পার্থক্য এবং ইসলামে শরিয়তের বিধি-বিধান - Islami Lecture
সাণ্ডা ও গুইসাপ পরিচয় পার্থক্য এবং ইসলামে শরিয়তের বিধি-বিধান – Islami Lecture

গুইসাপ (Monitor Lizard)

বৈজ্ঞানিক নাম: Varanus spp.

পরিচয়:

– নদী, বন বা জলাশয়ের আশেপাশে বাস করে।
– শরীর দীর্ঘ ও চঞ্চল; দাঁত ও নখ ধারালো।
– এটি মাংসাশী; মৃতপ্রাণী, সাপ, ব্যাঙ ইত্যাদি খায়।

হুকুম:

গুইসাপ সম্পর্কে সরাসরি হাদিস না থাকলেও এটি একধরনের শিকারি ও নাপাক প্রাণী হিসেবে ধরা হয়।
খাদ্যে হালাল হারাম সম্পর্কিত উক্ত মূলনীতির আলোকে সম্মানিত ফকিহ ও ইসলামি স্কলারগণ একে হারাম বলেছেন।

তবে আবু দাউদে বর্ণিত নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত একটি হাদিসের আলোকে কিছু আলেম এটিকে মাকরুহ (অপছন্দনীয়) বলেছেন। তবে অধিকাংশ হাদিস বিশারদের মতে উক্ত হাদিসটি সহিহ নয়।

উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে হাদিস অনুবাদ কারীদের কেউ কেউ আরবি الضب শব্দের অর্থ লিখেছেন, গুইসাপ। যার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। ‌অথচ এটি মারাত্মক ভুল। الضب অর্থ গুইসাপ নয় বরং সাণ্ডা। আর এই দুইটির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে যেমনটি আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি।

ইবন উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন

أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنِ الضَّبِّ فَقَالَ: «لَا آكُلُهُ وَلَا أَنْهَى عَنْهُ»
“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে শাণ্ঠা (ضبّ) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:
“আমি এটি খাই না। তবে আমি এটি থেকে নিষেধও করি না।”
[ইবন জারির তাবারির কর্তৃক সংকলিত মুসনাদের ইবনে ওমর রা. ১/১৬৫]
সহিহ বুখারি (৫৫৩৬), সহিহ মুসলিম (১৯৪৩) — তবে সেখানে এসেছে: “وَلَا أُحَرِّمُهُ” “আমি এটিকে হারামও বলি না।”

আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত,

سَأَلَ رَجُلٌ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ، عَنْ أَكْلِ الضَّبِّ، فَقَالَ: «لَا آكُلُهُ، وَلَا أُحَرِّمُهُ»
এক ব্যক্তি রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি তখন মিম্বারে ছিলেন—শাণ্ঠা (ضبّ) খাওয়ার ব্যাপারে।
তিনি উত্তরে বললেন: “আমি এটি খাই না। তবে আমি এটিকে হারামও ঘোষণা করি না।[সহিহ মুসলিম, হা/১৯৪৩ ও সহিহ বুখারি হা/৫৫৩৬, সামান্য ভিন্নতা সহ]

এই দুটি সহিহ হাদিস স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে: শাণ্ঠা (الضب) খাওয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের পছন্দ অনুযায়ী এড়িয়ে গেছেন। তবে তা খাওয়া নিষেধ (হারাম) করেননি।
অতএব, শরিয়তে শাণ্ঠা খাওয়া হালাল — চাইলে খাওয়া যাবে, না চাইলে না খাওয়ার স্বাধীনতা আছে।

আল্লাহু আলম-আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

  1. সহিহ, মুতাফাকুন আলাইহি: সহিহ বুখারি: ৫৩৮১, সহিহ মুসলিম: ১৯৪৬ ↩︎
Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button
Islami Lecture