মরচে ধরা হৃদয়

যে ছয়টি জিনিস হৃদয়কে কঠিন করে:
রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘জেনে রেখো! শরীরের মধ্যে এমন এক টুকরা গোশত রয়েছে, যা সুস্থ থাকলে সারা শরীরই সুস্থ থাকে, আর এটা অসুস্থ হয়ে গেলে সারা শরীরই অসুস্থ হয়ে যায়। জেনে রেখো, আর এটাই হ’ল ক্বলব।’
[সহীহ মুসলিম]

উপরে হাদিস থেকে এটা স্পষ্ট যে, আমাদের উচিৎ ক্রমাগত আমাদের হৃদয়কে পরীক্ষা করে দেখা, যাতে তা কঠিন না হয়ে যায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা বলেছেন –

....فَوَيۡلٌ لِّلۡقَٰسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ فِى ضَلَٰلٍ مُّبِينٍ
....অতএব ধ্বংস সে লোকদের জন্য যাদের হৃদয় কঠিন হয়ে গেছে আল্লাহর স্মরণ থেকে। তারা স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে নিপতিত।[৩৯:২২]

আমাদের অন্তর যখন পাথর হয়ে যায়, তখন আল্লাহর ইবাদত করাও কঠিন হয়ে পড়ে, এমনকি দৈনিক ন্যূনতম পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়াও কঠিন মনে হয়। আর এভাবে চলতে থাকলে অন্তরটা ধীরে ধীরে আরো কঠোর হয়ে যায়। এই অবস্থায় আমরা যখন কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করি, আমরা কিছুই অনুভব করি না; যখন আমরা ইসলামী বক্তৃতা শুনি, তখন তা আমাদের মনে কোন প্রভাব ফেলে না; কোন কিছুই তখন আর আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে না; আমাদের মুসলিম ভাই বোনদের দুঃখ কষ্টে আমাদের চোখে আর পানি আসে না। আমরা যদি আমাদের হৃদয়কে এই অবস্থায় থাকতে দেই, তাহলে শীঘ্রই তা মরে যাবে। হে আল্লাহ, আমাদেরকে এমন বিপর্যয় থেকে রক্ষা করুন!

হৃদয় শক্ত হওয়ার কিছু কারণ উল্লেখ করা হলো –

পাপ/গুনাহ:

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, “মুমিন বান্দা যখন গুনাহ করে তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে যায়। এরপর সে তাওবা করে ক্ষমা চাইলে তার অন্তর পরিষ্কার হয়ে যায় (কালিমুক্ত হয়)। আর যদি গুনাহ বেশি হয় তাহলে কালো দাগও বেশি হয়। অবশেষে তা তার অন্তরকে ঢেকে ফেলে। এটা সেই মরিচা, যার ব্যাপারে কুরআনে আল্লাহ বলেছেন : ‘কখনো নয়; বরং তাদের কৃতকর্ম তাদের অন্তরে জং ধরিয়েছে।’’’ [(সুরা মুতাফফিফিন, আয়াত : ১৪) তিরমিজি, হাদিস : ৩৩৩৪]

মানুষ যতই পাপ করে ততই তার হৃদয় কঠিন হয়ে যায়, এবং সে তখন অনুভূতি-শূন্য হয়ে পড়ে। কাজেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাপ করার পরপরই ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে, এবং হেদায়েতের জন্য দু’আ করতে হবে।

অত্যধিক কৌতুক এবং হাসি:

একজন মুসলিমের ব্যক্তিত্ব কিন্তু সহজ। আমরা সব সময় খুব রুক্ষ এবং কঠোর নই, এবং মানুষের প্রতি সব সময় আমরা ভ্রুকুটি করি না। আমরা হাসি এবং রসিকতা করি, কিন্তু সবসময় সংযম বজায় রাখি। রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘অল্প হাসুন, অধিক হাসি হৃদয়কে হত্যা করে।’ [আল আদাব আল মুফরাদ]

আল্লাহর নাম ব্যতীত অত্যধিক অনর্থক কথাবার্তা:

ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘আল্লাহ্ তা’আলার যিকির ছাড়া বেশী কথা বলো না। কেননা আল্লাহ তা’আলার যিকির ছাড়া বেশী কথা বললে অন্তর কঠিন হয়ে যায়। আর নিঃসন্দেহে কঠিন অন্তরের লোকই আল্লাহ তা’আলা থেকে সবচেয়ে বেশী দূরে থাকে।’

অতিরিক্ত খাওয়া:

আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, এক লোক খুব বেশী পরিমাণে আহার করত। লোকটি মুসলিম হলে অল্প আহার করতে লাগল। ব্যাপারটি রাসুলের (ﷺ) কাছে উল্লেখ করা হলে তিনি বললেনঃ মু’মিন এক পেটে খায়, আর কাফির খায় সাত পেটে। [৫৩৯৯; মুসলিম ৩৬/৩৫, হাঃ ৬০৬৩, ৬০৬৪, আহমাদ ৭৭৭৭]

আমরা যখন খাওয়া দাওয়ায় বেশি মনোযোগ দেই, তখন হৃদয়ের প্রতি মনোনিবেশ করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে ওঠে। অত্যধিক খাওয়া আমাদের শরীরের মেটাবলিজমকে দুর্বল করে, আমাদের অলস করে তোলে এবং অতি ভোজ অনেক ধরণের শারীরিক রোগের পূর্বসূরিও বটে। অতিমাত্রায় খাওয়া-দাওয়া লোভ এবং দুনিয়া প্রেমের বহিঃপ্রকাশ।

দুনিয়া নিয়ে ব্যতিব্যস্ততা:

يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُلۡهِكُمۡ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَلَآ أَوۡلَٰدُكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡخَٰسِرُونَ
হে মুমিনগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। আর যারা এরূপ করে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।
[৬৩:৯]

সম্পদ এবং সন্তান-সন্ততি মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় দুটি ধ্বংসের কারণ, আর সেজন্যই আল্লাহ উপরের আয়াতে এই দুইটি বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, এই জীবনের সমস্ত কিছু যা আমাদের চিন্তাভাবনাকে বিক্ষিপ্ত করে, এবং ব্যতিব্যস্ত করে রাখে, তাই আমাদেরকে আল্লাহর কাছ থেকে দূরে নিয়ে যায়।

কাব ইবনু মালিক আল-আনসারী (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুল (ﷺ) বলেছেন, ‘দুটি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘকে ছাগলের পালে ছেড়ে দেয়া হলে পরে তা যতটুকু না ক্ষতিসাধন করে, কারো সম্পদ ও প্রতিপত্তির লোভ এর চেয়ে বেশি ক্ষতিসাধন করে তার ধর্মের।'[তিরমিজি]

সুন্নত ত্যাগ করা:

ফরজ ব্যতীত আল্লাহর রাসুলের (ﷺ) আমলগুলোই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সর্বোত্তম উপায়। আমাদের মধ্যে কেউই আল্লাহকে রাসুলের (ﷺ) চেয়ে ভালো জানি না, এবং তিনি যেভাবে আল্লাহর ইবাদত করতেন সেটিই সর্বোত্তম পথ। এইভাবে রাসুলের (ﷺ) প্রথা এবং অনুশীলন ত্যাগ করার অর্থ হল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য উদ্যমের অভাব এবং রাসুলের (ﷺ) প্রতি ভালোবাসার অভাব। আল্লাহ বলেন –

سَابِقُوٓاْ إِلَىٰ مَغۡفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمۡ
তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমার প্রতিযোগিতা এগিয়ে যাও....
[৫৭:২১]

আমরা যদি প্রতিদিনের ভিত্তিতে সুন্নতকে অবহেলা করি তবে আমরা অবশ্যই আল্লাহর দিকে দৌড়াচ্ছি না, আমরা সম্ভবত শামুকের মতো হামাগুড়ি দিচ্ছি।

হাদিস কুদসিতে এসেছে আল্লাহ সুবহানাহু তা’য়ালা বলেছেন-

‘আমার বান্দা যে সমস্ত ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য হাসিল করে থাকে, তার মধ্যে ঐ ইবাদতের চেয়ে আমার কাছে অধিক প্রিয় আর কোন ইবাদত নেই যা আমি তার উপর ফরয করেছি। আর বান্দা নফল ইবাদতের মাধ্যমে আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকে।’
[সহিহ বুখারী: ৬৫২০]

হে আল্লাহ, আমরা আপনার কাছে সাহায্য চাই অন্তরের রোগ থেকে, অন্তরে মরিচা পাড়া থেকে, অন্তর কঠিন হয়ে যাওয়া থেকে। হে আল্লাহ, যে কাজগুলো অন্তরকে কঠিন করে দেয় সেই কাজগুলো থেকে আমাদের বিরত রাখুন, আমাদেরকে আপনার নৈকট্য অর্জনের তৌফিক দান করুন এবং কোমলতা দিয়ে আমাদের হৃদয়কে সুসজ্জিত করুন।

Source: understandQuran

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version