কথার আমল, আমলের কথা

“যদি আল্লাহ্‌ তোমাকে ইলম দান করেন, তাহলে তাঁর জন্য তুমি ইবাদাতে লিপ্ত থাকো। শুধু মানুষকে বর্ণনা করাই যেন তোমার উদ্দেশ্য না হয়।” – তাবেঈ আবু কিলাব।
বিশেষ করে সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেত্রে যেটা হওয়া উচিত, তা হচ্ছে – ইলম বৃদ্ধির ফলে আমল বৃদ্ধি পাওয়া ও কথার পরিমাণ কমে যাওয়া। কিন্তু সাধারণ মুসলিম এই আমাদের আমল কমে যাচ্ছে আর কথার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে! কারণ আমাদের ইলম বৃদ্ধি পাচ্ছে না, বরং জানাশোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খালি কলসি বাজছেও বেশি।

দ্বীন জানার ও মানার চেষ্টার পর একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া উচিত, সেটি হচ্ছে কথার স্বল্পতা।
কথার স্বল্পতার আমল ছাড়া অন্যান্য আমলে সময় করা যায় না। অন্যান্য আমল বেড়ে গেলে সত্যিকারের প্রয়োজন ছাড়া বেশি কথা বলাটা বিরক্ত লাগবে। অপ্রয়োজনীয় কথা বিরক্ত লাগাই উচিত।

সাহাবায়ে কিরামগণ প্রকৃত আমলওয়ালা ছিলেন, তাই তাঁদের কথার পরিমাণ কম ছিল।

অন্যদিকে, কথা বেশি বলাই যেন আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ আমল হয়ে গেছে! ফলে আমরা প্রকৃত আমলওয়ালা হতে পারছি না।

আমাদের এই নিয়্যত ও মাইন্ডসেট রাখা জরুরী যে – রাসূলুল্লাহ্‌র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমলসমূহ অনুসরণের বিষয়ে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন সাহাবায়ে কিরামগণ ও এরপর তাঁদের পদাংক অনুসারীগণ, সুতরাং আমাদেরকে জানতেই হবে তাঁদের আমলের ধরণ কেমন ছিল, যাতে করে তাঁদের মতো আমলওয়ালা হওয়ার চেষ্টা করে যেতে পারি।

নতুবা কী হবে?

কথার লোকদের ভিড়ে আরো অনেকের মতো হারিয়ে যেতে হবে।

কথার মানুষেরাই হচ্ছে ফিরেও হারিয়ে যাওয়া মানুষ, আর আমলের মানুষেরাই হচ্ছে দ্বীন পালনে কঠোর সংগ্রাম করা মানুষ যারা আসলেই এগিয়ে যাচ্ছেন।

কথার আসক্তির কারণে দ্বীন জানার ও মানার চেষ্টার পর যেমন আমলওয়ালা হওয়া দরকার আমরা অনেকেই তেমনটা হতে পারি না। এটাই আমাদের ব্যর্থতা। এটাই আমাদের দুঃখজনক বাস্তবতা। এটাই আমাদের দ্বীনের বুঝের অপরিপক্বতার প্রমাণ। আত্মমুগ্ধতার কারণেও এমন গাফলতি চলে আসে।

সাহাবায়ে কিরামগণ ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসারীদের কেউ কেউ ৭ দিনেই কুরআন খতম করতেন, তাঁদের কেউ কেউ প্রচুর নফল সালাত আদায় করতেন, কেউ কেউ প্রচুর তাসবীহ পাঠ করতেন …. এসব ঘটনা পড়ে শিক্ষা নিয়ে ফিকির করে আমলের ময়দানে নেমে পড়তে হবে।

বেশি বেশি কুরআন খতম করা, বেশি বেশি নফল সালাত আদায়, বেশি বেশি দরূদ পাঠ, বেশি বেশি ইস্তিগফার পাঠ, বেশি বেশি যিকির করা, সাধ্যমত সাদকা করা …. কতো যে আমল আছে, অথচ দুনিয়ার জীবনটা কতোই না ছোট্ট!

বিষয়টা গভীরভাবে চিন্তা করে দেখি। ইন শা আল্লাহ্‌, বুঝবো – ছোট্ট এই জীবনে আসলেই বেশি কথা বলার সময় নাই।

কিন্তু আমরা সেটার সময় করে নিই! আমলের সময়গুলো থেকে সময় কেড়ে নিয়ে! এই আমাদের দ্বীন পালনের চেষ্টার হালত!

দ্বীন জানার ও মানার চেষ্টার পর তো আমলের বিষয়ে সিরিয়াস হওয়ার কথা, অথচ আমরা অধিক কথা দ্বারা আমলের প্রচুর সময় নষ্ট করি!
তো, তোঁতা পাখিদের সাথে থেকে তোঁতা পাখি হতে চাই, নাকি উম্মতের একজন ঈগল হতে চাই, কিংবা একজন সিংহ?

ব্যক্তির পরিবর্তনে কথার আধিক্য নয়, নিরবচ্ছিন্ন আমল জরুরী, যদিও আমল স্বল্প হয়; আর কথার স্বল্পতা একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল – এই আমলটি নিরবচ্ছিন্নভাবে করার চেষ্টা করি।

শেষ করার আগে শেয়ার করি আখেরি যমানা সম্পর্কিত হাদিসের ব্যাখ্যা, যা এই পোস্টের বক্তব্যের সাথে সম্পর্কিত –

ক্বারী মুহাম্মাদ তৈয়ব বলেছিলেন,
“এক হাদিসে এসেছে, শেষ জমানায় ইলম কমে যাবে। অন্য এক হাদিসে এসেছে, শেষ জমানায় ইলম বেড়ে যাবে। হাদিস বিশারদ আলিমগণ উভয় হাদিসের এভাবে সমন্বয় দিয়েছেন যে –

ইলম অর্জনের উপকরণ বা মাধ্যম বেড়ে যাবে, কিন্তু ইলমের হাকিকত অন্তর থেকে কমে যাবে। ইলমের উপকরণ এতো পরিমাণ হবে যে, পদে-পদে তার চিত্র ভেসে উঠবে আর অন্তরের অন্ধকার এতো বৃদ্ধি পাবে যে, তাতে নূরের চিহ্ন থাকবে না।”

আর শেষ করার আগে একটু হিসাবের বিষয়ে আসি। দেখি, জেগে উঠতে পারি কিনা –

প্রতিদিন মাত্র ৪০ টি আয়াত তিলাওয়াত করলে ছয় মাসের ভিতর একবার কুরআন খতম হবে। বছরে হবে দুইবার।
প্রতিদিন মাত্র ২ রাকাআত নফল সালাত আদায় করলে বছরে প্রায় ৭২০ রাকাআত সালাত আদায় হবে।
প্রতিদিন মাত্র ৫০ বার দরূদ শরীফ পাঠ করলে বছরে প্রায় ১৮ হাজার বার দরূদ শরীফ পাঠ হবে।

প্রতিদিন ১০০ বার ইস্তিগফার করলে বছরে প্রায় ৩৬ হাজারবার ইস্তিগফার হবে।
প্রতি মাসে ৫০ টাকা সাদকা করলে বছরে ৬০০ টাকা সাদকা হবে।

এমনিভাবে, আপনি যদি খেয়াল করেন তাহলে বুঝতে পারবেন, জীবনের বড় একটা সময় কতো অদ্ভুতভাবে আমরা অপচয় করে আখিরাতের বিষয়ে নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ নিজ আমলনামায় রাখি, অথচ এরপরেও নিজেকে দ্বীনদার ভাবা চাই-ই চাই!

উল্লেখ্য, এটা হচ্ছে হিসাবের একটা এগজ্যাম্পল মাত্র। দৈনন্দিন আমলের হিসাবটা আমি যেমন দেখালাম সেটি কেবল উদাহরণস্বরূপ লিখলাম।

আমি প্রতিদিন ৫০ বার দরূদ শরীফ পড়ার বিষয়ে লিখলাম, এর মানে এই না যে ৫০ বার-ই পড়তে হবে। আমি জাস্ট উদাহরণ হিসেবে লিখলাম।

যে স্থানে ফিক্সড পরিমাণ রাখতেই হবে, সে স্থানে ফিক্সড রাখতে হবে। যে স্থানে বেশি বেশি করাটা সমস্যার না, সে স্থানে বেশি বেশি করতে পারি।

অমুক নফল সালাত (নফল সালাত বিভিন্ন ধরণের, যেমন – এমন নফল সালাত আছে যা নির্দিষ্ট ওয়াক্তের সাথে সম্পর্কিত) সর্বোচ্চ যতো রাকআত পর্যন্ত আদায় করার অনুমতি আছে, আমরা ততো রাকাআতের বেশি আদায় করবো না। সিজদাহ্‌ দুটোর জায়গায় তিনটা দিবো না। নফল করতে গিয়ে কারো হক নষ্ট করবো না। ইত্যাদি।

তো, দুনিয়ার বিষয়ে আমরা যতোটা হিম্মত করি, আখিরাতের বিষয়ে অন্তত তেমন হিম্মত করলে আমাদের অবস্থাটাই চেইঞ্জ হবে ইন শা আল্লাহ্‌। কেন যেন আমরা আখিরাতের বিষয়ে আমলের হিম্মত করতে পারি না!

চলুন আমলের হিম্মত করি; আমলের প্ল্যান করি, নিয়মিত আমল করি ও আস্তে আস্তে বাড়াই; আমলের মানুষ হই। বিশেষ করে কুরআন তিলাওয়াত ও বুঝার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিই, নিজেকে সুন্নাহ্‌ দ্বারা পরিশুদ্ধ করতে থাকি, হাদিসের সঠিক বুঝের উপর আমলের জন্য মাযহাব অনুসারে চলতে থাকি ….. সর্বোপরি কথার আমল থেকে যতো দূরে সম্ভব দূরে গিয়ে আসল আমলগুলোকে প্রায়োরিটি দিই।

আমলের সময় দ্রুতই চলে যাচ্ছে, দ্রুতই চলে যাবে। আর জীবন কেবল দ্রুত চলে যায় না, বরং মৃত্যুও দ্রুত চলে আসে।

একটু ফিকির করি – আমলের কতো সময় কতোভাবে নষ্ট করলাম! এরপর ইস্তিকামাতের নিয়্যত করে আল্লাহ্‌র কাছে দুয়া করতে থাকি যেন আমলওয়ালা হয়ে বাঁচতে ও মরতে পারি।

এমনিতেও আমাদের সময়ের বরকত কম, তার উপর আখেরি যমানা। ফিতনা আরো বৃদ্ধির আগেই আমলের দিকে আরো বেশি মনোযোগী হওয়া চাই।

লিখেছেন

মুজাদ্দিদ হুসাইন রিজভি

একজন সাধারণ মুসলিম, দ্বীনের খেদমত করে নিজেকে সৌভাগ্যবান করার বিষয়ে আল্লাহ্‌র তাওফিকের ভিখারি। চেষ্টা করি আলিমগণের খেদমত আরো ছড়িয়ে দিতে, সেই সাথে অনলাইনে লেখালেখিও করি।

লেখকের অন্যান্য সকল পোষ্ট পেতে ঘুরে আসুন
Exit mobile version