মা এবং সেলফ-কেয়ার

যদিও “সেলফ-কেয়ার” আজকাল বহুল ব্যবহৃত গতানুগতিক একটি শব্দ, তারপরও বলছি, মায়েরা নিজেদের যত্ন নিন, যেমন করে আপনারা অন্য সবার যত্ন নেন। সবকিছু এবং সবার যত্ন নিতে হলেও আপনাকে নিজের ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে।

নিজের জন্য ক্ষণিকের বিরতি স্বার্থপরতা নয়। আপনার হয়তো মনে হতে পারে, এখন বিশ্রাম না নিয়ে কিছু কাজ এগিয়ে নিলেও পারতাম। আমরা যখন বাচ্চাদের বলি এক ঘণ্টার জন্য একা থাকতে চাই, নিজের মতো করে একটু সময় কাটাতে চাই তখনও আমরা অনুশোচনায় থাকি। অলস, পরিশ্রম-বিমুখ, অনিবেদিত এই তোকমাগুলো লেগে যাওয়ার ভয়ে আমরা সব সময় উদ্বিগ্ন থাকি।

এ ধরনের মানসিকতার কারণ হলো আমাদের সাংস্কৃতিক আবহ, শৈশব থেকে আমরা আমাদের বাবা মাদেরও একই মানসিকতা লালন করতে দেখেছি। অনেক পরিবারে এই ধারণা পোষণ করা হয় যে আপনি যত বেশি সন্তানদের পেছনে খাটেন, তাদের আপনি তত বেশি ভালোবাসেন। আর এই ধারণাটাই আমরা প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতেও বয়ে বেড়াই।

এইসব বিভিন্ন কারণে, অনেক মায়ের কাছেই নিজের যত্ন নেওয়া স্বার্থপরতা এবং অলসতা বলে মনে হয়। কিন্তু, এটা নিছকই একটা মিথ্যা ধারণা। আপনি যদি একজন মা হন এবং প্রতিটি মুহূর্তে আপনাকে “কিছু না কিছু’ করতে হবে, এইরকম বাধ্যবাধকতা অনুভব করেন, তবে আপনাকে এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।

মাঝে মাঝে কাজ থেকে বিরতি নিন, নিজেকে একটু বিশ্রাম দিন। আপনার সন্তান, ঘরের কাজ, রান্নাবান্না কোন কিছুই যেনো এই বিশ্রামকে বাধাগ্রস্ত না করে। আপনার স্বামী-সন্তান, এবং আপনার ঘরবাড়ির প্রতি আপনি যতটা যত্নশীল, আপনার শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও আপনাকে ঠিক ততটাই যত্নশীল হতে হবে।

এই উদ্বৃতিটি আমরা প্রায়শই শুনে থাকি, “খালি কলস থেকে আপনি কিছুই ঢালতে পারবেন না।” এটাই সত্যি। তাই প্রথমে নিজেকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে কর্মক্ষম রাখতে শক্তি সঞ্চয় করুন, যাতে স্বামী সন্তানের চাহিদা পূরণের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখতে পারেন।

নিজের প্রয়োজন উপেক্ষা করে কেবল অন্যের প্রয়োজন দেখলেই চলবে না। সমীকরণে নিজেকে এবং নিজের চাহিদাগুলিকেও ফ্যাক্টর করুন এবং সেই চাহিদাগুলিকে ততটাই গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করুন যেমন আপনি অন্য সবার চাহিদাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।

আল্লাহ মরিয়মকে (আ:) খেজুর গাছ ধরে ঝাঁকাতে বলেছিলেন যাতে তিনি প্রসব বেদনার সময় খেজুর খেতে পারেন, তাঁর আশীর্বাদপূর্ণ মাতৃত্বের যাত্রার শুরুতেই। প্রসবের কঠোরতার মধ্যেও আল্লাহ তাঁকে খেজুর খেতে বলেছেন নিজের পুষ্টির জন্য।

وَهُزِّىٓ إِلَيۡكِ بِجِذۡعِ ٱلنَّخۡلَةِ تُسَٰقِطۡ عَلَيۡكِ رُطَبًا جَنِيًّا فَكُلِى وَٱشۡرَبِى وَقَرِّى عَيۡنًاۖ.....
আর তুমি খেজুর গাছের কান্ড ধরে তোমার দিকে নাড়া দাও, তাহলে তা তোমার উপর তাজা-পাকা খেজুর ফেলবে’। অতঃপর তুমি খাও, পান কর এবং চোখ জুড়াও.....
[সূরা মারইয়াম:২৫-২৬]

একদিন, সালমান আল-ফারসি (রা:) তার বন্ধু আবু দারদার (রা:) সাথে দেখা করতে গেলেন। তিনি তাকে দিনরাত ইবাদতে এতটাই মগ্ন দেখতে পেলেন যে তার কাছে মনে হলো আবু দারদা (রা:) তার নিজের, এবং তার স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করেছেন। তাই সালমান (রা:) তাকে বললেন –

“إنَّ لِرَبِّكَ عَلَيْكَ حَقًّا، ولِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، ولأَهْلِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، فَأَعْطِ كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ”. وقد أقره النبي صلى الله عليه وسلم على ذلك بقوله: “صدق سلمان.”
“আপনার উপর আপনার প্রভুর অধিকার আছে, নিজের নাফসের অধিকার আছে, এবং আপনার পরিবারেরও অধিকার আছে। সুতরাং প্রত্যেকে তাদের প্রাপ্য অধিকার প্রদান করুন।”

আর যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনলেন, তখন তিনি এর সত্যতা নিশ্চিত করলেন এবং বললেন, ‘সালমান সত্য বলেছেন।’

সিরাত থেকে আরেকটি ঘটনা আমরা জানতে পারি। যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনতে পেলেন যে, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস প্রতি রাতে সুদীর্ঘ সময় নামাযে দাঁড়িয়ে থাকেন, প্রতিদিন রোজা রাখেন, এবং প্রতি রাতে সম্পূর্ণ কুরআন তেলাওয়াত শেষ করেন, তিনি আব্দুল্লাহকে উপদেশ দিলেন –

فلا تَفْعَلْ، قُمْ ونَمْ، وصُمْ وأَفْطِرْ، فإنَّ لِجَسَدِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وإنَّ لِعَيْنِكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وإنَّ لِزَوْجِكَ عَلَيْكَ حَقًّا.
“এমনটা করবেন না। রাতে কিছুটা সময় নামাজ পড়ুন, আর কিছু সময় ঘুমান, কয়েকদিন রোজা রাখুন, আবার কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া করুন। কারণ আপনার উপর আপনার শরীরের অধিকার আছে, আপনার উপর আপনার চোখের অধিকার আছে এবং আপনার উপর আপনার স্ত্রীর অধিকার আছে।”

সময়কে নিরপেক্ষভাবে ভাগ করার গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতাটি সত্যিই আমাদের অর্জন করতে হবে এবং আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের নিজেদের প্রতি দায়িত্ববান হওয়া, এবং নিজেদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়াও এর অন্তর্ভুক্ত।

মা হিসাবে আমাদের উচিত প্রতিটি পক্ষকে তাদের ন্যায্য অধিকার দেওয়া – আমাদের প্রভু, স্বামী, সন্তান, বাড়িঘর, পিতামাতা, ভাইবোন, শ্বশুরবাড়ি, বন্ধু, প্রতিবেশী, এবং আমাদের নিজেদের প্রতি। কিন্তু আমরা মায়েরা প্রায়ই শেষের অংশটি ভুলে যাই।

মাতৃত্ব‘ – এই শব্দটির সাথে অনেক আপোস এবং আত্মত্যাগ জড়িত, তবে নিজেকে অস্বীকার করে নিজের অধিকারকে মুছে ফেললে চলবে না। এভাবে নিজের চাহিদাকে উপেক্ষা করলে তা কেবলমাত্র তিক্ততার দিকে আমাদের পরিচালিত করবে।

আমরা মা, তাই বলে মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করতে করতে শহীদ হয়ে গেলে তো চলবে না। তাই বলছি, প্রিয় মায়েরা, নিজেদের যত্ন নিন। ভাল খাওয়া দাওয়া করুন, পর্যাপ্ত পানি পান করুন, পর্যাপ্ত ঘুমান, ব্যায়াম করুন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিন, মানসিক চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখুন, উষ্ণ স্নান করুন, সুন্দর পোশাক পরুন, আপনার ত্বক এবং চুলের যত্ন নিন, বাড়িতে সুন্দর সুগন্ধি ব্যবহার করুন, আপনার প্রিয় বান্ধবীর সাথে মন খুলে কথা বলুন, আপনার স্বামীর সাথে হাসুন, বাচ্চাদের সাথে কৌতুক করুন এবং তাদের সাথে খেলা করুন।

প্রিয় মায়েরা, আপনারা নিজেরা সুখী হন, আপনাদের পরিবারও সুখী হবে, ইনশাআল্লাহ।

মূল: উম্মে খালিদ

লিখেছেন

ফাহমিনা হাসানাত

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন

কিছুটা লেখালেখি করি, ইসলামিক লাইনে কিছুটা পড়াশোনা করি। তাজউইদ, গ্রামার এবং কুরআন মেমোরাইজেশন এর ক্লাস করছি আলহামদুলিল্লাহ।
নিজে শিখছি, অন্যকেও শিখাচ্ছি। লেখালেখিটাও ঠিক এরকম। নিজে জানার জন্য মনের আনন্দে লিখি, শেয়ার করি।

Exit mobile version