মানুষের জীবনে তার নামের প্রভাব পড়ে কতটুকু সত্যি

মানুষের জীবনে তার নামের প্রভাব পড়ে।” কতটুকু সত্যি?
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব জীবনে ইতিবাচক শব্দ প্রয়োগের গুরুত্ব
‘মানুষের জীবনে তার নামের প্রভাব পড়ে’ এ কথা কি সত্য?

প্রকৃতপক্ষে মানুষ কেমন হবে, সৌভাগ্যবান নাকি দুর্ভাগা, তার আচার-আচরণ ও কার্যক্রম কী হবে ইত্যাদি সব কিছুই আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির পূর্বেই তার তকদিরে লিপিবদ্ধ করেছেন। সে আলোকেই সব কিছু সংঘটিত হয়। শুধু নাম কারও জীবন পরিবর্তন করে না।

ইসলাম ওয়েবে প্রশ্ন করা হয় যে, কারো নাম কি তার ভাগ্য ও ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলে?

উত্তরে তারা বলেন,

فإن أمر حظ الإنسان ومستقبله قد كتبه الله وقدره قبل خلقه للإنسان، ولا أثر لمجرد التسمية عليه فكل شيء مقدور ومكتوب في الأزل كما في حديث مسلم: كل شيء بقدر حتى العجز والكيس .

ومحاولة تعرف الشخص على مستقبله عن طريق اسمه أو بأية وسيلة أخرى يدخل في باب الكهانة. وبالتالي فهو حرام.

ولكن الشرع رغب في الأسماء الحسنة من باب التفاؤل، وكان النبي صلى الله عليه وسلم يتفاءل بالأسماء الحسنة، ويغير الاسم المشتمل على محظور شرعي أو ما لا يستحسن، وقد أثبتت الدراسات النفسية أن للاسم السيئ تأثيرا سلبيا على صاحبه

“মানুষের ভাগ্য ও ভবিষ্যতের বিষয় আল্লাহ তাআলা তার সৃষ্টি করার আগেই নির্ধারণ ও লিখে রেখেছেন। শুধুমাত্র নামকরণের কারণে এর কোনও প্রভাব পড়ে না। প্রতিটি বিষয় পূর্বনির্ধারিত ও লিখিত রয়েছে। যেমনটি সহিস মুসলিম একটি হাদিসে বলা হয়েছে:

كُلُّ شَىْءٍ بِقَدَرٍ حَتَّى الْعَجْزُ وَالْكَيْسُ
“প্রত্যেক বিষয়ই তকদির দ্বারা নির্ধারিত, এমনকি অক্ষমতা ও বুদ্ধিমত্তাও।”1

কিন্তু কারো ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার নাম বা অন্য কোনও মাধ্যম দিয়ে জানা বা অনুমান করার চেষ্টা করা জ্যোতিষশাস্ত্রের (কাহানাহ) মধ্যে পড়ে, যা ইসলামে হারাম

তবে ইসলাম ভালো নাম রাখার প্রতি উৎসাহ দিয়েছে সৌভাগ্যের আশা করা এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার জন্য।

রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভালো নাম দ্বারা শুভ লক্ষণ গ্রহণ করতেন এবং এমন নাম পরিবর্তন করতেন যা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ বা অ পছন্দনীয়।

বস্তুত, মনোবিজ্ঞান গবেষণাগুলো প্রমাণ করেছে যে, খারাপ নামের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে।” [islamweb]

খারাপ নামের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব থাকতে পারে” এ কথার পক্ষে আলেমগণ নিম্নোক্ত হাদিসটি দ্বারা দলিল গ্রহণ করেছেন:

ইবনুল মুসাইয়্যাব তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে,
তার দাদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে আসলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন: “তোমার নাম কী?”
তিনি উত্তর দিলেন: “হাজন” (কঠিন বা কঠোর)।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: “তুমি ‘সাহল’ (সহজ বা নমনীয়)।”
তিনি বললেন: “আমি সেই নাম পরিবর্তন করব না, যা আমার পিতা আমাকে দিয়েছেন।”
ইবনুল মুসাইয়্যাব বলেন: “এরপর থেকে আমাদের মধ্যে কঠোরতা (হাজন) থেকে গেল।” [সহিহুল বুখারি]

শিক্ষণীয় বিষয়:

এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, ভালো ও ইতিবাচক নাম রাখা ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। খারাপ নামের প্রভাব চরিত্র ও পরিবারের উপর পড়তে পারে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অনেক ক্ষেত্রে নাম পরিবর্তন করতেন, যা নেতিবাচক বা অপ্রীতিকর অর্থ বহন করে।

জীবনে নামের প্রভাব পড়তে পারে। তবে তা আবশ্যক নয়। অর্থাৎ অনেক সময় মানুষের নাম খুব সুন্দর হয় কিন্তু বাস্তব জীবনে সে অনেক খারাপ মানুষ হয়। আবার কারও নাম হয়ত এতটা সুন্দর নয় কিন্তু বাস্তব জীবনে সে ভালো হয়। এখানে কেবল সম্ভাব্যের বিষয়টি বলা উদ্দেশ্য।

শুধু নাম নয় বরং ইতিবাচক শব্দ মানুষের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে:

প্রকৃতপক্ষে শুধু নাম নয় বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে শব্দের প্রভাব পড়তে পারে।
তাই তো রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যক্তি, বস্তু এমনকি জায়গার নামও পরিবর্তন করে দিতেন।
এ মর্মে কায়েকটি হাদিস পেশ করা হলো:

আবু উমামা ইবনে সাহল ইবনে হুনাইফ তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন না বলে,

لاَ يَقُولَنَّ أَحَدُكُمْ خَبُثَتْ نَفْسِي وَلْيَقُلْ لَقِسَتْ نَفْسِي
“আমার মন বা আত্মা খারাপ বা দুর্বিষহ হয়ে গেছে’ (খবুসাত নাফসি); বরং তার বলা উচিত, “আমার মন বা আত্মা অবসাদগ্রস্ত ও ভারাক্রান্ত হয়েছে” (লাকিসাত নাফসি)।”2

এই হাদিসে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের শেখাচ্ছেন ভাষার ব্যবহার ও ইতিবাচক শব্দ চয়নের গুরুত্ব। “খবুসা” (খারাপ বা দুর্বিষহ) শব্দটি নেতিবাচক এবং আত্মার প্রতি খারাপ ধারণা তৈরি করতে পারে। আর “লাকিসা” (ভারাক্রান্ত বা ক্লান্ত) শব্দটি বেশি নমনীয় এবং ইতিবাচক। এটি ইসলামের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির একটি শিক্ষা।

ইমাম ইবনুল কাইয়েম রাহ. বলেন,

فكره رسول الله ﷺ لفظ الخبث؛ لبشاعته، وأرشدهم إلى العدول إلى لفظ هو أحسن منه
“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম “খুবস” (দুর্বিষহ, খারাপ বা অপবিত্র) শব্দকে অপছন্দ করেছেন, কারণ এটি অসুন্দর। তিনি তাদের এমন একটি শব্দ ব্যবহারের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন, যা এর চেয়ে উত্তম।” [আত তুরুকুল হাকিমাহ, পৃষ্ঠা নং ৪১]

ইবনে উমর রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম “আসিয়া” عاصية (পপিষ্ঠ বা অবাধ্য নারী) নাম পরিবর্তন করেন এবং বলেন, তুমি জামীলা (সুন্দরী)।” [আল-আদাবুল মুফরাদ, অধ্যায়: অর্থপূর্ণ নাম রাখা এবং কদর্য নাম পরিবর্তন, পরিচ্ছেদ: ৩৬১- আছিয়া নাম পরিবর্তন করা-সহিহ]

ইমাম আবু দাউদ বলেন,

“وغيّر رسول الله اسم العاص، وعزيز، وعتلة، وشيطان، والحكم، وغراب، وشهاب، وحباب، فسماه هاشماً، وسمى حرباً سلماً، وسمى المضطجع المنبعث، وأرضاً يقال لها: عفرة خضرة، وشعب الضلالة سماه شعب الهدى، وبنو الزينة سماهم بني الرشدة، وسمي بني مغوية بني رشدة”] سنن أبي داود (2/ 707 [.

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আস (অবাধ্য), আযীয (পরাক্রমশালী), আতলাহ (কর্কশ), শয়তান, হাকাম (বিচারক), গুরাব (কাক), হুবাব (সাপ) ও শিহাব (উল্কা) নামকে পরিবর্তন করে রেখেছেন যথাক্রমে হিশাম (বিধ্বস্তকারী)। তিনি হারব (যুদ্ধ)-এর পরিবর্তে সালাম (শান্তি), মুনবাইছ (জাগ্রত)-কে মুযতাজি‘ (শয়নকারী), আফিরাহ (অনুর্বর) নামক এলাকাকে খাযিরাহ (সবুজ-শ্যামল), দ্বালালাহ (বিপথ ও ভ্রষ্টতা) উপত্যকাকে আল-হুদা (সুপথ), বনু যানিয়াহ (জারজ সন্তান)-এর নাম বনুর-রিশদাহ (নির্মল সন্তান) এবং বনু মুগবিয়াহ (বিপথগামী নারীর সন্তান)-এর বনু রিশদা (হিদায়াতপ্রাপ্ত নারীর সন্তান) নামকরণ করেছেন। [আবুদাউদ, ২/৭০৭]

এমন আরও অনেক হাদিস রয়েছে যেগুলোতে দেখা যায়, আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খারাপ অর্থ বোধক বা নেতিবাচক ইঙ্গিত বাহী নামগুলোকে ভালো ও সুন্দর অর্থ বোধক শব্দ দ্বারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন।

তাই আমাদের কর্তব্য, সবসময় ইতিবাচক ও সুন্দর শব্দ প্রয়োগ করা

নেতিবাচক শব্দের পরিবর্তে ইতিবাচক শব্দ প্রয়োগের আরও কয়েকটি উদাহরণ:

প্রকৃতপক্ষে ভালো ও ইতিবাচক শব্দ শুনলে মানুষ মানসিকভাবে ভালো অনুভব করে ও প্রশান্তি পায়। আর খারাপ ও নেতিবাচক শুনলে মনের মধ্যে বাজে ফিলিংস তৈরি হয় এবং মানসিকভাবে অশস্তি অনুভব করে। এটা মানবিক স্বভাবগত বিষয়।

তাই আমাদের কর্তব্য, নাম রাখা, কাউকে সম্বোধন করা বা দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনে যথাসম্ভব ইতিবাচক শব্দ এবং সুন্দর ভাষা প্রয়োগে কথা বলা এবং নেতিবাচক ও খারাপ শব্দের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা।

আল্লাহ তওফিক দান করুন। আমিন।

আল্লাহু আলাম।

  1. সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) ৪৮/ তকদির, পরিচ্ছেদ: ৪. সকল তকদির অনুযায়ী (সৃষ্ট) ↩︎
  2. সুনান আউ দাউদ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), অধ্যায়: ৩৬/ আদব, পরিচ্ছেদ: ৮২. নিজের নাফসকে খাবিস (খারাপ) না বলা সম্পর্ক↩︎
Exit mobile version